সভ্যদের উলঙ্গ থাকার ইতিহাস

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি
লিখেছেন সৈয়দ আখতারুজ্জামান (তারিখ: মঙ্গল, ১০/০৬/২০০৮ - ১২:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে ঠিক এ রকম একটা পথের দেখা পাই,
স্পষ্ট দেখি - একটা অন্ধগলির শেষ প্রান্তে এসে ঘুরে দাঁড়িয়েছি
একটা তীব্র যতিচিহ্ন এসে রোধ করেছে চলমান গতি
আর আদেশ পেয়েছি সমাপ্তের বন্দর থেকে নোঙর তুলে
আবার শুরুর দিকে ফিরে যাওয়ার

নিজেকে দেখতে পাই পরিষ্কার - অন্ধগলি থেকে ফিরছি ক্রমশ
আর অকস্মাৎ আমার টনক নড়ে ওঠে -
অনুভূতির আকাশ খামচে ধরেছে দৃষ্টির নখর
একটু আগের সেই চেনা-পথ আর নেই
যে পথ চিরচেনা ছিলো -
শরীরের ছায়া গড়িয়েছে কত এর ধূলো মাটি ঘাসে
কত সহজেই অচেনা হয়ে গেছে সেই চেনা পরিপার্শ্ব
'আমি' আর 'সেই আমি' নেই - দীর্ণ, শীর্ণ, ক্লিষ্ট হয়ে গেছি
রাজপথ যেন পরিত্যক্ত ভূমি, খানা-খন্দের রাজত্ব
বুনো মহিষের জিভের মতো অমসৃন বাতাস ঝাপটা মারছে গালে
পায়ের তলায় ঢুকে যাচ্ছে বিষাক্ত ভাঙা শামুকের খোল্
রোদ্রের উজ্জ্বল পাখায় গজিয়ে উঠছে কালচে মেঘের পালক
আর সুরমার ব্রীজের তলায় চেয়ে দেখি
বাঁধ-না-মানা যুবতী-নদীটার দেহ মরাকটালের টানে
শুকিয়ে এখন মমি হয়ে আছে;
কীর্তনখোলা নদী ধরে আরেকটু এগুলেই বিশখালি
দেখি তার হা-করা কংকাল মুখ কাত হয়ে আছে ধানক্ষেতের পাশে
বুকের ভেতর একটা সাপে ধরা ব্যাঙ মোচড় দিয়ে ওঠে;
গোসাই পাড়ায় দেখা পাই প্রথম প্রেমিকার -
পান-বরজের মতো মুখ তার পাথরকুচি ঝোপ
বজ্রাহত হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ি
ঘোলাটে চোখের ঝুলে পড়া চামড়ার নিচে
জমাট বেঁধেছে কবরের অন্ধকার;
দুই হাতে মুখ ঢাকি,
হারপুন-বিঁধে-যাওয়া হাঙরের গোঙানী দলা পাকিয়ে ওঠে গলার ভেতর;

রাস্তার ওপর ইতস্তত বাবলার পাতা আর ছইলার ভাঙা-ডাল পড়ে আছে
নতুন নিমগ্নতায় ফিরে যাচ্ছি পুরনো গন্তব্যে
এই সেই মাতৃদ্বারমুখী যাত্রাপথ
এই সেই সভ্যদের উলঙ্গ থাকার ইতিহাস
দেখতে দেখতে অবিশ্রাম অগ্রসর হচ্ছে দেহগাড়ি আর চোখের পানসি

মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে ঠিক এ রকম একটা পথের কথা ভাবি
যখন চোখের সামনে অস্তিত্ব বলি হতে দেখি
যখন নিগূঢ় সত্যটা মুখোশ খুলে ফেলে, আর বুঝে যাই
আসলে বেজন্মা কুকুরের মতো দু'মুঠো ভাতের জন্য এই বেঁচে আছি।


মন্তব্য

পুতুল এর ছবি

মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন জাগে মনে, মাকে শুধাই মা ধরতি তুমি কার?
তখন তথাকথিত সভ্য মানুষ গুলোকেই বেশি অসভ্য মনে হয়।
"বেজন্মা কুকুরের মতো দুমুঠো ভাতের জন্য" অনেকেই বেঁচেও থাকতে পারে না।
কবির সাপের মুখে আটকে পরা হৃদয়টাকে নমস্কার।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

ধন্যবাদ দিয়েন না, ধন্যবাদ আপনারই প্রাপ্য!

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

আপনার কথায় ভালো লাগলো। আসলে লেখাটা অনেকটা একটানে লেখা। সময় পেলে এর অবয়বটা আরেকটু ছেঁটে দেয়ার পক্ষে। কবিতা এম্নিতেই কেউ পড়ে না (অনেকে ভয় পায়), তার ওপর এই দৈত্যাকৃতির রাখলে পাঠক পাছে আবার গাল-মন্দ না করেন!

