ইউটোপিয়, বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রঃ আজকের যুগের প্রলেতারিয়েত বা বুর্জোয়া

স্বাধীন এর ছবি
লিখেছেন স্বাধীন (তারিখ: শুক্র, ২৪/০৭/২০০৯ - ৫:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[আমার ইউটোপিয়, বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র লেখায় জনাব কল্লোলের মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে দেখলাম যে মন্তব্যটি অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আমার মনে হল আমার লেখায় যদিও আমি বলেছি কাদের আমি প্রলেতারিয়েত এবং কাদের আমি বুর্জোয়া হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই আজকের যুগে, তথাপি ঠিক কোন কারণে আমি তা বলেছি সেটার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়নি। তাই মন্তব্য হিসেবে না দিয়ে এটি পোষ্ট হিসেবেই দিলাম আগ্রহী পাঠকদের জন্য।]

আমি অন্য যেকোন আলোচনায় যাবার আগে প্রথমে আমার শ্রেনী সম্পর্কে ধারণাটি পরিষ্কার করতে চাই। আমার কাছে জনাব পড়ুয়ারও একই প্রশ্ন ছিল যে আমি কি বুর্জোয়া বা প্রলেতারিয়েত কারা তা সঠিক বুঝেছি কিনা। তাই আমি কি বুঝেছি সেটাই সর্ব প্রথম বলছি। আমি আমার লেখায় মূল বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছি কিন্তু কখনই নির্দিষ্ট লাইন বা প্যারা তুলে দিতে চাইনি। আমি মনে করি একটি নির্দিষ্ট লাইন পড়ে কখনই একজন লেখকের পুরো বক্তব্য বুঝা যায় না।

যা হোক - কমিউনিজমের মূলনীতি [১] থেকে প্রলেতারিয়েতের যে সজ্ঞাটি পাইঃ

"The proletariat is that class in society which lives entirely from the sale of its labor and does not draw profit from any kind of capital; whose weal and woe, whose life and death, whose sole existence depends on the demand for labor – hence, on the changing state of business, on the vagaries of unbridled competition. The proletariat, or the class of proletarians, is, in a word, the working class of the 19th century. "

একই বইয়ের [১] আরো এক স্থানে তিনি বলেছেনঃ

"The class of the wholly propertyless, who are obliged to sell their labor to the bourgeoisie in order to get, in exchange, the means of subsistence for their support. This is called the class of proletarians, or the proletariat. "

সুতরাং এই দুই সজ্ঞা থেকে এবং মার্ক্স ও এংগেলস আর অন্যান্য লেখা থেকে আমি যা বুঝেছি - প্রলেতারিয়েত হল তারাই যারা জীবন ধারণের জন্য তাদের শ্রম বিক্রি করে এবং যারা কোন লভ্যাংশ পায়না তাঁদের সে শ্রম দ্বারা তৈরী পূঁজি বা মুনাফা হতে। প্রলেতারিয়েতের কোন নিজস্ব সম্পত্তি নেই, যার কারনে তাঁদের শ্রম বিক্রি ব্যাতীত অন্য কোন উপায় নেই বেঁচে থাকার জন্য। সেই শ্রমের বিনিময়ে যেটুকু মুজুরী পায় তা দিয়ে তাঁরা কোনমতে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু কোন সম্পত্তি গড়তে পারে না। শিল্প বিপ্লব এর সময়কালের ইংল্যান্ডে তাই মার্ক্স প্রলেতারিয়েত বলতে বুঝিয়েছেন তখনকার কারখানার কর্মজীবি শ্রমিক শ্রেনীদের।

ঠিক এ কারনেই আমি বুঝি আজকের যুগে প্রলেতারিয়েত হল আমাদের দেশের খেঁটে খাওয়া মানুষেরা, যারা শুধু শ্রম বিক্রি করে জীবন ধারণ করে থাকে। যারা দিন আনে দিন খায়। কোন বেলা কাজ না থাকলে তাদের সংসারে খাবার থাকে না। তাঁদের আয় এতই কম যে তা মৌলিক চাহিদা পূরোনেও যথেষ্ট নয়। এ কারনেই আমি আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বা নিম্ন বিত্ত শ্রেনীকে বলেছি প্রলেতারিয়েত হিসেবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় – গার্মেন্টস কর্মী, বর্গা চাষী, দৈনিক মুজুর, রিক্সাচালক, সরকারী/বেসরকারী চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী ইত্যাদিদের। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই শ্রেনী সংখ্যা গরিষ্ঠ কিনা তা আমি জানি না, তবে তাদের সংখ্যা যে অনেক তাতে কোন সন্দেহ নেই। একই কারনে আমি মনে করি না আমার বা আপনার মত পেশাবিদ শ্রমিকেরা প্রলেতারিয়েতের শ্রেনীতে পরি। কারন আমরা যে মুজুরী পাই তা থেকে উদ্ধৃত থাকে এবং তা দিয়ে আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানাতে পারি, যদিও আমরাও শ্রম বিক্রি করেই জীবিকা অর্জন করে থাকি।

