আমার ছেলে অনুভব। বয়স সাড়ে তিন বছর। সিগারেটের সাথে ইতিমধ্যে তার এক ধরনের সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছে। এই সম্পর্ক নিয়েই আমার এই লিখা। তবে মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে অনুভব সম্পর্কে ২/১ টা কথা বলে নেয়া ভাল। অন্যান্য সকল বাচ্চাদের মতই সেও তীব্র কৌতুহল আর ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে জন্মেছে। আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব তার কৌতুহলকে উৎসাহ দেয়ার। আর তার ক্রিয়েটিভিটির ঘটনাগুলো নিয়ে অনেকদিন ধরেই ইচ্ছা আছে একটা গল্প লিখি, কিন্তু গুছিয়ে উঠতে পারিনি। কোন একসময় আশা করছি লিখবো। একটা ছোট্ট উদাহরন দেই। তার ২ বছর বয়সের সময় কোন একদিন আমি রুমের দরজা চাপিয়ে দিচ্ছিলাম। অনুভব চিৎকার করে বলে উঠলো, “নো... দরজা খোলানো থাকবে।” আমরা বললাম, “খোলানো! এই শব্দ তুই কই পেলি?” সে তো আর উত্তর দিতে পারে না। আমরা অনেক ভেবে বের করলাম যে আগেরদিন সে বারবার দরজা খুলে দিচ্ছিল, তাকে আমরা বলছিলাম দরজা “চাপানো” থাকবে। ওটা থেকেই পরেরদিন সে আবিস্কার করেছে যে “চাপানো থাকবে” কথাটার বিপরীত হবে “খোলানো থাকবে।” তার অত্যন্ত যুক্তিসংগত উপায়ে তৈরী শব্দ মেনে নিয়ে এখন আমরাও বলি “খোলানো থাকবে।” অনুভবের কারনে আমাদের পারিবারিক ডিকশনারীতে আরো অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই হচ্ছে অনুভব সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা। এবার মূল ঘটনায় আসি।
তার প্রশ্ন করার হার যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। সবসময় তাল মেলানো সম্ভব হয় না। তাও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। একদিন বাসার ছাদে হাটাহাটি করছি। অনুভব তার মত করে খেলছে। হঠাৎ সে কিছু একটা খূঁজে পেয়ে আনন্দে লাফাতে লাফাতে আমাদের কাছে আসল। আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল “বাবা, বাবা, এটা কি?” জিনিসটা দেখে আমার তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তার হাতে একটা সিগারেটের অংশবিশেষ। আমি তাকে বললাম “বাবা, এটা পঁচা জিনিস, ফেলে দাও।” ফেলে দেয়ার ব্যপারে তাকে মোটেও আগ্রহী মনে হলো না। সে আবার জিজ্ঞেস করলো “এটা কি বাবা?” আমি বললাম “এটা সিগারেট। পঁচা একটা লোক এটা খেয়ে ছাদে রেখে গিয়েছে। তুমি ফেলে দাও।” সে ফেলে দিল ঠিকই কিন্তু একটা ব্যাপারে সে মনে হয় হিসাব মেলাতে পারছিল না, “একটা জিনিস খাওয়া যায়, সেটা আবার পঁচা”। যাই হোক, সে তখন আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
ছাদের ওই ঘটনার কিছুদিন পর। টিভিতে কেউ একজন সিগারেট খেয়ে মাটিতে ফেলেছে। ওটা দেখেই অনুভবের মাথা কাজ করা শুরু করে দিলো। সে হঠাৎ করে জিনিসটা চিনতে পারল। আবিষ্কারের আনন্দ নিয়ে আমাকে বলল, “বাবা, বাবা, পঁচা লোক, সিগারেট খাচ্ছে।” আমি আমার বিস্ময় লুকিয়ে বললাম, “হ্যাঁ বাবা, পঁচা লোক।” তারপর বললাম “অনুভব আর টিভি দেখতে হবে না, ওই রুমে চল, ব্লকস নিয়ে খেলবে।”
এরপর একদিন রিক্সা নিয়ে যাওয়ার সময় সামনের রিক্সা থেকে সিগারেটের ধোঁয়া আসছে। অনুভব বলে উঠলো, “মামনি, মামনি, ধোঁয়া আসছে, রান্নাঘরের মত।” রিক্সাওয়ালা ওই রিক্সাটাকে ওভারটেক করার সময় অনুভব ৩য় বারের মত সিগারেট বিষয়ক আবিষ্কারের সুযোগ পেল। সে বলে উঠলো, “মামনি, মামনি, পঁচা লোকের সিগারেট থেকে ধোঁয়া আসছে।” তার মামনি বলল “হ্যাঁ, এগুলো তোমার দেখতে হবে না।”
