এই পর্যন্ত প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করেছি গণতন্ত্রের ক্রমবিকাশ নিয়ে এবং দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করেছি নৈরাজ্যবাদ ও অভিভাবকতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রের সমালোচনা নিয়ে। এই পর্বে থাকছে গণতন্ত্রের কিছু তত্ত্বীয় বিষয়, এর সীমাবদ্ধতা এবং সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা।
তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির যৌক্তিকতা কী?
আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থা অথবা আদর্শ রাষ্ট্র কখনোই ছিল না এবং আশা করা যায় কখনো হবেও না। সুতরাং বাস্তব রাষ্ট্রে, বাস্তব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের মাঝে মতভেদ থাকবেই এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই সম্ভব সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে সন্তুষ্ট করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল মানুষ রাজনৈতিক ভাবে সমান হিসেবে বিবেচিত হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল মানুষ সর্বোচ্চ ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারী হয়, যেমনঃ বাক স্বাধীনতার, যাকে খুশি ভোট দেওয়ার, যে কোন রাজনৈতিক দল সমর্থন করার ইত্যাদি। এই ব্যবস্থায় একজন মানুষ সর্বোচ্চ নৈতিক স্বাধীনতাও ভোগ করে। তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির একটি বড় যুক্তি হচ্ছে যে - কোন একটি গোষ্ঠীতে বা সমাজে বা রাষ্ট্রে কোন একক ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তি অন্যান্য সকল সদস্যের তুলনায় এমনতর উন্নত নয় যে তাঁরা সকলকে শাসন করার অধিকার রাখে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটা ধারণা রাখা হয় যে গোষ্ঠীর সকল সদস্য সমানভাবে যোগ্য এবং সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সমান অধিকার রক্ষা করে। এটাকে লেখক বলেছেন রাজনৈতিক সমতার যুক্তি।
এবার আমরা দেখি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল উপাদান কী কী যা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল উপাদান পাচঁটি এবং এই পাচঁটি উপাদান আবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সমস্যাগুলোও তুলে ধরে।
১। কার্যকরী অংশগ্রহণঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকল সদস্যের কার্যকরী অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল কথা যেটা আমরা প্রাচীন গ্রীসের মডেলেও দেখতে পাই। যদি বিপুল সংখক মানুষ মতামত প্রদানে বিরত থাকে তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হবে না। একই সাথে চলে আসে তথ্যের অবাধ প্রবাহের বিষয়টি। যদি মতামত প্রদানের পূর্বে সমস্যা সম্পর্কে যথাযত ভাবে সকল সদস্য অবহিত না হয় তবে সে ক্ষেত্রেও প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত সার্বিক লক্ষ্যের জন্য কাজ করবে না। তাই সকলের কার্যকর্রী অংশগ্রহণ এবং মতামত প্রদানের পূর্বে সমস্যা সম্পর্কে যথাযত জ্ঞান রাখা গণতন্ত্রের প্রাথমিক মন্ত্র।
২। সমান ভোটাধিকারঃ রাজনৈতিক ভাবে সকল পূর্ণবয়স্ক নাগরিকেরই সমান ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। ধনী/গরীব, মেধবী/মিডিওকার, নারী/পুরুষ, সাদা/কালো, শ্রমজীবি/পেশাজীবি সকলের সমান ভোটাধিকার হচ্ছে গণতন্ত্রের আরেকটি মৌলিক উপাদান।
৩। ব্যক্তির বিচারবুদ্ধিতাঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সমস্যা সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বোঝার ক্ষমতা। যদি অধিকাংশ জনগণের সেই ক্ষমতায় ঘাটতি থাকে তবে সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হবে কাক্ষিত ফলাফল অর্জনে। এই সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে।
৪। এজেন্ডার পরিচালনাঃ কোন্ কোন্ সমস্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে এটা যারা পরিচালনা করে, যেমন নির্বাচন কমিশন, তাঁদের কথা বোঝানো হচ্ছে এখানে। নির্বাচন কমিশন যদি যথেষ্ট স্বাধীন ও নিরপেক্ষ না হয় তবে জনগণের প্রকৃত মতামত না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৫। ইনক্লুসিভনেসঃ ভোটের অধিকার কারা কারা সংরক্ষন করবে সেটা নিশ্চিত করা। কিছু গোত্র বা শ্রেণীকে শাসনযন্ত্র হতে বাদ দেওয়ার চেষ্টা নানান সময়েই দেখা গিয়েছে । যেমনঃ বহুদিন নারীদের, কালোদের ভোটাধিকার ছিল না। এখন অবশ্য এই সমস্যাটি আর নেই। এখন যেকোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিশু, সিদ্ধান্ত নিতে মানসিকভাবে অক্ষম এমন ব্যক্তি, এবং সাজাপ্রাপ্ত ব্যাক্তি ব্যতীত সকলেরই ভোটাধিকার রয়েছে।