অতিথি লেখক এর ছবি

উদ্ধৃতি
কবিতা এম্নিতেই কেউ পড়ে না (অনেকে ভয় পায়)...

তবে কবিতা প্রেমীরও অভাব নেই। মন্তব্য করতে যেয়ে ভীড়ের চাপে ছিটকে পড়ি। তাই মন্তব্য হয় না।
আপনার মাঝে এখন কবিতার ভরা মৌসুম চলছে। কাটছাটে সময় নষ্ট না করে আরো লিখুন। অবসাদ কালে যা খুশি তাই করতে পারবেন। ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

ভালো বলেছেন। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

হারপুন-বিঁধে-যাওয়া হাঙরের গোঙানী দলা পাকিয়ে ওঠে গলার ভেতর;

পুরা কবিতাটা পইড়া টাস্কি খাইলাম। এইটা কি ভাই? আপনি তো আগুন জ্বালাইয়া দিলেন। জীবনে এরচেয়ে তীব্র সত্যি আর কী আছে!

মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে ঠিক এ রকম একটা পথের কথা ভাবি
যখন চোখের সামনে অস্তিত্ব বলি হতে দেখি
যখন নির্গূঢ় সত্যটা মুখোশ খুলে ফেলে, আর বুঝে যাই
আসলে বেজন্মা কুকুরের মতো দুমুঠো ভাতের জন্য এই বেঁচে আছি।

ভয়ংকর! দোয়াকরি আপনি আমাদের গৌরব হন।

পরশ পাথর

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

জানি না কী হতে পারবো, তবে আমৃত্যু লিখে যাবো এ কথা বলতে পারি। আপনাকে মন্তব্যের অনেক ধন্যবাদ।

মুজিব মেহদী এর ছবি

আদেশ পেয়েছি সমাপ্তের বন্দর থেকে নোঙর তুলে
আবার শুরুর দিকে ফিরে যাওয়ার

আবার শুরু আবার শেষ, আবার শুরু আবার শেষ...

সুরমা থেকে বিশখালী-- মনভ্রমণে অনেক পথ।
................................................................
আমার সমস্ত কৃতকর্মের জন্য দায়ী আমি বটে
তবে সহযোগিতায় ছিল মেঘ : আলতাফ হোসেন

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

মুজিব ভাই, সত্যি এ এক চক্র!
আর স্বীকার করছি সুরমা থেকে বিশখালি মনভ্রমণে অনেক পথ। আমি চেয়েছিলাম এই পথ আরো দূরগামী করে তুলতে, কিন্তু নিজের দৌরাত্ম্যও এর থেকে খুব দূরে নয়। আর কবিতার কলেবর ছোট রাখার একটা আগাম সিন্ধান্ত মাথায় থাকায় অনেক দ্রুত অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। কবি এই ভ্রমণে পরিশ্রান্ত হয়ে থাকলে ক্ষমা চাচ্ছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

দোস্ত, আমার অনুরোধ কবিতার একটা লাইনও কাটার চিন্তা করিস না। তাহলে এ কবিতার অঙ্গহানী হবে। অসাধারন এ কবিতা, অসাধারন এর পঙতিমালা। মনে দারুন দাগ কেটে গেল।

কীর্তিনাশা

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

তাই? তবে তাই হোক!

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অসাধারণ! আপনার আগের কবিতাগুলোকেও ছাপিয়ে এক নতুন মাত্রা পেয়েছে এই কবিতাটা।
একটাই অনুরোধ, যখনই যাই মাথায় আসে না কেন, লিখে ফেলবেন। কবিতা সবাই লিখতে, পড়তে, বুঝতে পারে না। আপনার ভেতরে কবিতার জন্য আলাদা একটা ভালবাসা আছে বোঝা যায়। ধরে রাখেন এটা।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

আপনার এই পরামর্শটা আসলেই দুর্দান্ত! মাঝে মাঝে কিছু লাইন বিদ্যুত চমকের মতো মাথায় ঝলসে উঠে হারিয়ে যায়, তারপর যখন লিখতে বসি তখন আর তারে খুঁজে পাই না। হায়রে স্নায়ু তোলপাড় করে খোঁজাখুজি। লাইনতো দূরের কথা, কী যে বিষয় মনে এসেছিলো তাই-ই আর মনে আসে না।
মন্তব্য আর পরামর্শ - দুয়ের জন্যই অশেষ কৃতজ্ঞতা।

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

সত্যি অসাধারণ! গর্বিত এরকম এক কবিকে সাথে পেয়ে! তোমার ধ্বনিমঙ্গল রণিত হোক দিকে দিকে...
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

আপনার মন্তব্যে অসীম সাহস পাই। সাহস পাই অ-ধরাকে ধরার আর দুর্জয়কে জয় করার। আবার শঙ্কিতও হই। যতই উপরে উঠি, পতনের ভয়াবহতা ততই বেড়ে যায়, শঙ্কাও বাড়ে সাথে সাথে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।