এই সিরিজের আগের তিনটি পর্ব পড়া না থাকলেও এই পর্বটি বুঝতে কোন অসুবিধে হবে না। এই পর্যন্ত প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করেছি গণতন্ত্রের ক্রমবিকাশ নিয়ে, দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করেছি নৈরাজ্যবাদ ও অভিভাবকতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রের সমালোচনা নিয়ে এবং তৃতীয় পর্বে আলোচনা করেছি গণতন্ত্রের কিছু তত্ত্বীয় বিষয় ও এর সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে। এই পর্বে থাকছে গণতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর বা বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র (Polyarchy) নিয়ে আলোচনা এবং সেই সাথে আগামী দিনে কেমন গণতন্ত্র আমরা দেখতে চাই সে সম্পর্কে লেখকের কিছু কথা। সবশেষে পুরো বইটি সম্পর্কে নিজের কিছু মতামত দিয়ে লেখাটি এই পর্বেই শেষ হচ্ছে। যারা এই পর্যন্ত ধৈর্য ধরে লেখাটির সাথে ছিলেন তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ।
গণতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর বা বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র ঃ
আমরা এটি আগেই আলোচনা করেছি যে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় রূপান্তরের একটি মূল প্রাপ্তি হলো প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা। এর ফলে সরাসরি গণতন্ত্রের যে আকারগত সীমাবদ্ধতা ছিল সেটি নিমিষেই দূর হয়ে গিয়েছে। নগরকেন্দ্রিক গণতন্ত্র থেকে আমরা চলে যাই এখন দেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্রে। কিন্তু এর ফলে এখন কিছু নুতন সীমাবদ্ধতার উদ্ভব হয়েছে। প্রথমতঃ প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি কী হবে কিংবা ক্ষেত্র কী হবে? নির্বাচন কি পপুলারিস্টিক ভোটের মাধ্যমে হবে নাকি ভোটের হার অনুপাতে হবে? দ্বিতীয়তঃ নাগরিকদের সরাসরি শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ যা গ্রীক গণতন্ত্রের মূলে ছিল সেটা এখন আর সম্ভব নয়। তৃতীয়তঃ রাষ্ট্রের আকার বৃদ্ধির ফলে নাগরিকদের মাঝে বৈচিত্র আরো বেড়ে যায় এবং যার ফলে মতভেদ আরো তীব্র হয়, শাসন ব্যবস্থা আরো জটিলতর হয়।
বৃহৎ আকারের গণতন্ত্রে শাসনযন্ত্রকে সঠিক ভাবে পরিচালিত করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রের মাঝে আরো এক ধরনেরর রূপান্তর ঘটে। তৈরী হয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, জন্ম নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের। এর ফলে শাসন যন্ত্র শুধু প্রতিনিধিদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না, ক্ষমতার বন্টন ঘটে নানান প্রতিষ্ঠানের হাতে যারা নিজেরা হয়ে উঠে স্বায়ত্বশাসিত। এভাবে সৃষ্টি হয় বহুসংস্থার শাসন। এমনই কিছু সংস্থা হচ্ছেঃ বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন মিডিয়া ইত্যাদি। বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রকে লেখক বলেছেন গণতন্ত্রের সর্বোচ্চরূপ, যা আমরা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির মাঝে দেখতে পাই।
বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের মৌলিক সাতটি উপাদান লক্ষ্য করা যায়ঃ
১। নির্বাচিত প্রতিনিধি ২। প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ৩। ইনক্লুসিভ সাফরেজ (Inclusive Suffrage) ৪। নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার
৫। বাক স্বাধীনতা ৬। বিকল্প তথ্যের অধিকার ৭। স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা
তাহলে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের উদ্ভব কীভাবে হয়ে থাকে?
