ইসলামিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কার্যক্রম, ইত্যাদি। (পর্ব ২)

নৈষাদ এর ছবি
লিখেছেন নৈষাদ (তারিখ: রবি, ১৫/১১/২০২০ - ২:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

উনিশ’শ পঁচাত্তরের নভেম্বরে ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউর রহমানের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর একটি ছিল সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ক্ষমতায়ন। তাঁর দল গঠনের প্রাথমিক চিন্তাভাবনা নিয়ে তাঁরই শাসনকালের এক আমলা, প্রথমে নোয়াখালি এবং পরে চিটাগাঙের জেলাপ্রশাসক, সবেক সিএসপি অফিসার জিয়াউদ্দিন চৌধুরির পর্যবেক্ষণ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।

ক্ষমতায় আসার পরপরই জিয়া ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেটে পরিবর্তন করে সামরিক খরচ বাজেটের ৭% থেকে ২০% উন্নীত করেন। একই সাথে সামরিক কর্মকর্তাদের নতুন বাসস্থান তৈরি সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করেন। (পাকিস্তান আমলের কিছু সুবিধাদি ফিরিয়ে আনা হয়)। জিয়ার শাসনকালে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা হিসাবে সামরিক বাজেটের পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ানো হয়েছে (১৯৭৫ এ ০.৭% থেকে শুরু করে ১৯৮০ তে ১.৮% এ উন্নীত করা হয়)। (১)

একই সময়ে জিয়া সামরিক বাহিনীর তথাকথিত বিশৃঙ্খলা এবং বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেছিলেন। একটা স্টাডি বলছে, সিপাহী বিদ্রোহের পর এত সংখ্যক সামরিক কর্মীকে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। পাকিস্তান-ফেরত সামরিক কর্মকর্তাদের উপর জিয়ার নির্ভরতা অনেক বেশি ছিল এবং তিনি তাদের ক্ষমতায়নও নিশ্চিত করেছিলেন। ১৯৮১ প্রথমার্ধে Marcus Franda জানাচ্ছেন, সামরিক বাহিনীর ৫০ জন মেজর জেনারেল এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের মধ্যে মাত্র দুজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। (২)

একই ভাবে বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ক্ষমতায়ন করেন তিনি। খুব বেশি বিশ্লেষণে না গিয়ে রবার্ট এন্ডারসনের (Impressions of Bangladesh… Pacific Affairs, Fall 1976) বিশ্লেষণ উল্লেখ করা যায়। তিনি লিখেছেন, “জিয়ার শাসন আমল মূলত আইউব খানের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টেটেরই পুনরুত্থান।"

জিয়া তাঁর পরামর্শদাতা হিশাবে ‘কাউন্সিল অভ অ্যাডভাইজার্স’ নামের এক পরিষদ গঠন করেন। সেখানে প্রথমে ৭ জন সিভিলিয়ান, ৩ আর্মি এবং ৬ জন আমলা ছিল। পরে মোট সংখ্যা ২৪-এ উন্নীত করা হয়, আমলার সংখ্যা উন্নীত করা হয় ১০ জনে। (আমার জানা মতে ১৯-সদস্য বিশিষ্ট প্রাক্তন আমলাদেরও একটি পরিষদ ছিল, যার কনভেনার আমার পরিচিত ছিল, কিন্তু রেফারেন্স পাচ্ছি না।)

ক্ষমতায় আসার পর জিয়া রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেন, এবং ১৯৭৭ এর এপ্রিল পর্যন্ত নিজে শুধুমাত্র ‘সামরিক কর্মকর্তা’ হিসাবেই ছিলেন। এপ্রিলের ২১ তারিখে নামের সাথে প্রেসিডেন্ট পদ যোগ করেন।

ফিরে আসি জিয়াউদ্দিন চৌধুরির পর্যবেক্ষণে। তিনি লিখেছেন, পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরও তৃণমূলে এবং তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতৃত্বে একচেটিয়া আওয়ামী লীগের প্রাধান্য ছিল। জিয়াউদ্দিন ১৯৭৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর একটি ব্যক্তিগত জরিপ করেছিলেন। তিনি দেখেছেন, সর্বোচ্চসংখ্যক জয়ী প্রার্থীরা প্রাক্তন আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন (তখন নির্দলীয় নির্বাচন হত)। Marcus Frenda ও একই উপসংহারে এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, “১৯৭৭ মার্চের পৌরসভা এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার শত্তিমত্তার পরিচিয় দিয়েছে।" (২)

