১৩
ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪। পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ওআইসির (OIC) দ্বিতীয় সম্মেলন। অনুষ্ঠানে আগত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তুন আবদুল রাজাকের সাথে স্বাগতিক দেশ, অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর একান্তে বৈঠকের আয়োজন করা হল। সময়মত আবদুল রাজাক বৈঠকের নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হলেও জুলফিকার আলী ভুট্টোর দেখা নেই। পাগল-প্রায় প্রটোকল অফিসাররা ভুট্টোর অবস্থান নিশ্চিত করতে পারল না। অনেক চেষ্টা করেও ভুট্টোকে পাওয়া না গেলে আবদুল রাজাক ক্ষুব্ধ হন, এমনকি দেশে ফিরে যাবেন এমন কথাও বলেন।
প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছ থেকে এ ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয় প্রটোকল অফিসাররা হয়ত প্রত্যাশা করেন নাই। পরবর্তীতে ভুট্টোর সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার ইমতিয়াজ সাফাই দেন, ‘ভুট্টো গাদ্দাফির সাথে বাংলাদেশকে কিভাবে পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করা যায় সেই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন’। নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক, এবং এর সিম্বলিক অন্য অর্থও করা যায়।
শেখ মুজিবকে ওআইসি সম্মেলনে আমন্ত্রণের ঘোর বিরোধী ছিলেন ভুট্টো। পরে কুয়েত, মিশর, আলজেরিয়া, সিরিয়া, ইরাক এবং কথিত সৌদি আরবের বাদশাহের চাপে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য হোন। কুয়েতের তখনকার ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী শেখ সাবাহের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসেন শেখ মুজিবকে ওআইসিতে আমন্ত্রণ জানাতে। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতির ব্যাপারটাও নিশ্চিত করেন সেই প্রতিনিধি দল। তারপরই বঙ্গবন্ধু ১০-সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন।
এদিকে গাদ্দাফি সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের আজীবন আশ্রয় দিয়েছেন, খুনিদের বিচার হওয়ার পর তাদের প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। প্রোটকল ভেঙ্গে এই দুই কুশীলবের গোপন আলোচনা কৌতূহলোদ্দীপক তো বটেই।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বাংলাদেশ গোলান হাইটসে অবস্থিত সিরিয়ান সেনাবাহিনীর সদস্যদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক দল (মেডিক্যাল কোরের সদস্য) পাঠিয়েছিল এবং মিশরের সেনানীর জন্য পাঠিয়েছিল চা-পাতা। এই সফল ডিপ্লোমেসিতে পাকিস্তানের প্রোপাগাণ্ডার বিপরীতে শেখ মুজিবের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড হয়েছিলেন আরব নেতারা।
আবার একই সময়ে পাকিস্তানের সাথে, আরও বিশেষ করে বললে, ভুট্টোর সাথে গাদ্দাফির প্রণয়লীলা একেবারে তুঙ্গে। সেই বছরই পাকিস্তানের আইকনিক লাহোর ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে গাদ্দাফি স্টেডিয়াম নাম দেয়া হয়। পাঠকদের জন্য আরেকটা তথ্য দিয়ে রাখি, ভুট্টো ফাঁসির পর গাদ্দাফিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৮১ সালের মার্চে ‘আল-জুলফিকার’ (পিপিপি-সাপোর্টার সন্ত্রাসী গ্রুপ) পিআইএর যে বিমান ছিনতাই করে তাতে সরাসরি মদদের অভিযোগ তোলা হয় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে। (১৩ দিনের জিম্মি নাটকের পর ৫৫ জন পিপিপি রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় জিয়াউল হক সরকার। মুক্তিপ্রাপ্ত নেতাদের আফগানিস্তান হয়ে ত্রিপোলিতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মাঝপথে পথ পরিবর্তন করে দামাস্কাসে নিয়ে যাওয়া হয়)।
১৪
উপরের ঘটনাগুলির প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে কিছুটা পিছনে ফিরে যেতে হয়। গত শতকের মাঝামাঝি সময় এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকায় যে ইসলামিক সমাজতন্ত্র ধারনা ছড়িয়ে পরেছিল, সেই সময়টাই ছিল সেই মতবাদের স্বর্ণযুগ। সেই অতিমাত্রায় বিস্তৃতি এবং কৌতূহলোদ্দীপক প্রেক্ষাপটের কয়েকটা ঘটনা সংক্ষেপে এবং সরলভাবে আলোচনা করা যাক। আমি নিজে অবশ্য নির্মোহ থাকতে পারিনা, সেই স্বর্ণযুগের ইসলামিক সমাজতন্ত্রের প্রতি তুলনামূলক পক্ষপাতিত্ব সবসময়ই দেখাই। পাঠককে ষাটের দশকের শেষদিকের কিংবা সত্তরের শুরুরদিকে ইসলামিক সমাজতন্ত্রের সাথে সেই স্বর্ণযুগের ধারণার আকাশপাতাল ব্যবধানের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই।
শুরু করি পাকিস্তান দিয়েই। ওবায়দুল্লাহ সিন্ধ কিংবা হাফিজুর রহমানের পর চল্লিশের দশকে যে দুজন ইসলামিক সমাজতন্ত্রের প্রস্তাবক এবং পণ্ডিতের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, তাঁরা হলেন গোলাম আহমেদ পারভেজ এবং খলিফা আবদুল হাকিম (১)। তখনকার ইসলামি সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা আর বিশ্লেষণে গেলাম না। তবে এর মূল কথা ছিল রাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলাম এবং সমাজতন্ত্রের কিছু মিশ্রণ, ইসলামের সাম্যবাদের যে ধারণা (egalitarianism) তা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করার নিশ্চয়তাও ছিল। ইসলামের অনেক ইন্টারপ্রিটেশনও ছিল ভিন্ন। একধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্নিহিত ছিল সেই মতবাদের মধ্যে। (অনেকের কাছে বিরোধালঙ্কারযুক্ত বাক্য বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আসলেই ছিল।)
গোলাম পারভেজের চিন্তাভাবনার উদাহরণ দেয়া যাক। তাঁর মতে পবিত্র কোরানের মতে মুসলিমদের তিনটি মূল দায়িত্ব – দেখা, শোনা এবং উপলব্ধি করা, এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া। সুতরাং জ্ঞানার্জন আসলে গবেষণামূলক এবং যাচাইযোগ্য পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে হওয়া প্রয়োজন। তার মানে হল সেগুলি বৈজ্ঞানিক অনুসিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত।
তার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা অবশ্য বর্তমান দুনিয়ায় অস্বাভাবিক ঠেকবে। পবিত্র কোরান, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কোরানিক টেক্সট এবং সুফি বিষয়ে তাঁর ব্যাপক জ্ঞান এবং পড়াশোনার ভিত্তিতে তিনি এই অনুসিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, বেশিরভাগ হাদীসই আসলে প্রাচীন স্বেচ্ছাচারী শাসকদের ঐশ্বরিক বৈধতা দিতেই তৈরি করা হয়েছে। এবং শরিয়ার মধ্যমে ইসলামের যে বিচ্যুতি ঘটনো হয়েছিল তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার এক ধরনের উপায় হল এই ইসলামিক সমাজতন্ত্র। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা খলিফা আবদুল হাকিমও পরবর্তীতে পারভেজের পথেই হেঁটেছিলেন।
এমন চিন্তাভাবনা যে তোপের মুখে পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে মজার কথা হল, দার্শনিক এবং কবি মোহাম্মদ ইকবালের মাধ্যমে গোলাম পারভেজের পরিচয় হয় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে। জিন্নাহ তাঁকে ‘তালু-ই-ইসলাম’ নামের ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসাবে নিয়োগ দেন। সেই প্রভাবশালী পত্রিকা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ইসলামিস্টদের অপপ্রচারের জবাব দিতে ব্যবহৃত হত।
জিন্নার বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে একটা ছিল, ‘তাঁর হাব-ভাবে ইসলামের কোন চিহ্নই নেই’। ১৯৪৭ দেশ বিভাগের পর পারভেজ জিন্নার সরকারে যোগ দেন। ১৯৪৮ এর সেপ্টেম্বরে জিন্নার মৃত্যুর পর তাঁকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, করাচিতে পাকিস্তানের আইন পরিষদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে (সম্ভবত ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্টে) জিন্নাহর পাকিস্তানকে সব ধর্মের মানুষের দেশ হিসেবে পরিচয় করিয়ে হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টানকে যে যার ধর্ম পালনে স্বাধীন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা কখনই শরিয়া আইনের ভিত্তিতে হবে না। তবে এ কথাও অস্বীকার করা যাবেনা, জিন্নাহ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু সহকর্মী ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন হলেও ৪৭-পূর্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক আন্দোলনে ইসলামিক বাগ্মিতার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। একথাও বলা প্রয়োজন, পাকিস্তানের ‘স্বপ্নদ্রষ্টার’ ‘আদিপাপের’ ভাষণের কপি পরবর্তীতে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
জিন্নার মৃত্যুর পর পাকিস্তানে কট্টর ইসলামপন্থিদের আর সামরিক বাহিনীর মেলবন্ধনে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে, সেটা এই লেখার জন্য অপ্রাসঙ্গিক। ভুট্টোর ইসলামিক সমাজতন্ত্রে যাওয়ার আগে ৪০/৫০ দশকের মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকানো যাক।
১৫
মধ্যপ্রাচ্যে একই সময়ে তাঁদের নিজেদের ভার্সনের ইসলামিক সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ছিল। আরব জাতীয়তাবাদী এবং সিরিয়ান দার্শনিক মিশেল আফলাক এই ধারণার অন্যতম প্রবক্তা। ইসলামিক সমাজতন্ত্রের এই ধারাই বিখ্যাত বা’থ সোশ্যালিজম (Ba’ath Socialism) নামে পরিচিতি পায়।
বা’থ সোশ্যালিজমের সাথে এই উপমহাদেশের ইসলামি সমাজতন্ত্রের কিছুটা পার্থক্য ছিল। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি সমাজতন্ত্রে আরব জাতীয়তাবাদের প্রাবল্য ছিল। প্রবক্তারা মনে করতেন পাঁচটা বিষয় আরব জাতির ক্রমশ অধঃপতনের জন্য দায়ী – পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, আরব রাজতন্ত্র, ইসলামিক কট্টরপন্থা এবং ইসলামিক কট্টরপন্থীরা যারা আরব সমাজকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বা'থ সোশ্যালিজমের মূল মন্ত্র ছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা; আধুনিক শিক্ষা; বিজ্ঞান এবং সংষ্কৃতির মাধ্যমে প্রগতিশীল এবং আধুনিক সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ধর্মের সাথে রাষ্ট্রকে না মেশানো, এবং সর্বোপরি ইসলামের অনুপ্রেরণায় সমাজে সাম্যবাদ (egalitarianism) নিশ্চিত করা।
চল্লিশের দশকে ইরাক, মিশর, ইয়েমেন, আলজেরিয়া, সিরিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকার কিছু দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে আরব/বা’থ সোশ্যালিজম।
আমি শুধু প্রাসঙ্গিক কয়েকটা ঘটনার উল্লেখ করব। বা’থ সোশ্যালিজমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৪৮ সালে মিশরে কর্নেল গামাল আবদেল নাসের সামরিক বাহিনীর ভিতর ‘ফ্রি অফিসার মুভমেন্ট’ নামে এক গোপন সংগঠনের পত্তন করেন এবং ১৯৫২ সালে যুক্তরাজ্য-সমর্থিত মিশরীয় রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করেন। মজার ব্যাপার, ডানপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড নাসেরের এই অভ্যুত্থানে সহায়তা করে। ক্ষমতায় গিয়ে নাসের দ্রুতই অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন শুরু করেন। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার প্রক্রিয়াও শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিক ব্রাদারহুড নাসেরের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে, এমনকি ১৯৫৪ সালে তাঁকে হত্যারও চেষ্টা করা হয়। নাসের শক্ত হাতে ব্রাদারহুড এবং কট্টরপন্থাকে দমন করেন।