যদিও বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র বড় আকারের জনগোষ্ঠীর জন্য গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রুপ তথাপি সকল দেশে এই শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। তাহলে কীভাবে এই শাসনতন্ত্র গড়ে উঠে? তার আগে আমরা ধারণা করি যে এক বা একাধিক অনুকূল পরিস্থিতিতে আমরা নিম্নোক্ত তিন ধরনের শাসন ব্যবস্থা পেতে পারি।
যদি পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে অনুকূল হয় তবে
১। NPR (Non Polyarchy Region) -> PR (Polyarchy Region)
যদি পরিস্থিতি অনুকূল না হয় তবে
২। NPR -> NPR
যদি পরিস্থিতি মাঝামাঝি হয় তবে
৩।(ক) NPR ->PR -> NPR
(খ) NPR -> PR -> NPR -> PR
(গ) NPR->PR->NPR->PR->NPR->PR-> ………(দোদুল্যমান)
তাহলে কি সেই অনুকূল পরিস্থিতিঃ
১। বল প্রয়োগের যন্ত্রগুলোর ক্ষমতার কেন্দ্রঃ রাষ্ট্র সাধারণত বল প্রয়োগ করে থাকে পুলিশ এবং সামরিকবাহিনী দ্বারা। তাই এটি দেখার বিষয় যে এই দু’টি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কাঁদের হাতে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বড় শর্ত হচ্ছে এই দু’বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত বেসামরিক ব্যাক্তির হাতে যিনি গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত। সাম্প্রতিক আফগানিস্তানে আমেরিকার সেনকমান্ডারের আপসারনের চিত্রটি এখানে দ্রষ্টব্য হতে পারে। তবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও বিপক্ষ মতের দমনে বল প্রয়োগ করতে পারে। তাই গণতান্ত্রিক ভাবে তাঁদের অপসারণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।
২। আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজঃ ঐতিহাসিক ভাবে দেখা যায় যে, যে সব সমাজে জনগণের আয়ক্ষমতা অধিক, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক, উন্নতর জীবন ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্রে অবাধ বৈচিত্র, উন্নত শিক্ষার হার, ক্ষুদ্র কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী, উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন বৃহৎ জনগোষ্ঠী, অধিকতর সংখ্যক স্বায়ত্বশাসিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অধিকতর সংখ্যক পেশাজীবি, ইত্যাদির হার বেশি সেই সব সমাজে বহুসংস্থার শাসন তন্ত্রের দেখা পাওয়া যায় বেশি। এ ধরণের সমাজকেই লেখক আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী (MDP: Modern, Dynamic and Pluralism) সমাজ হিসেবে বলেছেন। কেন এই ধরণের সমাজ বহুজনের শাসনতন্ত্রের জন্য সহায়ক? প্রথমতঃ নানান শিক্ষিত ও স্বনির্ভর জনগোষ্ঠীর কারণে ক্ষমতার পেছনের শক্তিগুলো নানান ক্ষেত্রে ছড়িয়ে যায়। যার ফলে কোন একক ব্যক্তি বা কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে সকল ক্ষমতা থাকা সম্ভবপর হয় না। দ্বিতীয়তঃ স্বনির্ভরতা ও শিক্ষা মানুষকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দিকে পরিচালিত করে।
তারপরেও প্রশ্ন থাকে যে অনেক দেশই পুরোপুরি আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজ না হওয়া সত্বেও বহুসংস্থার শাসন এসেছে। উদাহরণ হিসেবে ভারত, বাংলাদেশের কথা বলা যেতে পারে। ভারত, বাংলাদেশ সে রকম আধুনিক, উন্নত দেশ না হওয়া সত্বেও সেখানে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র বিদ্যমান। এই সব দেশে বহুসংস্থার শাসন এসেছে তাদের উপনেবেশিক শাসকগোষ্ঠী (বৃটিশ শাসন) হতে। তাই বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের জন্য আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজই একমাত্র উপায় এ কথাও জোর করে বলা যায় না।