জিয়াউদ্দিন চৌধুরির ভাষ্য, জিয়াউর রহমান প্রাথমিকভাবে আওয়ামী লীগের সেই বিরাট সমর্থকগোষ্ঠীর মন জয়ের প্রত্যাশা করতেন। (৩)

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর (রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেবার আগে) সারাদেশ প্রচুর ভ্রমণ করে ছোট ছোট জনসভা করতেন। প্রথমে তিনি তাঁর ভ্রমণ শুরু করেন সামরিক হেলিকপ্টারে, এবং পরে সামরিক জিপে। কিছু কিছু মাসে তিনি ১৫ দিনই ঢাকার বাইরে থাকতেন (Marcus Frenda )। জিয়াউর রহমান জেলা ভ্রমণের সময় আওয়ামী লীগের সাংসদ এবং জেলা পর্যায়ের নেতাদের সাথে বৈঠকের ব্যবস্থা করতে ডেপুটি কমিশনারদের আদেশ দিতেন। জিয়াউদ্দিন চৌধুরি জানাচ্ছেন, তাঁর অনুরোধ কিংবা আদেশের পরও আওয়ামী লীগের নেতারা জিয়ার সাথে দেখা করতেন না।

জিয়াউদ্দিন চৌধুরি আরও জানাচ্ছেন, জেলার কেন্দ্রীয় নেতারা দেখা করলেও তাঁর দলে যোগ দেননি। তিনি প্রয়াত শহিদউদ্দিন ইস্কান্দার (কচি ভাই নামে জনপ্রিয় ছিলেন) এবং তাঁর স্ত্রীর উদাহরণ দিয়েছেন। কচি ভাই তখন নোয়াখালি জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, তাঁর স্ত্রী ছিলেন সাংসদ। কচি ভাই জিয়ার আমন্ত্রণে তাঁর সাথে দেখা করলেও জাতীয়তাবাদি দলে কখনোই যোগ দেননি।

জেলাপ্রশাসক জিয়াউদ্দিন চৌধুরির পর্যবেক্ষণ ছিল, “প্রাথমিক ভাবে” জিয়াউর রহমান ‘বাকশাল’ এবং ‘ভারতের’ ভয় দেখানো ও এই দুই ‘জুজুর’ বিষোদ্গার করলেও সরাসরি আওয়ামী লীগের বদনাম করতেন না। আওয়ামী লীগের সমর্থকগোষ্ঠীর মন জয় করার প্রয়াসেই তিনি এটা করেছিলেন।

এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ করতে হয়। ১৯৭২ সালে জিয়াউদ্দিন চৌধুরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী প্রয়াত কামারুজ্জামানের ব্যক্তিগত সহকারী হিসাবে কাজ করতেন। জিয়াউর রহমান সেই সময় প্রায়ই কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করতে যেতেন (কামারুজ্জামানের প্রিয়পাত্র ছিলেন বিধায় প্রোটোকলের দরকার হত না)। জনাব কামারুজ্জামান বাকশালের ‘পলিটব্যুরোর’ সদস্য হওয়ার পর জিয়া অভিনন্দন জানিয়ে কামারুজ্জামানকে পত্র দিয়েছিলেন, এবং পরে ব্যক্তিগতভাবে এসে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন।

প্রাক্তন জেলাপ্রশাসক জিয়াউদ্দিন চৌধুরি আরেকটা কথা জানাচ্ছেন আমাদের। প্রাথমিকভাবে তার সামরিক এবং বেসামরিক উপদেষ্টারা বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত ‘অসাম্প্রদায়িক দেশ-শাসনের নীতি’ অনুসরণ করে জিয়াকে “ক্লিন-ব্রেকথ্রুর” কথা বলেছিলেন। জিয়া এতে একমত ছিলেন না।

