ইসলামিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের কার্যক্রম ইত্যাদি। (পর্ব ৪)

নৈষাদ এর ছবি
লিখেছেন নৈষাদ (তারিখ: সোম, ০৩/০৪/২০২৩ - ১:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯

সেনাবাহিনী ছেড়ে গোপন সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দেয়া লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সরকারি চাকুরিতে প্রত্যাবর্তন (অথবা প্রাইজ পোস্টিং) বেশ কৌতুহলোদ্দীপক। বাহাত্তর থেকে চুয়াত্তরের কোন একসময় (পরস্পর বিরোধী তথ্য আছে) সেনাবাহিনী ছেড়ে জিয়াউদ্দিন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে জেনারেল এরশাদের শাসন আমলে তিনি সাধারণ ক্ষমার সুযোগে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যানের মত গুরুত্বপূর্ন পদে নিযুক্তি পান (১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেই পদে বহাল ছিলেন)। পরে তিনি চট্টগ্রাম প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নামের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল প্রতিষ্ঠা (পরস্পর বিরোধী তথ্য আছে) করে সেখানে প্রিন্সিপাল হিসাবে যোগ দেন। এখন চট্টগ্রামে সুখ-শান্তিতে বসবাস করছেন। একটি বিপ্লবী জীবনের মধুরেণ সমাপয়েৎ।

গণচীনের পিপলস আর্মির আদলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘প্রোডাক্টিভ আর্মি’ হিসাবে তৈরি করার ঘোর সমর্থক ছিলেন কর্নেল আবু তাহের এবং লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিন। কর্নেল তাহেরের ব্যাপারে অনেক কিছু লেখা হলেও জিয়াউদ্দিন কার্যকলাপ গোপনই রয়ে যায়। বছর সাতেক আগে মাছরাঙ্গা টেলিভিশন বীরেদের সম্মাননার অংশ হিসাবে লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিনের প্রায় ৩০/৩৫ মিনিটের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। উপস্থাপক ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, যিনি আবার তার অধিনে সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সেই তেল-চপচপে সাক্ষাৎকারে দু’টা জিনিস আমার নজর কেড়েছে – তিনি বেশির ভাগ কথাই ইংরেজিতে বলেছেন এবং তার সেনা-জীবনের বীরত্বগাঁথার পরই তিনি স্কুলে চলে গিয়েছেন। মধ্যে থেকে ২০/২২ বছরের কোন কথা নেই। উপস্থাপকও সযতনে এড়িয়ে গেছেন।

লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সাধারন ক্ষমা কিংবা সিডিএর চেয়ারম্যান পদে নিযুক্তির প্রক্ষাপট কোথাও পাওয়া যায় না। তবে সামরিক বাহিনী থেকে চাকুরিচ্যুত এবং পনেরো-ষোল বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা একজন সশস্ত্র বিপ্লবীকে এমন পদায়ন (প্রাইজ পোস্টিং) নিশ্চয়ই একাধারে কৌতুহল এবং সন্দেহের জন্ম দেয়। পাঠকের জ্ঞাাতার্থ জানিয়ে রাখি লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিন এবং মেজর জিয়াউদ্দিন (যিনি পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টে ডিএফআইয়ের ঢাকা ডিটাচমেন্টের অফিসার ইন চার্জ ছিলেন) সম্পূর্ন আলাদা ব্যাক্তি। দূ’জনকে এক করে ফেলার প্রচুর উদাহরন দেখেছি। (উদাহরণঃ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে ৩০ জুলাই ২০১৭ সালের এক প্রবন্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক রাহাত মিনহাজ মেজর জিয়াউদ্দিনের সম্বন্ধে লিখেন, ‘সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থাতেই মেজর জিয়াউদ্দিন সে সময় সরকারের কট্টর সমালোচক ‘হলি ডে’ পত্রিকাতে ‘হিডেন প্রাইজ’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন”। অথচ সেই প্রবন্ধ লেখেন লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিন যা তার চাকুরি থাকা বা না থাকার নিয়ামক হয়ে উঠে।)।