উন্নত পুঁজিবাদী দেশে কোন প্রলেতারিয়েত শ্রেনী পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কারণ সেখানে শুধু শ্রম বিক্রির আয় ছাড়াও সরকার থেকে অনেক ধরণের সুবিধে পাওয়া যায়, যেমন বিনামুল্যে চিকিৎসা, সাবসিডাইজড বাসা, বিনামুল্যে পড়াশুনা ইত্যাদি। এগুলো আসে জনগণের ট্যাক্স এর টাকা থেকে। এবং ট্যাক্স আসে উচ্চ আয়ের লোকদের কাছ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের থেকে। সুতরাং সেখানে নিম্নবিত্তের লোকেরাও ঘুরিয়ে রাষ্ট্রে মাধ্যমে এক ধরণের লভ্যাংশ/সেবা পায়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে দেখবেন যে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বছর শেষে বেতনের বাহিরেও প্রতিষ্ঠানের মূল লভ্যাংশের ভাগ পায়। সে ক্ষেত্রেও এদেরকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে ফেলতে পারবেন না।

এবার আসি বুর্জোয়া প্রসংগে। একই বইয়ে [১] তিনি বলেছেন-

"The class of big capitalists, who, in all civilized countries, are already in almost exclusive possession of all the means of subsistance and of the instruments (machines, factories) and materials necessary for the production of the means of subsistence. This is the bourgeois class, or the bourgeoisie. "

বৃহত পূঁজিপতি শ্রেনী, যারা উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান (কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, কারখানা) এর একচেটিয়া অধিকার সংরক্ষণ করে। এখানে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কোন প্রশ্ন নেই। যারাই পূঁজি খাঁটিয়ে লাভ করে তারাই বুর্জোয়া শ্রেনী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কারখানার মালিক শ্রেনী, বাড়িওয়ালা, বড় দোকানি, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের।

মার্ক্স এর সময়কালে হয়তো ইংল্যান্ডে মধ্যবিত্তেরাই বেশী ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিল। উচ্চবিত্তের প্রচুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকার কারনে তাঁরা সেই সব সম্পত্তির থেকে প্রাপ্ত খাঁজনা থেকেই জীবিকা অর্জন করতো। এ কারনেই হয়তো মার্ক্স সে সময়কার মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলেছিলেন, এবং যাদের ধ্বংসের মাঝে দিয়ে নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আমি সকল ব্যবাসায়ী বা পূজিঁপতিদের কে বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলতে রাজী নই। সে কারনেই রাজী নই আজকের যুগের মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়ার সজ্ঞায় ফেলতে। আমি যা বুঝেছি তা হল বুর্জোয়া তারাই যারা সমাজকে শোষণ করে অন্যায়ের মাধ্যমে, অসৎ পথে, দূর্ণীতির মাধ্যমে। তাঁরাই দেশের শত্রু হতে পারে, সমাজের শত্রু হতে পারে, সকল ব্যবসায়ী বা পূঁজিপতি নয়। তাই বলেছিলাম আজকের যুগে আমার চোঁখে বুর্জোয়া হতে পারে – দূর্ণীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, দূর্ণীতিগ্রস্থ আমলা, দূর্ণীতিগ্রস্থ পেশাবিদ, অসৎ ব্যবসায়ী, ঋণখেলাপী ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ব্যবসায়ী ইত্যাদি।

আমি খুব চিন্তিত ছিলাম আমি নিজে কোন শ্রেনীতে পড়ি তা নিয়ে। সেটার জবাব পেলাম ইস্তেহারে [২]।

"A part of the bourgeoisie is desirous of redressing social grievances in order to secure the continued existence of bourgeois society. To this section belong economists, philanthropists, humanitarians, improvers of the condition of the working class, organisers of charity, members of societies for the prevention of cruelty to animals, temperance fanatics, hole-and-corner reformers of every imaginable kind. This form of socialism has, moreover, been worked out into complete systems."

আমার মনে হয় আমার মত পেশাবিদরা – ডাক্তার, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ ইত্যাদিরা – সরাসরি বুর্জোয়া না হলেও আমাদের সহানুভুতি থাকবে সমাজের উচ্চশ্রেনীর প্রতিই। সেটা মনে করেই মার্ক্স হয়তো আমাদেরকে রক্ষনশীল বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলেছেন। জনাব কল্লোলের কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন এখানে, কোন কারনে আপনি নিজেকে মার্ক্সবাদী বলছেন অথচ কমিউনিজম হচ্ছে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসন। অথবা নিজেকে আপনি প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতেই ভাবছেন কিভাবে? আমি জনাব পড়ূয়া কে যে প্রশ্নটি করেছিলাম সেটিই আবার এখানে রাখবো, আজকের যুগে কাদেরকে আপনি বুর্জোয়া বা প্রলেতারিয়েত বলে মনে করেন তা আমার মত উদাহরণ সহকারে তুলে ধরলে আমার নিজেই বুঝতে পারতাম কোথায় আমাদের মতবিরোধ।

আপনার মন্তব্যের একটি বক্তব্যের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করছি। আপনি বলেছেন আমার লেখা সম্পর্কে যে ঃ

তিনি মধ্য আয়ের বেতন ভোগী ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিতদেরকে মধ্যবিত্ত বা পেটিবুর্জোয়া বলছেন

