ডিএফআইয়ের তিন কর্মকর্তা হলেন, ডিরেক্টার কমোডোর ইসলাম, চিফ এডমিনিস্ট্রেটর কর্নেল ইসলাম, এবং ডিএফআইয়ের বিদেশি মিশনের যোগাযোগ কর্মকর্তা মেজর মোহসিন। (তারবার্তা 1975DACCA05398_b) । জিয়াউর রহমানে পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত শুভেচ্ছার পর দু’টি ব্যাপারে রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পুরানো সম্পর্কের কোন পরিবর্তন হবে না, বরং আরও ভাল হবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়। দ্বিতীয়ত, নিশ্চিত করা হয় যে, জেনারেল জিয়া এক-দুদিনের মধ্যেই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করবেন। রাষ্ট্রদূতও ‘পুরনো বন্ধুর’ সাথে দেখা হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে দুটি গুরত্বপূর্ন খবর দেখি – আগের রাত (৬ নভেম্বর, সময় রাত একটা) থেকে ব্যপক সংঘর্ষ শুরু হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান সামান্যই – ত্রিশ কিংবা তার থেকে কম লোক মারা গেছে। ডিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের কাছে জেনারেল খালেদ মোশাররফের কথা জানতে চাইলে জানানো হয়, তিনি তাদের কাছে বন্দি অবস্থায় আছেন, যদিও তার কুশল জানতে চাইলে কিছুটা অস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়। (অবশ্য মার্কিন দূতাবাস তার আগেই খালেদ মোশাররফের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে।)
সময়টা খেয়াল করতে হবে, বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ তখনও পুরাপুরি থেমে যায়নি। ডিএফআইয়ের ভূমিকাটাও কৌতূহলোদ্দীপক।
অবশ্য ৭ নভেম্বরের পরপর সম্ভব্য ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপ’ প্রতিরোধের জন্যই রাষ্ট্রদূতের সাথে যোগাযোগ বেশি হচ্ছিল। বিভিন্ন তারবার্তায় এই সম্ভাব্য ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপের’ ব্যাপারে ‘নতুন সরকা্রের’ উদ্বেগ ভালভাবেই টের পাওয়া যায়। পুরষ্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক বি জেড খসরু তার বইতে (The Bangladesh Military Coup and the CIA Link) জানাচ্ছেন জিয়াউর রহমান ২৩ নভেম্বরে ‘দ্বিতীয় বারের’ মত ভারতীয় হস্তক্ষেপের ব্যাপারে মারাত্মক উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। সামরিক বাহিনী সম্ভ্যাব্য হস্তক্ষেপের ব্যাপারটা এতটাই গুরুত্ব সহকারে নেয় যে এ ব্যাপারে সাহায্যের জন্য পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে বিশেষ দূত পাঠানো হয়। দূত মারফত খবর পাওয়ার পরপরই ভুট্টো পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আগা শাহীকে বলেন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করতে।
দিল্লী থেকে ৭ তারিখে পাঠানো একাধিক রিপোর্টে ভারতীয় সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিশ্লেষণ দেখা যায়। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্মসচিব ‘আজমানীর’ সাথে বিস্তারিত কথাবার্তা এবং বিশ্লেষণ পাঠানো হয়। নতুন ‘সরকার’ নিয়ে আজমানীর বিশ্লেষণটা কৌতূহলোদ্দীপক, সরাসরি ইংরেজিতেই তুলে ধরলাম “ Ajmani described current situation as inherently unstable since military leaders (whom he called men without morals or principals, ruthless killers, and total opportunist) now in power had no ‘roots’ among people of Bangladesh. He explained he meant by this that they had no political base, no ideology, and no objectives other than to remain in power. All they could do was kill each other off and none of them could sleep easy in his bed at night”.
