একাত্তরের ১০ ডিসেম্বরের পর থেকেই নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ যুদ্ধ বন্ধের জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করে দেয়। মার্কিন হস্তক্ষেপের জন্য পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা অবমুক্ত করা মার্কিন নথিতে পাওয়া যায়। ১৪ ডিসেম্বরে (১৯৭১) পাঠানো বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল স্পিভাকের টেলিগ্রামে (নং ৫৬২৭) জানতে পারি তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মালিক এবং জেনারেল ফরমান আলী স্পিভাকের সাথে যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
সেই টেলিগ্রামে দেখতে পাই মালিক-ফরমান স্পিভাককে এ ব্যাপারে বিস্তারিত প্রস্তাব পাঠানোরও নিশ্চিয়তা দেয়। মজার ব্যাপার হল, একই দিনে পাঠানো স্পিভাকের পরবর্তী টেলিগ্রামে (নং ৫৬২৮) দেখতে পাই গভর্নর মালিক টেলিফোনে স্পিভাককে নিশ্চিত করেন ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারলেন্ড যুদ্ধ বন্ধ প্রস্তাবের ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করবে, ঢাকা থেকে প্রস্তাব পাঠানোর আর প্রয়োজনীয়তা নেই।
যাইহোক, ১৫ ডিসেম্বরে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যানেনবার্গের টেলিগ্রামে (১১৪১০) মার্কিনীদের সাথে মতদ্বৈততার কিছু মজার তথ্য উঠে আসে। যুক্তরাজ্যের বিদেশ এবং কমনওয়েলথ বিষয়ক উপ-‘আন্ডার সেক্রেটারি’ স্যার স্ট্যানলি টমলিনসন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের যুদ্ধের ব্যাপারে মার্কিনীদের সাথে বিলেতের কিছু মতদ্বৈততার ব্যাপার তুলে ধরেন। স্ট্যানলি বিলেতি এবং কূটনৈতিক সৌজন্যের পর খুবই স্পষ্টভাবে মতদ্বৈততার ব্যাপারগুলি বলেন।
সৌজন্যের পর স্ট্যানলি সরাসরি বিস্ময় প্রকাশ করেন যে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র কি একই গোয়েন্দা তথ্য এবং রাজনৈতিক পর্যালোচনার বা মূল্যায়নের ভিত্তিতে এগোচ্ছে। তিনি সরাসরি কিছু মার্কিন পলিসিকে যুক্তরাজ্যের কাছে দুর্বোধ্য এবং “ডিস্টার্বিং” বলে মন্তব্য করেন।
স্ট্যানলি বেশ কয়েকটা বিষয়ে আলোকপাত করেন। প্রথমত, স্ট্যানলি ভারতে ত্রান-সাহায্য বন্ধের ব্যাপারে মার্কিনী সিদ্ধান্তের (এবং জাপান, জার্মানীর মত অন্যান্য কিছু দেশকে এই সিদ্ধান্তে প্রভাবিত করার) কথা তুলে ধরেন। মার্কিনীদের যুক্তি ছিল এতে ভারত যুদ্ধ প্রলম্বিত করতে পারে, এবং সেই যুক্তি ত্রান-সাহায্য নীতির পরিপন্থি। তিনি তাদের মতদ্বৈততার কথা জানিয়ে দেন।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটায় স্ট্যানলি আলোকপাত করেন, তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাথে মার্কিনী যোগাযোগ এবং এ সংক্রান্ত তথ্যসূত্রের ব্যাপারে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি নিশ্চিত করেন যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা নিঃশর্ত স্বাধীনতা ছাড়া কোন সমাধানে রাজি হবেন না। যদিও তিনি মন্তব্য করেন যে বিলেত নিজেও স্বাধীনতার পক্ষে ওকালতি করছে না, অথবা কনফেডারেশন জাতীয় কোন সমাধান যদি হয়, তা বিলেতের কাছে গ্রহণযোগ্যই হবে। কিন্তু রুঢ় বাস্তবতা হল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন অবশ্যম্ভাবী। মার্কিন অন্য কোন মূল্যায়ন থাকলে তা যেন বিলেতকে জানানো হয়। এখানে দেখা যায়, ১৪-১৫ ডিসেম্বরের দিকেও যুক্তরাষ্ট্র কনফেডারেশনের স্বপ্নে বিভোর ছিল, যদিও বিলেত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল।
পরবর্তী যে ব্যাপারটা স্ট্যানলি উত্থাপন করেন, তা নিশ্চিতভাবেই কনফেডারেশন সংক্রান্ত, কিন্তু ব্যাপারটা উহ্যই থাকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে যে “গঠনমূলক রাজনৈতিক সমাধানের” নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে, বিলেতের কাছে যে যেটা গোলমেলে মনে হচ্ছে, সেটা পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেন। তিনি আবারও বলেন যদি মার্কিনীদের অন্য কোন মূল্যায়ন থাকলে তা যেন বিলেতকে জানানো হয় এবং এটাও নিশ্চিত করেন যে যদি এধরণের কোন কথাবার্তা যদি চলতেও থাকে, তাতে কোন ফল বয়ে আনবে না। পরিস্কারভাবেই তিনি কনফেডারেশনের ধারণাকে বাতিল করে দেন।
