রাষ্ট্রের কথা এবং মানুষের কথা বলতে গেলে ধর্ম ও শ্রেনী বিভেদ এই দুইটি প্রসংগ চলে আসে অবধারিত ভাবে। আমার কাছে ধর্ম মানুষের ভাষার মতই একটি অংশ। পৃথিবীর সমস্ত কিছু যেমন গতিশীল, সর্বদা পরিবর্তনশীল, তেমনি ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি সর্বদা পরিবর্তনশীল। এক সমাজের ভাষার সাথে অপর সমাজের ভাষার সংমিশ্রনের ফলে তাদের মাঝে এক ধরনের আদান প্রদান ঘটে। সে পরিবর্তন খুব ধীরে ঘটে থাকে, কিন্তু তা চোখে পড়ার মত। আজ আমাদের ভাষায় ইংরেজীর অতি মিশ্রন, সেরকম একটি রুপান্তর এর বহিঃপ্রকাশ। আমাদের সংস্কৃতিতে হিন্দি এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উপস্থিতিও চোখে পড়ার মত। এ ধরনের পরিবর্তন আমার আপনার ভাল লাগুক বা না লাগুক তাতে সমাজের কিছু আসে যায়না। আপনি আপনার সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম আরো বেশি করে আকঁড়ে ধরতে পারেন। তাতে পরিবর্তনের গতিটাকে কমাতে পারবেন কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারবেন না। একে আমি তুলনা করবো নদীর প্রবাহের সাথে। আপনি বাঁধ দিয়ে নদী প্রবাহকে থামাতে পারবেন না, সে যেদিক দিয়ে পারবে সেইদিক দিয়ে বয়ে যাবে। মানুষের মাঝে পরিবর্তনটি সেরকম। যখন তার মাঝে পরিবর্তন এর জোয়ার আসবে তখন সে নিজের অজান্তেই সে জোয়ার এর অংশ হয়ে যাবে। এটাই মানুষের চরিত্র।
সেইদিন হয়তো বেশী দূরে নয়, সহস্র বছর কিংবা তারও কম সময়, যখন মানুষের মাঝে কেবল একটি ভাষা, একটি সংস্কৃতি, একটি শ্রেনী এবং একটি ধর্ম বিদ্যমান থাকবে। সেই ধর্ম হবে মানব ধর্ম। যেখানে কোন মহাপ্রভু বসে থাকবে না মৃত্যুর পরে পাপীদের শায়েস্তা করার জন্য। যেখানে সকল মানুষ হবে আক্ষরিক অর্থে সমান। যেখানে মানুষকে কোন কাল্পনিক মহাপ্রভুকে উদ্দেশ্য করে সেজদা করতে হবে না। যেখানে মানুষ নিজেই তার নিয়তি ঠিক করবে। বিজ্ঞান হবে তার পথ পদর্শক। যে বিজ্ঞান মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করবে, নয় ধ্বংসের জন্য।
শ্রেনীভেদ মুক্ত সমাজ হতে পারে সবার শেষ পর্যায়ে। তার আগে মুক্ত হতে হবে ধর্ম, ভাষা এবং সংস্কৃতির বিভেদ। যতদিন এই বিভেদগুলোর একটিও বর্তমান থাকেব ততদিন শ্রেনীবিভদ থাকবে। তবে এটা ঠিক যে, সবকিছুর মত মানুষের শ্রেনী বিভেদও সাম্যব্যবস্থার দিকে থাবিত হচ্ছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃত শ্রেনীবিভেদ দূর করা সম্ভব কেবল শ্রমের প্রয়োজন বিলুপ্তির মাধ্যমে। যখন শিল্প-কারখানায় কিংবা বাসা বাড়িতে কিংবা অফিস আদালতে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ গুলো সয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় অথবা রোবটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাবে তখ্ন শ্রমের প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। উন্নতদেশ গুলোয় জনসংখার ঘাটতি থাকায় তারা সব ক্ষেত্রেই কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থার ব্যবহার বেশি করছে। সেখানে মানুষের জীবনযাত্রার মান এক ধাপ এগিয়ে অনুন্নত দেশগুলোর তুলনায়। তবে যতদিন মানুষের আধিক্য থাকবে ততদিন মানুষ নিজের প্রয়োজনেই শ্রমের প্রয়োজন বাচিয়ে রাখবে। শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলে গেলেই শ্রেনী বিভেদ দূর হয়ে যাবে না। শ্রমিক শ্রেনী ক্ষমতার অংশ হয়ে গেলেই শ্রমের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে না। তবে শ্রমিকদের নুন্যতম মৌলিক আধিকারগুলো (খাদ্য, বাসস্থান, চিকিত্সা, এবং শিক্ষা) বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরি, এবং তার জন্য আন্দোলন হতে পারে। প্রকৃত শ্রেনীবিভেদ মুক্ত সমাজ একটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
সেরকম প্রকৃত ধর্ম বিভেদ দূর হওয়াও দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে এই ঈশ্বরযুক্ত ধর্ম হতে মানুষ মুক্ত হতে পারবে। মানুষের মনে ঈশ্বরের এই অবস্থান মানুষের জন্ম লগ্ন থেকেই। আমারা যদি একটু মানব সভ্যতার ইতিহাসটিকে পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাই যে মানুষ চরিত্রগত ভাবে খুব দুর্বল প্রকৃতির। কিন্তু তার বেঁচে থাকার আকাঙ্খা অত্যন্ত প্রবল। যে কোন অবলম্বনে সে বেঁচে থাকতে চায়। মানব সভ্যতার একদম আদিম যুগে যখন সে কিছুই জানতো না, তখন সে রাতের অন্ধকারকেই ভয় পেত। সে কামনা করতো যেন এই অন্ধকার চলে যাক, এবং সুর্য যেন অতিসত্বর চলে আসুক। পরবর্তীতে যখন সুর্য উদয় হয়, সে ভাবে কেহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছে। সেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকুক বা না থাকুক তার কাছে প্রাধান্য পায় তার সাময়িক মুক্তি, এবং তাতেই সে আনন্দিত। অতপর সে যখন আগুন আবিষ্কার করলো, রাতের অন্ধকারকে তার আর তেমন ভয় লাগে না, কিন্তু এখনো প্রাকৃতিক দূর্যোগকে তার ভয় লাগে। ওই কালো মেঘ, বিকট শব্দে পতিত বজ্রপাতকে তার বড় বেশি ভয় লাগে। সে গুহায় বাস করিতে শিখল। সংঘবব্ধ ভাবে বাস করা শিখল। কৃষিকাজ, পশুপালন করা শিখল। কিন্তু প্রাকৃতিক দূর্যোগ, মহামারী রোগ, অনিশ্চিত বিপদ তাদের পিছু ছাড়ে না এবং ঈশ্বরের প্রয়োজনও তাদের ফুরিয়ে যায় না।