আমি পেশাবিদদের মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে ফেলিনি আর পেটি-বুর্জোয়াতেতো নয়ই। আমি তাঁদের ফেলেছি উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে বা জনাব পড়ূয়ার ভাষায় বুর্জোয়া সমাজের যন্ত্রবিশেষ হিসেবে। পেটি-বুর্জোয়া বলতে আমি বুঝেছি মধ্যবিত্তের নিম্ন শ্রেনী বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেনী কে, যারা স্বল্পপূঁজির ব্যবসায়ী, কিন্তু বৃহৎ পুঁজির শোষণে একদিন প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতেই রূপান্তরিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (হস্তশিল্পী, ফুটপাতের ব্যবসায়ী) সরকারী/বেসরকারী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী ইত্যাদিদের। যাদের আয় খুব সামান্য এবং যে কোন বড় বিপদে সর্বসান্ত হয়ে পথের ভিকিরি হয়ে যায়।

পেটি বুর্জোয়া সম্পর্কে ইস্তেহারে [২] যা মার্ক্স বলেছেনঃ

"The lower strata of the middle class — the small tradespeople, shopkeepers, and retired tradesmen generally, the handicraftsmen and peasants — all these sink gradually into the proletariat, partly because their diminutive capital does not suffice for the scale on which Modern Industry is carried on, and is swamped in the competition with the large capitalists, partly because their specialised skill is rendered worthless by new methods of production. Thus the proletariat is recruited from all classes of the population. "

ইস্তেহারের [২] অন্য এক স্থানে বলেছেন -

"In countries where modern civilisation has become fully developed, a new class of petty bourgeois has been formed, fluctuating between proletariat and bourgeoisie, and ever renewing itself as a supplementary part of bourgeois society. The individual members of this class, however, are being constantly hurled down into the proletariat by the action of competition, and, as modern industry develops, they even see the moment approaching when they will completely disappear as an independent section of modern society, to be replaced in manufactures, agriculture and commerce, by overlookers, bailiffs and shopmen. "

আমি আমার অবস্থান পরিষ্কার করলাম। কোন্‌ কারণে এবং কাদের কে আমি কোন্‌ শ্রেনীতে ফেলেছি। আমার স্বল্প জ্ঞানের অভাবে বুঝার ভুল হতে পারে। তবে নিশ্চিত থাকবেন ভুল বুঝে থাকলে তা শুধরে নেওয়ার সুযোগ আমার কাছে সব সময় আছে। আপনার মত সমাজের পরিবর্তন আমিও চাই। তবে কিভাবে চাই সেটাই এখনো খুঁজছি। আমি মার্ক্স বা এংগেলস এর লেখা দিয়ে তাঁদের বুঝতে চাই, লেনিন বা মাও বা অন্য কারোর চোখ দিয়ে নয়। তাই নিজের মত করেই তাঁদের বুঝতে চাই।

১. http://www.marxists.org/archive/marx/works/1847/11/prin-com.htm

২. http://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/communist-manifesto/index.htm


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমি মার্ক্স বা এংগেলস এর লেখা দিয়ে তাঁদের বুঝতে চাই, লেনিন বা মাও বা অন্য কারোর চোখ দিয়ে নয়। তাই নিজের মত করেই তাঁদের বুঝতে চাই।

আপনার এই লেখাগুলো একারণেই অনন্য। অনেক চিন্তা/দ্বিধা/মতামত মিলে যায় দেখে সেভাবে কিছু লেখা যাচ্ছে না।

বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতের মাঝে আমার অবস্থান ঠিক কোথায়, এটা আমিও ভেবে পাই না। এই দু'টার কোনোটাতেই আমাকে সরাসরি ফেলে দেওয়া যাবে না। মার্ক্সের লেখায় বলা আছে এক সময় বুর্জোয়ার নিপীড়নে আমার প্রোলেতারিয়েত হয়ে যাওয়ার। অথচ বর্তমান সমাজ আমাকে আরেকটু বেশি নিরাপত্তা দেয়। একই সাথে এটাও সত্যি যে আগের তুলনায় উপরে উঠার সুযোগ অনেক বেশি এখন। সোশাল ডেমোক্রেসির কথা মার্ক্স বলেননি। আমরাও হয়তো সেজন্যই দ্বন্দ্বে ভুগি।

আমার একটা বিচ্ছিন্ন ভাবনা বলি। এটার কোনো সূচনা বা সমাপ্তি খুঁজতে গেলে পাবেন না, আগেই বলে নেই। যে-মানুষ খোলা আকাশে নিচে ঘুমায়, শুধু সে-ই পুরো আকাশটা পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে, আকাশের দাবিতে প্রাণ দিতে পারে। যে-মানুষ এক তলা বাসায় ঘুমায়, সে বড় জোর আরেক তলা চায়। জীবনে বহুবার দেখেছি, মাঝের মানুষগুলো মাঝেই থেকে যায়। এরা উপরেও উঠে না, নিচেও নামে না। অথচ উপর থেকে নিচে (এবং বিপরীত) হয় প্রচুর। কথা হলো, মানুষের কি আসলেই আকাশ দরকার?

