তিনঃ সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ
সমাজতন্ত্রের ধারণাও মার্ক্সই প্রথম বলেননি। ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯-১৭৯৯) আগে দার্শনিক রুঁসো (Rousseau, ১৭১২-১৭৭৮) রচনা করেছিলেন ‘সামাজিক চুক্তি (social contract)’। যেখানে তিনি বলেন- মানুষ জন্ম নেয় মুক্ত হয়ে, কিন্তু জন্মের পর দেখে চারিদিকে শুধু বাঁধার শেঁকল [১]। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বলেছেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা, যে আইন হবে সকল মানুষের নিজেদের তৈরী আইন- এক ধরণের সামাজিক চুক্তি [১]। রুঁসো সমাজতন্ত্রের কথা সরাসরি না বললেও তাঁর লেখায় ছিল নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির কথা। যে কারনে ফরাসী বিপ্লব যদিও রুঁসোর মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পর সংঘঠিত হয়, তারপরও ফরাসী বিপ্লবে রুঁসোর দর্শনের অবদান ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির চিন্তা মনে হয় মার্ক্স পেঁয়েছেন এই ফরাসী বিপ্লব থেকেই।
সেইণ্ট সিমন (Saint Simon, ১৭৬০-১৮২৫) ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের সন্তান। তাঁর মতে ভবিষ্যত সমাজে সকলকে অবশ্যই কাজ করতে হবে, এবং সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির স্থান নির্ধারিত হবে তার শ্রমের কৃতিত্বগুলো দিয়ে[২]। তবে রাজনীতিক সংগ্রাম ও বিপ্লব সম্পর্কে তিনি নেতিবাচক অবস্থান গ্রহন করেছিলেন। ফরাসী বিপ্লবে সর্বহারাদের শাসন কে আখ্যায়িত করেছেন ‘সন্ত্রাসের শাসন’ হিসেবে [৩]। তিঁনি চেয়েছিলেন সরকারি সংস্কারকর্ম আর এক নুতন ধর্মের চেতনায় সমাজের নৈতিক প্রশিক্ষনের ফলেই শ্রেনী-বিরোধের বিলুপ্তি ঘটবে [২], যা মার্ক্স এবং এংগেলস এর মতে ইউটোপিয়।
পরবর্তীতে ফুঁরিয়ে (Fourier, ১৭৭২-১৮৩৭), তাঁর লেখায় বুর্জ়োয়া সমাজের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তবে তিনিও হিংসাশ্রয়ী বিপ্লবের ধারণার বিরোধিতা করতেন এবং মনে করতেন যে ভবিষ্যত সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে শান্তিপূর্ণ প্রচারনের মধ্য দিয়ে-যেখানে লোকে কাজ করবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে [২]। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন, যে কোন একটি সমাজের সাধারণ মুক্তির মাপকাঠি হল সে সমাজের নারী মুক্তির মান [3]।
ইংলেন্ডে যখন শিল্প বিপ্লবের শুরু হয়, সে সময় ওয়েন (Owen, ১৭৭২-১৮৫৮) একটি সুতাকলের সুপারেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। তিনি মনে করতেন যে সামাজিক অসাম্যের প্রধান কারণ যথেষ্ট জ্ঞানালোকের অভাব যা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের দ্বারা দূর করা যায় [২]। তাই যেখানে অন্য কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করতো দৈনিক তেরো-চৌদ্দ ঘন্টা সেখানে তাঁর শ্রমিকরা কাজ করতো সাড়ে দশ ঘন্টা [৩]। তিনি শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য কিন্ডারগার্ডেন এর ব্যাবস্থা করেন। যখন কারখানা বন্ধ থাকে তখনো তাঁর শ্রমিকরা পুরো মজুরি পেয়েছে। এ সব সত্ত্বেও তাঁর কারখানার মুনাফা কম হয় না।
সেইণ্ট সিমন, ফুঁরিয়ে কিংবা ওয়েন এরা সবাই সামজিক অসাম্য দূর করতে চেয়েছেন সমাজকে সংস্কারের মাধ্যমে। শিল্প বিপ্লব ইংলেন্ডে সবে মাত্র শুরু হয়েছে, এমন সময় পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার স্বরূপ তাঁদের পক্ষে ধরা অসম্ভব ছিল আর তাই তাঁদের সমাজ সংস্কারের ধারণা ইউটোপিয় হতে বাধ্য বলেই মার্ক্স ও এংগেলস মনে করতেন [৩]।
মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়কালে আরো বেশ কয়েকজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন। যাদের মধ্যে প্রুধুন (Prudhon, ১৮০৯-১৮৬৫), বুকিনিন (Bukinin, ১৮১৪-১৮৭৬), এবং ব্লাঙ্কুই (Blanqui, ১৮০৫-১৮৮১) অন্যতম। প্রুধুন এবং বুকিনিন ছিলেন ণৈরাজ্যবাদী (Anarchsim) সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিতা। তাঁরা মার্ক্স এর শ্রমিক শ্রেনীর একনায়কতন্ত্রিক শাসনের বিরোধী ছিলেন। আর ব্লাঙ্কুই ছিলেন মুলত বিল্পবী চিন্তা ধারণার।
এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি তাতে দেখা যায় যে মার্ক্স এর সাম্যবাদ চিন্তার পেছনে যে সমস্ত মানুষের অবদান আছে তাঁরা হলঃ
১। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দর্শনঃ জার্মান দার্শনিক হেগেল।
২। বস্তুবাদ দর্শনঃ আরেক জার্মান দার্শনিক ফুয়েরবাখ।
২। সমাজতন্ত্র অথবা সাম্যবাদ এর প্রাথমিক ধারণাঃ রুঁসো, সেইন্ট সিমন, ফুরিয়ে, ওয়েন।
এর বাহিরে আরো কয়েকজনের কথা উল্লেখ করতে হয়। মার্ক্স এর বস্তুবাদী হবার পেছনে ডারউইন (Darwin, ১৮০৯-১৮৮২) এর বিখ্যাত ‘অন দা ওরিজিন অফ স্পিসিস’ এর অবদানও ছিল [৩]। মার্ক্স এর কাজকে দুভাগে ভাগ করা যায়। একটি মুলত দর্শন নিয়ে এবং আরেকটি হল অর্থনীতি নিয়ে। রাজনৈতিক অর্থনীতি (Political Economy) এর উপর মার্ক্সের বেশ কয়েকটি লেখা আছে যেখানে তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপর আলোচনা করেছেন। অর্থনীতি একটু কম বুঝি বিধায় সে গুলো নিয়ে আলোচনায় গেলাম না। রাজনৈতিক অর্থনীতির মুল ধারণা তিনি নিয়েছেন এডাম স্মিথ (Adam smith, ১৭২৩-১৭৯০) এবং রিকার্ডো (David Ricardo, ১৭৭২-১৮২৩) থেকে। এর মাঝে স্মিথ কে বলা হয়ে থাকে আধুনিক অর্থনীতির জনক হিসেবে। স্মিথ তার লেখায় প্রথম পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা এবং মুনাফার জন্য শোষন এর ব্যাপারটি তুলে এনেছিলেন, যা পরপর্তীতে মার্ক্সকে অনুপ্রানিত করেছে।
সর্বশেষ ব্যক্তিটি হল তাঁর বন্ধু এবং সহলেখক এংগেলস (Engels, ১৮২০-১৮৯৫)। মার্ক্স এর লেখায় আমি একধরণের অস্থিরতা লক্ষ্য করেছি, যা তাঁদের সম্মিলিত লেখায় নেই। আমার মতে তাঁর কারন এংগেলস এর লেখার ধরণ অনেক গোঁছানো। তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনা অনেক পরিষ্কার। এংগেলস অবশ্য নিজে স্বীকার করেন যে সাম্যবাদের মূল ধারণা মার্ক্সেরই [২], তথাপী এটাও অনস্বীকার্য যে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির স্বপ্ন এংগেলস নিজেও দেখতেন। মার্ক্স এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এর মাধ্যমে এংগেলস দেখলেন যে পুঁজি এবং শ্রেনীর দ্বন্দ্বটি প্রমান করা যায়। যে কারনে সাম্যবাদের বা মার্ক্সের দ্বন্দ্বমূল্ক বস্তুবাদের উপর বিজ্ঞানের তঁকমা লাগানোর কাজটিও তিনিই করেছেন তাঁর ‘ইউটোপিয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ লেখায় [৩]।
মার্ক্সের দর্শনের উপর তিন পর্বের বিশাল ভূমিকা এখানেই শেষ হচ্ছে। পরবর্তীতে আমরা সরাসরি মার্ক্সের ‘কমিউনিষ্ট পার্টির ইস্তেহার [২]’ এর মূল বক্তব্যগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
১.http://www.marxists.org/reference/subject/economics/rousseau/social-cont...
২. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1848/communist-manifesto/istahar.pdf
৩. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1880/utopia/Socialism,%20Utopian%20and%20Scientific.pdf
মন্তব্য
গুরুত্বপূর্ণ লেখা। শেষ করুন।
কি ধরনের অস্থিরতা? একটু যদি বুঝিয়ে লিখতেন!
ভাবছি, সবগুলো কিস্তি শেষ হলে একবারে পড়ব এবং তখন আলোচনা করা যাবেখন।
থাকতে না পেরে এখনই প্রথম কিস্তি পড়লাম। এক কথায় অসাধারণ! কেবলমাত্র খটমট ভাষায় লেখা বিদঘুটে বইপত্তর পড়ে এই বিষয়ে জ্ঞান আহোরণে কোনো শখ কখনই মনে জাগে নাই। কিন্তু আপনার পোষ্ট পড়ে উৎসাহ পাচ্ছি। প্রথম কিস্তির কমেন্টে আমি বেশ কিছু বালখিল্য প্রশ্ন করেছি, যেহেতু আমার দর্শনভীতি আছে, তাই সেগুলোকে হালকাভাবেই নেবেন, কিন্তু জবাব পেলে ভালো লাগবে। সেটা হলে, এই সিরিজ থেকে কিছু জ্ঞানার্জন করা সম্ভব।
ইশতিয়াক রউফ একবার বলেছিলেন, তিনি মাঝে মাঝে দর্শন, সমাজতন্ত্র- এগুলোর উপর পড়াশোনা করেন, তার এবং বদ্দাসহ অন্যসবার আলোচনায় অংশগ্রহন আশা করছি। বেশ জমবে মনে হচ্ছে।
এই পোষ্ট এখনও পড়ি নাই, পড়ে মন্তব্য করব আশা রাখি।
লিখতে থাকুন। আছি। শেষ হলে বাতচিত হবে।
আশা করি পরের পর্বে বাতচিতের জন্য অনেক মশল্লাই থাকবে
নতুন মন্তব্য করুন