২১ নভেম্বর, ১৯৭১। লেলাং স্তব্ধ হয় পাকস্তানী বাহিনীর গণহত্যায়। চট্টগ্রামে ফটিকছড়ির কয়েকটি স্থানে চলে গণহত্যা। এরমধ্যে আছে লেলাং ইউনিয়নের শাহনগর গ্রাম, কাঞ্চননগর, নানুপুর বিনাজুড়ি খাল, হাসনাবাদ, আজিমনগর, নিউ দাঁতমারা চা বাগান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-সেনারা নাজির হাট কলেজ ও রেল ষ্টেশন দখলে নিলে বাঙ্গালী মুক্তিযুদ্ধারা ফটিকছড়ির প্রত্যন্ত এলাকায় পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিরোধ ক্যাম্প গড়ে তোলে। এরমধ্যে লেলাং ইউনিয়নের শাহনগর গ্রাম অন্যতম।
১৯৭১ সালে ২১ নভেস্বর ছিল ঈদুল ফিতর। ঈদের নামাজ শেষে বাঙ্গালী মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ সবাই যখন ঈদের আনন্দ ভাগা-ভাগি করছিল, তখন পাক-বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় সাদা পোশাকে শাহনগর নাথ পাড়াসহ আশ-পাশের পুরো এলাকা ঘিরে সাধারণ জনতাকে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ দিতে বলে। কেউ যখন খোঁজ দিচ্ছিল না, তখন গণধর্ষণ, লুণ্ঠন ও নির্যাতন চালায় তারা। হত্যা করার জন্য বেছে বেছে সুঠাম দেহের অধিকারীদের ধরে নিয়ে যায়। ১৭ পরিবারের ২৯ বাঙলীকে সারিবদ্ধ ভাবে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। এই বর্বর হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন মোঃ জহুরুল ইসলাম, শহীদ মোঃ ইউনুছ, মোঃ জমিল উদ্দিন, নুর মোহাম্মদ, মোঃ এয়াকুব, মোঃ নুরুল আলম, তোফায়েল আহম্মদ, রুহুল আমিন, ফয়েজ আহমেদ, জাগের আহমেদ, আবছার আহম্মদ, নুরুল ইসলাম, চিকন মিয়া, জহুর আহম্মদ, ইদ্রিস, শহীদ সোলাইমান, রফিকুল আলম, বজল আহম্মদ, ক্ষেমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য, রমেশ চন্দ্র নাথ, কৃষ্ণ হরি নাথ, শুধাংশু বিমল নাথ, হরিপদ নাথ, হরি লাল নাথ, বিপিন চন্দ্র নাথ, শহীদ সুবেন্দ্র লাল নাথ, হরিধন নাথ, নগর বাঁশি নাথ ও গৌর হরি নাথ।
ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নের শাহনগরের বধ্যভূমিতে নির্মিত স্মৃতিসৌধ
সেদিনের অপমান সইতে না পারে আত্মহত্যা করেছিলেন নির্যাতনের শিকার অনেক নারী। অনেকে স্মৃতির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন!