তাঁর দল কিংবা প্ল্যাটফর্ম গঠনের সংশ্লিষ্ট অংশের আলোচনা পরে করা যাবে।

১০

আমার লেখায় অন্যান্যদের সাথে মাওলানা ভাসানী এবং আহমদ ছফার কথা উঠে এসেছে একাধিকবার – মজলুম জননেতা কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ দেখাতে নয়, বরং তাঁদের অন্য অংশে আলো ফেলতে। আলোচনা প্রাসঙ্গিক বিধায় করতে হয়েছে – ভাসানীর মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী গৌরবোজ্জ্বল ভুমিকা কিংবা ছফার বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষকে মাথায় রেখেই।

আহমদ ছফা জাসদের গণকণ্ঠ ছাড়ার পর ১৯৭৫ সালের জুন থেকে মাহবুবুল আলম চাষীর হয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি অবশ্য নিজেই এই ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চুম্বক অংশ পড়া যাক তার লেখনীতেই। কাকতালীয় মনে হলেও ঘটনার পরম্পরা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।

জিয়ার আমলের কৃষিমন্ত্রী আজিজুল হক ১৯৭৫ এ ইউনিসেফের বাংলাদেশ শাখার প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর অনুরোধে (ছফার ভাষ্য অনুযায়ী) তিনি আহমদ ছফাকে ইউনিসেফের একটি গবেষণা প্রকল্পের কাজ দেন (সেটা কী ধরনের কাজ জানা যায় না)। মজার ব্যাপার হল, ছফা সেই ধরনের গবেষণার বিষয়ে অনভিজ্ঞ ছিলেন। আজিজুল হক সাহেব ছফাকে সাত হাজার টাকার একটি চেক দিলেন এবং বললেন, “এক মাসের জন্য কুমিল্লা একাডেমীতে যাও। সেখানে যে লাইব্রেরিটি আছে তাতে সমাজ উন্নয়ন বিষয়ক অনেক বইপুস্তক আছে। মাসখানেক পড়াশোনা করে প্রাথমিক ধারণাটি গঠন কর।" (৪)

তিনি নিজেই লিখেছেন, “সপ্তাহতিনেক সমাজ উন্নয়নবিষয়ক বইপত্র নাড়াচাড়া করে দেখলাম। শেষ পর্যন্ত নিজের সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, আমাকে দিয়ে গবেষণা-টবেষণা ওসব কাজ হবে না”।

তারপরের ঘটনাটা চমকপ্রদ, তাঁর ভাষাতেই শুনি, “শুক্রবার একজন লুঙ্গিপরা ফর্সাপানা চেহারার এক ভদ্রলোক লাইব্রেরির কাছে সিঁড়ির গোড়ায় আমাকে ডেকে চাটিগেঁয়ে ভাষায় বেশ নরম জবানে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আহমদ ছফা নন?" সেই সৌম্য-দর্শন ভদ্রলোক হলেন মাহবুবুল আলম চাষী।

চা-টা খাইয়ে চাষী ছফাকে বললেন, “আপনাদের মত জ্ঞানীগুণী মানুষেরা বুদ্ধি-পরামর্শ না দিলে বঙ্গবন্ধু যে সমাজতন্ত্র করতে চান, তা কেমন করে সম্ভব হবে?"

তাপরপ চাষীর কাজে যুক্ত হলেন। ছফা লিখেছেন, “ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করার সময়েই আমি জনাব মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হই। তিনি আমাকে পছন্দ করতেন এবং অবসর সময়ে নানা বিষয়ে আলাপ করতেন। এমনও ঘটেছে, কোন কোন রাতে না ঘুমিয়ে শুধু কথা বলেই পার করে দিয়েছি।" সেই লেখাতেই জানতে পারি, চাষী প্রায় তিনি তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে ট্রাংক কল করে কথা বলতেন।

ছফা অগাস্টে ঢাকা ফিরে আসেন। তিনি লিখেছেন, “শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর আমি আর কুমিল্লা ফেরত যাইনি। সবাই আমাকে পরামর্শ দিলেন, আমি যেন ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে আমার স্কলারশিপটা ফেরত দিতে বলি…।"

