১৭
কুলাউড়া-সিলেট রেলযাত্রায় অলৌকিক এক ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা পাই সাগোতোর ডায়েরিতে। ১৯২০ সালের জানুয়ারির এক শীতের রাত্রে সিলেট থেকে কুলাউড়া ফেরার পথে কোন এক স্টেশনে রেল থামে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে। ব্যাখ্যাতীত কোন কারণে তিনি নেমে আসেন নির্জন স্টেশনে।
বাইরে কুয়াশার চাদর ভেদ করে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের অস্পষ্ট আলোর সাথে ইতস্তত ঝুলানো কয়েকটা লন্ঠনের আলো মিলেমিশে অন্ধকার যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। দূরে, স্টেশনের আরেক প্রান্তে, রেল-ইঞ্জিনের পাশে রাখা হ্যাজাকের আশপাশে টর্চ জ্বালিয়ে কয়েকজনের ছুটাছুটি আবছাভাবে দেখা যায়। রেলের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে লোকজনের অস্পষ্ট কথা ভেসে আসছে, হঠাৎ হঠাৎ ধাতব পেটানোর আওয়াজ, দূরে অস্পষ্ট ঢোলের আওয়াজ। তিনি লিখেন, ‘দেয়ার ইজ সামথিং সিনিস্টার আবাউট দ্যা প্লেস...’।
ভেজানো দরজা ঠেলে তিনি বিশ্রামাগারে প্রবেশ করেন। মাত্র চার বছর আগে তৈরি করা নতুন স্টেশনের বিশ্রামাগারে প্রবেশ করে মনে হয় যেন শতাব্দী পুরানো কোন কক্ষে প্রবেশ করলেন। উঁচু ছাদের বিশ্রামাগার জনশূন্য, টিম টিম করে একটা লন্ঠন জ্বলছে। এবং তারপর হঠাৎ করেই তিনি তাঁর (স্ত্রীলিঙ্গ) দেখা পান। সেই সাক্ষাতের দুই পৃষ্ঠা ভর্তি হেয়ালি ভরা বিবরণের মর্মার্থ বুঝা যায় না। ব্রজবুলি ভাষা, মন্ত্রপূত ছোরা, গোপন দলিল, উত্তরপূরুষের জীবনসংকট, প্রায়শ্চিত্ত এবং সংগ্রামের উল্লেখ পাই। চা-বাগান অধ্যুষিত সেই অঞ্চলে ভজপূরী হিন্দী বিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু ব্রজবুলি ভাষা? ঘটনাটা ঘটে বিলেত থেকে ফিরে সাগোতোর চা-বাগানে ‘অভিশপ্ত’ চাকুরি শুরুর দেড় বছরের মাথায়। এবং সেদিনই তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে ‘Schroeder-Freres’ ফিরে পান।
তিনি ব্যাপারটা নিজের মত করে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন Paracusia, Pareidolia জাতীয় শব্দমালা ব্যবহার করে, যা আমার কাছে তেমন অর্থবহ মনে হয়না। তিনি লিখেন, ‘এটা কি তার অবচেতন মনের সৃষ্ট কোন প্রপঞ্চ’?
১৮
সাগোতো ডায়রির বিচ্ছিন্ন তথ্যবলী জোড়া লাগিয়ে জুলিয়েট নামের চরিত্রটিকে বুঝতে গিয়ে তাকে এক রহস্যময় নারী বলেই মনে হল।
১৯২৭ সালের শেষদিকে চিটাগাং ইয়োরোপিয়ান ক্লাবের এক কর্মকর্তার বাসায় জুলিয়েটের ‘হাফ-সিস্টার’ এবং, সাগোতোর ভাষায়, ‘সোস্যাল-বাটারফ্লাই’ ক্যাথরিনের মাধ্যমে নিস্পৃহ এবং রাশভারী জুলিয়েটের সাথে সাগোতোর পরিচয়। তাঁর বর্ণনায় মনে হয় জুলিয়েটের সাথে পরিচয়ের জন্য তিনি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বেথুন কলেজে পড়াশোনা শেষ করে আসা জুলিয়েটের বিষয়ে ডায়েরিতে একটা শ্লেষাত্মক বাক্য পাই, যেখান সাগোতো লিখেন, ‘মিজ ডায়জের এবং তার মা’র পন্ডিচেরি সফর কি ‘দ্য মাদারের’ জন্য, নাকি তার জন্য (ফর হিম)’? মাত্র একটি বাক্যে জানা যায় জুলিয়েটের পদবী ডায়াজ, যেটা তার পিতৃসূত্রে পর্তুগিজ বংশপরম্পরার ইংগিত করে, আর কিছু জানা যায় না পিতা সম্বন্ধে। জুলিয়েটের মা’কে আরও দূর্বোধ্য নারী বলে মনে হয়। ধনী পরিবারের মেয়ে, অসমবর্ণে বিয়ের পর থেকেই পরিবারের সাথে যোগাযোগ ছেড়ে চিটাগাঙের কোন এক ‘এন, এ স্কুলে’ শিক্ষকতা করেছেন। ১৯২৮ সালের দিকে চাকুরি থেকে বিদায় নিয়ে একান্ত নিভৃতে (retired into complete seclusion) জীবন-যাপন করছেন। তার নাম জানা যায়না, কিংবা তার এই complete seclusion এর স্বরূপ কী তাও বুঝতে পারিনা।
