সংবিধান ও গণতন্ত্র
খবরে পড়লাম (ধন্যবাদ সচল জাহিদকে লিঙ্কটি নজরে আনার জন্য) যে বর্তমান সরকার সংবিধানকে পর্যালোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে যা নিঃসন্দেহে একটি ভাল পদক্ষেপ, যদিও সেই উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা কয়েক কোটি তারার প্রশ্ন। ঠিক একই সময়ে এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে পারছি বলে ভাল লাগছে।
রাষ্ট্র হিসেবে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রই সর্বাপেক্ষা উত্তম যেখানে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সকল প্রজাই সমান হয়ে থাকে। আর রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা বা সরকার পদ্ধতির জন্য গণতন্ত্রই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভাল পন্থা। আমাদের দেশের জন্য নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র নিয়ে ইশতি তাঁর লেখায় অনেক কিছুই বলে ফেলেছে। আমি সেটার সাথে নিজের কিছু চিন্তা যোগ করতে করছি কেবল।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মূলত দু’ধরণের। প্রথমটি হল - ডিরেক্ট বা সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যেখানে সকল প্রজা রাষ্ট্রের সকল স্বিদ্ধান্তে নিজের মতামত প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করবে। আর দ্বিতীয়টি হল- জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের সকল স্বিদ্ধান্ত গ্রহন ও প্রয়োগ করবে যা রিপ্রজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধিমুলক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। দু’পদ্ধতিরই ভাল এবং খারাপ দিক রয়েছে।
সরাসরি পদ্ধতির সবচেয়ে ভাল সুবিধে হল এর মাধ্যমে জনগণের সরাসরি চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময় নির্বাচিত হয়ে জনগণকে উপেক্ষা করে সে ধরণের প্রতারনার সুযোগ থাকে না। আরো একটি বড় সুবিধে হল যেহেতু এই পদ্ধতিতে জনগণের সরাসরি মিথষ্ক্রি য়া থাকে তাই এতে বিপুল সংখ্যক জনগণের অংশগ্রহন হয়ে থাকে যা একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য খুবই প্রয়োজনীয় অংশ।
এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় অসুবিধে হল একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি স্বিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই মিথষ্ক্রি য়ার আয়োজন সময় ও অর্থ সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণে এই ধরণের পদ্ধতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী – যেমন সচলায়তন – এর ক্ষেত্রে উপযোগী। বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তাই নির্বাচিত প্রতিনিধিমুলক পদ্ধতিই উপযোগী হয়ে থাকে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সরাসরি পদ্ধতির বা গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত সর্বোত্তম পদ্ধতি হলেও এই পদ্ধতিও ত্রুটিমুক্ত নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ত্রুটিগুলো প্রকান্তরে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিরও ত্রুটি। সরাসরি বা নির্বাচিত যে পদ্ধতিই হোক না কেন গণতন্ত্রের একটি প্রধান সমস্যা হল “বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শাসন”। যদিও গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতামত জানা, কিন্তু ক্ষুদ্র অংশের মতামতকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। যদি সেই মতামতকে উপেক্ষা করা হয় তবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীটি সর্ব সময় শোষিত হয়ে চলবে যা কোন সমাজের জন্যও ভাল ফল বয়ে আনবে না। এখানেই মানবতার প্রশ্নটি চলে আসে এবং এ কারণেই আসে সংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা। সংবিধান এমন একটি ব্যবস্থা যা ব্যক্তি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিৎ করার জন্য চেষ্টা করে। অন্য ভাবে বলা যায় ক্ষুদ্র অংশকে রক্ষা করে বৃহতৎ অংশের শোষন হতে। রক্ষা করে দুর্বলকে সবলের হাত হতে। রক্ষা করে নারী ও শিশুকে, রক্ষা করে লঘু সম্প্রদায়কে, রক্ষা করে মুক্ত চিন্তাকে, রক্ষা করে দরিদ্রকে।