মানুষে মানুষে ছোট পরিবার হয়, পরিবার থেকে সমাজ হয়, বিভিন্ন গোত্র হয়। গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ হয় পানির জন্য, খাবারের জন্য, নারীর জন্য, ক্ষমতার জন্য, সর্বোপরি বেঁচে থাকার জন্য। সেই যুদ্ধে জেতার জন্য ঈশ্বরের প্রয়েজনীয়তা নুতন করে অনুভিত হয়। ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজ, গোত্র, মিলে রাষ্ট্র গঠিত হয়। রাষ্ট্র মানুষের দায়িত্ব নেয়। মানুষ কাজ করে নিজের জন্য এবং রাষ্ট্রের জন্য। মানুষ এখন অনেক সংগঠিত। মানুষের হাতে ব্যবহার করার জন্য অনেক নুতন যন্ত্র, যা দিয়ে সহজেই পর্যাপ্ত ফসল ফলানো সম্ভব হয়। এই প্রথম কিছু মানুষের হাতে বাড়তি সময় থাকে চিন্তা করার জন্য। মানুষ চিন্তা শুরু করে। প্রশ্ন করে কে আমি? কে আমাকে সৃষ্টি করেছেন? ঈশ্বর কে? ঈশ্বরের অবস্থান কোথায়? দেখা যায় ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারনা মোটেই পরিষ্কার নয়। কিন্তু ঈশ্বরের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে। ঈশ্বরকে তারা অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখাতে সাহস পায়না। তাই ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করা তাদের বিশেষ প্রয়োজন। ঠিক এরকম একটি সময়ে মানুষ ঈশ্বরকে কল্পনা করে, রুপায়িত করে এবং হরেক রকমের বিশেষণে ভুষিত করে। কিন্তু রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সে সংজ্ঞা, বিশেষণ ভিন্ন হয়। যার দরুণ পূর্বে যে যুদ্ধ ছিল শুধু রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র, তা এখন হল ঈশ্বর বনাম ঈশ্বর। এই ঈশ্বর বনাম ঈশ্বরের যুদ্ধ আজো সভ্য সমাজে বংশ পরম্পরায় আমরা বয়ে চলছি।
যুদ্ধ মানুষকে আরো অমানুষ করে দেয়। মানবের যে মানবীয় গুণগুলো মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীবে পরিনত করে সে গুণগুলো চাপা পড়ে গেল যুদ্ধের মানসিকতার ফলে। হিংসা, বিদ্বেষ, শ্রেনীভেদ বহুগুনে বেড়ে গেল এবং তা মানুষের চরিত্রের অংশ হয়ে গেল। এর মাঝেও বিক্ষিপ্ত কিছু মানুষ সর্বদা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, যাদের আমারা বলে থাকি দার্শনিক। কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষের তুলনায় সে সংখা ছিল এতই নগন্য যে তারা শুধু ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল। এর মাঝে কিছু ঈশ্বর প্রেরিত দাবীকৃত কিছু পুরুষ এর আগমন ঈশ্বরের মহিমাটিকে আরো কয়েকগুনে বৃদ্ধি করে দিল এবং বলা যায় আমাদের ধর্মের সাম্যবস্থায় যাওয়াটিকে সহস্র বছর পিছিয়ে দিল। বলাই বাহুল্য ঈশ্বরের হাত ধরে তাদের সাম্রাজ্য সারা বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়লো অগনিত মানুষের প্রানের বিনিময়ে। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা, শোষনের প্রয়োজনীয়তা আর দূর্বল মানুষের ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা কখনই বিলীন হয়নি মানুষের মন থেকে।
তারপর শুরু হয় সভ্যতার নুতন যুগ। বিজ্ঞানের যুগ, যুক্তির যুগ। মানুষ বিজ্ঞানকে চিন্তে শুরু করেছে। মানুষ যুক্তিকে বুঝতে শুরু করেছে। মানুষ শুধু প্রশ্ন করতে শিখেনি, মানুষ শিখেছে কিভাবে ধারাবাহিক ভাবে প্রশ্ন করে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া যায়। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু আবিষ্কার করতে শুরু করেছে। এক একটি বিজ্ঞানের আবিষ্কার তাকে আরেকটি নুতন আবিষ্কারের নেশায় মাতিয়ে তুলে। কিছু মানুষ এখন আর নিজেদের নিয়ে চিন্তা করে না। তারা সমগ্র মানবকূলের কথা চিন্তা করে। বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কার তাই মানুষের জীবন ধারাকে বদলে দিল। গাড়ি হল, জাহাজ হল, কল কারখানা হল। পৃথিবী গতিময় হল, পৃথিবী ছোট হয়ে এল, একে অপরের কাছাকাছি হল, ধর্ম ভাষা সংস্কৃতির আদান প্রদান হল। কিন্তু মানুষের মাঝে লুকায়িত স্বার্থপরতার বীজ কখনই দূর হয়নি। তাই বিজ্ঞানের অগ্রগতি সত্বেও কিছু মানুষের হঠকারিতার জন্য শুরু হল নুতন সমস্যা, যার নাম সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদের নেশায় এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিল। এই সাম্রাজ্যবাদ এসেছে কখনো পুজিবাদী রাষ্ট্র থেকে, কখনো সমাজতন্ত্রবাদী রাষ্ট্র থেকে আবার কখনো ধর্মবাদী রাষ্ট্র থেকে। ধর্মবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুজিবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ সব সমার্থক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের জয়যাত্রা কখনই থেমে থাকেনি। মানুষ যত বেশী জেনেছে, মানব ধর্ম তত বেশী সমৃদ্ধশালী হয়েছে। মানুষ জেনেছে কেন প্রতিদিন সূর্য অস্ত যায় আবার ঊদিত হয়, মানুষ জেনেছে কেন কালো মেঘ হয়, কেন বজ্রপাত হয়, কেন প্রাকৃতিক দূর্যোগ হয়, কেন মহামারী হয়। তাই ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এসেছে পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে।
কিন্তু আজো মানুষের মাঝে সংঘাত রয়েছে। এখনো সাম্রাজ্যবাদ রয়েছে, শ্রেনী বিভেদ রয়েছে, শোষণ রয়েছে, অনিশ্চয়তা রয়েছে। আগে যে মানুষের অনিশ্চয়তা ছিল শুধু রাতের অন্ধকারে, কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগে আজ সেটা ভর করেছে এক বেলা খাবার আয়োজনের অনিশ্চয়তায়, ক্যান্সার এইডস এর মত প্রানঘাতী রোগের অনিশ্চয়তায়, আত্মঘাতী বোমা হামলার মত অনিশ্চয়তায়। বিজ্ঞান এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আজো আমরা সকল রোগকে জয় করতে পারিনি, এবং যা পেরেছি তা সকল মানুষের দুয়ারে পৌছে দিতে পারিনি। তাই আজো মানুষ অসুস্থ হলে, প্রিয়জন মৃত্যুর মুখোমুখি হলে কিংবা অজানা বিপদের সম্মুখিন হলে ঈশ্বর এর উপর ভরসা করে। ঈশ্বরের প্রয়োজন আজো তাই ফুরিয়ে যায়নি অনেক মানুষের কাছে।
তাই বলে কি আমরা ঈশ্বর বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করবো? অবশ্যই নয়। তারা দুর্বল বলেইতো তাদের কাছে ঈশ্বর এর প্রয়োজনীয়তা এখনো রয়েছে। তাদের হাতটিকে যদি একটু সবল করে দেওয়া হয় তাহলে সে প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। তাই ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনাকারী সকল নিরীশ্বরবাদীদের বলবো- কল্পনার ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধ করা চলে না। আপনার যুদ্ধ ঘোষনায় সে আরো বেশী ভীত হয়ে পড়বে এবং আরো বেশী করে ঈশ্বরকে আকঁড়ে ধরবে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যান বিপুল গতিতে, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করুন, দেখবেন তাদের ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে আজি হতে সহস্র বছর পরে।
মন্তব্য
যতদিন মানুষের মরার পরেও বেঁচে থাকার শখ থাকবে, যতদিন "আমি যামু তুমি যাবানা হে হে" মনোভাব থাকবে ততোদিনে এমন কিছু হবে বলে মনে হয় না.. তবু আশাই একমাত্র ভেলা..
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
আপনার দাদা, বাবা, আপনি এবং আপনার ছেলে, শুধু এই চার পুরুষ প্রজন্ম এর মানসিকতার পরিবর্তন যদি খেয়াল করেন তাহলে পরিবর্তন কিন্তু চোখে পড়ে। আমি শুধু সেটাকেই আরো দূরে আর অতীতে কল্পনা করলাম মাত্র।
বেশ ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ সিরাত ভাই। ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম। দেখাই যাচ্ছে দর্শন এর লেখার পড়ার মানুষ খুব বেশী নেই, আর সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। তার উপর নিজের প্রথম লেখা দর্শন এর উপর, পাঠক ধরে রাখার মত করে লিখতে জানিনে। আপনার ভাল লাগা অনুপ্রেরনা হয়ে কাজ করবে। ধন্যবাদ।
সুন্দর লেখার জন্য অভিনন্দন!
সব মতের মিল আপনার সাথে হলেও শ্রেণী ভেদ নিয়ে একটু সন্দেহ রয়ে গেল।
হাজার বছর পরের পৃথিবী যদি শোষণ মুক্ত হয়ও, তার পরেও মানুষ জ্ঞন-বুদ্ধি বা কোন বিশেষ ক্ষমতার অহংকার ছেড়ে দেবে, সেটা ভাবতে সাহস পাই না। তবে মানুষ এখন কে নিয়েই বেশী ব্যস্ত। তাই আপনার চিন্তার শরিক খুব বেশী পাওয়া কঠিন। তাতে একজন দার্শনিকের সমস্যা হওয়ার কারণ নেই। আপনি লিখতে থাকুন। লেখা এবং লেখার মাল-মসলা দুটোই আপনার যথেষ্ট পরিমানে আছে।
প্রথম দিকে একটু কম পাঠকই নতুনদের লেখা পড়ে। আর যদি এই লেখাটার মত এত উচ্চ চিন্তাশীল লেখা হয় তাহলেতো আরো কম পাঠক পাবেন। সে নিয়ে ভাবনার কিছু দেখি না। ভাল কোন কিছুর প্রতি মানুষ সময়মত আকৃষ্ট হয় না।
সচলায়তনে স্বাগতম!
সচল থাকুন সচল রাখুন!