পরবর্তী বিষয়টা ছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈনিকদের দ্রুত চলে যাওয়ার মার্কিন প্রস্তাবের সাথে মত বিরোধ। বিলেতের প্রস্তাব ছিল যাতে ভারতীয় বাহিনী কিছুদিন বাংলাদেশে থাকে। উদ্যেশ্য ছিল পাকিস্থানী কিংবা বিহারীদের উপর সম্ভাব্য প্রতিশোধ প্রতিরোধ করা। পরবর্তী যে বিষয়টাতে মনোযোগ আকর্ষণ করেন, তা ছিল মার্কিনী মূল্যায়নে ভারতের সম্ভাব্য ‘টেরিটোরিয়্যাল গেইন’ যেটার সাথে বিলেতের মতের মিল ছিল না। তিনি নিশ্চিত করেন, ভারত কোন ‘টেরিটোরিয়্যাল গেইনের’ কথা ভাবছে না।
সর্বশেষ বিষয়টা ছিল বিলেতের প্রাপ্ত তথ্যতে দেখা যাচ্ছে, জাতিসঙ্ঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল রেজ্যুলিউশনে বিলেত যে ‘শব্দচয়ণ’ করেতে চাচ্ছে, মার্কিনীরা সে ব্যাপারে সম্মত না।
ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিঙের পাঠানো টেলিগ্রামে (নং ১৯২৪৩) আরেকটা বিষয় উঠে আসে। কিটিং স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানায় যে ভারত মহাসাগরে অবস্থানরত ক্যারিয়ার টাস্ক ফোর্সের (সপ্তম নৌবহর) ব্যাপারে তার অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদের বিরূপ মন্তব্যের মধ্যে পরতে হচ্ছে। তারা মনে করছে, মার্কিনীরা যুদ্ধ উস্কে দিতে চাচ্ছে। অন্যান্য ভু-রাজনৈতিক সংসৃষ্টকরণের ব্যাপারেও ইঙ্গিত দিয়েছে।
তিনি কানাডিয়ান হাইকমিশনার জর্জের ব্যাপারে সরাসরি বলেন। জর্জ সম্ভাব্য বিভিন্ন সংশ্লিষ্টতার কথা বলে সরাসরি বলে দেন যে তিনি তার প্রসিডেন্ট ট্রুডো (বর্তমান কানাডার প্রধাণমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পিতা) কঠিন বার্তা দেবেন যেন তিনি এ ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলেন।
মার্কিন নথিতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মার্কিনীদের পাকিস্তানের পক্ষে চেষ্টা চালানোর কিছু নমুনার উল্লেখ করলাম মাত্র।
মন্তব্য
অনেক কিছু জানলাম।
কিন্তু বর্তমান কাল এমন অদ্ভুত যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু উপস্থাপন ভংগী কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বক্তাদের কোন মাথাবেথা নাই। সকালে টিভিতে এক চেনেলে দেখলাম শাহবাগের লাকী আকতার হাসিমুখে মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারীদের উপর ধর্ষন নির্যাতন নিয়ে কথা বলছেন। উনার চেহারা ছবি দেখে মনে হইছিল উনি টিভিতে আসতে পারার আনন্দ কিছুতেই চেপে রাখতে পারছিলেন না, তাই এরকম একটি বিষয়ে কথা বলতে গিয়েও বারবার খুশির ধাক্কায় হাসতেছিলেন। উনি আবার এই আমলের নারী নেত্রী। বুঝেন অবস্তাটা।
টিভি চেনেলগুলি যদি এই নেত্রীদের একটু বেশী করে ডাকেন, তাহলে হয়ত কয়েক বতসরের মধ্যে উনারা টিভিতে চেহারা দেখানর আনন্দের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধে নারীর উপর যে পাশবিক নির্যাতন চালান হইছিল, সেটা নিয়ে একটু মানানসই গম্ভীর্য্য নিয়ে কথা বলতে পারবেন। আমার মত যাদের পরিবারের নারীরা একাত্তর সালে ভয়ে আতংকে খানসেনা ও বিহারীদের হামলার ভয়ে এক জায়গা হতে আরেক জায়গায় পালিয়ে ঘুরেছেন, তারা এমন আদেখলামির উতপাত থেকে তাতে করে একটু রক্ষা পাব।
গুরুতর অভিযোগ হল। ভিডিও আছে?
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
দেখিনি। ইউটিউবে খোঁজ করলাম, পেলাম না, তাই এই বিশেষ টকশোর ব্যাপারে মন্তব্য নেই। তবে আপনার সাথে সম্পূর্ণ সহমত যে এসব ব্যাপারে অসংবেদী ব্যবহার কিংবা শব্দচয়ণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
লেখক এত কষ্ট করে যে লেখাটি পোষ্ট করলেন, তার বিষয়বস্তু নিয়ে অন্তত দু কলম লিখতেন।
ছবিগুলো আসেনি।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
কোন ছবির কথা বলছেন? ওহ। দুঃখিত, শেষের বাক্যটা মিসলিডিং হয়ে গেছে। ঠিক করে দিলাম।
পাকিস্থান > পাকিস্তান
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
খাস মার্কিনী যুক্তি!! বিশ্বগুণ্ডামির ধাঁচটাই বোধহয় এরকম।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন