নদীর নাম তাগুশ, লোকে তারে হাজার বছর ধরে তেজো নামে ডাকে। কিন্তু রকম সকমে সে মহাসমুদ্রের ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে। গ্রামের চেয়ারম্যানের দোনালা বন্দুক-বাহক দুবলা-পাতলা যে বডিগার্ড লোকটি ঢিলা প্যান্টের পতন ঠেকাতে পাইরেট-বকলস লাগিয়ে ধান ক্ষেতের আইল ধরে চেয়ারম্যানের পিছে পিছে হাঁটে কিন্তু পুরু গোঁফের তলায় সংসদ-সদস্য টাইপ হাসি ঝিলিক মারে তার মতো আর কি! গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল!
নদী সাগরে মেশে, সাগর গিয়ে মহাসাগরে মেশে - এটাই জলের গতিধারা। কিন্তু এই ইঁচড়ে পাকা তাগুশ নদী সাগরের তোয়াক্বা না করে, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়ে, সোজা গিয়ে মিশেছে আটলান্টিক মহাসাগরে। এই নদীর পাড়ে দাঁড়ালে জলের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজের বদলে সাগরের বালুকা বেলায় জলের আছড়ে পড়ার শো শো শব্দ পাওয়া যায়। এই নদীতে বড় বড় প্রমোদতরী আসা যাওয়া করে। দশ-বারো তলা, অনেক বড় বড় ক্রুজ শীপ।
এই নদীর উপর বড় বড় ঠ্যাং ফেলে দাঁড়িয়ে আছে ইউরোপের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু - ‘ভাস্কো দা গামা’। কিছুটা দূরত্বে নতুন বউয়ের সিঁথিতে শুয়ে থাকা সোনার টিকলির মতো আরো একখানা অনিন্দ্য সুন্দর সেতু - 'ভিন্তে সিঙ্কো দো এব্রিল’ পুরো লিসবনের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। পাল্টে দিয়েছে তাগুশ নদীর রূপ। যে রূপে আগুন জ্বলে। তাগুশের ওপারে আরো কত জনপদ। আলমাদা, কাসিলাস, কাপারিকো, ট্রেফারিয়া, সেইশাল আরো কত কী! তাই তাগুশের এত অহং, এত বড়াই, চোখে তার অফুরন্ত যৌবনের শিখা।
স্পেনের তেরুয়েল থেকে জন্ম নেয়া এই নদী ১০০৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, এই লিসবন শহরের বুক চিড়ে, মিশে গেছে আটলান্টিক মহাসাগরে। হাজার বছর ধরে এই তাগুশ নদীর তীরে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে লিসবন শহর। জন্ম নিয়েছে আধুনিক পর্তুগাল। সেই প্রাচীনকালে সাগর, নদী, মোহনা আর স্থলভূমি মিলে জনপদ গড়ে ওঠার জন্য পর্তুগাল ছিলো খুবই মোক্ষম জায়গা। ইউরোপের সবচেয়ে পশ্চিমের দেশ। এক সময় এই নদীর তীরে ভিড়েছে সাগর থেকে আসা বেনিয়া নাবিকের জাহাজ, জেলে নৌকা, জল দস্যুর তরী। পা ফেলেছে সারা দুনিয়ার দূর দূরান্তের সৈন্য-সেনাপতি, ব্যবসায়ী, কৃতদাস, জাদুকর, পাদ্রী-পোপ-পুরোহিত, ছাত্র-বিজ্ঞানী-রাজনীতিবিদ, কুলি-কামার-মজুর। শত পেশার হাজার মানুষের ভিড়ে এই জনপদ মুখরিত হয়েছে। বিন্দু বিন্দু নোনা জলের ভেতর, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণার মিলনে ধীরে ধীরে এখানে গড়ে উঠেছে ইউরোপের দ্বিতীয় প্রাচীন পর্তুগীজ সভ্যতা, যা রোমান সভ্যতার চেয়েও পুরনো।
না, শুধু মুখরিত হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, রক্তাক্তও হয়েছে বহুবার। তাগুশ নদীর জল বহুবার রক্তে লাল হয়েছে। অগনিত জীবনের শেষ নিঃশ্বাস এই নদীর জলে ত্যাগ হয়েছে। নিরবধি স্রোতে ভেসে গেছে অগণিত দেহ, পচেঁ-গলে মিশে গেছে ধরিত্রির গভীরে।
যুদ্ধের পর যুদ্ধ ঝনঝনিয়ে বেজেছে। মৃত্যুর পাহাড়ের উপর আবারো মৃত্যুর স্তুপ গড়ে উঠেছে। রাজার পরে রাজা শাসকের পরে শাসক ক্ষমতার গদি আকড়ে ধরতে অথবা ক্ষমতার গদি হারিয়ে ভগ্নহৃদয়ে পাড়ি দিয়েছে এই তাগুশ নদী। আর এই ইতিহাসের অলিতে গলিতে, নালা-নর্দমায় কত চোর, ডাকাত, দস্যু, গুপ্তচর, গায়ক, লেখক, কবি ও কবিরাজ জন্ম নিয়েছে এবং ভেসে গেছে তাগুশ নদীর জলে তার হিসেব কেউ রাখেনি।
এখন তাগুশ নদীর তীরে রাতভর অন্তহীন আলোকসজ্জা। আতশবাজির ডামাডোল। অগণিত প্রমোদ তরী থেকে উদ্দাম তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ভেসে আসে। জীবনকে নিংড়ে তার সমস্ত রস আস্বাদন করে দুরন্ত যৌবন। তীরের খোলা প্রাঙ্গনে একবিংশ শতাব্দীর কনসার্ট বাজে। এক বছর আগে থেকে টিকেট বিক্রি শুরু হয়।
নানা উৎসব পার্বণে এই নদীর তীরে লাখো মানুষের ভিড় দেখা যায়। স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানী, যুক্তরাজ্য, আরো কত ইউরোপের দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, সারা দুনিয়া থেকে পর্যটক আসে এই নদীর ধারে। কেউ একা, কেউ দলেবলে, কেউ দুজনে দুজনায়। সেজে গুজে, প্রেয়সীর চিক্কণ কোমড়ে পারদর্শী আঙুল রেখে তারা টগবগিয়ে আসেন। ওপেন এয়ার ডিনার টেবিলে বসেন। পর্তুগালের বিখ্যাত পোর্ট ওয়াইনের বোতল খোলেন, নিপুন দক্ষতায় ঐতিহ্যবাহী কড ফিশ-কাবাবের নরম শরীরে যখন বাঁ হাতে ধরা কাঁটা চামচ বসিয়ে দেন, তখন তাগুশের জলে সাঁতার কাটতে দেখা যায় অনেক অনেক কমন কার্প, ট্রাউট ফিশ বা জিপসি বারবেল।
সূর্য ডুবে গেলেই হাজার বাতি জ্বলে উঠতে থাকে। পর্যটকের ভিড়ে মুখ হয়ে ওঠে তাগুশ নদীর দুই পাড়। তখন হয়তবা নদীর ধারের জেলে গ্রাম আলফামার ছোট্ট রেঁস্তরায় টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে জীবনের সমস্ত আবেগ একীভূত করে কোন এক ফাদো শিল্পী সেই প্রাচীন সংগীতের রস গলায় তুলে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
মুগ্ধ পর্যটকের চোখে যতই বাহাবা থাকুক না কেন রেঁস্তরা-মালিকের চোখ থাকে বিলের অংকে। হে ফাদো সংগীত, তুমি কতটা আয়ের উৎস, কতটা ঘুরাতে পারছো অর্থনীতির চাকা! পর্যটনখাতে তাহলে ডাটা ড্রিভেন মার্কেটিং প্রয়োগ করে কী লাভ হলো! ঐতিহ্যের মুখ এখন ‘পাইথন’ কোডিং বা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ এর মুখোশ পরে তাগুশ নদীর জলপ্রবাহের মতো স্ক্রলড হয়ে যাচ্ছে মোবাইল স্ক্রিণে, অন্তর্জালে।
রাত বাড়ে, পর্যটকের ভিড় কমে না। ঢেউয়ের মতো আসে আর যায়। গ্রীষ্মে এই সমাগম আরো বাড়বে। গ্রীস্মের লিসবন শহর সারা রাত জেগে থাকবে। এখন এপ্রিল মাস। শীত সরে গিয়ে গরম বাড়ছে। তাগুশের দুই পাড়ের রেস্তরাগুলোয় রঙ আর মেরামতের কাজ প্রায় শেষ। শিক্ষার্থী ও নবীনরা গ্রীস্মকালীন চাকরির জন্যে জীবন-বৃত্তান্ত নিয়ে ছুটছে সবখানে। অনাগত চাপ সামলাতে সব জায়গায় বাড়তি লোকবল লাগবে। যার অধিকাংশের অবস্থানই এই তাগুশ নদীর দুই পাড়ে। জুন থেকে গ্রীস্মকাল শুরু হয়ে যাবে। চলবে নভেম্বর পর্যন্ত।
পৃথিবী সাক্ষী হয়ে থাকবে এই তাগুশের নয়নাভিরাম রূপের।
মন্তব্য
চমৎকার লাগল ঘুরে বেড়াতে। উজবেকিস্তানের কি কি সব গল্প বাকি আছে না?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। উজবেকিস্তানের আবারো যেতে চাই। কত কত জায়গায় যেতে পারিনি। মাত্র দিন দশেক ছিলাম। দিন তো ফুরিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে!
আপনি যে কবি সেটা ফুটে ওঠে যখন গদ্য লেখেন, অথবা ছবি তোলেন তখনও।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এক সময় যতই কাজ থাকুক না লিখলে ঘুম হতো না, এখন কাজ আর ঘুমের যন্ত্রণায় লিখতে পারি না। পড়ে যে কিছু বোঝা গেছে তাতেই মুক্তি। ভালো থাকবেন, আপনারা দু'চার জন এই ছাইপাশ পড়েন বলেই এখনো বেঁচেবর্তে লিখছি।
নতুন মন্তব্য করুন