২০

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম খেতাব পান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে জিয়াউদ্দিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এডিসি এবং পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। একাত্তরের জুলাইয়ে তিনি মেজর আবু তাহের, মেজর এম এ মঞ্জুর এবং ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারির (পরে সবাই পদোন্নতি পান) সাথে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেন। জিয়াউদ্দিন ৪ নম্বর সেক্টারে যুদ্ধ করেছেন। জিয়াউর রহমান এবং মেজর নূর চৌধুরি সেখানে তার সহযোদ্ধা ছিলেন।

স্বাধীনতার পর কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত ৪৪তম ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের অধিনায়কত্ব দেয়া হয় কর্নেল তাহেরকে এবং ঢাকায় অবস্থিত ৪৬তম ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়কত্ব দেয়া হয় লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে। এক হিসাবে সেই সময়ে তারা দুজনে দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ পদাতিক সৈন্যের অধিনায়ক ছিলেন। তাহের এবং জিয়াউদ্দিন দু’জনেই সৈনিকদের সমাজতন্ত্রের দীক্ষা দিতেন এবং ‘প্রোডাক্টিভ আর্মির’ ঘোর সমর্থক ছিলেন ।
মেজর নাসিরের বয়ানে জানা যায়, কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার ব্রিগেডে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি তার অধিনস্ত সৈন্যদের সমাজতন্ত্রের দীক্ষা দিতেন, সরকার উৎখাতের কথা বলতেন। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থয়ই তার সাথে সিরাজ সিকদারের গভীর যোগাযোগ ছিল।

এদিকে তার সহযোদ্ধা মেজর নুর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। পরে তিনি সর্বহারা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। কথিত আছে সিরাজ শিকদারের নিহত হওয়ার ঘটনা নুরকে ক্ষুব্ধ করে। মহিউদ্দিন আহমদ আমাদের জানাচ্ছেন, “১৫ আগস্টের কয়েক দিন পর সর্বহারা পার্টির কয়েকজন নেতা কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা বাসায় সন্ধ্যাবেলা বৈঠক করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন, আকা ফজলুল হক ও মহসীন আলী। তাঁরা নূর ও ডালিমকে ডেকে পাঠান। নূর একাই এসেছিলেন” [মহিউদ্দিন আহমদ ২০১৪]।

আওয়ামী লীগের সাংসদ ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম একটা টক-শোতে আমাদের নিশ্চিত করেন পঁচাত্তরেও লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সেনা এবং বিমান বাহিনীর সাথে গভীর যোগাযোগ ছিল। বস্তুত তিনি ৩রা নভেম্বরের অভ্যুথানের আগে সেই অভ্যুত্থানের নায়কদের [ক্যাপ্টেন তাজও সেই দলে ছিলেন] ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের লিডারশিপ বাদ দিয়ে অন্য কারো অধিনে অভ্যুত্থান শুরুর অনুরোধ করেন।

৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে নজরুল সৈয়দ আমাদের জানাচ্ছেন, “রাজনৈতিক সমর্থনের আশায় মাওলানা ভাসানী, রাশেদ খাঁন মেনন, সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত সর্বহারা সমর্থক জিয়াউদ্দিনকে জানানো হল অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা”। ক্ষমতা দখল করে তার হাতে তুলে দেয়ার অনুরোধ করে জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘এই সুযোগে আমরা বাংলাদেশে বহু কাঙ্খিত একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করব’। [নজরুল সৈয়দ, ২০২১]

