ছেলেটি শুধু এক মুহূর্ত ভালবেসেছিল মেয়েটিকে। আর কেউ না জানুক, মেয়েটি জানে, সেই একটি মুহূর্ত একটি মহাকাল। ছেলেটি চিনিয়েছিল মেয়েটিকে জীবনের অপরূপ রূপ। মেয়েটি ছেলেটিকে দিয়েছিল একটিমাত্র স্ফুলিঙ্গ— যার তপস্বায় ছেলেটি মগ্ন ছিল জীবনভর।
ছেলেটি মেয়েটিকে ডাকে জুনি। মেয়েটি ছেলেটিকে ডাকে জিউস।
ছেলেটি গল্প শোনায় মেয়েটিকে—
ছোটবেলায় গ্রামে দেখেছি, সন্ধ্যা নামতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকার ভেদ করে মাঠে-ঘাটে, ঝোপে-ঝাড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে জ্বলে ওঠে জোনাকী। অন্ধকার ভেদ করা জোনাকীর দ্যুতি দেখে, কী যে ভালো লাগতো আমার! মাঝে মাঝে ছুট দিতাম একটুখানি আলো ছুঁয়ে দেখবো বলে। একটা জোনাকী ধরতে পারলে ঢুকিয়ে নিতাম জামার পকেটে। জামা ভেদ করে জোনাকী আলো ছড়াতো! নিজেকে মনে হতো গর্বিত এক আলোবাহী! কতদিন ভেবেছি, বড় হয়ে জোনাকী হব! হতে পারিনি। আমার গ্রামে জোনাকীকে বলে জুনি। সেই শৈশব থেকে আমি এক টুকরো আলোর স্বপ্ন লালন করেছি আমার মাঝে। আমি জোনাকী হতে পারিনি, তবে তোমাকে পেয়েছি আমার বুকে। ঠিক যেন তুমি আমার শৈশবের স্বপ্নমাখা দ্যুতিময় জুনি!
মেয়েটি এবার গল্প শোনায় ছেলেটিকে—
আমার শৈশব বন্দী ছিল চার দেয়ালে। শুধু ছোট্ট একটি জানালা ছিল বন্ধু আমার। সেই জানালা দিয়ে এক টুকরো আকাশ প্রবেশ করতো আমার ঘরে। আমি আকাশ দেখতাম প্রাণ ভরে! আর ভাবতাম, ওই আকাশে দেবতা থাকে। আমি দেবতাকে খুঁজতাম আকাশে। কোথাও খুঁজে পেতাম না দেবতাকে। কীভাবে খুঁজে পাবো, আমার জানালাটা যে খুব ছোট! তাতে কেবল ছোট্ট এক টুকরো আকাশ দেখা যায়। দেবতা যে অনেক বিশাল, এত ছোট আকাশে দেবতাকে পাওয়া যায় না! মাঝে মাঝে চেষ্টা করতাম জানালাটাকে আরেকটু বড় করবার। আমার ক্ষুদ্র শক্তিতে কুলাতো না কিছুই। একদিন দেবতার প্রতীক্ষা করতে করতে ক্লান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙে দেখি সোনা-রূপার জীয়ন কাঠি হাতে তুমি আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে! দেবতা, এলে আমার ঘরে অবশেষে ! আমার জিউস, তোমাকে আসতেই হলো আমার ক্ষুদ্র জানালা গলে।
জিউস আর জুনি হয়ে যায় একপ্রাণ। জিউস বিশাল আকাশ চেনায় জুনিকে। জুনি সমুদ্রের গভীরতা বোঝায় জিউসকে। জুনিকে নিয়ে জিউস আকাশে নীড় বুনতে চায়। কিন্তু উচ্চতায় বড় ভীতি জুনির। জিউসকে বোঝায় জুনি, অতো উঁচুতে শান্তি নেই। সারাক্ষণ পতনের আশংকা বয়ে বেড়াতে হবে। হঠাৎ আছড়ে পড়লে স্বপ্নগুলো চুরমার হবে, জোড়া লাগানো যাবে না কিছুতেই! জুনি সমুদ্রে সংসারের ভেলা সাজাতে চায়। জিউসের বড় ভয় সমুদ্রজলে। জুনিকে বোঝায় জিউস, একবার অতল জলে ডুবে গেলে কূল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কূলের নিশানা হারিয়ে স্বপ্নগুলো ছিটকে গেলে, আর কী তা পূর্ণ হবে!
জুনির স্বপ্ন তবু সমুদ্রই ভাসে। জিউসের স্বপ্ন ওড়ে আকাশে। জিউসের বুকচেরা দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় বাতাস! জুনির চোখের লোনাজল সমুদ্রে একাকার হয়!
(শিরোনাম জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙক্তি)
মন্তব্য
'তোমায় আমি দেখেছিলাম বলে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;
শিশিরকণার মতন শূন্যে ঘুরে...
শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে,
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে'
# তোমায় আমি : জীবনানন্দ দাশ।
আপু, পোস্টে জীবনবাবুর নামের বানানটা (জীবনান্দ> জীবনানন্দ) ঠিক করে দাও।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
'পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।
এই আছে, নেই-- এই আছে, নেই-- জীবন চঞ্চল;
তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল
বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।'
তিথী, তোর জন্যে ধনে-- পাতা-গাছ-শিকড়-বাকরসহ।
সুন্দর, সাবলীল এবং কাব্যময় ।
ভালো লাগল ।
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ
ভাল লাগল খুব।
উফ! কি অসাধারণ আপনার গদ্য। আগের লেখাটিতেও দেখেছি। সুরেলা, কাব্যিক ও নাটকীয়! এমন ভাষা অনেক প্রত্যাশা জাগায় দারুণ খরায় পুড়তে থাকা পাঠকের মনে!
ছেলেটি জোনাকি পায় আর মেয়েটি দেবতাকে পায়। ছেলেটি আকাশে বাসা বাঁধতে চায়; কিন্তু মেয়েটি সমুদ্রে ভেলা ভাসাতে চায়। ছেলেটির ভয় ডুবে যাবার, মেয়েটির ভয় আছড়ে পড়ার। সবশেষে আপনার অতুল্য গল্পটি শেষ হয়, ছেলেটির দীর্ঘশ্বাস ও মেয়েটির অশ্রু দিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ভারী করে বাতাস আর অশ্রু আরও লোনা করে দেয় সমুদ্র।
ছোট্র অনুগল্পটি পড়ে পাঠক তাই চলমান জীবনের চিরন্তন ছবি দেখতে পায়। আমাদের জীবনে জোনাকি পকেটে পুড়তে পারি, জিউস এসে দাঁড়ায় শিয়রে, আবার সঙ্গে থাকে নিরন্তর দীর্ঘশ্বাস ও অশ্রু। আকাশ আর সাগরের মাঝে যেমন থাকে আবহমানকালের মিতালি আর দ্বন্দ্ব।
আরও নিয়মিত লেখা চাই আপনার কাছ থেকে।
লেখা পড়েছেন জেনে আমারো ভালো লাগলো খুব।
ভালো লাগলো।
ডাকঘর | ছবিঘর
অনুপ্রাণিত হলাম, তাপস।
কবিতার মতো
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
অথবা কবিতাই
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
অথবা যাচ্ছেতাই
ধন্য হলাম, ধুসর জলছবি।
নতুন মন্তব্য করুন