প্রথম কিস্তি – দ্বিতীয় কিস্তি – তৃতীয় কিস্তি
চারঃ সাম্যবাদ
তাহলে ইউটোপিয় সমাজতন্ত্র আর কমিউনিজম বা সাম্যবাদের মাঝে পার্থক্য কি? মার্ক্স এর মতেই ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীরা চান সমাজের প্রত্যেক সদস্যের, এমনকি সবচেয়ে সুবিধাভোগীর অবস্থার উন্নতি করতে [১]। আর মার্ক্সবাদীরা চান কেবল শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি, যা কিনা হবে বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে [১]। মার্ক্স মনে করতেন না যে সমাজের সকল সদস্যের মুক্তি সম্ভব, তাই এই ধরণের যে কোন চিন্তা ইউটোপিয় হতে বাধ্য। এটা পরিষ্কার যে মার্ক্স নিজেকে মানবতাবাদী বলে মনে করতেন না, বরং মানবতাবাদীদের তিনি আখ্যা দেন রক্ষনশীল বলে যারা আসলে বুর্জ়োয়া সমাজ ব্যবস্থাকেই রক্ষা করতে চায় মানবতার আড়ালে [১]।
এবার দেখা যাক মার্ক্সবাদের মূল ধারণা কি এবং তা কিভাবে আসলো। মার্ক্স হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিকে বস্তুবাদের উপর দাঁড় করিয়ে দেখলেন যে আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস [১]। ডারউইন তার বিবর্তনবাদে যেমন দেখালেন যে প্রকৃতিতে সব সময় বিবর্তন হচ্ছে এবং যোগ্যতমরাই টিকে থাকছে, সে রকম মার্ক্সও দেখলেন যে মানব সমাজে সর্বত্র অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চলছে, এবং একটি সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার উপর আরেকটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। প্রাচীন রোমান যুগে ছিল দাসভিত্তিক সমাজ। পরে মধ্যযুগে সেটা ভেঙ্গে হয় সামন্তপ্রথা সমাজ। সামন্তপ্রথা হচ্ছে আমাদের উপমহাদেশের জমিদারী প্রথার মত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে মধ্যযুগে এই সামন্তপ্রথার সমাজই ছিল। আধুনিক যুগে সেই সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে হল বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থা যা মার্ক্স এর মতে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা। মার্ক্স এর মতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে মধ্যবিত্ত শ্রেনী পুরোনো সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করে আজকের এই সমাজ, যার সুচনা হয় ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে [১]।
আধুনিক এই বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট কি? ব্যক্তি স্বাধীনতা, অবাধ বানিজ্য, ব্যক্তি মালিকানা, পুঁজিবাদ। এ সবই হল বৈশিষ্ট, কিন্তু বুর্জ়োয়া বা পুঁজিবাদী সমাজের মুল দ্বন্দ্ব কি – তা হল পুঁজি এবং শ্রমের দ্বন্দ্ব। এখন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির নিয়ম অনুসারে এই পুঁজি এবং শ্রম তারা বিরোধাত্বক, অর্থাৎ তারা একত্রে অবস্থান করতে পারেনা। তারা একে অপরকে উচ্ছেদ করতে চায়। পুঁজির কাজ হল শ্রমকে শোষন করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। শ্রমিক শ্রেনী যতদিন পর্যন্ত না পুঁজিকে উচ্ছেদের মত শক্তি অর্জন করছে, ততদিন তারা সহবস্থান করবে। যখনি সেই শক্তি অর্জন করবে তখন পুঁজির পতন অনিবার্য। এই হল স্বল্প কথায় মার্ক্স এর মুল তত্ব।
এখন মার্ক্স এই তত্ব কিভাবে পেলেন? মার্ক্স(১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়টা এমনই যে তখন ইউরোপের চারিদিকে শিল্পের ব্যাপক প্রসার। স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারের ফলে সর্বত্রই কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এই সব কারখানায় কাজ করে প্রচুর শ্রমিক। ১৮২৫ সালে ইংলেন্ডে প্রথম একটি অর্থনৈতিক মন্দা আসে [২], যার কারনে প্রচুর শ্রমিক চাকুরী হারায়। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা তখন অঙ্কুরে বিধায় মন্দা প্রায় দশ বছর পর পর দেখা দিত [২], আজ যেটা অনেক বছর পর দেখা দেয়। ১৮২৫ সাল থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত এরকম মন্দা আসে পাঁচবার এবং ১৮৭৭ সালে আসে ষষ্ঠবার [২]। বলাই বাহুল্য যে মার্ক্স এই সব মন্দা এবং এর ফলাফল খুব কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং একই কথা প্রযোজ্য এংগেলস এর জন্য। এ কথা অনস্বীকার্য যে মার্ক্স পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে বেশ ভাল ভাবে ধরেছিলেন। কিভাবে এই মন্দা আসে এবং এই মন্দার চিত্র তিনি বেশ ভাল ভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। একের পর এক কারখানা গড়ে উঠার ফলে, উৎপাদন হয়ে যায় প্রচুর। এক পর্যায়ে অতিপ্রাচুর্যের ফলে অনেক উৎপন্ন পন্য অবিক্রিত থেকে যায়, কারখানা লোকসান দেয়। কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকেরা চাকুরী হারায়। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আরো কমে যায়, পন্য বিক্রি আরো কমে যায়। এভাবেই চলতে থাকে যা ঠিক হতে কয়েক বছর লেগে যায়- ঠিক যেন আমাদের এখনকার মন্দারই চিত্র।
এরকম একটি চিত্র থেকে মার্ক্স তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রয়োগে স্বিদ্ধান্তে আসলেন যে, বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থা যেমন সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে উৎপত্তি, তেমনি বুর্জোয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরি হবে নুতন একটি সমাজ ব্যাবস্থা। এটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দ্বিতীয় সুত্র ‘বিকাশের পথে অবলুপ্তি (Negation of the Negation)’ থেকে পাই। সেই নুতন সমাজ হবে প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেনীর সমাজ। তিনি ভাবলেন যেভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিচ্ছে, অচিরেই শ্রমিক শ্রেনী হবে সংখ্যায় গরিষ্ঠ। আর সেই শ্রেনী একদিন এই বুর্জ়োয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করবে কমিউনিষ্ট সমাজ। কমিউনিষ্ট পার্টির কাজ হচ্ছে সেই শ্রমিক শ্রেনীকে সংঘবদ্ধ করা, তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে সাহায্য করা।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল। মার্ক্সবাদ এর সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক কিভাবে আসলো। বিজ্ঞান যেভাবে তত্ব প্রদান করে যা সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য, সে রকম মার্ক্সও সমাজের ক্ষেত্রে তার তত্বটি দিয়েছিলেন। মার্ক্স যেমন বলেন নি যে শ্রমিক শ্রেনীর সংঘবদ্ধ হওয়া উচিৎ বা তাদের ক্ষমতায় যাওয়া উচিৎ তাদের মুক্তির জন্য। তিনি বলেছেন শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি আর বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংস দুইই অনিবার্য [১]। অর্থাৎ এটি বস্তুবাদের ইতিহাসের নিয়মে বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সুত্র অনুসারে হবেই, এক ধরণের প্রেডিকশন (ভবিষ্যতবানী)। বলাই বাহুল্য সে রকম কিছু হয়নি আজো। বব্রং আধুনিক সমাজ এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বেশ ভাল ভাবেই আছে এবং থাকবে।
তাহলে মার্ক্স এর তত্বের ভুল কোথায়? কোথায় মার্ক্স ভুল বুঝেছেন? আমি বলবো প্রতিটি দার্শনিক বা গবেষক যেমন তাঁর সময়কাল দ্বারা আবর্তিত, তেমনি মার্ক্স পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বা আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থাকে পুরোপুরি দেখতে পারেননি। পুঁজিব্যবস্থা তখন সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে আমি বলবো। এটা অনস্বীকার্য যে মার্ক্স এর পর প্রায় দেড়শত বছর পার হয়ে গেলেও বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অনেক ভুল আছে, যার কারনে এখনও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। কিন্তু সেটা কেটে যায়, তা থেকে মানুষ নুতন কিছু শিখে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরো সুসংহত হয়।
আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুবই জটিল একটি ব্যাপার। একক ভাবে মানুষ নিজে একটি জটিল প্রানী। তার মাস্তিষ্কের ব্যবহার অন্য যে কোন প্রানী থেকে অনেক বেশী বিধায় তাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এমন কোন তত্ব নেই যা দিয়ে বলা সম্ভব মানুষ একটি অবস্থায় কিভাবে নিজেকে বদলে নিবে বা কাজ করবে। অতীত ইতিহাস দেখে আমরা একটি ধারণা করতে পারি, কিন্তু সেটা ঘটবেই বলতে পারি না। আর এই মানুষ যখন গোষ্ঠিবদ্ধ ভাবে চলে, যখন একটি সমাজ গঠন করে, সেই সমাজে উক্ত মানুষগুলো কিভাবে চলবে সেটা কোন তত্ব দিয়ে প্রকাশ করা আরো অসম্ভব। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর সমাজ ব্যবস্থা দুইই সরাসরি ব্যক্তি ও গোষ্ঠিবদ্ধ মানুষের কাজের সাথে জড়িত। এই দুই ব্যবস্থা এতই নন-লিনিয়র (Non-linear) এবং নন-ডিটারমিনিষ্টিক (Non-Deterministic) যে সমাজ বিজ্ঞানে বা অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে সে রকম কোন নির্দিষ্ট তত্ব নেই। যা আছে তা কোন নির্দিষ্ট পারিপার্শ্বিকতার ক্ষেত্রে কিছু সুত্র (theoretical or empirical)।
একটি নন-লিনিয়র চিত্রের উদাহরণ যদি দেই তাহলে আরো পরিষ্কার হবে। সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিচলণ প্রক্রিয়া। আমাদের জলবায়ুর মডেল আছে, তাত্বিক সুত্র আছে- তথাপি এই প্রক্রিয়া নিজেই এত নন-লিনিয়র যে সে প্রক্রিয়াটিকে সঠিকভাবে প্রেডিক্ট করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা সর্বোচ্চ পাঁচদিন পর্যন্ত প্রেডিকশন করতে পারি, তারপরেও বলা হয়ে থাকে ৩০% বা ৬০% বৃষ্টি হবার সম্ভবাবনার কথা। কোন ভাবে হয়তো এই মুহুর্তের কথা বলতে পারবো, যদি পর্যাপ্ত তথ্য থাকে, বা পরবর্তী এক ঘন্টার কথা বলতে পারবো কিন্তু এক মাস পর কি হবে তা বলা অবাস্তব বা ইউটোপিয়। যে কারণে আজকের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরাও নিশ্চিত করে বলতে পারেন না ঠিক কোন পদ্ধতিতে বা কবে বর্তমান মন্দা দূর হবে।
নন-লিনিয়র এর আরেকটি মজার দিক রয়েছে, যা তার প্রেডিকশনকে আরো কঠিন করে তুলে। তা হল এক কথায় ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’। বলা হয়ে থাকে আজ যদি বাংলাদেশে কোন একটি প্রজাপতি তার পাখা নাঁড়ায় আর সেই সঞ্চালণ, নন-লিনিয়র এফেক্ট এর কারণে বাড়তে বাড়তে নিউইয়র্কে বৃষ্টি ঘটাতে পারে। যেমন ঘটতে পারে - কোন এক পথচারীর আকষ্মিক মৃত্যু, যা রূপ নিতে পারে বিশাল ভাংচু্রে। সেখানে কিছু হলে সেটা আরো বড় আকার হয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।
এরকম একটি জটিল সামাজিক এবং অর্থৈতিক ব্যবস্থাকে অঙ্কুরে দেখে যে তত্বই দেওয়া হোক না কেন তা কাজ না করাটাই স্বাভাবিক, বরং যদি কাজ করে আমি বলবো সেটাই কাকতলীয়।
তা হলে মার্ক্স এর দর্শনের সব কিছু কি ভুল? না তা নয়। পরবরতীতে আমরা দেখবো মার্ক্স এর দর্শনের কোন পর্যবেক্ষণ গুলো আজো প্রযোজ্য আর কোন গুলো নয়।
১. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1848/communist-manifesto/istahar.pdf
২. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1880/utopia/Socialism,%20Utopian%20and%20Scientific.pdf
মন্তব্য
এই ব্যপারটিতে আমার সন্দেহ আছে। ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষের আচরন যতটা পছন্দতাড়িত সামষ্টিক পর্যায়ে বোধহয় ততটা নয়। এর কারন স্টাটিস্টিকাল এক্সপেক্টেশন মোটামুটি ভালভাবে প্রেডিক্ট করা যায় - অন্তত ব্যক্তি আচরনের তুলনায়।
বেশ গুরুত্বপূর্ণ লেখা। তবে ব্যখ্যা যেন কেমন সংক্ষেপিত মনে হল এই কিস্তিতে।
নতুন মন্তব্য করুন