আবার আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজ হলেও যে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র টিকে থাকবে তাও নয়। বলপ্রয়োগের যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ কাঁদের হাতে সেটি একটি মূল বিষয় যা আগের অংশে বলা হয়েছে। সামরিকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ যদি গণতান্ত্রিক প্রতিনিধির হাতে না হয় তবে যেকোন সময় সেই সমাজে অগণতান্ত্রিক সরকার চলে আসতে পারে। এ ছাড়া, একটি দেশে যদি বিভিন্ন জাতিগত দ্বন্দ্ব থাকে তবে সে ক্ষেত্রেও গণতন্ত্র বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করে। বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের সম্ভাবনা অনেক কমে যায় যদি জাতিগত বিভেদ প্রকট হয়। এই সব ক্ষেত্রে সকল জাতিকে নিয়ে একধরণের ঐক্যমতের সরকার গঠণ কার্যকরী হয়ে থাকে । অথবা প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীকে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন দিতে হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এই কারণেই এত জাতিগত বৈচিত্র থাকা সত্বেও গণতন্ত্রের ভিত ওদের শক্ত। জাতিগত বিভেদ টিকিয়ে রেখে কোনভাবেই বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। জাতিগত বিভেদ ছাড়াও বহিঃশক্তি গণতন্ত্রের একটি নিয়ামক। যদি বহিঃশক্তি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে সমর্থন জুগিয়ে চলে তবে একটি দেশে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্থ হয়।
পরিশেষে, একটি রাষ্ট্রে যদি সামরিক ও পুলিশ বাহিনী নিরপেক্ষ থাকে, যদি আধুনিক ও উন্নত সমাজ ব্যবস্থা থাকে, যদি জাতিগত বিভেদ বা জনগণের মাঝে মতভেদ প্রকট না থাকে, যদি বহিঃশক্তির প্রভাব না থাকে এবং রাজনৈতিক সংস্থাগুলো বহুসংস্থার শাসনে বিশ্বাস ও চর্চা করে তবে সেই রাষ্ট্রে বহুসংস্থার শাসনের উদ্ভব হবে এবং সেটি টিকে থাকবে।
আগামী দিনের গণতন্ত্রঃ
প্রায় দু’সহস্র বছরের অধিক পূর্বে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার চালু হয়েছিল যেখানে সকল সদস্য একে অন্যের তুলনায় রাজনৈতিক ভাবে সমান এবং সমষ্টিগত ভাবে নিজেরাই নিজেদের শাসন যন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ছিল। এই ব্যবস্থা অন্যান্য যে কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনায় উৎকৃষ্ট ছিল কারণ- প্রথমতঃ এই ব্যবস্থা সর্বোচ্চ ব্যাক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে, দ্বিতীয়তঃ এই ব্যবস্থা মানব সভ্যতার উন্নয়ন করে, তৃতীয়তঃ মানুষের সার্বজনিন ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করার এটাই সবচেয়ে উন্নত পন্থা ।
গণতন্ত্রের প্রথম রূপান্তরটি ঘটে গণতন্ত্র অথবা প্রজাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্রকে দূর করে ক্ষমতার কেন্দ্রে জনগণকে নিয়ে আসার মাধ্যমে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা ছিল মূলত ক্ষুদ্র নগর কেন্দ্রিক এবং সরাসরি গণতন্ত্র। দ্বিতীয় রুপান্তরটি ঘটে যেখানে প্রতিনিধিমূলক গনতন্ত্রের মাধ্যমে নগর কেন্দ্রিক গণতন্ত্র হতে দেশ কেন্দ্রিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। বৃহৎ আকারের শাসন যন্ত্রের কাজ যথাযত ভাবে সম্পন্ন করার জন্য উদ্ভব হয় শাসন যন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগ, যেমনঃ সংসদ, আদালত, নির্বাচন কমিশন। একে আমরা বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের (polyarchy) প্রথম রূপ বলতে পারি।