নির্বাচিত প্রতিনিধিমুলক পদ্ধতির একটি অসুবিধে হচ্ছে সব সময় সঠিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না। অনেক সময় সঠিক জনপ্রতিনিধি পাওয়া যায় না বা অনেক সময় জনগণ সঠিক প্রতিনিধি খুঁজে পেতে ভুল করে। তাই সংবিধানের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাকে সীমিত করে রাখা যেন তাঁর কখনই নিজেদেরকে জনগণের চেয়ে ক্ষমতাশালী বলে ভাবতে না পারে। সুতরাং বলা যায় সংবিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল ব্যক্তির মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের ক্ষমতাকেও নিশ্চিত করা। যদি আমরা সংবিধানের এই উদ্দেশ্যগুলো পরিষ্কার করে বুঝতে পারি তবেই বুঝবো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কেমনতর সংবিধান প্রয়োজন। পরবর্তীতে সেই বিষয়ে আলোকপাতের আশা রাখি।
মন্তব্য
ভাইয়া আসিফ নজরুলের এই লেখাটিও এই প্রেক্ষাপটে লেখা।
সময়চিত্রঃ আসিফ নজরুলঃ সংবিধান সংশোধনের চিন্তা কেন
----------------------------------------------------------------------------
জাহিদুল ইসলাম
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
ধন্যবাদ জাহিদ। উনি ভাল লিখেছেন। আমার চিন্তার সাথে অনেক কিছুওই মিল আছে। আমি আসলে খুব সরল করে এই বিষয়গুলো লেখার চিন্তা থেকে এই সিরিজটি শুরু করেছি। এবং প্রতিটি পর্বও ছোট আকারে রাখার চেষ্টা করছি। খুব বেশি মানুষের আগ্রহ নেই জানি। তারপরেও লিখে যাবো। মানুষের জানার প্রয়োজন আছে। সাধারণ মানুষ যদি সচেতন না হয় তবে প্রকৃত গণতন্ত্র কখনোই আসবে না।
এই কথা বলে একবার ধরা খেয়েছিলাম একটি ঘরোয়া আলোচনায়। রাজনীতিকরা তো বটেই, রাজনীতি সচেতন অ্যাকাডেমিশিয়ানরাও মনে করেন জনগণ কখনও ভুল করতে পারেন না। আপনি ঠিক কোন অর্থে বা কী মনে করে এটা লিখলেন, তা ব্যাখ্যা করবেন কি? তাহলে বিষয়টা সম্পর্কে আমি নিজেও একটু ক্লিয়ার হই।
লেখা পড়ছি, তা বলাই বাহুল্য। ধন্যবাদ।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
লেখায় যেমন বলেছি ডিরেক্ট বা সরাসরি গণতন্ত্র ছোট পরিসরের জন্য উপযোগী, তাই কোন দেশেই সেটার প্রচলন নেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গ সংস্থায় এই ধরণের পদ্ধতি ব্যবহার হতে পারে। ইংরেজী উইকিতে দেখতে পারো আরো কিছু তথ্যের জন্য।
তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবটি আমি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দিব। আমি মনে করি না যে বৃহত অংশের রায়ই সব সময় সত্য হয়। গণতন্ত্র ছাড়া কোন বিকল্প নেই, কিন্তু গণতন্ত্রই সত্য বা সবাই যেটাকে সত্য বলে মানে সেটাই সত্য সেটা ঠিক নয় বলেই মনে করি। এক সময় পৃথিবীর সবাই বিশ্বাস করতো যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। তখন যদি এই ব্যাপারে স্বিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ভোট হত তবে সেটাই জয়যুক্ত হতো। ঠিক এখনও তেমনি বিবর্তন অন্যান্য যেকোন বিজ্ঞানের মত সত্য হলেও সেটা মানুষের বিশ্বাসের কাছে হেরে যাবে বিপুল ভোটে। এ কারনেই আমি মনে করি জনগণের রায়ই চুড়ান্ত কিন্তু সেটা সঠিক নাও হতে পারে। কিন্তু জনগণের রায়কে চুড়ান্ত ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কারণ এটাও ঠিক যে জনগণ আজকে ভুল করলেও সেটা আবার সে শুঁধরিয়ে নেয়। এখন যেমন সবাই মানে যে সূর্য নয় পৃথিবীই সূর্যে চারপাশে ঘুরছে। সেই হিসেবে ঠিক আছে যে জনগণ ভুল করে না, কিন্তু কখনই করে না সেটা ঠিক নয়। জনগণের এই ক্ষনিক ভুলের কারণে যেন নিজেদের ক্ষতি না হয় সেটার জন্যই কিন্তু সংবিধান এর মত রক্ষা কবচের প্রয়োজন।
নতুন মন্তব্য করুন