জুলিয়েটের জাতিগত পরিচয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন মনে হয়, সে কথায় পরে আসছি। ধারনা করি, জুলিয়েটের পিতার দ্বিতীয় বিয়ে কোন ইয়োরোপিয়ান মহিলার সাথে, যাদের কন্যা এই ক্যাথরিন। জুলিয়েটের পিতা বাঙালীও হতে পারেন, এমনকি ক্যাথরিনের মা’ও বাঙালী হতে পারেন। সেই সময়ে, সেই মহলে চলাফেরা করা জুলিয়েট কিংবা ক্যাথরিন নামগুলি আসলে কোন নির্দিষ্ট জাতিসত্ত্বার নিশ্চিত নির্দেশক হয়ে উঠে না। আবার কথিত সেই ‘মহলকেও’ গোলমেলে মনে হয়। জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামের নতুন ঘরানার এক কবির সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ নিয়ে গৃহকর্তার সাথে ক্যাথরিনের উচ্ছ্বাসিত আলোচনা সেই কর্মকর্তা যে অ্যাঙ্গলিসাইজড বাঙালী, সেই ইঙ্গিতই দেয়। সাগোতোর ডায়রিতে সমসাময়িক বেশ কয়েকটা নাম পাওয়া যায়, কিছু নামের সাথে যোগাযোগ বুঝতে পারা যায়, কিংবা তাদের কোন কর্মকান্ড জানা যায়, আবার কিছু নামের কোন কিছুই জানা যায় না। একটা নাম আমার দৃষ্টি কাড়ে – চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলের ‘আর্টসের’ শিক্ষক ললিত স্যার। তার সাথে সাগোতোর একাধিক বার দেখা করার প্রসঙ্গ উঠে আসে।
পন্ডিচেরির ‘দ্য মাদার’ নিশ্চিতভাবেই মিরা আলফাসাকে নির্দেশ করে – স্থানীয়ভাবে ‘শ্রীমা’ নামে পরিচিত সেই ফরাসি রমণী যিনি অরবিন্দ আশ্রমের শীর্ষ আধ্যাত্বিক গুরু হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন সেই ১৯২৬ সালেই। তার কাছে যাওয়ার কারণ কি আধ্যাত্বিক কোন সান্ত্বনার জন্য? সেই ‘হিম’ই বা কে? ব্যার্থ আইসিএস অফিসার, পরে সফল বিল্পবী এবং সর্বশেষ আধ্যাত্বিক গুরু অরবিন্দ ঘোষ? নাকি অন্য কেউ?
১৯
জুলিয়েটের সাথে সাগোতোর সম্পর্কের ব্যাপারটাও পরিস্কার হয় না। কখনও মনে হয় প্রণয়ঘটিত প্রবল আকার্ষণ, আবার সংশয়েরও প্রচুর সুযোগ থেকে যায়। জুলিয়েটের মা’র প্রতিও সাগোতোর তীব্র আকার্ষণ দেখা যায়, কিন্তু তার সাথে দেখা করার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত বলে মনে হয়। কখনও মনে হয়, জুলিয়েটের মায়ের কাছে পৌছানোর জন্য জুলিয়েটকে একজন মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছেন মাত্র। ১৯৩০ সালের এপ্রিলের মধ্যভাগে সাগোতো চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন জুলিয়েটের জন্মদিন উদযাপন করার জন্য। মেষ রাশির জাতক জুলিয়েটের জন্মদিনে উদযাপনের দিন নির্ধারন করা ১৯ এপ্রিল, শনিবার। সেদিন জুলিয়েটের দেখা না পাওয়ার আক্ষেপ এবং কিছু দূর্বোধ্য কথার পর সাগোতো লিখেন, ‘হোয়াট অ্যা কোইন্সিডেন্স’? গুড ফ্রাইডে সেইভড দেম’।
চিটাগাং তখন বিদ্রোহের আগুনে জ্বলছে। সেই ১৮ এপ্রিলই ব্রিটিশ-বিরোধি আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস রচিত হয়েছিল খোদ চিটাগাঙেই। সেদিনই সূর্য সেনের নেতৃত্বে অগ্নিযুগের একদল স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ব্রিটিশ পুলিশ ও সহায়ক বাহিনীর চিটাগাঙে অবস্থিত একাধিক অস্ত্রাগার লুঠের দুর্ধর্ষ এক অভিযানে বৃটিশ-রাজের মেরুদন্ডে ঠান্ডা ভয়ের স্রোত বইয়ে দেয়।