নাসেরের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইরাকি রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হয় ১৯৫৮তে। চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ইরাকে বা’থ পার্টি স্থায়ী হয় ১৯৬৮তে। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতন পর্যন্ত চলে বা'থ পার্টির নিরবচ্ছিন্ন শাসন।
ইরানও পঞ্চাশের দশকেই আরব সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মোহাম্মদ মোসাদ্দেক যে গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ন্যাশানাল ফ্রন্ট গড়ে তুলেন, সেখানে ইসলামিক সমাজতান্ত্রিকেরা ছিলেন। অনেক কিছুর সাথে তিনি অ্যাংলো-ইরানিয়ান ওয়েল কোম্পানিকেও জাতীয়করণ করেন। ১৯৫৩ তে সিআইএ, যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এসআইএস এবং কিছু ইসলামিক কট্টরপন্থীর সহায়তায় সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করে। শাহ আসেন ক্ষমতায়। অবশ্য অভ্যুত্থানের পর কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। শাহ কিছু সময়ের জন্য ইরাক হয়ে ইতালি চলে গিয়েছিলেন এবং কথিত আছে, বেশিরভাগ সময়ই নাকি কুইন সুরাইয়ার সাথে নাইট-ক্লাবে কাটাতেন, যদিও এ দূই ব্যাপার মিউচুয়্যালি এক্সক্লুসিভ হওয়াই উচিত।
ইরানের বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিকেরা ১৯৬৫ সালের দিকে এম-কে পার্টি গঠন করে। বাম-পন্থীদের গুরু হয়ে ওঠেন আলি শরিয়তি। শাহের সরকার আলি শরিয়তি এবং এম-কের বিরুদ্ধে ‘সোভিয়েত এজেন্টের’ অভিযোগ আনেন। ১৯৭৯ সালে যে ইরানিয়ান বিপ্লবের মাধ্যমে শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে আয়াতোল্লা খোমিনি ক্ষমতায় আসেন, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বাম দল এম-কে। পরে খোমিনি কঠিন ‘ইসলামিক শাসন’ চালু করলে এম-কে তার বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে। খোমিনি নির্দয়ভাবে তাদের ‘কতল’ করেন।
এবার ফিরে আসি আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের কুশীলবের কাছে। গামাল আবদেল নাসের তখন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন আরব বিশ্বে। লিবিয়াতে নাসেরের সেই ‘ফ্রি-অফিসার্স মুভমেন্টের’ অনুকরণে কর্নেল গাদ্দাফি অভ্যুত্থান করেন ১৯৬৯তে। গাদ্দাফি নাসেরের অনুকরণে আরব সোশ্যালিজম গড়ে তোলেন, ১৯৭১ গঠন করেন আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন।
কিন্তু তিনি দ্রুতই তার নিজস্ব ভার্শনের আরব সোশ্যালিজমের প্রচার শুরু করেন। তার সোশ্যাল-রিফর্মের ভিত্তি হয়ে উঠে শরিয়া। শুরু হয়ে মোরাল পুলিশিং - বন্ধ করে দেয়া হয় মদ-বিক্রি, মদ্যপান, পানশালা, নাইট-ক্লাব (এবং কথিতমতে চার্চ)। আরও কিছু রিফোর্মের সূচনা করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে তার বিখ্যাত ‘থার্ড ইন্টারনেশন্যাল থিওরী’ প্রচার শুরু করেন (পরে সেই বিখ্যাত ‘গ্রীন-বুকে’ যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়)। বিশ্লেষকরা চেয়ারম্যান মাওয়ের থ্রি-ওয়ার্ড থিওরীর সাথে গাদ্দাফির থার্ড ইন্টারনেশন্যাল থিওরীর মিল পান। গাদ্দাফি কোনভাবেই লিবারেল এবং ধর্মনিরপেক্ষ বা’থ সোশ্যালিজমের ধারক কিংবা বাহক নন।