আমি এক তলায় ঘুমাই। আপনিও তাই। এযুগে হয়তো সবাইই। নিম্নবিত্তের আকাশ এখন স্রেফ এক তলার সমান। আর আমাদের দোতলার বেশি কিছু চাই না। সমাজতন্ত্র আর সাম্যবাদের আকাশে কি তাহলে আদৌ কেউ যেতে চায়?

এলোমেলো মন্তব্য হয়ে গেলো বলে দুঃখিত।

স্বাধীন এর ছবি

মন্তব্য এলোমেলো হয়নি মোটেই, তবে তুমি কি বলতে চাচ্ছিলে তা বুঝেছি। আমি নিজে সেটাই সব সময় করতে চাই যা আমি নিজে বুঝি আর যা আমার করার সামর্থ্য আছে। এর বেশী আমি কখনই স্বপ্ন দেখিনি। এটা মনে হয় কৈশরের ডেল কার্নেগীর প্রভাব।

সোশাল ডেমোক্রেসি কিন্তু মার্ক্স এর সময় এবং তার পরে বেশ ভাল ভাবেই ছিল। কার্ল কউটস্কির লেখায় কিছু পাবে। এখানে তুমি পাবে কিভাবে লেনিন তার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। মার্ক্স তরুন বয়সে বেশ বিপ্লবী ধারণার ছিলেন, তাই সোস্যাল ডেমোক্রেসির স্থলে কমিউনিজম এর মন্ত্র দিলেন। তার পরেও তিনি ডেমোক্রেসির যে একদম বিপক্ষে ছিলেন না তার প্রমান হল তার ১৮৭২ সালে দেওয়া সাক্ষাতকার যেটা আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু লেনিন বিপ্লবী ধারণাকেই নিলেন এবং দাঁড় করালেন লেনিনিজম। অনেকটা আমাদের ইসলাম ধর্মের মত। ধর্মে ভাল কথা বলা থাকলেও কিছু মানুষ জিহাদের বাণীকেই সর্বাধিক মূল্য দিচ্ছে।

ইচ্ছে আছে সময় পেলে সোস্যাল ডেমোক্রেসি নিয়ে লেখা দিব। ইচ্ছে ছিল এই সিরিজেই দিব। আমার শিরোনাম ও তাই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কথাটি ছিল।

অতিথি লেখক এর ছবি

@ রাগিব ভাইঃ কিছুদিন আগে টাইমস এ লিখেছিলো, আমেরিকানরা ধনীদের হিংসা করে, কিন্তু ঘৃণা করে না। কারণ সবাই বিশ্বাস করে তাদেরও সুযোগ আসতে পারে। মোট কথা ওরা সিস্টেমটার প্রতি একেবারে বীতশ্রদ্ধ নয়। বোধহয় সেজন্য বিপ্লব-টিপ্লবে ওদের আস্থা নেই।

সবজান্তা এর ছবি

নানারকম বিজাতীয় ঝামেলায় বহুদিন আপনার এই লেখাটা পড়া হয়ে উঠেনি। একটু গুছিয়ে উঠতে পারলেই শেষ করে ফেলবো শেষ দুই কিস্তি।

যাই হোক, লেখার প্রেক্ষিতে না, মন্তব্যের প্রেক্ষিতে একটা মন্তব্য করে ভাগি।

দ্বিজেন শর্মার আত্মজীবনীমূলক একটা লেখা পড়েছিলাম। সেখানে তিনি সমাজতন্ত্রকালীন রাশিয়ান সমাজের বেশ কিছু ভালো দিক তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু তিনি যুক্তি দিয়েই দেখিয়েছিলেন কীভাবে সমাজতন্ত্রের পতন অবশ্যম্ভাবী ছিলো। অনেক দিন আগে পড়া তাই সব স্পষ্ট খেয়াল নেই, তবে একটা কথা এখনো খেয়াল আছে, যার সারাংশ ছিলো এমন, কমিউনিস্টরা প্রচণ্ড পরমতঅসহিষ্ণু, তাঁরা সবসময় ভাবে তাঁদের চিন্তাই ঠিক।

কথাটা এখনকার এবং এখানকার প্রেক্ষিতেও আমার কাছে অনেকাংশে যথার্থ মনে হয়।


অলমিতি বিস্তারেণ

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার তো মনে হয় পরমত অসহিষ্ণুতা সমাজতন্ত্র চর্চার এক দরকারি অংশ। পুরো ব্যাপারটাই যেহেতু কৃত্রিম এবং নিয়ন্ত্রিত, উদারতা বা পরমত সহিষ্ণুতা এখানে একটি সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা। পরমতকে যদি পাত্তা দিতেই হয়, তবে প্রলেতারি‌য়েতের একনায়কত্ব দূর্বল হয়ে পরবে না? আমি স্বীকার করি যে আমি এ সম্পর্কে জানি খুবই কম। ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

@ রাগিব ভাইঃ টাইমস ম্যাগাজিনে পড়লাম, আমেরিকানরা তাদের ধনীদের হিংসা করলেও ঘৃণা করে না। তারা বিশ্বাস করে যে তাদের জীবনেও ওপরে ওঠার সুযোগ আসতে পারে। তারা সিস্টেমটার ওপর এতটা বীতশ্রদ্ধ নয়। তাই বোধহয় তাদের অন্য কোন সিস্টেমের দরকার নেই।