২৩ তারিখের আগ পর্যন্ত জুলিয়েটের কোন খোঁজ পান না সাগোতো। ২৩ তারিখ যখন দেখা হয়, তার আগের রাত্রেও বিপ্লবীদের হাতে আবার কড়া মাশুল দিতে হয়েছে ব্রিটিশ-রাজকে। আগের দিন সেনানিবাসের কাছে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া অকুতোভয় বিপ্লবীদের ঘিরে ফেলেছিল ব্রিটিশ-রাজের কয়েক হাজার সৈন্য। দুই ঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধে শহীদ হন বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন, কিন্তু তার আগেই সেই দুর্ধর্ষ বিল্পবী বাহিনীর কাছে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০-১০০ জন চৌকস সৈন্যের প্রাণ দিতে হয়।
না, সাগোতো রাজদানের ডায়রিতে এসব কিছুই উঠে আসেনা – না অনুরাগ, না বিরাগ। চিটাগাং যখন বিদ্রোহের আগুনে জ্বলছে, তখন তার লেখনীতে সমসাময়িক সেসব কিছুই না উঠে আসেনা, ব্যাস্ত থাকে প্রণয়ীকে নিয়ে। তার ঘোর আকর্ষণ দেখি ‘অভিশপ্ত’ এক custom-made Schroeder-Freres with ornate engraving of a hound on the metal নামক বস্তুর প্রতি। সেই বস্তুর ‘শাপ-মোচনের’ জন্য তার আকুলতা দেখি। তিনি বিদেশি চিত্রকলা নিয়ে লিখেন, যেটা আমাকে তেমন আকর্ষণ করে না। জনৈক চিত্র শিল্পী Vermeer এর আঁকা চিত্র An Officer and a Laughing Girl – ব্যাপারে তার দীর্ঘ টীকা দেখি। তার হেঁয়ালি ভরা লেখা পাই, ‘সবাই তাঁর চিত্রকল্পে আলোর ব্যবহারে উচ্ছ্বাসিত। আমি প্রথমে যখন দেখি অতিভুত হই আলোকে চিত্রায়িত করার জাদুকরী কাজে। কিন্তু দ্বিতীয়বারে আলোর ব্যাপারটা আমার চোখে ধরা পরেনা, শুধু দেখি ঘাপটি মেরে থাকা ছায়া, এবং তার পিছনের অন্ধাকার। আমি দেখি জানালা দিয়ে আসা আলোর পিছনের ধীরে ধীরে নেমে আসা সন্ধ্যার অন্ধকারের অবয়ব। আপাত আলোতে বসা মায়াবি নারীকে ঘিরে থাকা অন্ধকার। সৈনিকের বেশে বসে থাকা আততায়ী, অন্ধকারের প্রতিভূ’।
তবে আমার দৃষ্টিতে একটা নকশা ধরা পরে। Velentine Ackland এর কবিতার ‘দ্বৈততার’ প্রতি মুগ্ধতা, Vermeer এর চিত্রকল্পের ব্যাখ্যার দ্বৈততা তাঁর চারিত্রিক দ্বৈততার নির্দেশক হয়ে উঠে আমার বিশ্লেষণে।
আর আমার মনে হয় সমসময়িক সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ধরে রাখার কী অপূর্ব সুযোগ হারিয়ে গেল। তখনকার অবস্থাটা একজন ইংরেজের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে ইচ্ছে হয়।
যাই হোক, আগ্রহভরে দেখি সাগোতোর ডায়রির পিছনের ফ্ল্যাপে রাখা কিছু কাগজের মধ্য দুদিকে টাইপ করে লিখা একটা প্রতিবেদনের কয়েকটা পাতা (পৃঃ ২৭ থেকে ৩৪) । দেখে মনে হয়, বিপ্লবী বাহিনীর উপর লিখা গোয়েন্দা পুলিশের প্রতিবেদন, যেটাতে কোন তারিখের উল্লেখ পাই না। দ্বিতীয় যে কাগজটি দৃষ্টি কাড়ে সেটি ১৯০২ সালে প্রাকাশিত লন্ডন গ্যাজেটের দুটো পাতা (চার পৃষ্টা)।
২০
সাগোতোর ডায়েরি ফ্ল্যাপে রাখা Supplement to the London Gazette, June 26, 1902 সংখ্যার চার পৃষ্ঠা (পৃষ্ঠা ৪১৯৭ থেকে ৪২০০ পর্যন্ত) জুড়েই দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের ‘নাইট’ উপাধিপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের তালিকা। যে নামটি সাগোতোর ডায়রিতে উল্লেখ পাই, তার নাম প্রথম পৃষ্ঠাতেই (৪১৯৭) পাওয়া যায়। India Office শিরোনামের নিচে Knights Commanders উপাধীতে ভুষিত দ্বিতীয় নামটি Maharaja Rameshwara Singh Bahadur, of Darbhanga। শিরোনামের নীচে Knight Grand Commander প্রাপ্ত প্রথম নামটি Sir Sultan Muhammad Shah Agha Khan, of Bombay, KCIE.