একই দিন ফটিকছড়ির সীমান্তবর্তী দুর্গম ইউনিয়ন কাঞ্চন নগরে পাক-বাহিনী চালায় আরেক হত্যাযজ্ঞ। এই গ্রামের যুবক হেদায়তুল ইসলাম চৌধুরী এবং অজ্ঞাত নামা এক যুবককে রক্তছড়ি খালের পাড়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকবাহিনী ও রাজাকারেরা। সেখান থেকে এসে পাক-বাহিনী দক্ষিণ কাঞ্চনপুরের গোমস্তা পুকুর পাড়ে নিরীহ ৯ বাঙ্গালীকে এক রশিতে বেঁধে ব্রাশফায়ার করলে ৭ জন তৎক্ষনাৎ মৃত্যু বরণ করেন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান দুইজন। আর এসময় শহীদ হন নুরুল আলম, ভোলা, বানু হোসেন, জেবল হোসেন, ইসলাম ও কালা মিয়া।
এ ছাড়া ফকিছড়িতে আরেকটি গণহত্যা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২ জুন। ফটিকছড়ির নানুপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান নুর আহম্মদের বাড়ী থেকে তার বৃদ্ধ বাবা ও অসুস্থ স্ত্রীকে পাক বাহিনী আটক করে বিনাজুড়ি খালের পাড়ে নিয়ে যায়। মির্জা আবু পরিবারের সন্তান মির্জা মনসুরকে না পেয়ে তাদের ম্যানেজার হিরেন্য কুমার দত্তকেও এখানে ধরে আনে। এছাড়া এই ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান থেকে আরো ৫/৭ জনকে এখানে আটকে রেখে নানা প্রকার নির্যাতন করে পাক-বাহিনী। পিতা ও স্ত্রীকে আটকের খবর পেয়ে তৎকালীন সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তা চেয়ারম্যান নুর আহম্মদ চট্টগ্রাম শহর থেকে ছুটে আসেন। নানুপুর এসে পাক-সেনাদের কাছে পিতা ও স্ত্রীকে আটক করার কারণ জানতে চাইলে তাকে আটক করে তার পিতা ও স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ দিকে বিনাজুড়ি খালের পাড়ে হিরেণ্য কুমার দত্ত, প্রদীপ দত্ত ও জসিমকে আটক করে চরম নির্যাতন চালাতে থাকে পাক বাহিনী। একসময় চেয়ারম্যান নুর আহম্মদ সহ ৬ জনকে বিনাজুড়ি খালের পাড়ে সেতুর নীচে নামিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে এবং পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে পাক বাহিনী।
বিনাজুরিখালের সেতুর নিচে হত্যা করা হয়েছিল ৬জনকে। এখানে নেই কোনো স্মতিফলক
গণহত্যার স্থানেই বিনাজুড়ি সেতু। এখানে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতি সৌধ । অনেকটা নীরবেই কেটে যায় দিবসটি। অনেকে জানেনও না দিবসটি সম্পর্কে। বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেউ।
১৯৭১ সালের ২৯ এপিল হাসনাবাদ গ্রামে পাকিস্তানী সেনারা নারকীয় উল্লাসে মেতে হত্যা করেছিল ২২ জন মানুষ। সেই সাথে আগুনে ঘরবাড়ী পুড়িয়ে, গণধর্ষণ চালিয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছিল শান্ত জনপদ হাসনাবাদ গ্রামটি।
দাঁতমারা ইউনিয়নের হাসনাবাদে গণহত্যার স্থানে জীর্ণ সাইনবোর্ড
ছবি: সংগৃহীত
তথ্যসূত্র: দৈনিক আজাদী, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ
মন্তব্য
শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
ধন্যবাদ।
সারা দেশ জুড়েই এমন কত স্থান, কত ইতিহাস! মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় বলে একটা মন্ত্রনালয় আছে, তারা আসলে কি কাজ করে আমি জানিনা।
আপনাকে ধন্যবাদ, আরও লিখুন।
শহীদদের জন্য শ্রদ্ধা
খুব দুঃখ হয়, এতোগুলো বছর পেরিয়েও আমরা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত স্থানগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে পারিনি।
ভালো থাকবেন, তানিম ভাই।