সাবিহ ওমর

কল্লোল এর ছবি

স্বাধীন, আপনাকে নতুন করে আলোচনা করার জন্য ধন্যবাদ। আপনার আলোচনার ধরনটা বেশ ভালো লাগলো কেননা গ্রহন বর্জন করার একটা মানসিকতার ছাপ রয়েছে সেখানে। আর আদর্শগত অর্থে আপনিও আমার মত এই বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থার আমুল পরিবর্তনই বোধহয় চাইছেন। যাই হোক, আমার মনে হয় আমার আগের মন্তব্যে আমি আজকের যুগে কারা প্রলেটারিয়াত আর কারা বুর্জোয়া সে বিষয়ে আমার বক্তব্য পরিস্কার করার চেষ্টা করেছিলাম। তারপরও এখানে একটি উদাহরণ দিয়ে আমার আগের বক্তব্যটি পরিস্কার করার চেষ্টা করি। ধরা যাক এক জন প্রকৌশলী একটি রিয়েল এস্টেট কম্পানি খুলেছেন যেখানে তিনি আরও ১০ জন প্রকৌশলী, ২০ জন টেকনিশিয়ান, ১০০ জন নির্মান শ্রমিককে বেতন দিয়ে পোষেন। কোম্পানীর মালিক প্রকৌশলী পুজি বিনিয়োগ করে বিভিন্ন প্লটে ফ্লাট বানানোর কাজ শুরু করেন। প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানরা তাদের দক্ষ/আধা দক্ষ শ্রম দিয়ে নকশা এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার কাজ করেন। নির্মান শ্রমিকেরা সেই নকশা অনুযায়ী তাদের অদক্ষ/আধা দক্ষ শ্রম দিয়ে সেই কাজটিকে বাস্তবায়ন করেন। এখন এখানে কার কি শ্রেণী অবস্থান?

# নিয়োগ কারী প্রকৌশলী যেহেতু পুজি বিনিয়োগ করে উদ্বৃত্ত আত্মসাত করেন এবং সেই উদ্বৃত্ত পুনরায় বিনিয়োগ করেন আরও বেশী মুনাফার জন্য, সেহেতু মার্ক্সবাদ অনুসারে তিনি হলেন একজন বুর্জোয়া। এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। তিনি ব্যাক্তি হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু যেহেতু পুজিবাদী উতপাদন পদ্ধতিতে তার নিয়োগকৃত শ্রমিক, প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের উতপাদিত উদ্বৃত্তে তিনি ভাগ বসাচ্ছেন, সেই কারণে তিনি শোষণকারী বুর্জোয়া।

# বেতন ভোগী প্রকৌশলী/টেকনিশিয়ান আর মজুরী ভোগী নির্মান শ্রমিক প্রত্যেকেই শ্রমিকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত যেহেতু তারা তাদের শ্রম বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করছেন। বেতনভোগী প্রকৌশলী টেকনিশিয়ানরা হলো হোয়াট কালার শ্রমিক যেহেতু এদের শ্রমের মূল্য অপেক্ষাকৃত বেশী দেয়া হয়, যেহেতু এরা মূলত মানসিক শ্রম বিক্রী করে এবং এদের শ্রমকে দক্ষ শ্রম বলা হয় যেটাকে অর্জন করতে নির্দিষ্ট ধরনের ট্রেনিং বা শিক্ষার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। আর নির্মান শ্রমিকরা হলো ব্ল-কলার শ্রমিক যেহেতু এদের শ্রমের মূল্য কম দেয়া হয়, যেহেতু এদের শ্রম অদক্ষ বা আধা দক্ষ এবং শারীরিক শ্রম নির্ভর। এরা শ্রম বিক্রিয়কারী হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত বা Class in itself হলেও চেতনাগত অর্থে প্রলেতারীয় শ্রমিক শ্রেণীর চেতনা ধারণ নাও করতে পারে অর্থাত Class for itself হলো রাজনৈতিক চেতনার ব্যাপার যা অর্জন করার বিষয়।