শাসন যন্ত্রের ধরন আরো জটিলতর আকার ধারণ করলে নির্বাচিত প্রতিনিধির পক্ষে সকল সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে অনির্বাচিত প্রতিনিধি যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ। তৈরী হয় বিভিন্ন অভিজ্ঞ কমিটি। এটি একধরণের ছদ্ম অভিভাবকত্ব যেখানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিজেদের ইচ্ছা জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে না কিন্তু জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের উদ্দেশ্য জনপ্রতিনিধিদের সাথে কাজ করছে। বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত মিডিয়া কিংবা জনগোষ্ঠী নানান ভাবে জনপ্রতিনিধিগণকে উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকে। এই ধরণের ব্যবস্থাকে আমরা বলতে পারি বহুসংস্থার শাসন যন্ত্রের দ্বিতীয় রূপ। এটিই এই পর্যন্ত গণতন্ত্রের আধুনিকতম রূপ যা আমরা সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখে থাকি।
এখন বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর কি অবশ্যাম্ভাবী? লেখকের মতে এটি হতে পারে সাধারণ জনগণের সাথে রাজনৈতিক এলিটদের যে জ্ঞানের ব্যবধান রয়েছে সেটিকে কমিয়ে। ক্ষমতায় আরোহীরা সাধারণ জনগণের চেয়ে অধিকতর বোঝদার সেটা নয় বরং তাঁরা সাধারণ জনগণের চেয়ে বেশি তথ্য পেয়ে থাকেন। যদি জনগণের কাছে সকল তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করা যায় তবে জনগণও সঠিক ভাবে যে কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারতো। তাই তথ্যের বিকল্প ব্যবস্থার উপর লেখক জোর দিচ্ছেন এবং অভিবাবকদের উপর নির্ভিরতা কমিয়ে জনগণের উপর নির্ভরতা বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছেন। লেখকের মতে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের শেষ ধাপ হবে যখন জনগণের সরাসরি অংশ গ্রহণেরর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রতিফলিত হবে, অনেকটা প্রাচীন গ্রীসের সরাসরি গণতন্ত্রের মত।
এই অংশের মাঝে দিয়ে বইটির মূল অংশের অনুবাদ শেষ হলো।
আমার নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণঃ
এই বইটির মূল অংশ যে কারণে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি তা হল লেখকের যুক্তিবোধ। গণতন্ত্রের প্রতিটি সীমাবদ্ধতাকে লেখক এখানে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন এবং সেগুলোকে সমাধানের চেষ্টা করেছেন। প্রথমত যেটা করেছেন ইতিহাসের আলোকে গণতন্ত্রকে দেখেছেন এবং গণতন্ত্রের প্রধান পরিবর্তনগুলোকে চিহ্নিত করেছেন। অতঃপর গণতন্ত্রের প্রধান সমালোচক, প্রতিদ্বন্দ্বী নৈরাজ্যবাদ এবং অভিবাবকতন্ত্রের চোখ দিয়ে এর সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করেছেন এবং যুক্তি দিয়ে স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন কেন গণতন্ত্র অন্যান্য যে কোন শাসন ব্যবস্থা হতে সর্বোৎকৃষ্ট। যোগ্য লোকের শাসন নাকি সাধারণ জনগণের শাসন – বহুল আলোচিত এই প্রশ্নের কিছু জবাব আমরা এখানে পাই। লেখক শুধু এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল উপাদান, এর নিয়ামকগুলোকে তুলে ধরেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কেন যৌক্তিক, এবং কীভাবে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা হতে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের উদ্ভব হল সেটি দেখিয়েছেন। সাথে দেখিয়েছেন বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের সহায়ক শক্তিগুলো কী কী এবং কেনই বা কোন কোন দেশে এই শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে কিন্তু অন্য কোন দেশে নয়। বহুসংস্থার শাসন ব্যবস্থাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন আধুনিক গণতন্ত্রের সর্বোচ্চরূপে। তারপরে লেখক দেখিয়েছেন যে এই ব্যবস্থাকেও আরো উন্নত করা সম্ভব যদি সাধারণ মানুষকে শাসনযন্ত্রে আরো জড়িত করা যায়, জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ আরো বাড়ানো যায়। সে কারণে জনগণের কাছে তথ্যের সহজগম্যতার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি মূলত জনগণকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রীসের মূল গণতান্ত্রিক মডেলেই ফিরে যাবার একটি স্বপ্ন দেখেছেন।