স্বাধীনতার মূল্যায়ন এভাবেই দিন কেটে যাবার সাথে সাথে অস্তমিত হতে থাকবে। দুর্ভাগ্য
ডাকঘর | ছবিঘর
এই দুর্ভাগ্যকে ডিঙিয়ে যেতে হবে।
শ্রদ্ধা
লেখা চলুক।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
লেখা চালিয়ে যাবার চেষ্টা থাকবে, ত্রিমাত্রিক কবি। ধন্যবাদ আপনাকে।
এইখানে আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে . মা'র মুখে শুনেছিলাম এসব ঘটনা। ইতিহাস তুলে ধরার জন্যে ধন্যবাদ আর শ্রদ্ধা সকল শহীদদের
জেনে ভালো লাগলো যে, মায়ের মুখে এসব ইতিহাস আপনার আগেই শোনা হয়েছে।
ধন্যবাদ, দারুচিনি।
নভেম্বরের ঘটনায় কি বি এস এফ বা ভারতীয় ২৩ ব্য়াটালিয়ানের পক্ষ থেকে কোন গোলানিক্ষেপ হয়েছিল? আমরা জানি যে ফেনি ও দাগনভূইয়াতে, বিশেষ করে সীমানার এপাড়ের রেলপথ ও রাস্তার ওপরে ৭১ এর অক্টোবর নভেম্বরে তুমুল গোলানিক্ষেপ করা হয়েছিল সীমারা ওপারের মনু বাজার-জলাবাড়ি-লাওগাংবাজারের ব্য়াটারিগুলও থেকে। নভেম্বর নাগাদ ত্রিপুরার দক্ষিনে ভারতীয় ২৩ ব্য়াটালিয়ান ও জেনারেল উবানের বাহিনীর পুরো শক্তি এই এলাকাগুলোতে জমজমাট অবস্থান থাকার কথা। সীমানার কাছাকাছি মুক্তিবাহিনীর রিট্রিট পরিস্থিতিতে সীমানার ওপার থেকে গোলাগুলি বা অতিরিক্ত মুক্তিযোদ্ধামোতায়েনের প্রচলন ছিল।
৭১ এর বর্ষাকেলে ভারতীয় জেনারেল উবানের নেতৃ্ত্বে মুজিববাহিনী ও তিব্বতী মিলিশিয়া পার্বত্য় চটটগ্রামে প্রবেশ করেছিল, যাদের গতিবিধি বা কার্যক্রমের বিস্তারিত আমার জানা হয়ে ওঠেনি কখনো। ৭১ এর গ্রীষ্মে পার্বত্য় চটটগ্রামে রাইফেল্স ও নয় বেঙ্গল সক্রিয় ছিল, কিন্তু বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর কোন কার্যক্রমের কথা বিস্তারিত জানার আগ্রহ আছে আমার।
যে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজছিল, তারা পাকিস্তানের ঠিক কোন বাহিনীর?
ওরা আমাদের যে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজছিল, তারা মুক্তিবাহিনীর কোন অংশের, কোন সেক্টরের, তাদের কমান্ডপোস্ট কি সীমানারে এপাড়েই ছিল? কোথায় ছিল?
যদি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আপনার যোগাযোগ থাকে, তাহলে দয়া কারে তাদের যুদ্ধ-অভিগ্গতা নিয়ে সবিস্তার লিখুন।
ধন্য়বাদ।
***
"মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ সবাই যখন ঈদের আনন্দ ভাগা-ভাগি করছিল" এটা কতটুকু ঘটনা আর কতটুকু কল্পনা?
সব তথ্য সংগ্রহ করে বিস্তারিত পোস্ট দেব। এই সংক্ষিপ্ত পোস্টে সব তথ্য স্পষ্টভাবে আসেনি। আমি নিজে সরাসরি স্পটগুলোতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করবো।
ধন্যবাদ, দুর্দান্ত।
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা।
আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
আরও বিস্তারিত লিখুন।
বিস্তারিত লিখবো নিশ্চয়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
এ বিষয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য আগাম সাধুবাদ থাকলো।
আসলে গোটা দেশ জুড়েই তো শহীদদের রক্ত-স্বপ্ন আর র্দীঘশ্বাস মিলেমিশে একাকার!
ফটিকছড়ির শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা।
ধন্যবাদ, আয়নামতি।
মুক্তিযুদ্ধের এরকম ইতিহাস আরও জানতে চাই। লেখা ভালো লেগেছে।
স্মৃতি স্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণে এই অবহেলা বরাবরই চোখে পড়ে!
অমি_বন্যা
ধন্যবাদ। চেষ্টা থাকবে আরো লেখার।
নতুন মন্তব্য করুন