মাহবুবুল আলম চাষী তখন বঙ্গভবনে, মোশতাক সরকারের অংশ। ছফা লিখেন, "… আমি মাহবুবুল আলম চাষী সাহেবকে টেলিফোন করলাম। তাঁর পিএ টেলিফোন ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গেই চাষী সাহেবের কণ্ঠস্বর শুনলাম। এতদিন বাদে আপনি যোগাযোগ করছেন। আশা করেছিলাম আগেই টেলিফোন করবেন। …চাষী সাহেব টেলিফোন করে অবিলম্বে মতিন চৌধুরী সাহেবকে আমার স্কলারশিপ ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং মতিন চৌধুরী সে কথা রক্ষা করেছিলেন।"

শেষে তিনি লিখেছেন, “মাহবুবুল আলম চাষীকে আমি সর্বাংশে না হলেও অনেকখানি পছন্দ করতাম। তাঁর চরিত্রের প্রশংসা করার মত অনেক গুণ ছিল। তিনি জীবনে আমার অনেক উপকার করেছেন। তাঁর ঋণ আমার পক্ষে কোনদিন শোধ করা সম্ভব হবে না। এ পর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে যেসব কথা বলেছি সব সত্য বলেছি। একটি কথাও বানিয়ে বলিনি। এই বিষয়টা নিয়ে আমি দীর্ঘদিন চিন্তা করেছি। শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে আমি সুখে ছিলাম না। বর্তমানেও আমি আওয়ামী লীগ সমর্থক নই। তবু শেখ হত্যার ব্যাপারটি আমার জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভবিষ্যতের গবেষকদের কাছে আমার দেয়া তথ্যসমূহ বিশেষ কাজে আসবে মনে করে এ রচনাটি লিখলাম।"

মাহবুবুল আলম চাষী ডানপন্থী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাকে মোশতাকের ‘prodigy’ হিসাবে ধরা হত। এক বছর ধরে করা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৫০ এর দশকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের দূতাবাসে চাকুরি করতেন। ষাটের দশকে শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকুরি ছেড়ে ‘চাষী’ নাম যুক্ত করে পাকিস্তানের ‘সবুজ বিপ্লবে’ যুক্ত হন। ১৯৭১ কোলকাতায় যুক্তরাষ্ট্র ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে যে আটবার মোশতাকের সাথে দেখা করেন, সেখানে সেই ত্রিরত্ন উপস্থিত ছিলেন (মোশতাক-চাষী-ঠাকুর)। পঁচাত্তরের জুন-জুলাইয়ে তিনি একাধিকবার কুমিল্লায় বসে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে মিটিং করেছেন (ঠাকুর-মোশতাক-সেনা সেখানে ছিল)। এমনকি হত্যার পরিকল্পনার অংশহিসাবে সামরিক বাহিনীর সাথে গোপনে দেখাও করেছিলেন। (৫)

১১

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর সাথে সাথেই বুদ্ধিবৃত্তিক মহলের স্বাধীনতাবিরোধী প্রচার এবং প্রপাগাণ্ডা শুরু হয়। পথচলার শুরুতেই লেখক, বুদ্ধিজীবি এবং প্রাক্তন মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদ (ডেইলি স্টারের বর্তমান সম্পাদকের পিতা) আমাদের জানান, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় আসলে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবেরই ফসল। অথচ, এই দুয়ের মূল স্পিরিট বিপরীতধর্মী। (৬)

সাংবাদিক আবেদ খান আমাদের জানাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৭টি দৈনিক ও প্রায় ৬০টি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ হতো। কয়েকটি পত্রিকা সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হলেও সেগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা। (৭)

তিনি জানাচ্ছেন, “অন্যান্য দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার অধিকাংশেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুবিরোধী প্রচারণা চালানো। সংবাদের নামে তারা এমন সব গল্প লিখত, যেগুলোকে কোনো বিচারেই সংবাদ বলা যায় না। সেগুলো ছিল সরকারবিরোধী বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনি। আর এ কাজে তখন সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল জাসদের মুখপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’, মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’, অলি আহাদের ‘ইত্তেহাদ’ এবং ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর ‘দেশবাংলা’।" [এনায়েতুল্লাহ্‌ খানের সাপ্তাহিক হলিডেও এই দলের অন্তর্ভুক্ত।)

“বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু বিরোধী রাষ্ট্রসমূহ এ ধরনের পত্রিকা পরিচালনায় বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা বঙ্গবন্ধু হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের অন্যতম তাহের উদ্দিন ঠাকুর তখন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী। ফলে তাহের উদ্দিন ঠাকুর তাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ওইসব পত্রপত্রিকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, উল্টো নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে।"

আবেদ খান সেই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদের উদাহরণ দেন, “প্রয়াত ফণীভূষণ মজুমদার তখন বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী। সে সময় কয়েকটি পত্রিকায় বেশ ফলাও করে একটি সংবাদ প্রকাশিত হলো। তাতে বলা হলো, খাদ্যবোঝাই কয়েকটি বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশে আসছিল, খাদ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সেগুলো পথ পরিবর্তন করে ভারতের বন্দরে গিয়ে উঠেছে। অথচ বাস্তব সত্য এই যে, এ ধরনের কোনো ঘটনাই তখন ঘটেনি। তবে খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক, তাই পাকিস্তানপন্থীরা ওই ‘বানোয়াট গল্প’কেই সত্য বলে গ্রহণ করে এ‌বং গোয়েবলসীয় কায়দায় সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়।"

১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয় ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি। এই চুক্তির ভাষ্য না জেনেই ১৯৭২ সালের শেষদিকে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার লে. কর্ণেল জিয়াউদ্দিন সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় ‘হিডেন প্রাইজ’ শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লিখেন। আমরা শুধু একটুকু জানি, জিয়াউদ্দিনকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু মূল ঘটনা হল জিয়াউদ্দিন এই প্রবন্ধ লিখেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তাঁর ব্রিগেডে প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং প্রায় বিদ্রোহের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পরে তাঁর কাছে সহকর্মীরা জানতে চাইলে তিনি বলেন জেনারেল ওসমানী তাকে এই চুক্তির ব্যাপারে বলেছেন। (৮)

স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে গৌরবোজ্জ্বল ভুমিকা সত্ত্বেও মাওলানা ভাসানীর স্বাধীনতাপরবর্তী কার্যক্রম প্রশ্নবোধক। ১৯৭২ তিনি মুসলিম বাংলা ধারণা নিয়ে এলেন, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। তাঁর মুসলিম বাংলা ধারণা স্বাধীনতাবিরোধীরা স্বাগত জানায়। ভূট্টো, আরব এবং লিবিয়াপন্থীরাও লুফে নেয়। তাঁর ‘হক কথা’ প্রাথমিক ভাবে স্বাধীনতাপরবর্তী শাসন আমলের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরলেও প্রপাগাণ্ডা ছড়াতে শুরু করে। (৬)

হক কথার একটি সংখ্যা ‘কে এই সি আর দত্ত?’ নামে একটা লেখায় মেজর জেনারেল সিআর দত্ত বীর উত্তমকে ভারতীয় এজেন্ট হিসাবে ইঙ্গিত করা হয়।

১২

ফিরে আসি লিবিয়ায় আশ্রয় নেয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ব্যাপারে। লিবিয়ায় আশ্রিত সেনাবাহিনীর খুনি দলের ১২ জনকে দূতাবাসে চাকুরি দেয়া হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ৮ জুন। যেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে বিভিন্ন পদে তারা চাকুরি পান সেগুলি হল - চীন, আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, ইরান, কুয়েত, আবুধাবি, মিসর, কানাডা এবং সেনেগাল ।

তবে ১২ জন সেনা কর্মকর্তা চাকরিতে যোগ দিলেও ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রধান দুই হোতা কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ও চাকরি গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। তারা লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদ্দাফির সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে ইসলামি বিপ্লব করে এসেছেন’ এই কথা বলে ফারুক-রশিদ গাদ্দাফির কাছের লোক হয়ে উঠেছিলেন। ব্যাপারটা হয়ত এত সরল নয়।