নজরুল সৈয়দ আরও জানাচ্ছেন, “… জিয়াউদ্দিন সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিলেও জাসদের হয়ে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কাজ করতেন। কিছু অফিসার তার নিয়ন্ত্রণে ছিলো, অভ্যুত্থান হলে তাদের সক্রিয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অক্টোবরের শেষ নাগাদ তিনি একটি কাজে খুলনায় চলে গিয়েছিলেন। ফলে নভেম্বরের অভ্যুত্থানের দায়িত্বে কোনো অফিসার থাকেনি, যা ছিলো একটি চরম ভুল।… যার খেসারত জাসদকে ধ্বংস হয়ে দিতে হয়েছে। [নজরুল সৈয়দ, ২০২১]। এ ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ন। যদি তার উপর অফিসার পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয়, যা তার এত দিনের স্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে আসার কথা, সেই দায়িত্বপূর্ন কাজ ফেলে তিনি কেন খুলনা যাবেন।

২১

১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের সম্ভাব্য পরিকল্পনার ব্যাপারে সামরিক বাহিনীর অনেকেই জানতেন। কর্নেল তাহেরও জানতেন, তবে ধারনা করি দিন-ক্ষণের ব্যাপারে জানতেন না। হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করা কয়জন সামরিক কর্মকর্তার পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সংশ্লিষ্টতায় ধারনা করা যায় লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিনও জানতেন। এদিকে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার ব্যাপারেও জিয়াউদ্দিন সাথে রীতিমত কন্সাল্টেশন করা হয়েছে, যদিও কর্নেল তাহেরকে এত বিস্তারিত জানানো হয়নি।

বস্তুত পরপর তিনটি অভ্যুত্থানে তাহেরের ভুমিকা দেখে আমার মনে হয়েছে, তিনি শুধুই ব্যবহৃত হয়েছেন। ১৯৭২ সাল থেকেই ‘মুজিব সরকার’ হঠাবার জন্য তার হঠকারী কাজ কারবার শুধু যে পঁচাত্তরের হত্যাকান্ড ক্ষেত্র তৈরি করেছে তা নয়, এর ফলাফল ২০০৯ এর বিডিয়ার বিদ্রোহ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু মূল পরিকল্পনায় তাকে নেয়া হয়নি। ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের পর তিনি নিজ উদ্যোগে রেডিও স্টেশনে গিয়েছেন, কিন্তু পরবর্তী কার্যক্রমে কোন পাত্তা পাননি।

মেজর নাসিরের ভাষ্যে জানা যায়, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার ব্যপারে তাহের সাথে কথা হয়েছে (দিন-ক্ষণ জানানো হয়নি)। তিনি ‘চোখের পলকে এক লক্ষ’ লোক নামিয়ে দিবেন এমন কথা বলেছিলেন (কিন্তু বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কথা বলেননি)। কিন্তু মূল পরিকল্পনার ব্যাপারে তার সাথে আর যোগাযোগ করা হয়নি।

কর্নেল তাহেরের (এবং জাসদের) বিরাট সাফল্য ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে এবং তার অনুসারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে “সিপাহী-জনতার বিপ্লব” করা।

তাহেরের মাধ্যমে জিয়াকে মুক্ত করার দাবি করা হয়। অথচ লেফটেন্যান্ট কর্নেল হামিদ আমাদের জানাচ্ছেন, টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের মেজর মহিউদ্দিন আর সুবেদার মেজর আনিস একদল সৈন্য নিয়ে জিয়াকে মুক্ত করে টু ফিল্ড আর্টিলারির অফিসে নিয়ে আসেন (হামিদ: ১৯৯৬)। উল্ল্যেখ্য, টু ফিল্ড আর্টিলারি রশিদের অধিনের একটি বাহিনী যারা ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করেছিল। নজরুল সৈয়দ আমাদের জানাচ্ছেন, এই মেজর মহিউদ্দিন খুনি দলের সাথে ব্যাংককে না গিয়ে দেশ রয়ে যান এবং ৭ নভেম্বরে আবির্ভুত হন এবং খুনি রেজিমেন্টের সৈন্যদের নেতৃত্ব নিয়ে নেন।

শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান কে টু ফিল্ড আর্টিলারির অফিসে নিরাপত্তা দিয়ে রাখা হয়। পরে কর্নেল তাহের টু ফিল্ড আর্টিলারির অফিসে আসেন এবং জিয়াকে তাঁর সঙ্গে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে জিয়া এবং তার সঙ্গের অফিসাররা তাহেরের সেই অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন। বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, সেই সময় জিয়ার পাশে থাকা ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাক্তন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিনুল হক, টু ফিল্ড আর্টিলারির সুবেদার মেজর আনিস কর্নেল তাহেরের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন (হামিদ: ১৯৯৬)। অসন্তষ্ট হয়ে তাহের সেখান থেকে চলে যান।

ফারুকের অধিনের আধিনের সৈন্যরাও ৭ নভেম্বরে যুক্ত ছিল। “৭ নভেম্বর খালেদ-শাফায়াতের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান পরিচালনায় গণবাহিনী কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈনিকদের মধ্যে মুজিব হত্যাকাণ্ডে জড়িত মেজর ফারুক, মেজর রশিদের অধীনস্ত বিভিন্ন মোশতাকপন্থী সৈনিকও অন্তর্ভূক্ত ছিল। এই সৈনিকরা ডানপন্থী মোশতাক ও ফারুক-রশিদের অনুসারী জেনেও জাসদের বামপন্থী বিপ্লবে এদের যুক্ত করা হয়” (আনোয়ার হোসেন: ২০১২)। শুধু তাই নয়, কর্নেল তাহেরের ওয়ারেছাত হোসেন বেলাল আমাদের জানাচ্ছেন, “এই রকম একজন সেনাসদস্য ছিল ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারসের সুবেদার সারোয়ার যার নেতৃত্বে খালেদের পতনের পর কিলিং স্কোয়াড গঠন করে সামরিক নেতাদের হত্যা করা হয় আর তার দায় চাপানো হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের ওপর।” (পারভেজ: ১৯৯৫)।

এই প্রেক্ষাপটেই লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিনে ‘খুলনায় কাজের ছুতোয় অনুপস্থিতির ব্যাপারটা দেখতে হবে।

২২

মেজর নাসিরের বয়ানে জানা যায়, পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের আগে অন্তত তিন জন অভ্যুত্থানের কথা বলেছিলেন, লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিন, মেজর ফারুক এবং বেসামরিক আমলা এবং ফারুকের মামা প্রাক্তন সিএসপি অফিসার মোহাম্মদ নুরুল কাদের। প্রথম দু’জন সামরিক কর্মকর্তার আগস্টের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কার্যকলাপেই তাদের মনভাব বুঝা যায়।

তবে মোহাম্মদ নুরুল কাদেরের ব্যাপারটা কৌতুহলোদ্দীপক, যদিও ঢাকা ক্লাবে উৎকৃষ্ট সুরা পানের পর লঘুচালে অনেক ধরনের বিল্পবের কথাই মাথায় আসতে পারে। আবার সেটা বেসরকারি আমলাদের সংশ্লিষ্টতারও সূত্রও দিতে পারে।

নুরুল কাদেরের চৌকষ সিএসপি অফিসার ছিলেন। তিনি ‘দেশ গার্মেন্টসের’ প্রতিষ্ঠাতা এবং গার্মেন্টস ব্যবসায়ের একজন অগ্রপথিক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনে পাবনার জেলা প্রশাসক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, পরে জিপ চালিয়ে কোলকাতায় গিয়ে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারে যোগ দেন। সেখানে তিনি সংস্থাপণ মন্ত্রাণালয়ের সেক্রেটারির দায়িত্ব পান। মজার ব্যাপার, সেময়ে সেই পদটিকে সেক্রেটারি, সার্ভিসেস এন্ড জেনারেল অ্যডমিনিষ্ট্রেশন বলা হত।

তিনি পদবীটিক কিছুটা উল্টেপাল্টে সেক্রেটারি জেনারেল, এসজিএ বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেক্রেটারি জেনারেল তখন ভারতে খুব ‘ভারী পদবী’ হিসাবে পরিগণিত হত। শুধুমাত্র পদবীর গুণে তিনি অনেকের কাছে ‘ইজি এক্সেস’ পেয়েছিলেন।

২৩

কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। ১৯৭৫ সালে প্রায় ৩৬,০০০ জন সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিল (৩০,০০০ সেনাবাহিনীতে, ৫০০ নৌবাহিনীতে এবং ৫,৫০০ বিমান বাহিনীতে)। এই ৩৬,০০০ এর মধ্যে ২৮,০০০ হাজারই ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত। আর ১,২০০ অফিসারের মধ্যে ১,০০০ জনই ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত। [এমাজুদ্দিন আহমেদ ১৯৮৮] [মুনতাসির মামুনের এনালজি ধার করে প্রশ্ন করা যায়, মুক্তিযুদ্ধাদের মধ্যে কতজন লুঙ্গি পরা আর কতজন উর্দি পরা ছিল]।

পাকিস্তান প্রত্যাগতরা মুক্তিযুদ্ধা দলকে মনে করত ‘ধর্মনিরপেক্ষ, প্রো-ইন্ডিয়ান এবং সমাজতান্ত্রিক ধান-ধারনার’। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধারা পাকিস্তান প্রত্যাগতদের মনে করত ‘সুযোগ-সন্ধানী এবং প্রো-পাকিস্তানি’। [এমাজুদ্দিন আহমেদ ১৯৮৮]।

পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনারা সরাসরি রেডিক্যাল কার্যকলাপে জড়িত ছিল না। কিন্তু তারা ছিল কনজারভেটিল এবং পাকিস্তানি ধ্যান ধারনার। তারা সবাই মুজিব সরকারের বিরোধি ছিল এবং বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। জিয়াউর রহমান এই দলটিকে এমপাওয়ার করার পরও শেষরক্ষা হয়নি।

জেরেমি কর্ডন আমাদের জানাচ্ছেন, এদের (পাকিস্তান প্রত্যাগত) দেশ আনা মুজিব সরকারের মারাত্মক ভুল ছিল। জেরেমি আরও জানাচ্ছেন, জিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এরশান এই পাকিস্তান প্রত্যাগত সৈনিকদের নেতা হিসাবে অবির্ভুত হন। [Jérémie Codron 2007]

২৪

জাসদের ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ সিরাজুল আলম খানের রাজনীতিতে আগমন এবং উত্থান সিরাজ সিকদারের রাজনীতিতে অভিষিক্ত হওয়ার বহু আগেই, তদুপরি তিনি একটা সুস্থ ধারার রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করতেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, সিরাজুল আলম খানের মত জাসদের গঠনপ্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাদের অনেকেই ষাটের দশকের অন্দোলনের উত্তরাধিকার বহন করতেন। জাসদ গঠন করা নিয়ে সিরাজুল আলম খান তাজউদ্দীন আহমেদের মত রাজনীতিবিদের সাথে সবিস্তারে আলোচনা এবং তাঁকে দলে টানার বিস্তর চেষ্টাও করেছিলেন। তারপরও জাসদের প্রথম সভাপতি করা হয় পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট মেজর (অবঃ) আব্দুল জলিল নামের রাজনীতিতে অজ্ঞাতকুলশীল, সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত, সেনাবাহিনীর ভাষায় এক ‘Rogue soldier’কে। জাসদ গঠন হওয়ার পর অবশ্য সিরাজ সিকদার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের রিক্রুটমেন্ট লাইন বন্ধ হয়ে গেল’।

আরেকটা ব্যাপার, জাসদে বড় বড় নেতা থাকলেও, শেষদিকে সর্বহারা ফেরত, অবঃ এবং কর্নেল তাহের এবং তার ভাই-বেরাদের হাতেই চলে গেছিল।