সাগোতোর ডায়েরিতে যে রাজর্ষী রামেশ্বর সিং ঠাকুরের (বাহাদুর বৃটিশদের দ্বারা প্রাপ্ত উপাধি) নাম পাওয়া যায়, তিনি ছিলেন মিথিলা অঞ্চলের দারভাঙ্গার মহারাজা, যদিও সাগোতোর হেয়ালি ভরা টীকায় প্রথমে তার নামোল্লেখের প্রেক্ষিতটা পরিষ্কার হয় না। তবে তার খুব কাছের সহকারী হিসাবে একজন নিতিন রাজদানের নাম উঠে আসে। আরেকটা ব্যাপারে আগ্রহ পাই - মিথিলার তান্ত্রিক রাজর্ষির সহকারি কোন মৈথিলী ব্রাহ্মণ নয়, বরঞ্চ একজন কাশ্মিরী পন্ডিত। একটা মাত্র বাক্যে বয়বৃদ্ধ নিতিন রাজদানের কন্যা পার্বতী রাজদানের নাম উঠে আসে।
ম্যলকম ম্যাকেঞ্জি ডায়েরিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম, যদিও ঘৃনার সাথেই তাঁর নাম উচ্চারিত হতে দেখি। সায়মন থম্পসনেরও নাম পাই। তারা আবার জে বি ফুলারের সহকারী ছিলেন এমন ইংগিত পাওয়া যায়। ফুলার ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ এবং আসামের লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসাবে নিয়োগ পাবার আগে ১৮৯৯ থেকে ভাইসরয়ের কাউন্সিলে অতিরিক্ত সদস্য হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। রামেশ্বর সিং ঠাকুরও সমসাময়িক সময়েই গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিল অভ ইন্ডিয়ার সদস্য ছিলেন। রামেশ্বর-ফুলারের একটা যোগসূত্র পাওয়া যায় এখানে।
২১
জুলিয়েটের মা’র কর্মস্থল ‘এন, এ স্কুল’ সম্ভবত নন্দনকানন অপর্ণাচরণ স্কুল ধরে নিয়ে, শতবর্ষ আগের নাম না জানা এক শিক্ষিকা সম্বন্ধে কোন তথ্য যোগাড় করতে পারিনা। তবে, ব্রিটিশ-রাজের এক পুলিশ কর্মকর্তার আশীতিপর ছেলের কাছ থেকে কলেজিয়েট স্কুলের ‘ললিত বাবু’র কথা জানতে পারি। তার পিতা চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে সরাসরি ললিত স্যারের ছাত্র ছিলেন। তখনকার শিক্ষকদের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত ললিত স্যার আবার সরাসরি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছাত্র ছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের ঘোর সমর্থক এই শিক্ষক তাঁর প্রিয় ছাত্রদের কাছে তার যুবা বয়সের পাঠচক্র এবং আলোচনা সভায় যোগ দেয়ার কথা গল্প করতেন। সমিতির সাথে তার যোগযোগ প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি ছাত্রদের মনোজগতে বড় প্রভাব রাখতে পারতেন।
অন্তর্জাল তন্ন তন্ন করে Schroeder-Freres সম্পর্কিত কোন বস্তুর খোঁজ পাইনা। তবে বর্ণনা দেখে বন্দুক জাতীয় কোনকিছু হতে পারে এমন ধারনা হওয়ায় বনেদী অস্ত্র-ব্যবসায়ী মজুমদার এন্ড সন্সের বৃদ্ধ এক কর্নধারের সাথে কথা হয়। জানতে পারি, Schroeder-Freres ব্রাদার্স নামে বেলজিয়ামের এক বনেদী প্রতিষ্ঠান গত শতাব্দির প্রথমদিকে অত্যন্ত উচ্চমানের শটগান তৈরি করত। তারা অবশ্য চল্লিশের দশকের প্রথমদিকে অস্ত্র তৈরি বন্ধ করে দেয়। সৌখিন অস্ত্রবাজদের জন্য তৈরি সেসব দো-নলা শটগানের ঠুকোর (hammer) আশপাশের ধাতব অংশের উপর অত্যন্ত সুদৃশ্য কারুকাজ করা থাকত। তবে তিনি কোন প্রাণির কারুকাজ কখনো দেখেন নাই। হাতে কাজ করা এসব কারুকাজে প্রভাবশালী কোন ব্যক্তির অনুরোধে কিংবা কোন সীমিত উৎপাদিত বন্দুকে এই ‘কুকুরের’ ছবি থাকতে পারে। বুঝলাম, সেই অভিশপ্ত বস্তুটি একটি বিশেষ ভাবে তৈরি একটি দু’নলা বন্দুক।