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ধন্যবাদ। শ্রেনীবিভেদ নিয়ে এখানে না লিখলেও হত, কিন্তু লেখার সময় চিন্তার সাথে চলে এসেছে, বাদ দিতে পারিনি। তাই শ্রেনীবিভেদ নিয়ে চিন্তাটি পরিপূর্ণ নয় স্বীকার করছি।
এটা ঠিক হাজার বছর পরে কি হবে তা নিয়ে কেউই চিন্তিত নয়, মানুষ বর্তমান নিয়েই চিন্তিত। কিন্তু চিন্তাটি আমাকে হতাশাবাদী হওয়া থেকে বিরত রাখে। এই আমাকে চিন্তা করতে শেখায় যে সবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার ফলেই একদিন আমরা ধর্মহীন, শ্রেনীহীন সমাজ পাবো।তাই এখনই সাফাল্যের আশা না করে যার যার পক্ষ থেকে চেষ্টা করে যাই। এর মাধ্যমেই আমি আমার নিজের কাজের স্বার্থকতা খোঁজার চেষ্টা করি। আশা করি আরো কিছু চিন্তা উপহার দিতে পারবো।
ভাইয়া আপনার লেখাটা অন্তত ৭ থেকে ৮ বার পড়লাম, কিছু বিষয়ে দ্বিমত আছে কিন্তু যুক্তি খুজ়ে পাচ্ছিনা, আরেকটু সময় নিয়ে পড়ে মন্তব্য করব।
-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
দর্শন নিয়ে লেখা, তাই সময় করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। পড়তে পড়তে ইউটোপিয়ার স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। বাস্তবতা অনেক কিছুরই অনুমতি দেয় না, অনেক ভাবে মানুষের মনকে পঙ্গু করে রাখে। হয়তো সেজন্যই আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও আস্তিক।
ধর্ম হোক, বর্ণ হোক, সম্পদ হোক, যেকোন কিছু নিয়েই মানুষ গর্বিত হতেই পারে। এতে আমি দোষের কিছু দেখি না। স্বাতন্ত্র্য নিয়ে গর্ববোধ মানুষকে অভাবনীয় উদ্দম দিতে পারে। এ-ব্যাপারগুলো জাত্যভিমানের জন্ম না দিলেই হল।
ধর্ম যতক্ষণ পর্যন্ত হানাহানি সৃষ্টি না করছে, কিংবা সম্পদ যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যায় ভাবে অর্জিত না হচ্ছে, ততক্ষণ তাতে ক্ষতির কিছু আমি দেখি না। একটা সময় আমি সাম্যের স্বপ্ন খুব আক্ষরিক ভাবেই দেখতাম, এখন সেটাকে ডিসি সিগনালের স্বপ্ন মনে হয়।
তাই বলে কি স্বপ্ন থেমে যাবে? মোটেই না। স্বপ্নের সাথে আপোষ করা অনেক বড় অপরাধ। নিজেরই পুরনো একটা কথা আবার বলি -- দুটোর মাঝে অনেক মিল থাকা সত্ত্বেও স্বপ্ন পানির চেয়ে মূল্যবান। দুটোই বিনামূল্যে পাওয়া যায়, দুটোই মানুষ হেলায় হারায়। তবে পানির পরিশোধনাগার থাকলেও স্বপ্নের পরিশোধনাগার নেই। বাস্তবায়ন করতে হলে স্বপ্নকে বেহায়ার মত আঁকড়ে ধরে থাকতে হয়।
অতএব, আপনার ইউটোপিয়ার অবাস্তব স্বপ্নের সাথে এই অধমও পাশে আছে।
উত্তরাধুনিকতার ইতিহাসের সাথে পরিচিতি না থাকলে হয়তো কিছুটা দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে, তাই সারমর্মটা বলি। স্বপ্নের সাথে আপোষ করে আমরা সুশীলতা কিনি ন্যায়নিষ্ঠার দামে।
ভাষা প্রসঙ্গে
লেখক আপনার প্রথম লেখায় কয়েকটি সাহসী উক্তি আছে। প্রথম কথাটি ভাষা প্রশ্নে। পৃথিবীতে একদিন আমার আপনার প্রিয় বাংলা ভাষা থাকবে না এটা হজম করা সহজ নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে গত দুইশত বছরের পৃথিবীর বুক হতে দেড় সহস্রাধিক ভাষা হারিয়ে গেছে । অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ও হারিয়ে যাবে হয়ত। কেন ভাষা গুলো হারিয়ে গেচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি ভাষার ক্ষেত্রে তার একটা বিশেষ বিশেষ কারণ রয়েছে । আবার ধর্মে ক্ষেত্রে একই কথা সত্য । অনেক ধর্মও হারিয়ে যাচ্ছে্। আমি নিজে বাংলাদেশ থেকে একটা ধর্ম হারিয়ে যাওয়া বাস্তব অভিজ্ঞতা রাখি। ধর্মটির নাম ’সাংসারক’। নব্বই দশক পর্যন্ত বাংরাদেশে একজন সাংসারক জীবিত ছিলেন, সে সময় তার বয়স একশত কাছাকাছি। তার আত্মীয় পরিজন বহু আগেই খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। ধর্মটি আর বাংলাদেশে নেই। ভাষার মত এক একটি ধর্মেরও ক্রমাগত বিলুপ্তির এক একটি বিশেষ কারণ আছে। বিশেষ কারণগুলো একটু স্বচ্ছ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করলে সহজে পৃথক করা যায়। কিন্তু দৃস্টিকে আরেকটু প্রসারিত করলে, চিন্তা কে আরেকটু নিরেপেক্ষ একটু গভীর করলে এই বিশেষ কারণ গুলোর মধ্যে একটা সাধারন ঐক্য খুজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রত্যেকটি গটনার অন্তকরনে রয়েছে এক একটি বিশেষ কারণ ; একই সাথে সকলের রয়েছে একই সাধারণ কারণ। ঐক্য ও বিরোধ । দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। দ্বান্দিক বস্তুবাদী দর্শণ গত দিক থেকে আপনার চিন্তা কে ধাবিত করে দেখতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ; লেখক যে পাশ্চিম এর ভাষা সাংস্কৃতিক অগ্রাসন কে বাংলা ভাষার জন্য হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন
সে ভাষার নিজের স্বত্তার কি দশা একবার চোখ রাখুন। বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রাসী ভাষা নিশ্চয়ই ইংরেজি । এক গবেষনা রিপোটে দখা গেছে এক মাত্র ভারতের ছাড়া বিশ্বে কোথাও ইরেজি তার মৌলিক কাঠামো নিয়ে টিকে নেই। সার কথা হচ্ছে , বস্তু জগতে সবকিছু পরিবর্তন শীল , আপনার ভাষায় প্রবাহমান নদীর মত। কিন্তু চরম বাস্তবতা হচ্ছে যে, যার প্রভাবে অন্যরা পাল্টে যাচ্ছে সে নিজেও কিন্তু অপরকে প্রভাবিত করতে যেয়ে পাল্টাচ্ছে ; ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। কিস্তু , পরিবর্তনই যদি বাস্তবতা হয় ; তবে কেন সংরক্ষনের জন্য এতো চেষ্টা্। কেন আমরা বাংলা ভাষা সাংস্কৃতি ভাষা জন্য এত উদগ্রীব হব ?