উচ্চ বেতন ও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে বেতনভোগী প্রকৌশলীরা নিজেকে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ইত্যাদি অনেক কিছুই ভাবতে পারে কিংবা নিজেদের সুবিধা জনক অবস্থান বজায় রাখা এবং মূল্যবান চাকুরীটি হারানোর ভয়ে মালিক প্রকৌশলীর একান্তঅনুগত হিসেবে সেই বুর্জোয়া মালিকের শোষণের যন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে—অর্থাত সাংস্কৃতিক বিবেচনা, লাইফস্টাইল মূল্যবোধ ইত্যাদি অর্থে সে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত বিভিন্ন ধরণের মানসিকতা ধারণ করতে পারে কিন্তু অর্থনেতিক হিসেবে উতপাদনের উপকরণের সাথে মালিকানা সম্পর্ক বিচারে তার অবস্থান কিন্তু শ্রমিকতার অবস্থান। একইভাবে একজন টেকনিশিয়ান এমনকি কোন কোন উচ্চমজুরী প্রাপ্ত দক্ষ নির্মান শ্রমিকও পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিচারে নিজেকে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ভাবতে পারে, চাকুরী হারানো বা অন্যান্য বিবেচনায় মালিক শ্রেণীর স্বার্থবাহক শোষনের যন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে কিন্তু তাই বলে সে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিচারে কখনও বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত হয়ে যায় না। উচ্চ বেতন পাওয়ার জন্য হোয়াট কলার শ্রমিকদের কারও কারও হাতে উদ্বৃত্ত থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সেই অর্থকে পুজিতে রুপান্তর না করছে অর্থ মুনাফা অর্জনের জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে কারখানা বা কোম্পানী না খুলছে ততক্ষণ পর্যন্ত উতপাদন সম্পর্ক বিচারে তারা শ্রমিক শ্রেণীরই অংশ, যাদের কে লেনিনের ভাষায় বলা যায় লেবার এরোস্টেক্রেট। লেনিন উন্নত ধনবাদী দেশে ক্রমশ এই লেবার এরোস্প্রোক্রেটদের বৃদ্ধি দেখে বলেছিলেন কার্যকর শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই লেবার এরোস্ট্রোক্রেসি একাটা বিরাট বাধা, কাজেই এটাকে ভাঙা খুবই জরুরী।

এভাবে হোয়াইট কলার শ্রমিকেরা স্বাভাবিক সময়ে তাদের সুবিধাজনক অবস্থা হারানোর ভয়ে পুজি ও শ্রমের দ্বন্দ্বে পুজির পক্ষাবলম্বন করলেও সংকটের সময় যখন ব্ল-কলার শ্রমিকদের মতই তাদেরকে ছাটাই হতে হয় তখন কিন্ত দেখা যায় এরা শ্রমিকদের মতই ট্রেড ইউনিয়ন জাতীয় সংগঠন করে মালিক বুর্জোয়ার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। আপনি আপনি আপনার আলোচনায় যেসব স্যোসাল ওয়েল ফেয়ারের উদাহরণ দিয়েছেন এগুলো কিন্তু এই হোয়াট কলার আর ব্লু কলার শ্রমিকদের মিলিত আন্দোলনের ফল। এখন তারা তাদের সেই শ্রেণী চেতনা কতটুকু ধরে রাখবে এটা পুরোপুরি নির্ভর করে সেই সময়ের রাজনৈতিক অর্থনেতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সর্বপরি শ্রমিক শ্রেণীর চেতনাগত মান ও তার প্রয়োগ সক্ষমতার উপর।

আর আমি নিজে একজন প্রকৌশলী হয়েও কেন সর্বহারা শ্রেণীর শাসন কমিউনিজমে বিশ্বাস করি তার উত্তরে বলবো মার্কস/এঙ্গেলস নিজেরাও কিন্তু সেই অর্থে কারখানায় কাজ করা সর্বহারা শ্রমিক ছিলেন না কিন্তু চেতনাগত অর্থে তারা সর্বহারার সাথে একাত্মতা বোধ করেছেন অর্থাত ডি-ক্লাসড হয়েছিলেন। আর আমি তো নিজে একজন হোয়াট কলার শ্রমিক- আমার কেবল দরকার নিজেকে মধ্যবিত্তের মানসিকতা থেকে বের করে নিজের শ্রেণী অবস্থানটাকে বুঝে নেয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করা।

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

সমাজতন্ত্র তেমন একটা বুঝিনা বটে তারপরও একটা বিষয় বুঝতে অসুবিধা হয়্না যে এটা একটা কৃত্রিম ধারনা। মানুষের অর্থনৈতিক আচরন আমলে না নিয়ে সামগ্রিক আউট কাম নিয়েই এই ধারনার কাজ কারবার। এরপরও এই মতবাদ অনেক দরকারি বলে মনে করি। নীতি গবেষনা বা পরিকল্পনার কাজে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিগুলোকে আলাদা ভাবে খেয়াল করতে সাহায্য করে এই ধারনা। বলা বাহুল্য কোন মতবাদ যদি অনেক আচরনকে ব্যখ্যা করতে শুরু করে আমরা অনেক সময় সেটা চোখের সামনে একটা লেন্সের মত দাড়িয়ে যায়। যেমন মার্ক্স সাহেবের লেখা পড়লে সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসকে মনে হতে থাকে ক্লাস স্ট্রাগল [Class struggle], মিশেল ফুকোকে পড়ুন মনে হবে সব আচরন পাওয়ার রিলেশন [Power relation], হয়্ত এডোয়ার্ড সাইদ পড়লে মনে হবে প্রাচ্যবাদ [Orientalism], অথবা ডারঊইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে ভাবুন মনে হবে অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধটাই মানুষের আচরনের মূলে, আর হান্টিংটন সাহেবের clash of civilization পড়লেত কথাই নেই পৃথিবীর ইতিহাস হয়ত নতুন করে লিখতে হবে। তবে চিন্তার জগতে এই বন্দিদশা অনেকের পছন্দ হয়্না, আবার অনেক সময়ে এই বন্দিত্ব টের পেতেও কষ্ট হয়। তবে টের পেলে তার আগল থেকে বের হতে মন যে কেমন করে তা আমি বুঝেছিলাম যখন আমি বুঝলাম ফুকো আমাকে পেয়ে বসেছে। এখন নিজেকে মুক্ত মনে করি। কিন্তু সে এক বিরাট ইতিহাস! ভাল থাকুন।
@স্বাধীনঃ আপনার স্বধীন নামটি বেশ যুত্সই হয়েছে বলতে হয়।