জুলিয়েটের পড়াশোনা বেথুন কলেজে, তাঁর মা অপর্ণাচরণ স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন এই তথ্যগুলির উপর ভিত্তি করে তার মা’র বিল্পবীদের সংগে যোগাযোগ ছিল এমন একটা চিন্তা মাথায় আসে। চট্টগ্রামে অগ্নিযুগের একাধিক বিল্পবী বেথুন কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন, এদিকে আবার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কিছুদিনের জন্য অপর্ণাচরণ শিক্ষকতা করেছেন। তবে এই ধারনার বিপরীতেও কিছু যুক্তি দাঁড়া করানো যায়। যথাসময়ে আলোচনা করা যাবে।
২২
নাম কিংবা কোন সম্বোধন ছাড়া যে মহিলার (She) কথা বার বার উঠে আসে (যিনি শিলঙে আত্মহত্যা করেছিল) তিনি যে সাগোতোর মা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হই। আবার সাগোতোর মা যে নিতিন রাজদানের মেয়ে পার্বতী রাজদানই সে ব্যাপারেও মোটামোটি নিশ্চিত হই।
একটা ব্যাপারে সংশয় থেকে যায়। যদিও হিমাচল প্রদেশের কিছু কিছু জায়গায় (যেমন কিন্নর) মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কথা শুনেছি, মিথিলা কিংবা কাশ্মিরের মূলধারার সমাজে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কোন খবর আমার জানা নেই। সেজন্যই সাগোতোর নামের সাথে মায়ের পদবী আমাকে কিছুটা অবাক করে। চা বাগানের শ্রমিকদের ভাষ্যের বাইরেও সাগোতোর ডায়রিতে তার ‘বাই-রেসিয়্যাল’ আইডেন্টিটির কথায় নিশ্চিত হই তার মা কিংবা বাবা একজন অন্ততপক্ষে ইয়োরোপিয়ান ছিল। আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হল, সাগোতো তার মায়ের পদবিই ব্যবহার করছেন সমসময়। তার পিতার উল্লেখ কোথাও পাই না। তার মা কি ‘সিংগেল মাদার’ ছিলেন? নাকি তার জন্ম কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফল? কোথাও ব্যাপারটা পরিস্কার হয়না।
ডায়েরির ছোট ছোট টীকা থেকে তাঁর মায়ের ব্যাপারে একটা ধারনা পাবার চেষ্টা করি। তিনি বেথুন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। গত শতাব্দির প্রথম দিকে তার মা’র সহচর্যে আসা বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতদের কিছু নাম পাওয়া যায়। যেমন কল্পনা গোস্বামী, সরলা ঘোষাল, প্রতিভা নন্দী, মৃন্ময়ী দেবী, শৈলেন বোস, সলিমুল্লাহ কিংবা অধ্যাপক মুর্তজা। পরবর্তীতে তিনি ‘নিরালম্ব স্বামী’ নামে এক সন্ন্যাসীর সান্নিধ্যে আসেন এবং ভক্ত হয়ে পরেন। তবে এই বৈশিষ্টহীন নামগুলি হঠাৎ করেই অর্থবহ হয় উঠে একটা ঠিকানা দেখে - ২৬ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। কিছু নাম, সমসাময়িক পরিস্থিতি এবং ঘটনা সংগঠনের সময় ইতিহাসের কিছু চরিত্রকে নির্দেশ করে।
সেই ব্যাপারটা বুঝতে গিয়ে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হল। ফরাসি বিপ্লব কিংবা রাশিয়ান ন্যায়হিলিজম থেকে প্রেরণা নিয়ে গত শতাব্দির প্রথম দিকে কংগ্রেসের অহিংস ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে আলাদা ভাবে বৈপ্লবিক পথে সংগ্রামের চেতনা থেকে অন্য একটি ধারার জন্ম হয়। তরুন সমাজ মূলত ইতস্তত ছড়ানো শরীর-চর্চা কেন্দ্রের মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রাম ও আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
গত শতাব্দির শুরুর দিকে অধ্যাপক মুর্তজার তত্ত্বাবধায়নে সরলা ঘোষাল সেরকম একটা শরীর-চর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলেন ২৬ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। তবে সরলা ঘোষাল নতুন কিছু ধারণা নিয়ে কাজ করেছিলেন। ‘শাস্ত্র পূজা’ নামে একধরনের আচারের প্রচলন করেন তিনি যার মূল উদ্যেশ্য ছিল মেয়েদের অস্ত্র ব্যবহারে সঙ্কোচ এবং ভয় কাটানো। তিনি ‘প্রতাপাদিত্ব উৎসবের’ও আয়োজন করতে চেষ্টা করেন মারাঠাদের শিবাজী উৎসবের আদলে। মূল উদ্যেশ্য ছিল সংগ্রাম জোরদার করতে শিবাজীর মত একটা ‘আইকন’ বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকায় সৃষ্টি করা। মা-ভবানী ছিল সেই শিবাজীর শক্তির উৎস ছিল। সরলা ঘোষালের এইসব পরীক্ষণ যদিও সফল হননি, মেয়েদের সংগ্রামে সম্পৃক্ত করার চেষ্টার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ‘নিরালম্ব স্বামী’ নামের সন্ন্যাসীর মূল নাম জিতেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী। তিনি বারোদা স্টেট আর্মির একজন প্রাক্তন সৈনিক। তখনকার কোন এক শরীর-চর্চা কেন্দ্রে অস্ত্র এবং মল্লযুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিতেন। অনুশীলন সমিতির সদস্যরাও সেখানে যেতেন। অরবিন্দ ঘোষের সান্নিধ্যেও ছিলেন, পরে অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীনের বিরুদ্ধাচারণে কেন্দ্র ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান।
মা ভবানীর যোগাযোগের মাধ্যমে এই সন্ন্যাসী কিংবা সরলা ঘোষালের মাধ্যমে হওয়া সম্ভব। পার্বতী রাজদিন মহারাষ্ট্রের তুলজা ভবানী মন্দিরের এক ‘অগ্নি-চক্ষু’ আঁকা মন্ত্রপূত ছোরার অধিকারী ছিলেন।
কম্পারেটিভ রিলিজিওনের অধ্যাপকের মতে ভবানী আসলে দেবী দুর্গারই মাহারাষ্ট্রের প্রতিকৃতি। অগ্নিচক্ষু, সীমিত অর্থে দেবী দুর্গার তৃতীয় নয়ন নির্দেশ কর।
২৩
বিলেতে যাওয়ার আগে গৌহাটির কটন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েছেন বলে হয়ত সাগোতোর বর্তমান মেঘালয়ের রাজধানী শিলঙের ব্যাপারে একধরণের মোহ কাজ করে বলে মনে হয়। তিনি প্রচন্ড আক্ষেপের সাথে ১৯০৬ সালে শিলঙে ফুলার হত্যার ব্যর্থ অভিযানের কথা উল্লেখ করেন। ধারনা করি পত্রিকায় প্রকাশিত আলিপুর বোমা সংক্রান্ত মকদ্দমার নথির বিবরনে এসব তথ্য পেয়েছেন তিনি। আরও লেখা হয় হেমচন্দ্রের কথা। অরবিন্দ ঘোষের অনুমোদনে ১৯০৬ এর দিকে হেমচন্দ্র ফুলারকে হত্যার দায়িত্ব নিয়ে শিলঙে আসেন। যদিও অন্তিমে সেই অভিযান স্থগিত করা হয়, সাগোতো হেমচন্দ্রের সেই দুর্ধর্ষ অভিযানের প্রণোদনা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। গতানুগতিক ধর্মে বিশ্বাসহীন পয়ত্রিশোর্ধ তিন সন্তানের জনক নিরীহ এই মধ্যবিত্ত সংসারী ঠিক কিসের টানে স্ত্রী-সন্তান পিছনে ফেলে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে পা বাড়ায়? বায়বীয় এই ‘দেশপ্রেম’ জিনিসটা আসলে কী? এমন প্রপঞ্চের কাছে নিজের যাপিত জীবনের তুচ্ছতার কথাও প্রকাশিত হয় লেখায়।
২৪
সাগোতোর ডায়েরিতে প্রথম যে ‘আত্মহত্যার’ ঘটনা পাই সেটা ঘটে শিলঙে, ১৯১৯ সালের জুনে, রেলযাত্রার আলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার ছয় মাস আগে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, “দরজার কাঠের পরিকাঠামোর পেরেকে বন্দুকের ট্রিগার আটকে চিবুকের নীচে বন্দুকের নল ধরে বন্দুক নিজের দিকে টেনে নিয়ে আত্মহত্যা করলে কতটা কষ্টকর হতে পারে সেই মৃত্যু”? তিনি নিজেই উত্তর দেন, ‘দ্য ইম্পেক্ট ইজ অ্যাবসোলিউট, কোন কিছু অনুভব করার আগেই নিশ্চিত মৃত্যু’।
মেঝে থেকে ছয় ইঞ্চি উপর দরজার কাঠের পরিকাঠামোতে পেরেক এমনভাবে মারা হয়েছে, যাতে পেরেক ট্রিগারের উপর থাকলে বন্দুকের বাট মাটিতে লেগে থাকবে। আর বন্দুক ৪৫ ডিগ্রী কোণে আরাম-কেদারায় বসা কারোর চিবুকের ঠিক নিচে তাক হয়ে থাকবে।
তিনি লিখেন, ‘কেউই প্রশ্ন করল না, সারা জীবন অনেক বড় বড় ঝড়-ঝাপটা সহ্য করা এমন সাহসী একজন মহিলা কাপুরুষের মত আত্মহত্যার পথ বেছে নিবেন কেন? অথবা, বারো-বোরের উচ্চগতিসম্পন্ন গুলি ব্যবহারে শটগানের রিকোয়েলে দরজার পেরেক ছুটে না গেলেও পিছন দিকে নিশ্চিত বেঁকে যেতে বাধ্য”?