আপনি বলেছেন ” আমাদের সংস্কৃতিতে হিন্দি এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উপস্থিতিও চোখে পড়ার মত। এ ধরনের পরিবর্তন আমার আপনার ভাল লাগুক বা না লাগুক তাতে সমাজের কিছু আসে যায়না। আপনি আপনার সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম আরো বেশি করে আকঁড়ে ধরতে পারেন। তাতে পরিবর্তনের গতিটাকে কমাতে পারবেন কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারবেন না। একে আমি তুলনা করবো নদীর প্রবাহের সাথে।
স্রোতসীন নদীতে ছোট্ট নৌকায় আপনি। এ ক্ষেত্রে আপনা করণীয় চারটি বিকল্প থাকে।
এক) আপনি হাত পা গুটিয়ে হার ছেড়ে বসে তাকুন , ঈশ্বরের নাম জপুন। বিশে্ষ সম্ভাবনা অতলে তলিয়ে যাবার।
দুই) নঙ্গর ফেলে বসে থাকুন। নঙ্গর ছিড়ে না গেলে , রক্ষা হতে পাওে একদিন ; তবে তখন নদীটাই হারিয়ে যাবে।
তিন) শক্ত হাতে হালধরুণ স্রোতে অনুকূলে। নিজ গন্তব্যে পৌছাবেন না কখনও কিন্তু বেচে যাবেন।
চার) চিত্তে যদি সাহস থাকে পেমীতে যদি বল থাকে , লড়াই করুন স্রোতের সাথে।
বিশ্ব ভাষার একীভবন প্রক্রিয়া কালে প্রয়োজন বিশ্ব ভাষা ভান্ডাওে ভাল কিছু দেওয়ার সংগ্রাম টা জরুরী।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য। আপনি আমার লেখার মুল সুরটি ধরতে পেরেছেন এইজন্য আবারো ধন্যবাদ। আপনার কথাতেই বলিঃ চরম বাস্তবতা হচ্ছে যে, যার প্রভাবে অন্যরা পাল্টে যাচ্ছে সে নিজেও কিন্তু অপরকে প্রভাবিত করতে যেয়ে পাল্টাচ্ছে ; ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। সুতরাং পাশ্চাত্য সংষ্কৃতি, পাশ্চাত্য ভাষা, এরও পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তন কোথাও ধীর আবার কোথাও ধ্রুত। কিন্তু সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে এটাই বাস্তবতা। নিজের সংষ্কৃতি, ভাষা, বা ধর্ম হারিয়ে যাক এটা কে চায়, কেউই চায়না। নিজের মরণ কে চায়, কেউই চায় না, কিন্তু মরিতে আমাদের হয় একদিন সবাইকেই।
তবে সংগ্রামটি নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। প্রথমে আমাকে জানতে হবে আমি কার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি এবং কেন করছি। আমি মনে করি সংগ্রামের উদ্দেশ্য হতে পারে শ্রেনীবিভেদটিকে সাম্যবস্থায় নিয়ে যাবার জন্য সাহায্যের উদ্দেশ্যে। পুরোপুরি শ্রনীবিভেদ দূর হয়ে যাবে এক সংগ্রামের মাঝে দিয়ে এ ধরনের চিন্তা করা আমার জন্য ভীষন কষ্টকর। সে কারনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে ধর্মের কুসংস্কারগুলো কে দূর করার জন্য সংগ্রাম হতে পারে। ভাষা কিংবা সংষ্কৃতি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই তেমন। কারন ভাষার বিভেদ কিংবা সংষ্কৃতির বিভেদ মানুষকে দূরে ঠেলে দেয় খুব কমই।
আর সংগ্রামের ধরণটি নিয়েও আমি নিশ্চিত নই। সংগ্রাম মানেই রক্তঝরা আন্দোলন হতে হবে সে ব্যাপারেও আমি সন্দিহান। আসলে আমি নিজেই নিজেকে খুঁজছি এই লেখার মাধ্যমে। দেখা যাক স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে কোথায় যায়। সময় হচ্ছে সবচেয়ে বড় ঈশ্বর। সময়ই একদিন বলে দিবে এই পৃথিবীতে কে বেঁচে থাকবে আর কে হারিয়ে যাবে।
আপনার লেখায় মানব সমাজে ভাষা ও ধর্মের ভূমিকাকে একই কাতারে হাজির করা হয়েছিল। সে টা যদি নিছক পরিবর্তনশীলতার উদহারণ অর্থে হয়ে থাকে , তবে কোন বিরোধ নেই। যেমন মানবসমাজে ধর্মের আবির্ভাব ভাষার উৎপত্তির তুলনায় অনেক নবীন , তেমনি শ্রেনীর বিকাশের সাথে সাথে ভাষা ও ধর্মের ভূমিকা অভিন্ন নয়। তাই আমি ধর্ম ও ভাষা প্রসঙ্গ একই সাথে উত্থাপনের বিষয়ে স্পর্শকাতর। আমি আপনার সাথে সহমত পোশন করি যে, ধর্ম ও ভাষা সদা এক পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এবং এই পরিবর্তনশীলতা কে অস্বীকার করে মূল আকড়ে থাকা সমাজ প্রগতি বিরোধীতা , মৌলবাদীতা।