কিছুদিন পরে আমরা বেড়াতে গিয়েছি। ওখানে আমরা একটা জায়গায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের সাথের একজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার সিগারেট পিপাসা মিটিয়ে আসল। আসার পর অনুভব বলল “বাবা, বাবা, আঙ্কেল পঁচা, আঙ্কেল সিগারেট খায়।” আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। এইটুকু বাচ্চাকেও সিগারেটের যন্ত্রনা থেকে বাঁচাতে পারছি না! ওইরকম লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে কি করতে হয় সেটা আমি সাধারনত বুঝতে পারি না, এর উপর অনুভবকে স্ববিরোধী কোন কথা বলাও ঠিক হবেনা। এই রকম কনফিউশান নিয়ে শেষ পর্যন্ত বললাম, “না অনুভব, আঙ্কেল পঁচা না, আঙ্কেল ভাল।” অনুভব জবাব দিল, “ না বাবা, আঙ্কেল পঁচা, আঙ্কেল সিগারেট খায়।” উপায় না পেয়ে সেই আঙ্কেলকেই বললাম যে “প্লিজ কিছু মনে করবেন না। সিগারেট নিয়ে কিছু ঘটনার কারনে ওর মধ্যে একটু কমপ্লেক্সিটি তৈরী হয়েছে। ওকে আমরা কোন যুক্তিসংগত উপায়ে ব্যাপারটা ব্যখ্যা করতে পারছি না।”
সেই আঙ্কেল ওই ঘটনায় যথেষ্ট লজ্জা পেয়েছিলেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু অনুভবের মানসিক বিকাশের সময়টাতে তার এই বিপদজনক কৌতুহল নিয়ে আমরা যথেষ্ট দুশ্চিন্তিত। এবং আমি নিশ্চিত অনুভবের মত আরো অনেক কৌতুহলী শিশুই এই ধরনের বিপদজনক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হচ্ছে। তাই ধূমপায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানাতে চাই, আপনাদের ধুমপান যদি একান্তই চালিয়ে যেতে হয়, দয়া করে বাচ্চারা দেখবে এমন কোন স্থানে কাজটা করবেন না।
(সিগারেট বিষয়ক প্রথম লিখাঃ http://www.sachalayatan.com/guest_writer/40315)
সুমন_সাস্ট
মন্তব্য
Anuvover janno suvokamona,,,,,,,,,lojjito j amra anuvov der janno valo poribes ensure korte parcina
এই ধরনের সামাজিক অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খূঁজে বের করতে সাহায্য করার জন্য আপনারা চাইলে আমাদের সাথে যোগ দিতে পারেন।
http://www.facebook.com/groups/199047023485551/
শব্দটা পঁচা নয়, পচা।
আপনার আগের লেখাটাও তাড়াহুড়োয় পড়েছিলাম, এটাও তাই। চট করে বলি, প্যাসিভ স্মোকিং যে ক্ষতিকর সে বিষয়ে সহমত।
ধন্যবাদ। বাংলা বানান সংক্রান্ত একটু ঝামেলা হচ্ছে। এখন যেহেতু লিখছি আস্তে আস্তে ঠিক করে নিব।
সুমন_সাস্ট
@কৌস্তুভ: পঁচা নয় কেন?
বানানটাই যে "পচা"... কৌস্তুভ আর কী দোষ করলো বলুন?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বাপ কা বেটা.. যদিও ওর চোখে আমিও একজন পচা লোক, তবুও ওর প্রশংসা না করে পারলাম না..
BTW , ওর কি data structure শেষ? আমি ওকে javascript শিখাবো..
জাভাস্ক্রিপ্ট??? আমি তো শুনছিলাম সে থিসিস সাবমিট করতেছে....।
অনুভব এখন বাংলা, ইংরেজী বর্ন আর জ্যামিতির কিছু মৌলিক গবেষনা নিয়ে ব্যস্ত। প্রজেক্ট ভিত্তিক কাজ করার সময় মনে হয় করতে পারবে না। তবুও ওর সাথে কথা বলে দেখবো
সুমন_সাস্ট
হুমম... বাচ্চারা দেখবে না এমন স্হানেই করা উচিত। বিশেষ করে নিজের বাচ্চার সামনে তো অবশ্যই নয়।
@বাডি, নিজের বাচ্চা কেন, কোন বাচ্চার সামনেই করা উচিৎ নয়। যদিও আমি পচা লোক, তবে খুবই সচেতন থাকি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। এমনও হয়েছে যে সদ্য ধরানো সিগারেটও ফেলে দিসি, শুধু একটা বাচ্চা সামনে আসছে বলে।
শিশুরা সবদিক থেকেই (যেমন মানসিক, শারীরিক) কোমল থাকে। মানসিক দিক থেকে সে যেমন একটা বাজে জিনিষের উপর কৌতুহল তৈরী করে, শারীরিকভাবেও সিগেরেটের ধোয়া মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকে না।
------------------------------------------------------------------
পরোক্ষ ধুমপান করানো আর খুন করার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই
------------------------------------------------------------------
