লেম্যান ব্রাদার্সের কথা মনে আছে আপনাদের? সেই যে ১৮৫০ সালে যাত্রা শুরু করা দেড়শ বছরের পুরানো বিশাল সেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি, যাকে ২০০৮ সালে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়? দিগন্ত একটা চমৎকার ব্লগ লিখেছিলেন তখন সেই বিষয়ে।
স্বেচ্ছা-মৃত্যুর আগের লেম্যান ব্রাদার্সের ছোট্ট একটা আর্থিক তথ্য দেই এর কাজের ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য - ২০০৭ সালের শেষ কোয়ার্টারে এর মোটা আয়ের পরিমান ছিল এক লক্ষ কোটি টাকার বেশি (১৪,৮৯১ মিলিয়ন ইউএস ডলার)। এই সংখ্যাটার প্রভাব বোঝার জন্য আরেকটা তুলনামূলক সংখ্যা দেই, আমাদের ২০০৯-১০ সালের মোট বাজেটের পরিমান ছিল এক লক্ষ তের হাজার কোটি টাকা।
লেম্যান ব্রাদার্সের পতনের সময় অবশ্য সাব-প্রাইম লেন্ডিং সঙ্কট, হাউজিং বাবল এসবের ডামাডোলে এর হিসাবনিরীক্ষক আর্নেস্ট এন্ড ইয়াঙের কথা তেমন ভাবে উঠে আসেনি। লেম্যান ব্রাদার্সকে যখন দেউলিয়া ঘোষনা করা হয় তখন তার হিসাবনিরীক্ষক ছিল বিশ্বখ্যাত ‘চার-প্রভাবশালী’ হিসাবনিরীক্ষকদের একজন - আর্নেস্ট এন্ড ইয়াং। (অন্যরা হল কেপিএমজি, ডেলোয়েট এবং প্রাইসওয়াটারহাউজ-কুপারস)।
অবশ্য এই দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বে ‘পাঁচ-প্রভাবশালী’ হিসাবনিরীক্ষক ছিল। পঞ্চম জনের নাম ছিল আর্থার অ্যান্ডারসন এবং সেই মথারথি এই শতকের ‘করপোরেট ফেইলিওরের’ জনক এবং নিজের ক্লায়েন্ট এনরনের হাতে হাত রেখে একসাথেই ডুবেছিল। নয় বছর পর সেই পঞ্চম প্রভাবশালীর প্রেতাত্মা ফিরে এসেছে আর্নেস্ট এন্ড ইয়াঙকে পিছু ধাওয়া করতে।
ফিরে আসি আর্নেস্ট এন্ড ইয়াঙে। সাব-প্রাইম লেন্ডিং সঙ্কট, হাউজিং বাবল এবং বিশ্বমন্দার ডামাডোলে লেম্যান ব্রাদার্সের পতনে আর্নেস্ট এন্ড ইয়াঙের ভূমিকা নিয়ে তেমন হৈচৈ হয়নি তখন। সুতরাং লেম্যান ব্রাদার্সের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার (winding up) জন্য প্রধান পুরোহিতের দ্বায়িত্ব পায় আবার আর্নেস্ট এন্ড ইয়াংই। পুরোহিতের দক্ষিণার ব্যাপারে আমি অবশ্য নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য দিতে পারব না (গুগলে নিশ্চই পাওয়া যাবে)। তবে একজন বিবিসির রেফারেন্স দিয়ে বিলয়ন ইউএস ডলারের একটা সংখ্যার কথা বলল সেদিন আমাকে।
চলছিল ভালই, কিন্তু মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত-নিযুক্ত এক পরীক্ষক আর্নেস্ট এন্ড ইয়াঙের বিরুদ্ধে লেম্যান ব্রাদার্সের হিসাবনিরীক্ষায় গাফিলতির অভিযোগ আনেন। লেম্যান ‘রেপো ১০৫’ (Repo 105) নামের এক হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে যাতে তার ব্যালেন্স-শিটে প্রায় ৫০ বিলিওন ডলারের একটা শুভঙ্করের ফাঁকি দেখানো হয় (দেনা কম দেখানো হয়েছে)। এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলছে, যেমন আর্নেস্ট এন্ড ইয়াং বলছে তারা ‘সেই পলিসি’ ‘অ্যাপ্রুভ’ করেনি, শুধু তারা এই পলিসির ব্যাপারে ‘কম্ফোর্টেবল’ ছিল, কিংবা এটা গ্যাপ (GAAP) অনুযায়ী করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা সেই ‘সিমেন্টিক্সের’ বিতর্কে যাব না। তবে আর্নেস্ট এন্ড ইয়াঙের জন্য আরও খারাপ খবর হল যুক্তরাজ্যের রেগুলেটরও তাদের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চেয়েছে। এবং এই রেপোর বিরুদ্ধে আর্নেস্ট এন্ড ইয়াঙকে হুইসেল ব্লোয়িং (whistle blowing) করা হয়েছিল, যা তারা রিপোর্ট করতে ব্যার্থ হয়।