ফারুক-রশিদ এবং অন্যান্য খুনিদের সাথে এম জি তোয়াবের যোগাযোগ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। পঁচাত্তরের শেষদিকে অথবা পরের বছরের শুরুর দিনে তোয়াব ‘পারিবারিক কাজের’ ছুতায় জার্মানি গিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারির ৪ তারিখ ত্রিপোলি (লিবিয়া) থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রবার্ট চার্লির একটা তারবার্তা (1976TRIPOL00003_b) ব্যাপারটা জানা যায়।

সেই তারবার্তায় দেখা যায়, জানুয়ারির ২ তারিখে বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, তার ভগ্নীপতি জমির মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ‘জরুরী আলোচনার’ জন্য বাসায় আসতে আমন্ত্রণ করেন। রাষ্ট্রদূত সেখানে নিয়ে তোয়াবের দেখা পান। তোয়াব জানান তিনি ঢাকা থেকে জার্মানি হয়ে আগের দিন ‘গোপনে’ ত্রিপোলি এসেছেন। তোয়াব প্রথমে বলেন তিনি পুরানো বন্ধু জমিরের সাথে দেখা করতে এবং ‘Boys’ (অর্থাৎ নির্বাসিত খুনি মেজরদের)-এর অবস্থা জানতে এখানে এসেছেন।

তোয়াব এই বৈঠকের গোপনীয়তার ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন। তিনি নিশ্চিত করেন এই ব্যাপারটা শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট, সামরিক এবং নৌ-বাহিনীর প্রধানই জানেন।

তোয়াব নিশ্চিত করেন যে তিনি জার্মানিতে কয়েকদিন থাকবেন, এর পরে দূতাবাসের কর্মকর্তা জমির জানে কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করা যাবে। তিনি এই ব্যাপারটাকে এগিয়ে নিতে যে কোনো সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের পরিকল্পনার কথা নিশ্চিত করেন।

রবার্ট চার্লি অবশ্য ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিংবা ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে এ আলোচনা না করে লিবিয়াতে তার সাথে গোপন আলোচনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। তোয়াব জানান, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে আলোচনা করলে ‘রুশ-ভারতের’ কাছে খবর চলে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। এদিকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও বিশ্বাসভাজন নয়।

রবার্ট চার্লি অবশ্য তারবার্তায় তার সমাপনী বক্তব্যে কূটনীতিকসুলভ একটা ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ মন্তব্য করেন। তিনি লিখেন, “ত্রিপোলি এমন একটা জায়গা, যেখানে কেউ শুধুমাত্র বাংলাদেশি কিংবা মার্কিন লোকজনের সাথেই না - পাকিস্তান, এবং সর্বোপরি লিবিয়ার লোকজনের সাথেও আলোচনা করতে পারে।" এই ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ মন্তব্য থেকে ধারণা করা যায় তোয়াব পাকিস্তানি এবং লিবিয়ানদের সাথেও কোনো ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন।

অবশ্য এর পরপরই, এপ্রিলের শেষের দিকে (ছিয়াত্তর) তোয়াব তার পদ থেকে ইস্তেফা দিয়ে জার্মানি প্রত্যাবর্তন করেন।

কর্নেল হামিদের বইতে (এবং অন্যান্য বইতেও) জানা যায় ১৯৭৬ এর মার্চে প্রথমে কর্নেল রশিদ, এবং পরে ফারুক এসে ঢাকায় উপস্থিত হয়। ফারুক ঢাকায় আসলে সাভারে অবস্থিত ফার্স্ট ক্যাভালরির (পূর্বতন ফারুকের অধীনস্থ বেঙ্গল ল্যান্সারের একাংশ) সৈন্যরা তাকে বরণ করে। (পূর্বতন বেঙ্গল ল্যান্সারের আরেক অংশকে ১৪টি ট্যাংক সহ বগুড়া পাঠানো হয়)। পরে ফারুককে বগুড়ায় পাঠানো হয়।

তবে কূটনৈতিক বিভিন্ন তারবার্তায় দেখা যায় রশিদ, ফারুক এবং ডালিম তিনজনই ছিয়াত্তরের প্রথমার্ধে ঢাকা এসেছিল।