আদিম সাম্যবাদী সমাজে ধর্মের অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্ত্ব ছিল না । ধর্মের উৎপত্তি সামজে শ্রেনী বিভাগ আবির্ভাবের পরে । সুতরাং শ্রেনীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ধর্মের ভুমিকার চুড়ান্ত হবে এবং ধর্মেও প্রগতিশীল বিকাশমান ভুমিকা আজ আর কোন সুযোগ নাই। ্অপর দিকে , ভাষার উৎপত্তি পশু স্তর হতে মানব সমাজের র্সজনশীল বিকাশের মাধ্যমে। তবে আমি মনে করি ভাষার বিকশিত হবার প্রয়োজন এখনও ফুরিয়ে যায় নি এবং যে প্রক্রিয়ায় ভাষা সমূহ হারিয়ের যাচ্ছে বা স্বকীয়তা হারাচ্ছে তা মানব সমাজের বিকাশের সাথে সামাঞ্জস্য পূর্ন নয়।
লেখার প্রথম কিস্তিতে আমি ভাষাকে আলাদা প্রসঙ্গে হিসাবে উপস্থাপন করেছিলাম। কিন্তু , এর অর্থ এই নয় যে মানব সমাজের বিকাশের সাথে সাথে মানুষের ভাষা বিকশিত হয়নি কিংবা মানুষের ভাষা সমাজবিকাশের সমীকরণ হতে পৃথক বা সম্পর্কহীন। বরং এটা বড় সত্য যে , মানব সমাজ বিকাশের সকল নিয়ামক যেমন উৎপাদিকা শক্তিকে পরিমান ও গুনগত ভাবে বিকশিত করেছে , ঠিক তেমনি মানুষের ভাষা-সাংস্কৃতি কে গুনগত ও পরিমান গত ভাবে বিকশিত করেছে।
উদহারণ সরূপ অষ্টাদশ শতাব্দির বাংলা বা বঙ্গদেশের দিকে তাকানো যায়। এতদাঞ্চলের ক্ষয়ীসনু সামন্ততন্ত্রে আর পুঞ্জিভূত বণিকী পুজি সংঘাত কালে ইংরেজরা বাংলা তথা ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করে প্রাথমিক ভাবে পাশ্চাতের বিকাশমান শিল্পের কাঁচা মাল সংগ্রহের আকাঙ্খায়। কিন্তু, বিকাশমান ব্রিটিশ পুজিবাদের প্রভাবে বা সংস্পর্শে ইংরেজদের আকাঙ্খার বিপরীতে ভারত উপনিবেশে মাত্র এক শত বছরেরও কম সময়কালের মাঝে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় এক নতুন শ্রেনী হিসাবে এদেশীয় বুর্জেøায়াদের আবির্ভাব ঘটে এবং সেই সাথে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ। ভারত বর্ষেও তথা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের এই অভাবিত ঘটনার সাথে সাথে সহস্র বৎসরের বাংলা ভাষা সাংস্কৃতিতে এক নব ধারার বা বৈপ্লবিক যুগের সূচনা হয়।
ইংয়াঙ্গ বেঙ্গল নামক তরুণ সমাজ পাশ্চাৎ সংস্কৃতির অনুকরণে বাংলা ভাষার নব জাগরণ সূচনা করলেও অল্প সময়কালের মাঝেই বিকাশমান বুর্জেøায়া শ্রেনীর চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলা ভাষা পশ্চাৎ সাংস্কৃতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যেও বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। বিপরীত ক্রমে বিকাশমান ভাষা-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ক্ষুদিরাম-বাঘা যতীন আর সূর্য সেনে কিংবা সুভাষ বোসের মত বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ, কাঠামো গত ভাবে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় অভ্যন্তরে পশ্চাৎপদ বাংলা ভাষা সাংস্কৃতি বিলুপ্ত বা ’বাংলিশ’ না হয়ে আরও বিকশিত হয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কে বেগবান করেছে, শক্তি যুগËিয়ছে।
বিপরীত ভাবে , সারা বিশ্বে পুজিবাদ নিজেই আজ ক্ষয়ীসনু ,পুজি তার অস্তিতের প্রয়োজনে সামাজ্যবাদেও রূপ নিয়ে দেশে দেশে অগাÞসন চালাছে। এ অগ্রাসন একদিকে যেমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অপর দিকে ভাষা ও সাংস্কৃতিক উপরে। আজ বাংলাদেশ নামক ভূ-খন্ড স্বাধীন হওয়া স্বত্ত্বেও পাশ্চাৎ সাংস্কৃতি ( ইংরেজি ও হিন্দি কিংবা আরবীয়) এক বিরাট চ্যালেঞ্জে হিসাবে এসেছে। আমাদের দেশের পুজিপতি শ্রেনী ও শাসক শ্রেনী তার সকল প্রগতিশীল চরিত্র হারিয়েছে। তাদের কাঙ্খিত শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য এমন এক ভাষা-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল দরকার , যা শোষিত শ্রেনী কে স্বপ্ন দেখানোর সকল উপাদান বিহীন হয়। তার জন্য সৃজন শক্তিহীন পাশ্চাৎ প্রভাব দুষ্ট ভাষা-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল সর্বোৎকৃষ্ট।
লেখক আপনার সাথে সহমত পোষন করছি যে, মানব সমাজ বিকাশের ইতিহাস নিবিচ্ছিন্ন শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস। পুজি আজ যে বদ্ধ কুয়োয় আটকা পরেছে , সেখান থেকে মানব সমাজ কে মুক্ত করার একমাত্র ত্রাতা শ্রমিক শ্রেনী। উৎপাদিক শক্তির বিকাশের জন্য , মানব সভ্যতার অস্তিত্ত্বেব প্রশ্নে চাই শিক্ষিত উন্নতর সাংস্কৃতিক শ্রমিক শ্রেনীর নেতৃত্বে চুড়ান্ত শ্রেনী সংগ্রাম। এই আলোকিত শ্রমিক শ্রেনী গড়ে তোলা জন্য যদি ভাষা-সাংস্কৃতিক শক্ত ভীত রক্ষা আন্দোলন কে কোন ভাবে শ্রেনী সংগ্রামের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখবার অবকাশ রাখে না ।