উপোরক্ত পাচঁটি উপাদানের পরেও কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা রয়ে যায়ঃ
সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বনাম সংখ্যালঘুর শাসনঃ
এটি একটি আদি সমস্যা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির। গনতন্ত্র মানে কি সংখ্যালঘুর উপর সব সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন? সহজ উত্তর - সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হ্যাঁ। প্রতিনিধিমূলক পদ্ধতিতেও হ্যাঁ, তবে কিছুটা কম। এটি কি কোনভাবে এড়ানো সম্ভব? এ ক্ষেত্রেও সরাসরি জবাব না। যে কোন বাস্তব রাষ্ট্রেই মতভেদ থাকবে এবং কারোর মতামত গ্রহণ করা হবে এবং কারোর মতামত উপেক্ষিত হবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মতামত গৃহীত হবে এবং এর দ্বারা সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের সন্তুষ্টি অর্জিত হবে।
তবে প্রশ্ন আসে কোন বিকল্প পদ্ধতি কি সম্ভব? যেমনঃ সকলের মতামতের ভিক্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কিংবা দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশের ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সকলের মতামতের (১০০শত ভাগ) ব্যাপারে বলা হয় যে এটি একটি অসম্ভব ব্যবস্থা যে সকলেই কোন কিছুতে একমত হবে। সে ক্ষেত্রে যে কারোর হাতে ক্ষমতা রয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের উপর তার নিজের সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেওয়ার এবং সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর অবিচার হবে। একই যুক্তি খাটে দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশ ভোটের ব্যাপারে। তারপরেও বর্তমানে আমরা দেখি যে সংবিধান পরিবর্তনের মত মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অনেক দেশেই দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশ ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন আসে, কিভাবে সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করা যায়। এর একটি জবাব হতে পারে জনপ্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র, যা সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করে না। এছাড়া অন্যান্য সংস্থা, যেমনঃ বিচার বিভাগ, সংবিধান এর দ্বারাও সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কার্যকরী হতো যদি সকল নাগরিকের মাঝে সামাজিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমতা থাকতো। কিন্তু বাস্তব রাষ্ট্রে যেহেতু সকলের মাঝে নানান ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান, তাই সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলে সংখ্যালঘুরা সবসময় বঞ্চিত থাকতো। এ কারণেই আজ বেশিরভাগ দেশেই প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা দেখা যায়।
ব্যক্তিগত লক্ষ্য বনাম সার্বিক লক্ষ্যঃ
তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির লক্ষ্য কী? গণতান্ত্রিক পদ্ধতির লক্ষ্য হল সকলের মতামতের ভিক্তিতে সার্বিক ভালোর জন্য কাজ করা। এখানে তাহলে প্রশ্ন জাগে সার্বিক ভালো বলতে আমরা কি বুঝি। সার্বিক ভালো হচ্ছে সেটাই যেটাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এবং যেহেতু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত পাওয়া সম্ভব তাই এর মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব। এখানে আরো প্রশ্ন জাগে কীভাবে এই সার্বিক ভালো অর্জন করা সম্ভব। লেখকের যুক্তি হচ্ছে একটি গণ হচ্ছে কতিপয় সদস্যের সমন্বয়ে গড়া একটি সংস্থা যেখানে সকল সদস্য বুদ্ধিগতভাবে, অর্থনৈতিক ভাবে, সামাজিক ভাবে সমান বা প্রায় কাছাকাছি (Homogenous)। অর্থাৎ সদস্যদের মাঝে মতভেদ প্রকট নয়। এমন একটি গণের ক্ষেত্রে যখন প্রতিটি সদস্য যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করবে সে চিন্তা করবে নিজের লাভের কথা এবং সেই ভিক্তিতেই নিজের মতামত প্রদান করবে। এখন প্রতিটি নাগরিক যদি এভাবে নিজের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য মতামত দেয় এবং তাঁদের মাঝে যদি বৈষম্য