তিনজনকেই অবশ্য সে বছরের প্রথমার্ধেই দেশ ছাড়তে হয়। কর্নেল রশিদ এবং মেজর ডালিম প্রথমে দেশ ছাড়েন। রশিদ ব্যাংকক হয়ে লিবিয়ায় চলে যান। ডালিম যান যুক্তরাজ্যে।

আরেক কুশীলব হেনরি কিসিঞ্জারের তারবার্তায় রশিদের বরাতে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। রশিদ যখন দেশ ছাড়েন তখনও তিনি তোয়াবের ইস্তফা দেবার খবর জানতেন না। তবে রশিদ যুক্তরাষ্ট্রকে বলেন এই খবরে তিনি মোটেও আশ্চর্য হননি।

কিসিঞ্জারের তারবার্তায় আরও জানা যায়, রশিদ বাংলাদেশে ১০ দিন অবস্থানকালে জিয়া-তোয়াব-এম, এইচ খান সহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাদের সাথে দেখা করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাসিত খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা।

কিসিঞ্জারের বার্তায় জিয়া-তোয়াবের দ্বন্দ্বের মূল কারণও বুঝা যায়। তোয়াবের দর্শন ছিল সরাসরি – বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা, অন্যান্য ইসলামিক দেশগুলির সাথে যুক্ত হওয়া, এবং সরাসরি ভারত-বিদ্বেষী দর্শন গ্রহন করা। জিয়া এর সরাসরি সমর্থক ছিলেন না। তাছাড়া তোয়াব খুনি মেজরদের সরাসরি সাপোর্ট করছিলেন, জিয়া তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার সমস্যাটা বুঝতে পারছিলেন। রশিদের বক্তব্যে জানা যায়, জিয়া যে ‘থিম’ নিয়ে ৭ নভেম্বরে ক্ষমতায় এসেছিলেন (ভারত-বিদ্বেষ), তা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছেন। রশিদ-জিয়ার সাক্ষাতে জিয়া এমনও বলেছিলেন, "বাংলাদেশ সবসময় ভারত-বিদ্বেষী হয়ে টিকে থাকতে পারবে না।"

এটাও পরিষ্কার, খুনিদের সহায়তায় জিয়া ক্ষমতায় এলেও অন্তিমে ফারুক-রশিদ জিয়াকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবেই ধরে নেয় (খুনিদের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিলেও)। একই ভাবে জাসদও জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারটা ১৯৭৬এই বুঝতে পারে।

মজার ব্যাপার হল, জিয়ার আমলে খুনিরা বার বার দেশে ফিরে নানারকম অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছে। যদিও জিয়া সামরিক বাহিনীতে তার বিরুদ্ধমতকে কঠোরভাবে দমন করেছিলেন, খুনিদের ব্যাপারে শক্ত কোনো ব্যবস্থা নেননি। শুধুমাত্র শেষবারের অভ্যুত্থানের চেষ্টায় তাদের বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করেছিলেন।

কিন্তু পরবর্তীতে এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সরকার নতুন উদ্যমে এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে তাদের পুনর্বাসিত করেন।

(চলবে)

(১) Syed Serajul Islam, “The State in Bangladesh under Zia (1975-81)”, Asian Survey Vol. 24, No. 5 May, 1984

(২) Marcus Franda, “Ziaur Rahman and Bangladeshi Nationalism”, Economic and Political Weekly Vol. 16, No. 10/12, Annual Number Mar 1981

(৩) Ziauddin Chowdhury, “Assassination of Ziaur Rahman and Aftermath”

(৪) আহমদ ছফা, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ

(৫) Lawrence Lifschultz and Kai Bird, Bangladesh, Anatomy of a coup, Economic and Political Weekly, Vol. 14, No. 49 (Dec. 8, 1979)

(৬) Syed Badrul Ahsan, BDNews 24 23rd Aug 2016

(৭) আবেদ খান, ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (১৫), দৈনিক জাগরণ।

(৮) মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য।


মন্তব্য

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

পড়লাম । সিরিজ চলুক ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

তারেক অণু এর ছবি

মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু ভূমিকাটাও বিস্তারিত জানতে আগ্রহী, আশা করি আপনার লেখায় পাবো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।