জলিলকে জাসদের নেতা বানানোর ব্যাপারটার কোন ব্যাখ্যা আজও পাইনি। তবে, তাকে ঘিরে একটা মিথ তৈরি করা হয়েছিল। সবচেয়ে বড় ছিল, ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় কন্ঠস্বর। অথচ, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী আমাদের জানাচ্ছেন 'ডিসেম্বর মাসেরই শেষের দিকে মেজর জলিলকে খুলনা থেকে ধরে এনে বন্দি করার জন্য আমার কাছে হস্তান্তর করা হয়। তৎকালীন ক্যাপ্টেন কে এস হুদা (পরে কর্নেল ও ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের অভ্যুথানে নিহত) তাকে ধরে নিয়ে আসেন। মেজর জলিলের বিরুদ্ধে উচ্ছৃঙ্খলতা ও অন্যান্য সামরিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ ছিল। খুলনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক জলিলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ এবং গ্রেপ্তার সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। যদিও প্রচার করা হয় যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক অস্ত্রশস্ত্র লুটতরাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।...এখানে উল্লেখ্য, লে. কর্নেল তাহেরের সভাপতিত্বে ১৯৭২ সালে জলিলের কোর্ট মার্শাল হয়। কোর্ট মার্শালে জলিলের কোনো শাস্তি হয়নি। কিন্তু তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এরপর তিনি সক্রিয়ভাবে জাতীয় সমাজতান্ত্ৰিক দলের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং জাসদের অন্যতম প্রধান নেতায় পরিণত হন।' [মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অবঃ) বীরবিক্রম ২০১৪]

তৎকালীন জেলা প্রশাসক, পরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী একসময় তার ফেসবুকে মেজর জলিলের নারী-ঘটিত অপরাধের ঘটনা লিখেন। কিন্তু ফেসবুক স্টেটাসকে অথেনটিক সোর্স বিবেচনা না করায় সেসব বিবরণে আর গেলাম না।

২৫

স্বাধীনতার পর পর প্রাচারণা আর গুজবের ব্যাপ্তি এখনকার তথাকথিত ‘ইউটিউবারদের’ আবোল-তাবোলের থেকে কোন অংশে কম ছিল না। তাছাড়া, গণকন্ঠ, হক কথা ছাড়াও ছিল এনায়েতুল্লার হলিডে এবং শাহদাত চৌধুরির বিচিত্রা। প্রাচারণা প্রসঙ্গে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক আনোয়ার উল আলমের একটা স্মৃতিচারণের কথা উল্লেখ করা যায়। বাহাত্তরের সেপ্টেম্বরে মওলানা ভাসানী একটা ভুখামিছিল নিয়ে গণভবনে যান। সেখানে পুলিশের সাথে রক্ষীবাহিনীর সদস্যেরাও ছিল। তিনি রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের সাথে বিস্তর কথা বলেন (বাড়ি কোন জেলায়, কোন গ্রামে ইত্যাদি)। কিছুক্ষণ পর মওলানা ভাসানী তাঁর পাশে থাকে কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেননকে বলেন, “তোমরা না কও রক্ষীবাহিনীর সবাই ভারতীয়। আমি তো দ্যাখতাছি এরা আমাগো পোলা’।

বাহাত্তরের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটি করা হয়। এপ্রিলের ১৪ তারিখ সন্তোষের ন্যাপ (ভাসানী) এর এক সভায় সব পেশা এবং সংগঠনের মতামত নিয়ে সংবিধান তৈরির আহ্ববান জানানো হয়। তিন মাস পর ১৮ জনু টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী ময়দানে এক জনসভায় মওলানা ভাসানী বলেন, ‘দিল্লির শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে প্রণীত কোনো শাসনতন্ত্রই বাংলার বীর জনতা মানবে না’। তার চার মাস পর, ৪ অক্টোবর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘কোরআন, সুন্নাহ, ওয়াজেব, শরিয়ত এবং হাদিসের খেলাপ করিয়া কোন শাসনতন্ত্র মুসলমানদের উপর জোজ করিয়া চাপাইয়া দেওয়ায় হলে মুসলমানগণ এক বিন্দু রক্ত থাকিতে তাহা মানিবে না’। ( (বেলা-অবেলা, মহিউদ্দিন আহমেদ]