১৯৭৩ এর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ পুরো মুসলিক বিশ্বে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মিশরে নাসের জনপ্রিয় থাকা অবস্থায় ১৯৭০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অবর্তমানে তাঁরই প্রাক্তন কমরেড আনোয়ার সাদাত মিশরের আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়নের প্রধানের দায়িত্ব নেন এবং নাসেরের এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে থাকেন।
১৯৭৩ যুদ্ধের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে মিশরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় সৌদি আরব, বড় অংকের আর্থিক এবং জ্বালানির সাহায্যের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। সাথে আসে শর্তের বেড়াজাল। নাসেরের সময়ে কারাগারে কিংবা নির্বাসনে পাঠানো হাজার-হাজার মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন সাদাত। ১৯৭৪ সাদাত সোভিয়েট ক্যাম্প থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। ১৯৭৭ এ আরব সোশ্যালিজম থেকে পুরোপুরি বের করে আনেন মিশরকে – শুরু হয়ে বামপন্থী ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের উপর অত্যাচার। মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থন পান। তারপরও শেষরক্ষা হয় না, মুসলিম ব্রাদারহুডের মিলিট্যান্টদের হাতেই ১৯৮১ নিহত হন তিনি। মঞ্চে আসেন হোসনি মোবারক।
১৬
ভুট্টো, তাঁর গুরু বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী জালালুদ্দিন আবদুর রহিমকে নিয়ে গঠন করেন পিপিপি। জনাব রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার সময় ‘নিৎসের দর্শন’ নিয়ে থিসিস লেখেন। এদিকে ভুট্টোর পিপিপিও ইসলামিক সমাজতন্ত্র মূলমন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করে। তবে এখানে ত্রিশ/চল্লিশের দশকের ইসলামিক সমাজতন্ত্র থেকে একটা বড় পার্থক্য ছিল। প্রথম জেনারেশনের প্রবক্তা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধের সরাসরি রাশিয়াতে অবস্থান করে কমিউনিজম দেখার সুযোগ হয়েছে, সুতরাং রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের প্রভাব ছিল ২০/৩০ দশকের ইসলামিক সমাজতন্ত্রে। ভুট্টো ছিল পুরোপুরি চিনের চিন্তাভাবনার ধারক বাহক (তাঁর চিন প্রীতিতে এমনকি ধর্মপিতা যুক্তরাষ্ট্রও বিরক্ত হয়েছিল)।
ইসলামি কট্টর-পন্থী, জামায়াতে ইসলামির বিরুদ্ধাচরণ সত্ত্বেও ১৯৭০ নির্বাচনে ভুট্টোর পিপিপি বিশাল ব্যবধানে জয় পান। কিন্তু ১৯৭৩ এর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পট পরিবর্তন হয়। অর্থনৈতিক চাপ মোকাবেলা করতে সমাজতান্ত্রিক বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী রাজতন্ত্রগুলির সাথে বিভিন্ন চুক্তি করেন। এবং অবশ্যম্ভাবীভাবেই সাথে আসে শর্তের বেড়াজাল। সৌদিঘেঁষা চরম ডানপন্থীদের বিভিন্ন সুবিধা দিতে শুরু করেন ভুট্টো, সেই সাথে শুরু হয়ে সমাজতন্ত্রীদের দমন।
১৯৭৭ এর নির্বাচনে ইসলামিক সমাজতন্ত্র পেছনে চলে যায়। এত কিছু করেও চরম-ডানপন্থীদের মত জয় করতে পারেননি ভুট্টো। জিয়াউল হকের কাছে তাঁর পতন হয় এবং শেষমেশ ফাঁসির দড়ি।
সুতরাং, ইসলামিক সমাজতন্ত্রের স্বর্ণযুগের ধারণার সাথে ১৯৭৩ পরবর্তী ভুট্টো-গাদ্দাফির তথাকথিত ইসলামিক সমাজতন্ত্রের মিল তো ছিলই না, বরং উল্টো ধারাটাকে তারা লালন পালন করতেন।
১৭
সংক্ষেপে এবং কিছুটা সরলীকৃতভাবে এত বিস্তারিত প্রেক্ষাপট লেখার কারণ হল, ইসলামিক সমাজতন্ত্রীদের স্বর্ণযুগ থেকে পতনের একটা স্নাপশট দেয়া। আমাদের দেশও বামেরা অন্দোলনে ডানের সাথে মিশে যায়, ইতিহাসে তাদের পরিণতি পরিষ্কারভাবে লেখা আছে।