স্বাধীন এর ছবি

আপনি আমার লেখায় প্রথম থেকেই আছেন তাই ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এ ধরণের লেখার পাঠক খুব বেশী নয় আর মন্তব্যের বেলায় তো আরো নয়। মিশেল ফুকো আর এডয়ার্ড সাঈদ এর সম্পর্কে কিছু পড়েছি সিসিবি তে একজনের লেখায়। তবে হান্টিংটন সাহেবের কথা শুনিনি। সময় করে আমাদের উনার লেখার সাথে একটু পরিচয় করে দিন না কেন?

স্বাধীন নিক আমার বহূ পুরোনোই। যে দিন থেকে এই সকল সামাজিক বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু নিয়তির ফেরে আজ পুরোপুরি সাংসারিক মানুষ। জগৎসংসারের বন্ধনে আরো বেশী মাত্রায় আবদ্ধ। তারপরও এখনো মুক্তির স্বপ্ন দেখি। আমি বলে দিয়েছি পঞ্চাশ এর যে কয়দিন বাঁচবো সে গুলো শুধু আমার। তার আগে যদি চলে যাই অপূর্ণতা রয়ে যাবে মনে, তবে দুঃখ থাকবে না। কারণ সেটার উপরতো আমার হাত নেই।

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

আপনার ভাবনার কথা জেনে ভাল লাগল। চমৎকার চিন্তা।
হান্টিংটন সাহেবের অবদান আসলে সভ্যতার জন্য খুব কার্যকর কিছু নয় হয়ত। তবে বলা যায় বুশ সাহেব হয়ত এর ঘোর অনুসারি ছিলেন। তার বহুল আলোচিত লেখাটির পূর্ববর্তি সংস্করনটি ছিল একটি আর্টিকেল। পাবেন এখানে
তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। যেমন বাংলাদেশে বাংলাদেশি অধ্যাপক সেলিম রশিদের সম্পাদিত The Clash of Civilizations: Asian Responses বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে পূন প্রকাশিত। অথবা চামস্কির মন্তব্য শুনতে পারেন নিচেঃ

এডওয়ার্ড সাইদের মন্তব্য পাবেন নিচেঃ

মনে হয়েছে সাইদ তার প্রাচ্যবাদ মতবাদের আলোকে Clash of Civilization এর সমালোচনা করেন। আশা করি ভাল লাগবে।

স্বাধীন এর ছবি

ধন্যবাদ কল্লোল আপনাকে আপনার মন্তব্যের জন্য। আপনার বক্তব্যের পর এটা বুঝতে পারলাম আপনার সাথে আমার চিন্তার পার্থক্য খুবই সামান্য, তবে তা মৌলিক পার্থক্য। শুধু এইটুকু পার্থক্যের জন্যই আপনি নিজেকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে একাত্মতাবোধ করেন এবং মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী হয়ে সমাজ পরিবর্তণের স্বপ্ন দেখেন। পার্থক্যটি হল যত না প্রলেতারিয়েতের সজ্ঞায় তার চেয়েও বেশী বুর্জোয়ার সজ্ঞায়। প্রলেতারিয়েত এখানে মূল বিষয় নয়, শোষিত শ্রেনী মানেই প্রলেতারিয়েত। কিন্তু বুর্জোয়া কারা।

আপনারই ভাষায় -নিয়োগ কারী প্রকৌশলী যেহেতু পুজি বিনিয়োগ করে উদ্বৃত্ত আত্মসাত করেন এবং সেই উদ্বৃত্ত পুনরায় বিনিয়োগ করেন আরও বেশী মুনাফার জন্য, সেহেতু মার্ক্সবাদ অনুসারে তিনি হলেন একজন বুর্জোয়া। এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। তিনি ব্যাক্তি হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু যেহেতু পুজিবাদী উতপাদন পদ্ধতিতে তার নিয়োগকৃত শ্রমিক, প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের উতপাদিত উদ্বৃত্তে তিনি ভাগ বসাচ্ছেন, সেই কারণে তিনি শোষণকারী বুর্জোয়া।

আমিও ঠিক এটাই বুঝেছি যে মার্ক্স তাই বুঝিয়েছেন। আমি বলেছি- বৃহত পূঁজিপতি শ্রেনী, যারা উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান (কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, কারখানা) এর একচেটিয়া অধিকার সংরক্ষণ করে। এখানে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কোন প্রশ্ন নেই। যারাই পূঁজি খাঁটিয়ে লাভ করে তারাই বুর্জোয়া শ্রেনী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কারখানার মালিক শ্রেনী, বাড়িওয়ালা, বড় দোকানি, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের।