দেখা যাচ্চে আর্থার অ্যান্ডারসনের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল (যেমন সারবেইনস অক্সলে), তা হয়ত যথেষ্ট ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের The Securities and Exchange Commission (SEC) অবশ্য আরেকটা ভয়ের কথা বলেছে – রেপো ধরণের প্র্যাকটিস হয়ত ওয়াল-স্ট্রিটে আরও হচ্ছে।
বিশ্বখ্যাত এই ‘চার-প্রভাবশালী’ হিসাবনিরীক্ষকদের আবার আটলান্টিকের দুই পাড়ের সরকারের সাথে সু-সম্পর্ক আছে। এই বিতর্ক হয়ত আর্নেস্ট এন্ড ইয়াঙের মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি বাজাবে না। কিন্তু ‘প্রভাবশালী-চার’ থেকে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা আছে এর। এনরনের পতনের পর অ্যান্ডারসনের প্রেতাত্মা এখন আর্নেস্ট এন্ড ইয়াঙের পিছু ধাওয়া করছে।
আচ্ছা দেখা যাক তো S&P লেম্যান ব্রাদার্সকে কী রেটিং দিয়েছিল স্বেচ্ছামৃত্যুর আগে? দেখা যাচ্ছে ২০০৮ মে-জুনের দিকে S&P লেম্যান ব্রাদার্সের রেটিং A+ থেকে নামিয়ে A করে দেয়। সেই বছরই কিন্তু লেম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হবার জন্য আদালতে আসে।
থাক, S&P রেটিং নিয়ে কিছু বলব না। আমাদের দেশ এখন S&P রেটিং এর আওতায়। সাউথ-ইস্ট এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে বেশ ভাল অবস্থানে আছি। বিশ্বের বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান সংস্থাগুলি এখন আমাদের ব্যাপারে ‘কম্ফোর্টেবল ফিল’ করবে। আমাদের দেশের সরকার এখন ইচ্ছা করলেই ইন্টারনেশন্যাল বন্ড ছাড়তে পারবে, যদিও রেট কিঞ্চিৎ বেশি হবে, যেহেতু রেটিং নিচের দিকে...।
মন্তব্য
অনেক কিছুই হয়ত বুঝিনাই,মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেছে। সাব-প্রাইম, লেন্ডিং সঙ্কট, হাউজিং বাবল, করপোরেট ফেইলিওর, রেপো ১০৫, সিমেন্টিক্স, হুইসেল ব্লোয়িং এর মানে কি খোদা জানেন।
তো, S&P রেটিং কি একটা ফালতু ব্যাপার? সরকার, পত্রিকা কি এই নিয়া বেহুদা চিল্লাচিল্লি করছে?
নহক
বাদ দেন আমার কথা। S&P রেটিং কোনভাবেই ফালতু ব্যাপার না। যেটা আমার লেখায় উল্লেখ করেছি, S&P রেটিং জন্য বিদেশী ইনভেস্টররা আমাদের দেশের ব্যাপারে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। ... সরকার আন্তর্জাতিক বন্ড ছাড়তে পারবে...।
(যদিও লেম্যানের ব্যাপারে S&P রেটিং খুব ভাল ছিল। কিন্তু এইসব করপোরেট পতন গুলি আসলে কেউই তেমন ভাবে আগেভাগে বুঝতে পারেনি সম্ভবত। অথবা ম্যানিপুল্যাশন খুব উচ্চ শ্রেণির ছিল...।)
টার্ম গুলির জন্য দুঃখিত, উইকির লিঙ্ক করে দেয়া উচিত ছিল বোধহয়।
সাবোর্ন অক্সলে -> সারবে(ই)নস অক্সলে হবে মনে হয়।
লেখা ভালো হৈছে ।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ধন্যবাদ। পরিবর্তন করে দিলাম।
এই দামড়া-চার এর দাপটে টেকা দায়। খোলাবাজার অর্থনীতি মাই ফুট! কনসোর্টিয়াম করে কালোবাজারী নাকি শুধু আমাদের দেশেই।
- সুবিনয়'দা আসুক। একটা বিশদ আলোচনা পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
চমৎকার পোস্ট। বড় বড় চিটাররা দক্ষ চিটার বলেই নিপুন ভাবে সবাইকে ধোঁকা দিতে পারে। তাছাড়া লবিয়িং আমেরিকায় একটা গ্রহণযোগ্য প্রথা। তাই S&P র দায় কিছুটা কম মনে করি আমি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পজিটিভ যে দিকগুলো তুলে ধরলেন সে কারণেই আমি পজিটিভ হিসেবে দেখি বিষয়টা।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
নতুন মন্তব্য করুন