বিপরীত ভাবে এটাও সত্য যে, শ্রেনী সংগ্রামের উপলদ্ধি ব্যতিত ভাষা-সাংস্কৃতি রক্ষা প্রয়াস সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চেতনা অংশ এবং বিশ্বে ব্যাপী ঘনায়মান জাতিগত বিরোধ প্রাথমিক পদক্ষেপ।
প্রিয় লেখক
আপনার এই লেখাটির বিষয়ে আমার একজন বন্ধু, প্রকৌশলী তারেক, প্রায় মাসখানেক আগে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তখন আমি একদফা লেখাটি পড়েছি, এবং পরে প্রিন্ট করিয়েও পড়েছি। কিন্তু মন্তব্য করেত আসা হয়নি।
আপনার লেখাটি চিন্তাশীল নিঃসন্দেহে। এই ভাবনা কি আপনার স্বতোৎসারিত নাকি কারো প্রভাব-প্রসূত জানতে আগ্রহ হয়। যদিও কারো কোনো ভাবনাই নিতান্ত স্বতোৎসারিত হয় না, অপর কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার প্রভাব তার মধ্যে থাকেই। যাক এ প্রসঙ্গ।
বর্তমান পৃথিবী, এবং বাংলাদেশ-ও, এমন একটি ক্রান্তিকাল পার করছে যে যে-কোনো সুস্থ-সৎ-বিবেকবান-মননশীল মানুষের পক্ষে মস্তিষ্ক অচল করে রেখে বসে থাকা সম্ভব নয়। দুনিয়ার এ প্রান্তে-ও প্রান্তে 'দিন বদলের হাওয়া' বাস্তবে বইতে থাকুক আর না থাকুক, আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে, পরিবর্তন কি হবে না? দিন কি আদৌ বদলাবে না? নাকি সাধারণ মানুষের হতাশাবাদী কথাটাই সত্য হবে - 'যায় দিন ভাল আসে দিন খারাপ'! আমরা স্থির থাকতে পারছি না।
আপনার লেখায় সাধারণ যে বিষয়গুলো এসেছে তা নিয়ে আমার কোনো ভিন্নমত প্রকাশ করার জন্য লিখতে বসিনি। বরং দু'একটা জায়গায় আপনার লেখা আমাকে অভিভূত করেছে। বিশেষত আপনি ধর্মবিশ্বাসীদের সাথে আমরা যারা যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, সেক্যুলার চিন্তার মানুষ, আমাদের মনোভাব কি হবে, তাদের সম্পর্কে আমাদের কর্মনীতি বা কর্মকৌশল কি হবে সেটা আপনি যখন বলেছেন _ "তাই বলে কি আমরা ঈশ্বর বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করবো? অবশ্যই নয়। তারা দুর্বল বলেইতো তাদের কাছে ঈশ্বর এর প্রয়োজনীয়তা এখনো রয়েছে। তাদের হাতটিকে যদি একটু সবল করে দেওয়া হয় তাহলে সে প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে।" আপনি আপনার বোধের প্রশংসা না করে পারি না।
আমাদের চোখের সামনে, পরিচিতজনদের মধ্যে কেউ কেউ সামান্য দু'একটা যুক্তি-বিজ্ঞানের কথা শুনে বা বুঝে, ধর্ম এবং ধর্মবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে এমনভাবে উঠে-পড়ে লাগেন যে দেখে আমার কষ্ট হয়। তাদের ওইসব যুক্তির আঘাত যে দীর্ঘদিনের বিশ্বাস-সংস্কারে ফাটল না ধরিয়ে উল্টো আমরা যারা যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসহিষ্ণুতা বাড়িয়ে তোলে, যুক্তি এবং বিজ্ঞানক গ্রহণ করার রাস্তাটুকু পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়, তার ভুরি ভুরি উদাহরণ দেখতে পাচ্ছি। দু'একটা হয়ত ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যে অসহিষ্নুতার দায় ধর্মবিশ্বাসীদের ওপর আছে, আমরা তাদের চেয়েও বেশি অসহিষ্নু হয়ে উঠি। আমি নিজেও একসময় ওই কাতারভুক্ত ছিলাম, এখন টের পাই তা কত দায়িত্বহীনতা এবং নির্বুদ্ধিতা।
মানুষের প্রতি, আমার সমাজের প্রতি এই দায়বোধ, মমত্ববোধটাই হল আমার সেই অধিকার যে অধিকার নিয়ে আমি তাদের সাথে দ্বন্দ্বে-সংঘাতে লিপ্ত হতে পারি। আমার এ দায় এবং মমতার ছাপ যদি মানুষ দেখতে না পায়, তারা আমার শত ভাল কথা, ভাল পরামর্শ কিছুই গ্রহণ করবে না। মানুষের প্রতি দায়বোধ, মমত্ববোধ, কর্তব্যবোধ - এটাই হল আমার সেই আর্কিমিডয়ান পয়েন্ট যেখানে দাঁড়িয়ে আমি এ সমাজ পাল্টাতে চাই।
"সেইদিন হয়তো বেশী দূরে নয়, সহস্র বছর কিংবা তারও কম সময়, যখন মানুষের মাঝে কেবল একটি ভাষা, একটি সংস্কৃতি, একটি শ্রেনী এবং একটি ধর্ম বিদ্যমান থাকবে। সেই ধর্ম হবে মানব ধর্ম।" আপনার এ কথাটা আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি, কারণ এটাই মানবসমাজের ভবিষ্যৎ। কিন্তু এ ভবিষ্যৎ আপনা-আপনি নির্মিত হবে না, সচেতনভাবেই নির্মাণ করতে হবে।