সুতরাং দেখতেই পারছেন আমার মার্ক্স এর সজ্ঞা বুঝায় আর আপনার সজ্ঞায় তেমন বেশী পার্থক্য নেই। পার্থক্য হল আমি মার্ক্স এর এই সজ্ঞাকে মনে করি খুবই সরলিকৃত একটি সজ্ঞা হিসেবে। সকল পুঁজিপতিদেরই তিনি শত্রুর কাঁতারে ফেলেছেন। তিনি যেটা দেখেছেন যে সকলে মিলে লাভ করা হয়, কিন্তু সে লভ্যাংশ শুধু পায় পুঁজিপতি। সেই বাড়তি মুনাফা আবার বিনিয়োগ হয়, তা থেকে আরো মুনাফা হয়, সেটাও যায় পুঁজিপতির ঘরেই। সুতরাং যে কারোরই সেই পুঁজিপতির উপর ক্ষোভ হতেই পারে।

কিন্তু পুঁজিপতি যে বিনিয়োগটি করছে তার যে রিস্ক আছে সেটাও তো পুঁজিপতির, তাই না। সে কিছু লাভের আশায় ব্যবসায় এসেছে। আপনার সেই প্রকৌশলী তো নিজে ব্যবসায় না এসে সারাজীবন শ্রম বিক্রি করেই চলতে পারতো। কিন্তু সে ব্যবসায় এসেছে কারণ ব্যবসায় লাভ আছে আবার লোকসানের ভয়ও আছে। এখানে আপনি যে সিস্টেম এর কথা বলছেন সেটাই ক্লাসিকাল অর্থনীতি। সেই একই অর্থনীতি মেনেই কমিউনিষ্ট সমাজেও রাষ্ট্রকে ব্যবসা করতে হবে। পুঁজি খাটাতে হবে, সেখান হতে মুনাফা করতে হবে, সেই বাড়তি মুনাফা দিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরী করতে হবে। যদি এটা না করে তবে সে দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়বে। তবে এটাও মনে রাখা উচিৎ রাষ্ট্রের পক্ষে ব্যবসা করে মুনাফা করা এত সহজ কথা নয়, যার প্রমান আমাদের দেশের সকল রাষ্ট্রীয় শিল্প বা প্রতিষ্ঠান গুলো। যে কারনেই ব্যক্তি মালিকানায় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়। রাষ্ট্র সেখান হতে কর আদায় করে, অর্থ্যাৎঘুরিয়ে বললে রাষ্ট্র একটু কম মুনাফা করলো। রাষ্ট্রের বাকি মুনাফা ব্যক্তিকে দেওয়া হল কারণ সেই ব্যক্তি নিজে রিস্ক নিয়ে একটি কর্মক্ষেত্র তৈরী করলো এবং রাষ্ট্রকে মুনাফা দিল। রাষ্ট্র শুধু পুঁজি ধার দিয়ে মুনাফা করলো, আর ব্যক্তি তার শ্রম ও মেধা খাটিয়ে নিজে ও রাষ্ট্রকে মুনাফা দিল। এমন ব্যক্তিকে আমি কিভাবে শত্রু শ্রেনী হিসেবে চিহ্নিত করবো। আমার সাথে আপনার বা মার্ক্স এর মূল পার্থক্য এখানেই।

আরেকটি ক্ষুদ্র পার্থক্য হল, মানবতাবোধ বা নীতিবোধ। আপনি যেভাবে খুব সহজ করে বলে দিতে পারেন এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। আমি তা পারিনা। কারণ নীতি এবং মানবতা আমার কাছে অনেক বড়। একজন মানুষকে আমি শ্রেনী শত্রু আখ্যা দিয়ে মেরে ফেলে আর যাই করি কারোর ভাল করতে পারবো এ ধরণের বিশ্বাস আমার পক্ষে অসম্ভব। সে কারনেই বোমা মেরে মানুষকে ধর্মের বাণী পৌছে দেওয়া সম্ভব বলেও আমি মনে করি না।

মুনাফা, সে ব্যক্তিই করুক বা রাষ্ট্রই করুক, রাষ্ট্রের উচিৎ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তাবায়ন হচ্ছে কিনা তার তদারকি করা। অর্থাৎ সেই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা পর্যাপ্ত মুজুরি পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিৎ করা রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্র সেটা না করলে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে, তার জন্য আন্দোলন হতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরিবর্তন সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। কারন মার্ক্স যাকে পুঁজিবাদ বলেন তাকে আমি বলি আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থা। মার্ক্স যাকে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা বলেন আমি তাকে বলি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই অর্থনৈতিক বা সমাজ ব্যবস্থা এসেছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ হিসেবেই। সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করা মানে হল সভ্যতার চাকাকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া ।

এটা ঠিক যে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম শাসন ব্যবস্থা এখনো পাওয়া যায়নি। তাই বলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। যদি সমাজে পরিবর্তন আনতেই হয় তবে আমি বর্তমান ব্যবস্থাকেই ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করবো। আমি সভ্যতার চাকাটিকে সামনের দিকেই নিয়ে যাবার চেষ্টা করবো, পেছনের দিকে নয়।

সাজেদ এর ছবি

ত্বত্তে যাই থাক না কেন, পুজিবাদ অবিনশ্বর। যুগে যুগে এটা আধুনিক, মানবিক আর বিবর্তিত হয়ে অতীতের সকল দর্শন, ধর্মকে গিলে ফেলছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।