তিনি সেই সময়ে শিলং ছিলেন ছুটিতে। পরের ছয়টা দিন পুরোটা সময় তিনি একাএকা সেই বাসায় কাটান। ছড়ানো কাগজপত্রের মাধ্যে ব্রজবুলি ভাষায় লিখা কিছু গীতিকাব্যের মর্মার্থ উদ্ধার করে তাঁর মন গভীর বিষাদে ছেয়ে যায়। তিনি লিখেন গভীর এক সংকটের সময় ছিল সেটা। ব্রজবুলি ভাষার ব্যাপারটাও পরিস্কার হয়। সঙ্গীতানুরাগী এবং সাহিত্যানুরাগী মিথিলার রামেশ্বর সিং এর সহচার হিসাবে সাগোতোর পিতামহ নিতিন রাজদানের নিশ্চিতভাবেই ব্রজবুলি ভাষায় দারুন দক্ষতা ছিল। নিশ্চিতভাবেই কিছু শিক্ষা সাগোতোকেও দেয়া হয়েছিল।
২৫
সাগোতোর মা পার্বতী রাজদান আত্মহত্যা করে নাই – তাঁকে হত্যা করা হয় - এমন ধারনা পাওয়া যায়। সম্ভাব্য খুনি নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।
পার্বতীর কি ব্রিটিশ-বিরোধি আন্দোলনের সশস্ত্র অংশের সাথে যোগাযোগ ছিল? ব্রিটিশদের বিভিন্ন লেখাতে এবং প্রতিবেদনে (এমন কি যেটা সাগোতোর ডায়রিতে পাওয়া গেছে, যা যথাসময়ে আলোচনা করা যাবে) এটা পরিস্কার যে, সেই সব গোপন সমিতিতে অনুপ্রবেশ একেবারেই অসম্ভব ছিল। বিশেষকরে তাঁদের খুবই কঠোর অভিমন্ত্রণ প্রকৃয়া ছিল। কিন্তু খোদ বিপ্লবীদের লেখায় পাই সমিতিতে অনুপ্রবেশের সুযোগ ছিল।
পার্বতীর মত একজন ‘ব্রিটিশ-মহলে-চলাফেরা-করা’ মেয়ে কী করে আন্দোলনের সাথে যোগ দিবে? নাকি, পার্বতী নিজেই বিল্পবীদের পক্ষ হতে ব্রিটিশ মহলে একজন ‘অনুপ্রবেশকারী’ ছিল? নিজেকে পার্বতী ‘হানি-ট্র্যাপ’ হিসাবে উৎসর্গ করেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে সাগোতোর জন্ম? সাগোতো আসলে দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গের এক প্রতিরূপ। অথবা কোন শ্লীলতাহানীর ঘটনা এটা?
কী সেই গোপন দলিল? পার্বতী কি কোন গোপন দলিল কিংবা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করেছিল ব্রিটিশ মহল থেকে? যেটা এমনভাবে রাখা হয়েছিল যাতে পার্বতীর মৃত্যুতে সেই দলিল উদ্ধার সম্ভব ছিল না। সেজন্যই কি ‘উত্তরপূরুষের জীবনসংকটের’ কথা আসে? পার্বতীকে কি বলা হয়েছিল, যেই গোপন দলিল ফাঁস হলে তার পুত্রকে হত্যা করা হবে? সেসব ঘটনা পার্বতীর ‘আত্মহত্যার’পর গীতিকাব্যের আদলে লিখে রেখে যাওয়া সংকেত থেকে সাগোতো সেসব উদ্ধার করেন?
সাগোগোর ডায়েরিতে যে দ্বিতীয় আত্মহত্যার বিস্তারিত বিবরণ পাই, সেটা ম্যলকম ম্যাকেঞ্জির ভারতীয় রক্ষিতার - এবং সেই শিলঙেই। পার্বতীর ‘আত্মহত্যার’ মাত্র দু’বছরের মাথায়ই ম্যালকমকে ছুরি দিয়ে অত্যাচার করে হত্যার পর তার রক্ষিতার নিজেই আত্মহত্যার করে, সাগোতো তখন শিলঙেই। আরও দু’টো তথ্য পাই – ব্রিটিশরা ঘটনাকে কিছুটা ধামাচাপা দিয়েছিল সার্বিক আন্দোলনের পরিস্থিতি বিবেচনায়। এবং হত্যা এবং আত্মহত্যা ব্যবহৃত ছুরি পাওয়া যায়নি। সেটা কি সাগোতোর হাতে জোড়া খুন? সেই অগ্নি-চক্ষু ছোরা দিয়ে? ম্যালকম ম্যাকেঞ্জীর সাথে চা-বাগানের সেই দুর্গার স্বামী গ্র্যাহাম ম্যাকেঞ্জীর কি কোন সম্পর্ক ছিল?