এদিকে মেজর রশিদের স্ত্রীর এক পুরানো সহকর্মী ব্যাঙ্কক থেকে দেশে ফিরে আসেন ১৩ নভেম্বরে। তিনি জানাচ্ছেন যে ঘাতক মেজররা ব্যাঙ্কক থেকে দেশে ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে আছে। প্রতিনিয়ত তাদের যোগাযোগ হচ্ছে খন্দকার মোশতাক এবং জেনারলে জিয়ার সাথে। এমনকী আগের দিনও (১২ নভেম্বর) দুজনের সাথেই ঘাতক মেজরদের কথা হয়েছে। সেই সহকর্মী ভদ্রলোক মোশতাক, জিয়া এবং অন্যান্যদের জন্য ঘাতক মেজরদের চিঠি-পত্রও নিয়ে এসেছে। এটাও জানা গেল ফারুক এবং রশিদ ছাড়া অন্যান্যদের দেশে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া হবে। (তারবার্তা 1975DACCA05582_b)
আঠানো নভেম্বরে পাঠানো ছোট্ট তারবার্তাটা গুরুত্বপূর্ণ – Ambassador Boster departed post 1230 Hours, November 18, have assumed charge. কপি, রেফারেন্স ইত্যাদি থেকে ধারনা করা যায় তিনি ব্যাংকক গিয়েছিলেন।
এর আগে নভেম্বরের পাঁচ তারিখ পাকিস্তান থেকে পাঠানো (তারবার্তা 1975ISLAMA10267_b) তারবার্তায় সুইস দূতাবাসের বরতে বলা হয় ৫ নভেম্বর সকালে মোশতাকে ঢাকা বিমানবন্দরে দেখা গেছে। তিনি দেশের বাইরে যাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সামরিক বাহিনী তাকে বাধা দেয়। ব্যাপারটার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, তবে এখন আমরা জানি খুনি মেজরদের বিদেশে পাঠানোর যোগাযোগে মোশতাকের নামও একাধিক বার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১০ তারিখে পাঠানো তারবার্তায় (1975DACCA05470_b) দেখতে পাই, জেনারেল মোশাররফের সাথে দর-কষাকষির শেষ হওয়ার আগে মোশতাক সরকার কুমিল্লা সেনানিবাসে যোগাযোগ করেছিলেন তাকে দেশ ছাড়তে সাহায্য করতে। কিন্তু সেনানিবাস সেনাপ্রধানের আদেশ ছাড়া ঢাকা আসতে অস্বীকার করে।
সেই তারবার্তায় জেলখানায় চারনেতা হত্যার ব্যাপারে একটা কৌতূহলোদ্দীপক মন্তব্য লেখা হয় - “We have good reason to believe, had been a part of an earlier contingency plan to be carried out in the event Moshtaque were to be killed”
পাকিস্তান থেকে পাঠানো তারবার্তায় আরেকটা খবর দেখা যায়। খুনি মেজরদের পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হবে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তান জানায় - ‘সম্ভবত না’। কারণ হিসাবে দেখানো হয়, বাংলাদেশের সাথে যে নতুন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে সেটা যাতে ‘নতুন-যেই-ক্ষমতায়-আসুক” তাদের সাথে নষ্ট না হয়। (তখনও খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায়)।
আমার ধারণা, খুনি মেজরদের পাকিস্তানে জায়গা না দেয়া এবং দেশে ফিরতে না দেয়ার অন্যতম কারণ ছিল ‘সম্ভাব্য ভারতীয় হস্তক্ষেপের ভয়’।
১০ তারিখে জার্মানীর রাষ্ট্রদূত রিটারের বরাতে একটা তারবার্তা পাঠায় বোস্টার আমেরিকায়, যেটার উল্লেখ করা প্রয়োজন। তারবার্তায় জানা যায় খুনি মেজরেরা জার্মানীতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে যাচ্ছে। রিটার জানায় যে, জার্মানীতে অবস্থানরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (তখন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ছিলেন) ৬ তারিখই জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘খুনি মেজরদের’ রাজনৈতিক আশ্রয় না দিতে অনুরোধ করেন। রিটার নিজেও রাজনৈতিক আশ্রয় না দেবার পক্ষে কথা বলেন।
আবার উল্টোটাও দেখা যায়। লেঃ কর্নেল এম, এ হামিদ তার বই ‘তিনটি সেনা অভ্যূত্থান এবং কিছু না বলা কথাতে’ পচাত্তরের নভেম্বর নিয়ে অনেক ‘কথাই’ বলেছেন। খন্দকার নাজমুল হুদার (বীর বিক্রম) কন্যা সেদিন টেলিভিশনে হামিদ যে কথা তার বইতে বলেন নাই, তাই আমাদের জানালেন। আগরতলা মামলার অভিযুক্ত বীর মুক্তিযুদ্ধা খন্দকার নাজমুল হুদার (বীর বিক্রম) মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ সেনাবাহিনীর কবরস্থানে কবর দেয়ার অনুরোধ করতে গেলে কর্নেল হামিদ বলেন, “হি ডাজন্ট ডিজার্ভ ইট”। পরে বনানী করবস্থানে দাফন করা হয়।
খন্দকার নাজমুল হুদার কন্যার কাছে এও জানা গেল, নাজমুল হুদার মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী জিয়াউর রহমানের কাছে তাঁর স্বামীর মৃতদেহ বাংলাদেশের পতাকায় মুড়ে দেবার আবদার করেছিল, যেটা দিতে তিনি অস্বীকার করেন।
মন্তব্য
কর্নেল হুদা বীর বিক্রমের কন্যা টিভিতে যা বললেন সেটা ইউটিউব বা কোথাও থাকলে লিংকটা লেখায় যুক্ত করে দেওয়া যাবে কী?
এইখানে পাবেন।
এই আজমানি ভদ্রলোকের ব্যাপারে কৌতূহল হচ্ছে। এই মত কি তিনি খালেদ মোশাররফ - নূরুজ্জামান - হুদা - শাফায়াত জামিলদের সক্রিয়তার পর এবং "বিপ্লবের" আগে ব্যক্ত করেছেন (নভেম্বর ৩-৬), নাকি "বিপ্লবের" পর?