বা’থ সোশ্যালিজমের শক্তি এবং দুর্বলতার দিকগুলি নিয়ে আলোচনার এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে স্বীকার করতে হয়, সময় এবং স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বা’থ সোশ্যালিজমের ধারা যতই প্রগতিশীল হোক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের বা’থ আন্দোলনের পেছনে সেনাবাহিনীর বড় ভূমিকা ছিলে এবং গণতন্ত্রের দিকটা অনেকটাই উপেক্ষিত হয়েছিল।
১৮
ফিরে আসি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হলেও সামরিক বাহিনীর অনেক কার্যকলাপ গোপনই রয়ে যায়। সামরিক বাহিনীর লোকজনের কার্যকলাপকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায় – পঁচাত্তরের আগস্ট পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী।
আমরা এখন জানি বঙ্গবন্ধুর সরাসরি খুনি দলের অন্তত দুজন, মেজর ডালিম এবং নূর চৌধুরী বাম রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিল। শুধু বাম রাজনীতি নয়, সরাসরি সর্বহারা পার্টির মত ধ্বংসাত্মক একটা দলের সাথে জড়িত ছিল। প্রকাশ্যে সর্বহারা পার্টিতে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সেনাকর্তা জড়িত ছিল – লেঃ কঃ জিয়াউদ্দিন, কর্নেল আবু তাহের (এবং অতি অবশ্যই জাসদের সাথে), ফ্লাইট লেফটেনেন্ট সালাহউদ্দিন, মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর ডালিম এবং মেজর নূর চৌধুরী (ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত ছিল)।
মোটামোটি যে দুটি সামরিক বাহিনীর গোপন দলের কথা শোনা যায় তাদের একটা হল তাহেরের গণবাহিনী আরেকটা আরেকট হল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা (করপোরাল আলতাফ হোসেন)। বিল্পবী সংস্থার সাথে জাসদের যোগাযোগ ছিল মেজর জলিলের মাধ্যমে। তবে অতি শ্রেণিসচেতন সেনাকর্তারা যে ওপরে-বলা দুটি ‘নন-কমিশনড’ সৈনিকদের দলে মিশবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামরিক বাহিনীর কোন গোপন সংগঠনের কথা সরাসরি জানা যায় না।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও সামরিক বাহিনীর শ্রেণিসচেতনতা এবং সাম্যবাদ (egalitarianism) ধারণার একটা উদাহরণ দেয়া যাক। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর অভিযুক্ত ওসি প্রদীপের একটা টেলিফোন কথোপকথন অন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিংবা আইনজীবীর সাথে পরামর্শের জন্য কথা বলছিলেন। সেখানে শোনা যায়, অপরপক্ষের আলাপকারী যখন জানতে পারেন সিনহা একজন ‘অবসরপ্রাপ্ত’ তখন তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হন। তখনকার এক টক-শোতে, বর্তমানের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এবং অধুনা বদলে যাওয়া তালেবানের বড় সমর্থক ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে কথা বলেন। তাঁর সব রাগ গিয়ে পড়ে টেলিফোনের অপরপ্রান্তের সেই ব্যাক্তির প্রতি। তিনি টেলিভিশনে উত্তেজিত হয়ে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত হলেই কি সিনহা একজন ‘সাধারণ মানুষ’ (পাঠক সেই পুরনো টার্মেও পড়তে পারেন ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’) হয়ে গেল? কী আস্পর্ধা টেলিফোনের সেই অপরপ্রান্তের লোকের, চিন্তা করে দেখুন? মজার ব্যাপার হল টক-শোর উপস্থাপকও এ ব্যাপারে সায় দেয় (কে ছিল, মনে নাই)।
১৯