========
আমি জানি না
আমিও একজন পচা লোক
"বাবা, এটা খারাপ জিনিস, ফেলে দাও" এবং "একটা পঁচা লোক এটা খেয়ে ছাদে রেখে গেছে"।
প্রথমটা ঠিক আছে, কিন্তু দ্বিতীয় মন্তব্যটা একটু অন্যরকম লাগছে। একটা বাচছা ছেলের মাথায় ধূমপায়ীরা পঁচা লোক - এই জিনিস টা ইমপ্ল্যান্ট করাটা কি ঠিক হচ্ছে। ধুমপায়ীদেরকে আমার কাছে শুধুমাত্র ভিক্টিম বলেই মনে হয়।
উপরের মন্তব্যটা অনেক বেশি নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা হয়েছে। দূঃখিত
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
"বাবা, এটা খারাপ জিনিস, ফেলে দাও" এবং "একটা পঁচা লোক এটা খেয়ে ছাদে রেখে গেছে"। - এই কথাটা আসলে শুধু স্মোকিং এর জন্য বলা হয়নি।
আমরা তিন তলা একটা বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকি। সিলেটের পরিবেশ অনুযায়ী সবাই সবাইকে চেনে। ৪/৫টা বাচ্চা প্রায়ই ছাদে খেলে, এটা বিল্ডিং এর সবাই জানে। যে ওটা ছাদে ফেলে গিয়েছিল, তার কমনসেন্সের উপর মেইন বিরক্তিটা ছিল। আপনি কখনো বাচ্চা বড় করেছেন কিনা জানি না। সে যখন ওটা ফেলতে চাচ্ছিল না তখন ওইধরনের কথা বলা ছাড়া কাজ হওয়ার উপায় থাকে না। এখন পচা লোক কথাটা সব স্মোকারদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করাটা ঘটনাক্রমে অনুভব নিজে থেকে করে নিয়েছে।
আর নেগেটিভ দৃষ্টিভংগির কথাটা যে বললেন এই ব্যাপারে একটা কথা বলতে পারি। "আমার বাবা কখনো সিগারেট খাননি, আমি শখের বশেও কোনদিন একটা সিগারেট মুখে দিইনি। এর পরেও আমার ছেলে যখন আমার বাসার ছাদে একজনের কমনসেন্সের অভাবের কারনে সিগারেট হাতে নিয়ে ঘুরবে, অন্তত তখন কিভাবে পজিটিভ চিন্তা করতে হয় সেটা এখনো আমার জানা নেই। মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে কিছুদিন পড়ালেখা করলে হয়তো শেখা যাবে।"
সুমন_সাস্ট
ব্যাটা মরবি মর ভালো কথা, তা আমাদের কেন খামোখা যন্ত্রণা করিস!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়াকে অস্লীল ঘোষণা করা হোক...
আইডিয়াটা পছন্দ হয়েছে। একটু অন্য রকমও হতে পারে, "অন্য কাউকে ধুয়া খাওয়ানোকে না"
সুমন_সাস্ট
আইডিয়াটা পছন্দ হয়েছে। একটু অন্য রকমও হতে পারে “অন্য কাউকে ধোঁয়া খাওয়ানোকে শারিরীক ও মানসিক অত্যাচার হিসাবে ঘোষনা করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।”
সুমন_সাস্ট
লেখাটা পড়ে তো অনুভবের গালটা টিপে আদর করে দিতে ইচ্ছা করল । আমার হয়ে আদরটুকু করে দিও ।
আন্দোলনের সাফল্য কামনা করি ! আচ্ছা, ক্যাম্পাসে কিছু জায়গাকে 'স্মোকিং জোন' হিসেবে ঘোষণা করা যায় না ? যাদের সিগারেট খেতে ইচ্ছে করবে তারা সেইসব জায়গায় যেয়ে খাবে আর যারা সিগারেটের ধোঁয়া এড়াতে চায় তারা সেসব জায়গা এড়িয়ে চলবে ! ধোঁয়া না খাওয়াও যে নন-স্মোকারদের অধিকার -- এ ব্যাপারে সবার সচেতনতা খুবই জরুরি ! ভালো থাক -- লেখালেখি আর আন্দোলন চালিয়ে যাও -- অনেক শুভ কামনা !
----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!
ভালো হয়েছে
অনুভবদের সাথে সিগারেটের এমন পরিচয় ভাবিয়ে তুলল বটে।
সত্যিকার অর্থেই ভাবনার বিষয়।
সুমন_সাস্ট
লেখাটা আগে পড়া হয়নি (সচলায়তনে নতুন) । যাই হউক ভাল লেগেছে । কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা অন্যরকম মনে হল । আমার ধারনা শুধু বাচ্চারা কেন বড়রাও একি কাজ ই করে (যদিও বাচ্চাদের টা আমাদের চোখে পরে খুব সহজে )। যে সব ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকে ওই সব ব্যাপারে সবার (বিশেষ করে বাচ্চাদের) আগ্রহও থাকে বেশি। আমার মনে হয় নিষেধ বা খারাপ বলার চেয়ে বেপারগুলুকে অন্যভাবে যদি কাটিয়ে নেয়া যায় সেটাই ভাল।
--সচল দর্পণ ।
নতুন মন্তব্য করুন