বাহাত্তরের মার্চে স্বাক্ষরিত হয় ২৫ বছর মেয়াদী ‘বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি’। যথারীতি বেশ কয়টি রাজনৈতিক দল এই ‘চাপিয়ে দেয়া গোপন চুক্তির’ ফলে বাংলাদেশ যে ‘ভারতের করদ রাজ্য হয়ে গেছে’ এই দাবীতে চুক্তির প্রবল বিরোধিতা করেছিল। আমরাও এও জানি জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানীর কাছ থেকে এই ‘গোপন চুক্তির’ কথা শুনে লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার হিডেন-প্রাইজ নিবন্ধ লিখেন।

মজার ব্যাপার হলে, সেই চুক্তি ১৯৭১ শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ভারত-রাশিয়ার চুক্তির মোটামোটি হুবহু অনুকরণ, শুধুমাত্র কন্টেসচুয়েলাইজেশন করা হয়েছে। তাছাড়া, বাহাত্তরের চুক্তি কোন গোপন চুক্তি ছিল না, সেটা সংসদে আলোচনা হয়েছিল।

আরও মজার ব্যাপার ভারতের সেই চুক্তি নিয়ে বিরোধী-দলগুলি সেখানে কোন উচ্চবাচ্য করনি।

(চলবে।)


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এতো লম্বা সময় পরে একেকটা পর্ব দেন যে তাতে পাঠককে আবার পুরনো পর্বগুলো পড়ে আসতে হয়। তবে যাই হোক, লেখা যেমন হচ্ছে তাতে একটা বই আশা করা যেতেই পারে।

-----

১৯।
এদেশের সাবেক বিপ্লবীদের মধ্যে একটা শ্রেণী আছেন যারা কী করে যেন গানফাইট, এনকাউন্টার, দীর্ঘ জেল ইত্যাদি এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছেন। এগুলো কী করে যে কী হয়েছে সেসব নিয়ে নানা অনুমিতির কথা বলা যাবে, কিন্তু প্রমাণ করা দুরূহ।

২০।
সত্তরের দশকের সেনা অভ্যুত্থানগুলোর সাথে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বাম রাজনীতির একটা সংশ্লিষ্টতা লক্ষ করা যায়। এমনকি তাদের মধ্যে যাদেরকে পরবর্তীতে ইসলামী রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে দেখা গেছে তারাও ঐ সময়ে নিজেদেরকে বাম হিসেবে দেখিয়েছেন। এটা সম্ভবত ঐসময়কার লাতিন ও আফ্রিকান সমর নায়কদের দ্বারা প্রভাবিত অথবা তখনকার ফ্যাশন।

২১/২২।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার ব্যাপারে অনেকেই জানতেন, কিন্তু কেউই বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হননি, সতর্কতার কথা বলেননি। যারা জানতেন তাদের বড় অংশ সম্ভবত আলুপোড়া খাবার আশায় ছিলেন। অবশ্য তাদের অনেকেই আলুপোড়ার স্বাদ পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের বিচার না হওয়া পর্যন্ত অনেক কালপ্রিটকেই চিহ্নিত করা যাবে না।

২৩।
সামরিক বাহিনীর পাকিস্তান প্রত্যাগত অংশের ব্যাপারে আসলে ঢালাও মন্তব্য করার সুযোগ নেই। তাদেরকে গ্রহন করার সময়ে ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের ব্যবস্থা ছিলো কিনা জানি না। অবশ্য ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেও বিশেষ ফল হতো না। তাদেরকে সরাসরি অবসরে পাঠিয়ে দিলে হয়তো এক রকমের ঘটনা হতো। লক্ষ করা যাচ্ছে সত্তরের দশকে সামরিক বাহিনীতে ঘটা বড় বড় ঘটনাগুলোর নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধ করা অংশের। আসলে আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনার যৌক্তিকতা বিচার করা কঠিন।

২৪।
মেজর জলিলের ব্যাপারে জাসদের কোর নেতৃত্বের মূল্যায়ণ জানতে আগ্রহী। যারা তাকে নির্বাচন করেছিলেন তাদের যুক্তিগুলোও জানতে আগ্রহী।