এটি একটি বড় প্রশ্ন, আমরা কি আসলেই প্রাচীন গ্রীসের সেই সরাসরি গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পারি। এর তাত্ত্বিক জবাব হতে পারে আজকের এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একটি দেশের এর মত বৃহৎ আকারের গণের ক্ষেত্রেও এখন সরাসরি গণতন্ত্র সম্ভব। কিছুদিন আগেও আমাদের হাতে উন্নত প্রযুক্তি ছিল না যার মাধ্যমে নিমিষে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মতামত গ্রহন করা সম্ভবপর হতো। কিন্তু আজকের এই মিডিয়া, মোবাইল, ফোন, ইন্টারনেট এর যুগে কয়েক ঘন্টার মাঝেই যেকোন আকারের জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত জানা সম্ভব। তাই তাত্ত্বিক জবাব হল, হ্যাঁ, সরাসরি গণতন্ত্র এখন সম্ভব। তার উপর বিভিন্ন কারণেই আজ প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র মানুষের সার্বজনিন ইচ্ছার প্রতিফলেন ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষের মাঝে আজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি এক ধরণের হতাশা দেখা যাচ্ছে। তবে কি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে সরাসরি গণতন্ত্রই হবে আমাদের পরবর্তী রূপান্তর?
কিন্তু সরাসরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথা আমরা জানি। রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজে যদি জনগণের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তবে সেটা বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী হবে কি? আবার সরাসরি গণতন্ত্রের জন্য নাগরিকদের মাঝে বৈষম্য প্রকট না হওয়া উচিত। কিন্তু যে কোন বৃহৎ আকারের জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকবেই। তাই সরাসরি গণতন্ত্র এখনো বাস্তব সম্মত নয়। তাই এর একটি সমাধান হতে পারে প্রতিনিধিমূলক ও সরাসরি গণতন্ত্রের এক মিশ্র ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজ জনগণের পক্ষ হতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা করে যাবেন জনগণের দ্বারা রচিত বিধিমালা (সংবিধান) মোতাবেক। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা কখনই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে না। কেন্দ্রে থাকবে জনগণ। যে কোন মুহুর্তে, যে কোন জনপ্রতিনিধিকে জনগণ অপসারণ করতে পারবে, তাদের ভোটের মাধ্যমে। যেকোন ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে জনগণ, সরাসরি ভোটের মাধ্যমে। এই ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও বিভিন্ন স্বাধীন সংস্থাগুলো জনগণকে সহায়তা প্রদান করবে। বর্তমান পদ্ধতির সাথে এই নুতন পদ্ধতির একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে যে কোন জনপ্রতিনিধিকেই দীর্ঘমেয়াদের জন্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অনেকটা চাকুরীর ক্ষেত্রে যেমন বছর বছর কাজের মূল্যায়নের উপর নির্ভর করে চাকুরীর নবায়ন করা হয় সেরকম। এ রকম প্রতি ছয় মাস বা প্রতি এক বছর বা যে কোন সময়েই যে কোন জনপ্রতিনিধির কাজের মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকবে। কেউ ভাল কাজ করলে তিনি আজীবন থাকবেন, না হয় নুতন প্রতিনিধি আসবে। এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব এবং জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল তথ্যের বিকল্প ব্যবস্থার পথ নিশ্চিত করা। জনগণকে ক্ষমতার কেন্দ্রে রাখতে হলে, জনগণের কাছ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত পেতে হলে তথ্যের অবাধ প্রবাহের বিকল্প নেই। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি এই ক্ষেত্রেও সহায়ক হতে পারে। প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠনের তথ্য যদি অন্তর্জাল, পত্রিকা, মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌছানো সম্ভব হয় তবে জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানে ভুল করবে না এবং এর দ্বারা জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতাও নিশ্চিত করা সম্ভব।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ভিন্ন অন্য কোন উন্নতর শাসন ব্যবস্থা সম্ভবপর নয়। তাই শুধু প্রয়োজন এর সীমাবদ্ধতাগুলোকে দূর করে ব্যবস্থাটিকে আরো উন্নত করা। জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতার মাধ্যমে, জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধের মাধ্যমে, জনগণের হাতে মূল ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্রকে আরো সুসংহত করতে পারি। বহুসংস্থার শাসন, ই-গভর্নমেন্ট, ই-ভোটিং, আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচন, ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি করা উচিত যেন জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে না থেকে জনগণই ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্রে থাকে। গণতন্ত্র আরো সুসংহত হোক এই আশা ব্যক্ত করে লেখাটি এখানেই শেষ করছি।
মন্তব্য
আপনার অধিকাংশ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত নেই। স্বায়ত্তশাসিত বহুসংস্থা জরুরি সন্দেহ নেই। তবে প্রাইভেট সেক্টরের ভূমিকা এখানে আলোচিত হয় নি।
আমার মনে প্রাইভেট সার্ভিস গণতন্ত্রের একটি অন্যতম শক্তি। এর সাথে কন্ট্রাস্ট করা যায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যেখানে সকল সার্ভিস একমাত্র রাষ্ট্র প্রদান করে। সেখানে সিস্টেম বেশি ভঙ্গুর, দুর্নীতিপ্রবণ। কোনো সেবা কেবল একটি সংস্থার হাতে থাকলে সেই সেবার সুষম বন্টন বা কার্যকরভাবে প্রদানের জন্য অনেকগুলো নিয়ামকের উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে কোনো কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও যদি এমন ব্যবস্থার সফলতাও দেখা যায়, অন্য অনেক রাষ্ট্রে সেটার ব্যর্থতাই বেশি দেখা যায়।
এখানে প্রাইভেটাইজেশানের ভূমিকা অনেক। যেমন, নিরাপত্তা একটি সেবা। এই সেবাটার জন্য যে দেশেই থাকি আমি সরকারকে অর্থ দিতে বাধ্য থাকি। এবং আমার থেকে নেয়া এই অর্থের বিনিময়ে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান থাকে যে আমাকে নিরাপত্তা সেবা দিয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রেই সেই সেবা নামেমাত্র। এখন সরকার এই নিরাপত্তা সেবার উন্নতি করার নানা চেষ্টা করতে পারে। তবে, আরেকটা বিকল্প হলো ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান যদি আমাকে নিরাপত্তা দেবার জন্য অফার করত। তখন আমার অনেক অপশন থাকত। নামেমাত্র সেবা দেয় জেনেও একটি প্রতিষ্ঠানকে অর্থ দিতে বাধ্য থাকতে হত না। যে প্রতিষ্ঠানকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হত, তার থেকে আমি ইনস্যুরেন্স কিনতাম। সেই প্রতিষ্ঠান সেবা দিতে ব্যর্থ হলে আমার সুযোগ থাকত অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে যাবার। এতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই চেষ্টা করত সেবার মান উন্নত করার, বেশি গ্রাহক পাবার জন্য।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও এমন অনেক সেবা থাকে যেগুলো কেবল সরকারের হাতে থাকে। আমার প্রকল্প হচ্ছে, সেগুলো সরকারের হাতে থাকার তেমন গুরুত্বপূর্ণ কারণ নেই। যদিও, সকল সরকারই নানারকম কারণ উদ্ভাবন করবেন ওসব সেবায় তাদের প্রয়োজনীয়তা দেখানোর জন্য।