এবার আপনার লেখায় যে দু-একটা দুর্বলতা আমার চোখে পড়েছে আমি সে-দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমার মতটা বিবেচনা করে দেখবেন।
আপনি পরিবর্তনের নিত্যতার কথা বলেছেন। "পৃথিবীর সমস্ত কিছু যেমন গতিশীল, সর্বদা পরিবর্তনশীল, তেমনি ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি সর্বদা পরিবর্তনশীল।" এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। পরিবর্তন চলছে ব্যক্তিতে, সমাজে, রাষ্ট্রে, ধর্মে, ভাষায় _ কোথায় নয়। পরিবর্তন তো ঘটছেই _ কোথাও আস্তে, কোথায় ধীরে, কোথাও দৃশ্যত আকস্মিক, কোথাও সযত্ন প্রয়াসে। এই হেরফের কেন হচ্ছে? আমরা পরিবর্তনকে চোখ বন্ধ করে উপেক্ষা যেমন করতে চাই না, তেমনি পরিবর্তন যেমন যেমন করে চলছে তার সে গড্ডালিকায় ভেসেও যেতে নিশ্চয় রাজি নই। তাহলে কি করব? আমার কথাটা ওই 'কি করব' কথাটা নিয়ে।
কি করব তা নির্ণয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা করতে পারব না যদি না আমরা জানি এ পরিবর্তন কেন ঘটছে, কিভাবে ঘটছে। পরিবর্তন তো কার্য, আমরা কারণটা জানতে না পারলে সেই কার্যের গতিমুখ ঠিক করব কিভাবে? আপনার লেখা পড়ে আমরা এটাই মনে হয়েছে যে আপনি ওই কারণ'টির দিকে মনোযোগ দেন নি।
আমরা যদি কারণ অর্থাৎ পরিবর্তন কেন হয়, এবং সেই পরিবর্তনের নিয়ম (ল') সম্পর্কে অন্ধ থাকি, পরিবর্তন ঘটতেই থাকবে, কিন্ত আমাদের আকাঙ্ক্ষার সাথে তার সঙ্গতি থাকবে না। পরিবর্তনের নিয়ম জানার মধ্য দিয়েই পরিবর্তনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যেতে পারব।
আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
ভ্যানগার্ড
প্রিয় পোষ্ট যোগ করলাম।
ধন্যবাদ।
লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো। করণীয় নিয়ে দ্বিমত নেই। একটি বিষয়, ভবিষ্যতে ভাষা এবং ধর্ম একটি হয়ে যাবে, এটা কি উচিত অর্থে বোঝাচ্ছেন নাকি নিয়তি অর্থে বোঝাচ্ছেন? মানে সভ্যতার আপন গতি কি সেদিকে এগোচ্ছে নাকি আমাদের উচিত সভ্যতাকে সেদিকে ধাবিত করা?
দুর্বল মানুষের জন্য ধর্মহীন জীবন হলো একটা বিপর্যয়, তাই তাদের সবল বা আরো বেশি সচেতন করে তোলার বিকল্প নেই, যুদ্ধ ঘোষণা করে তা হবে না। এ বিষয়ে আমি একশত ভাগ একমত।
--------------------------------
~পর্যবেক্ষণ-অসাধ্য তত্ত্ব অর্থহীন~
ধন্যবাদ। আমি আসলে নিয়তি অর্থেই বুঝিয়েছি। তবে নিয়তি হলেও আমরা যদি চেষ্টা করি তবে সেটিকে ত্বরান্নিত করতে পারবো।
দুঃখিত, আসলে মন্তব্য দিয়েছেন খেয়াল করতে দেরী হয়ে গেল। ব্লগ এখানে কিভাবে অনুসরণ করা যায় ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
"ত্বরান্নিত" করার কথা বললেন বলে আন্দাজ করছি আপনি এটাকে উচিতও মনে করেন। এটা নিয়ে হয়ত আপনার সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। আমার মতামত হচ্ছে, এটা কাম্য নয় যে সবার সুর একই হবে। এটা আমার বর্তমান ধারণা। আপনার লেখা অনুসরণ করতে করতে হয়ত আরো বিস্তারিত জানব আপনার ধারনাটা সম্পর্কে। এর ব্যাখ্যা যদি আপনি অন্য কোনো লেখায় দিয়ে থাকেন, তাহলে সরাসরি ওই লেখাতেই নির্দেশ করে দিন। নতুবা আমি তো ধীরে ধীরে আপনার লেখাগুলো অনুসরণ করছিই।
সংক্ষেপে আমার মত হলো, কেবল একটি সুর থাকলে মানুষের অপশন কমে যাবে। অপশন কমে যাওয়া মানে স্বাধীনতা কমে যাওয়া। সবার একই শাসনে একমত হওয়া কি সম্ভব?
--------------------------------
~পর্যবেক্ষণ-অসাধ্য তত্ত্ব অর্থহীন~
ব্লগ অনুসরণ করা আসলেই কঠিন, বিশেষ করে অনেক পুরোনো ব্লগ। আমি লিখেছিলাম যে কেউ মন্তব্য করলে বা প্রতিমন্তব্য করলে একটি নোটিফিকেশন পেলে ভাল লাগতো। সচলের নুতন এই প্লাটফর্মে সে রকম কিছু করার নাকি চিন্তাভাবনা আছে। দেখা যাক। তবে তুমি সচলে এই অনুসরণ এর মাধ্যমে যে সব ব্লগে তুমি মন্তব্য করেছো সেগুলোতে নুতন কোন মন্তব্য এসেছে কিনা দেখতে পাবে। তবে অনেক ব্লগে বিচরণ করা হলে এই পদ্ধতিতেও বেশি কাজ দেয় না।
বাকি বিষয়ে সময় করে আলোচনা হবে কখনো। এই এক মাস নয়।
নতুন মন্তব্য করুন