স্বাধীনতার পর কুমিল্লা ধারণা করি একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হয়ে উঠেছিল ষড়যন্ত্রীদের জন্য। আবু তাহেরের প্রথম পোস্টিং ছিল ৪৪ ব্যাটালিয়ানের কমান্ডার এবং কুমিল্লার জিওসি হিসাবে। সেখানেই তাঁর সাথে সিরাজ শিকদার দেখা করত। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনি সুলতান শাহারিয়ার রশিদ খান যখন কুমিল্লা সেনানিবাসের ট্রেনিং স্কুলের চিফ ইনস্পেক্টর, তখন কুমিল্লার প্রথম বেঙ্গলে যোগ দেন ডালিম, বজলুল হুদা, এবং আজিজ পাশা। ১৯৭৪ সালে ডালিম লন্ডন যান, এসে আবার যোগ দেন কুমিল্লায়। মাহবুবুল আলম চাষী তখন কুমিল্লা বার্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট। লরেন্স লিফশুলৎস আমাদের জানিয়েছেন, চাষী এবং ঠাকুর অন্তত এক বছর আগে থেকেই এই পরিকল্পনা নিয়ে অংশীজনের সাথে মিটিং করে আসছিলেন। ১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্ট মেজর জেনারেল আমজাদ খানের নেতৃত্বে কুমিল্লার প্রথম বেঙ্গলের সৈন্যদের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার – যারা একটা গুলিও চলায়নি।
সামরিক বাহিনীর আরেক সদস্য মেজর জলিলের ভূমিকাও অনেক সময় আমার কাছে কুয়াশাচ্ছন্ন মনে হয়। জাসদের মত এমন পোড়-খাওয়া দলের শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ পদে জলিলের কী করে স্থান হল, তা আমার কাছে আজও পরিষ্কার না (তুলনা করার জন্য প্রয়াত মইনউদ্দীন খান বাদলের কথা বলা যায়, যিনি তাঁর আমৃত্যু ভূমিকার জন্য শক্তিশালী একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবেই বিবেচিত হবেন) মেজর জলিলের সাথে সিরাজ শিকদারের যোগাযোগ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ই। তবে জলিলের স্থূলবুদ্ধি এবং আবেগকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধ করেছিল।
পঁচাত্তর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ আবেগের ব্যাপার ছিল ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রাম। তবে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে যুবকদের আবেগকে অন্য কাজে লাগানো হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইয়াসির আরাফাত যখন বাংলাদেশে আসেন, ঢাকাস্থ আল ফাতাহর প্রতিনিধির মাধ্যমে জলিল তাঁর সাথে দেখা করেন। অনেকের মতে একাশিতে জলিলই প্রথমে ফিলিস্তিনে স্বেচ্ছাসেবী দল পাঠানোর দায়িত্ব নেন। মূলত দলের সদস্যরা ছিল প্রাক্তন গণবাহিনীর সদস্য। কিন্তু তারা ফিলিস্তিন গিয়ে যুদ্ধ করে নাই।
লেখক মহিউদ্দিন আমমেদকে উদ্ধৃত করি,
‘১৯৮২ সালের মার্চের এক সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরে কর্নেল আবু তাহেরের পরিবার যে বাসায় থাকত, সেখানে তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফের সঙ্গে প্রাক্তন গণবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের সভা হয়। সেখান আবু ইউসুফ বলেন,”আমাদের লিবিয়া যেতে হবে। গাদ্দাফির ডান হাত ক্যাপ্টেন সালেম ঢাকায় জলিলের সঙ্গে মিটিং করেছেন”।“ কর্নেল ফারুকের মিশনে আমরা কেন যাব”? এধরনের বিরোধিতা সত্ত্বেও এক সপ্তাহের মধ্যে ৪০-৫০ জনের একটা দল লিবিয়া রওয়ানা হলেন। জাসদের কয়েক শ তরুনকে লিবিয়া পাঠানো হয়, রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব ছিলেন আবু ইউসুফ’।
কিন্তু পরে দেখা গেছে, অনেককে লিবিয়াতে প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্য দেশে পাঠানো হয়েছে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানির প্রক্রিয়া হিসাবে। লিবিয়াতে প্রশিক্ষিত যুবকরা ফ্রিডম-পার্টির ক্যাডার হিসাবেও দেশে এসে কাজ করেছেন।
জলিলের সঙ্গেও লিবিয়ার ভাল যোগাযোগের ছিল। জলিলর বিরুদ্ধে লিবিয়ার টাকাপয়সা নয়-ছয়ের অভিযোগ ছিল, আবার তার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ারও ঘটনা দেখা যায়। শাজাহান সিরাজ এবং হাসানুল হক ইনু জলিল টাকা ‘নয়-ছয়’ করছে এমন সন্দেহ করার পর মীমাংসার জন্য জলিল তাদেরকে লিবীয় দূতাবাসে নিয়ে যান। আহমদ ছফার সাথেও লিবীয় দূতাবাসের যোগাযোগ ঘটে জলিলের মাধ্যমেই, পরে ছফা জলিলকে এড়িয়ে নিজেই সরাসরি যোগাযোগ শুরু করেন এবং গ্রীন বুক অনুবাদের জন্য আর্থিক অনুদানও পান। আমারা জানি পরবর্তীতে ছফা লিবিয়াতে গিয়েছিলেন।