কোনো সেবা যখন কেবল সরকারের একটি সংস্থা দেবে, তখন সেটাকে কার্যকর রাখার জন্য, সবচেয়ে উন্নত সেবা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে বেগ পেতে হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা প্রায় অসম্ভব কাজ।
একইভাবে, একাধিক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান দিয়ে সেবার ব্যবস্থাতেও অনেক জটিলতা থাকবে। বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন, আরবিট্রেশন, এটা একটা কঠিন কাজ। অর্থাত দুই ধরনের ব্যবস্থারই সমস্যা আছে। কিন্তু, আমার প্রকল্প, একাধিক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান দিয়ে সেবার ব্যবস্থা প্রয়োগ অসাধ্য নয়। অবাস্তবও নয়। গণতন্ত্র যেমন একটি ইম্পারফেক্ট ব্যবস্থা হয়েও গ্রহণযোগ্য হিসেবে সকল সমাজে গৃহীত হচ্ছে, তেমনি আমার প্রস্তাবিত ব্যবস্থাটিও বিভিন্ন সমস্যা সত্ত্বেও অবশ্যই গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর একটি ব্যবস্থা হবে।
তা এই প্রাইভেট সেবার ব্যবস্থা থেকে আমরা কি পাচ্ছি? কেন আমরা এই ব্যবস্থাতে আগ্রহী হব? সেটা হচ্ছে বেছে নেবার স্বাধীনতা। বর্তমান ব্যবস্থাতেও আমরা কোনকিছু বিনামূল্যে পাই না। সকল সেবার জন্যই সকল দেশে আমাদেরকে মূল্য দিতে হয়। আমার প্রস্তাব কেবল একাধিক সেবা প্রতিষ্ঠান থাকার যাতে আমাদের প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে উন্নত সেবা নিশ্চিত থাকে।
আর এই ব্যবস্থা গণতন্ত্রেই প্রয়োগ করা সম্ভব। তখন হতে পারে এটা গণতন্ত্রের চতুর্থ রূপান্তর।
কিন্তু প্রাইভেট ব্যবস্থায় যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে তবে সেখানেও কিন্তু গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রাইভেট কোম্পানীগুলো নিজেদের সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য একধরনের সিন্ডিকেট তৈরি করে যার ফলে জনগণের দুর্ভোগ আরো বেশি হয়। আমার মনে হয় তুমি যেটা বলছো সেটা ঠিক আছে যে সেবাগুলোকে প্রাইভেটে দিতে পারি তবে, সরকার নিজেও প্রাইভেটদের পাশাপাশি সেবা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার নিজেও প্রাইভেট সেবা প্রদানকারিদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই টিকে থাকবে। যারা সেবা ভাল দিবে জনগণ তাঁদের কাছে যাবে। এই একই কাজটিই মনে হয় ওবামা তার নুতন স্বাস্থসেবার প্যাকেজে এনেছে। আবার তুমি দেখো যে সরকারি সেবা মানেই কি খারাপ? যদি একটি সিস্টেম থাকে, এবং সকলের যদি জবাবদিহীতা থাকে তবে সরকারি ব্যবস্থাতেও ভাল সেবা দেওয়া সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে কানাডা, সুইডেন এর স্বাস্থসেবার কথা বলতে পারি। কানাডার শিক্ষা সেবার কথা বলতে পারি। প্রয়োজন কার্যকরী ম্যানেজমেন্ট। আমাদের দেশের এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে সঠিক ভাবে কন্ট্রোল করতে হলে দরকার আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার। সকলকে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের আওয়তায় নিয়ে আসলে দুর্নীতিগুলো কমানো যেত। অবৈধ আয়গুলোকে চিহ্নিত করা যেত। অনিয়মগুলো রোধ করা যেত। আর অন্য কোন ভাবে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় দেখি না।
চমৎকার একটি সিরিজ শেষ করলেন স্বাধীন ভাই। সাধুবাদ জানাই সেজন্য।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
ধন্যবাদ জাহিদ।
নতুন মন্তব্য করুন