একটু ভুল হয়েছে। আজমানী আসলে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, যাকে দূতাবাস ‘মোর রেডিক্যাল’ হিসাবে বলছে। রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে ৭ তারিখ বিকেলে। আজমানী ৭ নভেম্বরের পরের ‘ক্ষমতা-দখলকারী’দের ব্যাপারে এটা বলেছে (৭ নভেম্বরের ‘বিল্পবের’ পর)।
বহুল আলোচিত উক্তি 'তাহের, ইয়্যু হ্যাভ সেভড মাই লাইফ'-এর প্রত্যক্ষদর্শী কারা? মানে কারা নিজেরা জিয়াকে এই কথা বলতে দেশেছেন/শুনেছেন? বইয়ে/পত্রপত্রিকায়/আনুষ্ঠানিক আলোচনায় কে প্রথম এই উক্তিটি সাধারণ্যে নিয়ে আসেন?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ঠিক জানিনা। কোথায় কোথায় পড়েছি এটাও ঠিক মনে করতে পারছি না। (এখন অবশ্য বই পত্র হাতের কাছে নেই।) লরেন্স লিফসুলজ সাহেব কর্নেল তাহেরকে কিছুটা একপেশে দৃষ্টিতে দেখেছ।
- জেনারেল মোশাররফ কে?
ঐ সময়ে বাংলাদেশে 'ভারতীয় হস্তক্ষেপ'-এর সম্ভাবনা আসলে কতটুকু ছিল? এই ব্যাপারে ভারতের আদৌ কোন পরিকল্পনা/অবস্থান ছিল কি?
কাদের সিদ্দিকীর 'জাতীয় মুক্তিবাহিনী '৭৫' ভারতকে বেস করে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তে আক্রমণ করেছিল। ভারতের সাহায্য ছাড়া ভারতের ভূমি ব্যবহার করে বাংলাদেশ আক্রমণ করা ও প্রায় ২২ মাস (১১/৭৫ - ০৭/৭৭) ধরে যুদ্ধ চালানো কি সম্ভব! এই ব্যাপারে কাদের সিদ্দিকীর উক্তি স্মর্তব্য, "ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ইন্দিরা গান্ধীকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন মোরারজি দেশাই। জিয়াউর রহমান তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে প্রতিরোধ-সংগ্রামীদের প্রতি দেশটির সমর্থন বন্ধের ব্যবস্থা করেন। শুধু তা-ই নয়, ওই সময় মোরারজি দেশাই সরকার অসংখ্য প্রতিরোধ-সংগ্রামীকে ধরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়" (বাংলাদেশ প্রতিদিন, শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫)।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এট একটা চরম ফাঁকিবাজি লেখা। তবে আমি সেই সময় এবং পরবর্তী সময়ে পেছনের দৃশ্যপটে কি হচ্ছিল বুঝতে চেষ্টা করছি – নতুন কিছু পেলে লিখার চেষ্ট করব। এই মুহূর্তে একটা ‘ইয়ের’ দেশে আছি, বই-পত্র পাওয়া যায়না, আবার ‘হার্ড-কপি’ অন্য দেশ থেকে আনাও যায় না। (এখনও স্ক্রিন বই পড়া রপ্ত করতে পারিনি।)
আসলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে বুঝাতে চেয়েছি।
আমার মনে হয়না বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার তেমন কোন পরিকল্পনা ভারতের ছিল। তবে এটাও ঠিক যে জিয়া এবং তখনকার সরকার এ ব্যাপারে খুবই ভয় পাচ্ছিল। এই প্যানিকের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের উপদেশ, “ To calm the situation down, America urged Bangladesh to “take immediate steps to reassure” India that Dhaka intended to pursue good relations with New Delhi and to live up to its obligations to protect the foreign community and the Hindu minority. “In our judgment, this is the best way for the new regime to support our efforts in New Delhi to reduce the likelihood of Indian intervention.”
আপনার ধারণা এবং কাদের সিদ্দিকীর কথা ঠিক বলেই মনে হয়। দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা।
পচাত্তরের সবগুলো সমীকরণ মিলতে আরো বহুবছর লেগে যাবে। তবু এমন কৌতুহলী প্রচেষ্টাগুলো আরো জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। পোস্টটি আরো বড় হবার সুযোগ ছিল। কিন্তু যেহেতু আপনি বড় না হবার ব্যাখ্যাটা উপরের মন্তব্যে দিয়ে ফেলেছেন তাহলে আর বলার কিছু থাকে না। মাঝে মাঝেই এই বিষয়গুলো নাড়াচাড়া করা দরকার। তাতে কিছু না কিছু সত্য বেরিয়ে আসেই।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নতুন মন্তব্য করুন