২৫।
(ক) ঐ সময়ে সম্ভবত কবি শামসুর রাহমান বিচিত্রার সম্পাদক ছিলেন।
(খ) তথাকথিত রেড মাওলানার রাজনৈতিক নীতি, দর্শন, অবস্থান, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি কচুপাতার পানির মতো একটা ব্যাপার। তিনি সম্ভবত সবসময়ে আলোচনায় থাকতে ভালোবাসতেন।
(গ) বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তিটি যে কেন করা হয়েছিল সেটা বলা মুশকিল। কারণ, এই চুক্তিটি যে কার্যকর সেটা অনুভূত হয়নি। মাঝখান দিয়ে মাঠের রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতার জিগির তোলারা একটা সহজ হাতিয়ার পেয়েছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে তার সমর্থকেরা শ্লোগান দিতেন - রুশ ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান। কার্যত তাদের নেতা কখনো ভারত বিরোধী অবস্থান নেননি বা এই চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নেননি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ঐ সময়ে সম্ভবত কবি শামসুর রাহমান বিচিত্রার সম্পাদক ছিলেন।

পাণ্ডব দা,
কবি-সাহিত্যিকদের 'সম্পাদক' হওয়ার এই প্রক্রিয়াটা শুরু হওয়ার কারণ কি? আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ- হালের আনিসুল-মিলন অনেকেই তো আছেন। আমার দৃষ্টিতে 'সম্পাদক' বেশ পেশাদার একটি পদ হবার কথা, যেখানে ঐ পেশার ধারেকাছেও না থাকা যাকে-তাকে উড়িয়ে এনে বসানো অস্বাভাবিক। এখানে এই মিথোজীবিতার কারণ ঠিক কি? পত্রিকার সাথে সম্পর্কিত হলে কবি-সাহিত্যিকের প্রচারের সুযোগ বাড়ে? না কবি-সাহিতিকের সুখ্যাতির ছোঁয়ায় পত্রিকার পত্রিকার কাটতি বাড়ে? এই অসীম চক্রের শুরুটা ধরতে পারি নি।

সাংবাদিক যেহেতু কর্মসূত্রে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন, তাই সাংবাদিক থেকে সাহিত্যিকে রূপান্তরের যৌক্তিকতা মোটামুটি বুঝতে পারি। কিন্তু, সাহিত্যিকের রাতারতি সাংবাদিক বনে যাওয়ার ব্যাপারটি আজতক বুঝে উঠতে পারি নি।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এক সময়ে পত্রিকা অফিসগুলো কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলা ছিল। লেখা ছাপানোর জন্য সেখানে যেতে যেতে অগ্রজ সাহিত্যিকদের সাথে আলাপ হতো, আড্ডা হতো। এভাবে কেউ কেউ পত্রিকার কর্মী হয়ে যেতেন। সেখান থেকে কেউ কেউ একসময় সম্পাদক হয়ে যেতেন। কেউ কেউ নিজেই পত্রিকা বের করতেন। প্রথমে ছোট কাগজ হিসাবে, পরে সেটা বড় কাগজ হয়ে যেতো। এই তালিকায় রবীন্দ্রনাথ (সাধনা, ভারতী, বঙ্গদর্শন এবং তত্ত্ববোধিনী), নজরুল (ধূমকেতু, নবযুগ, লাঙল ইত্যাদি) থেকে শুরু করে অগণিত জন আছেন। টাইম-বাংলা ট্রাস্ট নামের সরকারী প্রতিষ্ঠানটিতে চাকুরি করার সুবাদে শামসুর রাহমান 'বিচিত্রা'র সম্পাদক হয়েছিলেন। আমার হিসাবে সাহিত্যকর্ম, পত্রিকা সম্পাদনা, সাংবাদিকতা - প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন পেশা (ফুলটাইম), এবং এর প্রত্যেকটির জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, চর্চ্চা, অখণ্ড মনোযোগ, পেশাদারিত্ব ও পূর্ণ সময় আবশ্যক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।