জুলিয়েটের মায়ের ভুমিকাই কী?
(চলবে)
মন্তব্য
দ্বিবর্ণ জাতক - ১ প্রকাশিতঃ ১৪/০৮/২০১১
দ্বিবর্ণ জাতক - ২ প্রকাশিতঃ ০৮/০৫/২০১২
দ্বিবর্ণ জাতক - ৩ প্রকাশিতঃ ০১/০৪/২০১৮
এই হারে সিরিজ চললে আপনি তো বস্ হারপার লী-কে ছাড়িয়ে যাবেন! তাও ভালো সিরিজটা আবার শুরু করেছেন। পরের পর্ব দ্রুত না আসলে আমাদেরকে ব্রাহ্মী শাক খাওয়াবার ব্যবস্থা করতে হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
২০১২ থেকে ২০১৮ – ছয় বছর। ছোট্ট একটা লেখার জন্য বড্ড বেশি সময়। তারপরও কিছু লিখছি … এই আরকি।
তবে ২০১২ থেকে ২০১৮ – বদলে যাওয়া পরিস্থিতিও বড্ড বেশি পীড়া দেয়। অনুপ্রেরণা পাইনা।
ব্রাহ্মী শাক – ব্যাপারটা জানতাম না। আসলেই আমার দরকার পাণ্ডব’দা।
ব্রাহ্মী শাকের চেয়ে "বিশ্রাম শাক" আরও ভাল। এখানে পাবেন।
****************************************
পুরনো এপিসোডগুলো বের করে একবারে তিনটা পড়লাম। পড়ে প্রথম যে অনুভূতি সেটা হচ্ছে নবারুণ ভট্টাচার্যের গদ্য পড়ার মতো। নবারুণের গদ্য পড়তে নিলে প্রায়ই গুগল হাতড়াতে হয়। এই সিরিজটা পড়তে গিয়ে অমন অনুভূতি হলো। তবে আমি গুগল হাতড়ে চার্ম নষ্ট করিনি। কখনো সিরিজটার শেষ পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেলে তখন অজানা বিষয়গুলো নিয়ে খোঁজখবর করবো।
সম্ভবত আকার ছোট রাখার জন্য বর্ণনা কমিয়েছেন, তাতে পাঠকের পক্ষে খেই রাখা কঠিন হয়ে গেছে। যে বিশাল ক্যানভাস আপনি ধরেছেন তাতে মিখাইল শলোখভের মাপের কাজ নামাতে হবে। দু'তিন বছর সময় হাতে নিয়ে যদি অমন কিছু করতেন তাহলে আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে যেতাম।
অটঃ দুই যুগ আগে একবার সিলেট থেকে ঢাকা ফেরার পথে পাহাড়ী ঢলে রেলব্রীজ ধ্বসে গিয়ে এমন এক জায়গায় আটকা পড়েছিলাম যার একদিকে পাহাড় আর অন্য দিকে আদিগন্ত জলাভূমি। সে'রাতে খাবার নেই, পানি নেই, টয়লেট নেই, ডাকাতের হামলা, মরণাপন্ন রোগীর চীৎকার, ঢাকা থেকে রাতের ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীর আকুতি, অন্ধকারে মুখে ঝাপটামারা অজানা উড়ন্ত বস্তু - সে এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। সাগোতো রাজদানের ট্রেন থেকে নেমে পড়ার কথা পড়ে সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেলো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আরে পাণ্ডব’দা, একটা লেখার চেষ্টা আরকি। আমি জানতাম আপনি পড়ে আপনার মন্তব্য জানাবেন। সবসময়ের মত ধন্যবাদ।
আপনি ঠিকই ধরেছেন, লেখার আকার ছোট করার জন্য বর্ণনা অনেক কমিয়েছি। এখন আমার নিজেরই মনে হচ্ছে বড় ক্যানভাস আর অনেক বেশি তথ্যে পাঠক আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তবে পরিকাঠামোতে যে তথ্যগুলি ব্যবহার করা হয়েছে, সবগুলি, যাকে বলে পুরাপুরি ‘অথেনটিক’।
রেলে আমারও এধরণের অভিজ্ঞতা আছে – অবশ্য আলৌকিক না।
পরের পর্ব ২০২৫ সালে নয়, বরং ২০১৮ সালের এপ্রিলেই আসুক।
ধন্যবাদ। অন্ততপক্ষে ২০১৮ তে আশাকরি।
নতুন মন্তব্য করুন