২০
মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক অফিসারদের অভ্যুত্থানের ইতিহাস, ‘ফ্রি অফিসার মুভমেন্ট’ ইত্যাদি দিয়ে খুনিদের প্রেষণা দেয়ার সুযোগ ছিল। ১৫ আগস্ট সকালে হঠাৎ করেই ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের ‘জয়-বাংলার’ হঠাৎ পরিবর্তন সবকিছুই ইঙ্গিতবহ। খুনিদের পরবর্তী কর্মকাণ্ড এবং সর্বদা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকাও অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে বিরুদ্ধাচরণ কঠিনভাবে দমন করেছেন, অথচ খুনিদের সবধরনের ‘অগ্রহণযোগ্য ব্যবহার’ সত্ত্বেও কিছুই করেন নই। পরবর্তী সরকারগুলির খুনিদের সকল সুবিধা দেয়া, উদাহরণস্বরূপ ১৯৮৭ সালে ডালিমকে গুলশানে প্লট বরাদ্দ ইত্যাদি তাদের ‘আনটাচেবল’ বৈশিষ্ট্য ইঙ্গিত দেয়।
পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীর ভূমিকা আমার কাছে সবসময়ই ধাঁধার মত মনে হয়। সবকিছু বাদ দিলেও ১৫ আগস্ট থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গ্লানিকর একটা সময়। কিছু মেজর পুরো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চালাত (তবে ‘দেশ-গড়ার’ আগেই বিল্পবীরা রেডিও স্টেশনে ব্যবসায়ীদের ধরে মারধর করে টাকা আদায়ে বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছিল)। কিছুই করেনি সেনাবাহিনী, এমনকী শক্তিশালী কোন নেগোশিয়্যাশনের খবরও পাওয়া যায়নি। অনেক সামরিক কর্মকর্তারা তাদের লেখা বইতে ইনিয়ে-বিনিয়ে ‘রক্তক্ষয় এড়াবার’ খেলো যুক্তি দিতে চেষ্টা করেছে। অথচ সেই তথাকথিত খুনিরা শুধুমাত্র বঙ্গভবন এবং রেডিও স্টেশন-বেজড ছিল (জিয়াউর রহমান হত্যার পর নেগোসিয়্যাশন অকার্যকর হলে তথাকথিত বিদ্রোহীদের 'সারেন্ডার ওর ফেস এটাক'-এর যে সময় দেয়া হয়েছিল, সেই বিদ্রোহীদের সুযোগ ছিল চট্টগ্রামের সাধারণ লোকজনের সাথে মিশে গেরিলা-ওয়ারফেয়ারের দিকে নিয়ে যেতে, যে সুযোগ পঁচাত্তরেরে খুনিদের ছিল না।)। অথচ ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে ৩ নভেম্বরে যখন তথাকথিত অভ্যুথান হল, তখন কিন্তু কোন গুলি চলেনি, রক্তপাত তো দূরে থাক। তিন-বাহিনীর প্রধান, পুলিশপ্রধান সবাই রেডিও স্টেশনে গিয়ে করজোড়ে খুনিদের কাছে তথাকথিত ‘এলিজেন্স’ জানানোর গ্লানিকর দৃশ্য জনগণের মনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
এমনকি বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদও সেনাবাহিনীকে প্রচণ্ড আন্ডারমাইন করেছেন। নজিরবিহীনভাবে সামরিক বাহিনীর প্রধানের পদকে অবনমন করেছেন, সেনাবাহিনীর প্রধানের এবং তার নিজের মধ্যে একজন সিভিলিয়ানকে নিয়োগ দেয়া (ওসমানী তখন অবঃ, অবশ্য ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াতে মতে অবঃ হলেও ব্লাডি সিভিলিয়ান হয় না)। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান করলে তাঁকেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ‘হাইকোর্ট’ দেখিয়েছেন।
(চলবে)
১। ISLAMIC SOCIALISM IN PAKISTAN: AN OVERVIEW, HARVIE M. CONN, Islamic Studies Vol. 15, No. 2 (SUMMER 1976)
মন্তব্য
ভাল লাগলো। ছবিটা একটা বড় পরিসরে- দেখা যাচ্ছে।
ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ন কালো অধ্যায় পরম যত্নে উন্মোচন করছেন, এ জন্য ধন্যবাদ জানাই। গাদ্দাফীর স্বরূপটাও অনেক পরিস্কার হয়ে উঠছে। সিরিজটা অসাধারণ হচ্ছে।
নতুন মন্তব্য করুন