কম থাকে তবে সেই মতামতের ভিক্তিতে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তাতে সার্বিক সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে এবং এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের দ্বারা সার্বিক ভালোর লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে। তাহলে এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হচ্ছে যে যদি সদস্যদের মাঝে বৈষম্য (বুদ্ধিগত, অর্থনৈতিকগত, সাংস্কৃতিকগত, জাতিগত ইত্যাদি) প্রকট হয় তবে সবাই নিজ নিজ উদ্দেশ্যে মতামত প্রদান করলে সার্বিক লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভবপর হবে না, যা আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য।
সরাসরি গণতন্ত্র বনাম প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র বনাম সাংবিধানিক গণতন্ত্র বনাম বহুসংস্থার শাসনঃ
আমরা দেখি যে সরাসরি গণতন্ত্রের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরাসরি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যার ফলে সংখ্যালঘু সব সময় নিগৃহীত থাকার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এছাড়া সরাসরি গণতন্ত্র বড় আকারের গণের পক্ষে ততটা কার্যকরী নয়। গণের আকার বড় হয়ে গেলে সকলের কার্যকরী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না, সে ক্ষেত্রে জনগণের প্রকৃত মতামত না পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এ কারণে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিবর্তনে আমরা দেখি প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা। প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থার ফলে গণের আকারের সীমাবদ্ধতা আর থাকে না। কিন্তু প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থাও সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করে না। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ব্যবস্থা অধিকতর কার্যকরী। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থাকে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিক্তিতেই সংবিধান রচিত হয় তবে সেটা কীভাবে সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করবে? এই ক্ষেত্রে আসে বহুসংস্থার শাসন* (Polyarchy) যেখানে ক্ষমতা শুধু জনপ্রতিনিধি কিংবা সংসদেই সীমাবদ্ধ থাকে না, ক্ষমতার বেকেন্দ্রীকরণ ঘটে নানান স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার হাতে। এমনই কিছু সংস্থা হচ্ছেঃ বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন মিডিয়া ইত্যাদি। এটিকে বলা হয় গণতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর যা আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করবো।
* Polyarchy এর অনুবাদ গুগুল ডিকশনারি দেখায় বহুজন কর্তৃক শাসনব্যবস্থা বা বহুশাসনতন্ত্র। কিন্তু আমার কাছে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রকেই সঠিক বলে মনে হয়েছে এর চরিত্র দেখে। বহুজন শাসনতন্ত্র এক প্রকার গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্য। তাই আমি Ployarchy এর অনুবাদ বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করেছি।
আর দুই পর্বে এই লেখাটি সমাপ্ত হবে। আগামী পর্বে থাকবে মূল বইয়ের শেষ অংশ, এবং শেষ পর্বে থাকবে মূল বইয়ের আলোকে নিজের কিছু বিশ্লেষণ।
মন্তব্য
জিনিসটা পরন লাগবো, পরে রাজনীতি কল্লে কাজে দিব। ভারি জিনিস।
শাফি।
এটা কিন্তু ভাইয়া টেক্সটবুক ধরণের হয়ে যাচ্ছে। এরকম হলে পড়তে মজা পাই না।
হু, এই পর্বটি বিরক্তিকর। আর বইটা আসলেই একটি টেক্সটবুক, তাই লেখাও সেই রকম হয়ে গিয়েছে। দেখি পরের পর্বটিতে কিছু করা যায় কি না। কি করবো বলো, বিষয়টিও তো একাডেমিক ধরনের।
লেখাটি আগামী পর্বেই শেষ করে দিব, কিছুটা বড় হলেও। শেষ পর্বে তোমার নিজের মতামতগুলো জানিও।
এই পর্বটিকে ব্যক্তিগত ব্লগে নেওয়া হল, শেষ পর্বটি দেওয়ার জন্য। কিছুটা আগেই শেষ পর্বটি দিয়ে দিলাম। যত তাড়াতাড়ি ঝামেলা মুক্ত হই তত ভাল। সিরিজ মানেই এক অশান্তি।
বোঝেন তাইলে আমি কিসের মধ্যে আছি।
তুমারে দেখে তো মনে হয় তুমি সিরিজের মধ্যে থাকলেই শান্তিতে থাকো। কিছুদিন পর পরই নানান ধরনের লেখা দাও। তুমার ইদানিং কালের টুকুন গল্প প্রায়ই মাথার উপর দিয়ে যায় আমার। তাই মন্তব্য করা হয় না সেগুলায়। ভাল থেকো।
নতুন মন্তব্য করুন