[পূর্ব প্রকাশিতের পর। পর্ব ১, পর্ব ২]
এবার ভারতের উল্টোরথ
ভারতীয় কুটনীতিক দূর্গা প্রসাদ ধরের বক্তব্য উদ্ধৃত করে আগেই বলা হয়েছে যে যুদ্ধাপরাধের বিচারে ভারত শুরুতে কিছুটা অনাগ্রহী ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশের অব্যাহত চাপে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের হস্তান্তরে রাজী হলেও, ধীরে ধীরে ভারত বিচার-বিরোধী অবস্থান প্রকাশ করা শুরু করে।
ইতমধ্...[পূর্ব প্রকাশিতের পর। পর্ব ১, পর্ব ২]
এবার ভারতের উল্টোরথ
ভারতীয় কুটনীতিক দূর্গা প্রসাদ ধরের বক্তব্য উদ্ধৃত করে আগেই বলা হয়েছে যে যুদ্ধাপরাধের বিচারে ভারত শুরুতে কিছুটা অনাগ্রহী ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশের অব্যাহত চাপে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের হস্তান্তরে রাজী হলেও, ধীরে ধীরে ভারত বিচার-বিরোধী অবস্থান প্রকাশ করা শুরু করে।
ইতমধ্যে চিহ্নিত ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বাইরে যেন আর কোন পাকিস্তানী সৈন্যের বিচারে বাংলাদেশ আগ্রহী না হয়, ভারত সেজন্য চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে। ১৯৭৩ সনের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় বিশেষ কুটনীতিক পি এন হাস্কর যখন ঢাকা সফরে আসেন, তখন ভারতীয় প্রভাবশালী দৈনিক ‘দি স্টেটসম্যান’-এর এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “বাংলাদেশকে যে আরো সহনশীলতা ও রাজনৈতিক নমনীয়তা প্রদর্শন করতে হবে, এই কথাটা যেন হাস্কর সাহেব নম্র কিন্তু জোরালো ভাবে বাংলাদেশকে জানিয়ে দেন”। [৩৪]
বাংলাদেশ সফর শেষ করে পি এন হাস্কর জুলাই এর শেষ সপ্তাহে যখন পাকিস্তান সফর করেন, সেখানেও ওই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিষয়টি মুল আলোচ্য বিষয় ছিল। [৩৫]
এদিকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিচারে চীনের অনাগ্রহ ভারতের জন্যও সমস্যার কারন হয়ে দাড়ায়। ফলে আর্ন্তজাতিক ও অভ্যন্তরীণ দাবীর মুখে ভারত দ্রুত পাকিস্তানী বন্দীদের ছেড়ে দেবার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে। এসময় ভারত তার বিচার-বিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করে বাংলাদেশকে জানিয়ে দেয় যে, ‘এই বিচার প্রক্রিয়া উপমহাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে’। [৩৬]
বন্দীত্বের দুইরূপ
উল্লেখ্য, ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সনে সিমলা চুক্তির সময় ভুট্টকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পাকিস্তান যে কোন একটি বিষয় প্রাথমিকভাবে ভারতের কাছে ফেরত চাইতে পারে- হয় আটক পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীর মুক্তি, অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু অংশ যা যুদ্ধে ভারতের দখলে চলে গিয়েছিল তার অবমুক্তি। ভুট্ট নির্দিধায় যুদ্ধবন্দীর বদলে ভারতের দখলে থাকা জমি অবমুক্ত করার উপর জোর দেন ফলে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তই সিমলাতে অগ্রাধিকার পায়, যুদ্ধবন্দী নয়। [৩৭]
আপাতদৃষ্টিতে অমানবিক এই সীদ্ধান্তের কারন ভুট্ট সিমলায় তার সঙ্গে থাকা কন্যা বেনজীরকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে- বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দীর খাদ্য, বাসস্থান ও নিরাপত্তা ভারতের জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দিবে এবং অনির্দিষ্টকাল এভাবে রাখাটা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মানবিক হবে না। ফলে ভারতকে যুদ্ধবন্দীদের এমনিতেও ছেড়ে দিতে হবে।[৩৮]
বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই ছিল অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিদানের বিপক্ষে, কিন্তু অন্যান্য যুদ্ধবন্দীর প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে নয়। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়ে যুদ্ধবন্দী প্রত্যাবাসনে ভুট্ট তার আপত্তি বজায় রাখেন। তিনি জানতেন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ভরন-পোষন ছিল ভারতের জেনেভা কনভেনশনের শর্ত, কিন্তু পাকিস্তানে আটক অধিকাংশ বাঙালীই সাধারন জনগন এবং তারা কোন আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা-বঞ্ছিত। ফলে এসব বাঙালীদের নির্যাতনের খবর খুব একটা প্রকাশিত হবে না। অধিকাংশ বাঙালীই যুদ্ধের পর চাকরী হারান এবং বেকার অবস্থায় আটক থাকায় সর্বস্ব বিক্রি করে দিন চালাচ্ছিলেন। [৩৯] এ অবস্থায় আটক বাঙালীদের পক্ষে আর বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব নয় জেনে ৮ মার্চ ১৯৭৩ সনে শেখ মুজিব জাতিসংঘসহ অন্যান্য আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করেন এ অচলাবস্থার অবসানে এগিয়ে আসার জন্য।[৪০]
অবশেষে প্রত্যাবাসন
অবশেষে দীর্ঘ আলোচনার পর বাংলাদেশ-ভারতের ‘যুগপৎ প্রত্যাবাসন’ প্রস্তাব মেনে নিয়ে পাকিস্তান ২৮শে আগস্ট ১৯৭৩ দিল্লিতে ভারতের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের সম্মতিতে স্বাক্ষরিত এ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অবশেষে পাকিস্তান ও ভারতে প্রায় দুই বছর ধরে আটক ‘প্রায়’ সকল বাঙালী ও পাকিস্তানী বন্দীর মুক্তি তরান্বিত করে। ১৯৭৩ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর শুরু [৪১] এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার প্রথম সপ্তাহেই ১৪৬৮ জন বাঙালী এবং ১৩০৮ জন পাকিস্তানী সৈন্যের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হয়।[৪২]
তবে বাংলাদেশের আপত্তির মুখে ১৯৫ জন পাকিস্তানীকে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। দিল্লি চুক্তিতে সীদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে ১৯৫ জন পাকিস্তানীর বিষয়টির নিষ্পত্তি করবে। [৪৩] তবে পাকিস্তানও তার ১৯৫ জন পাকিস্তানীকে ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত দুইশতাধিক বাংলাদেশি নাগরিককে পণবন্দী হিসেবে এই প্রত্যাবাসনের বাইরে রেখে দেয়।
পাকিস্তানের বিকল্প প্রস্তাব
এক কিছুর পরেও যখন বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন পাকিস্তানীর বিচারের বিষয়ে অনড় থাকে, তখন ১৯৭৩-এর এপ্রিলে পাকিস্তান সরকার একটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়। পাকিস্তান এ্যাফেয়ার্স পত্রিকার ১৯৭৩ সালের ১ মে প্রকাশিত এই প্রস্তাবে বলা হয়-
অভিযুক্ত অপরাধ যেহেতু পাকিস্তানের একটি অংশেই ঘটেছে, সেহেতু পাকিস্তান তার যে কোন যুদ্ধবন্দীর বিচার ঢাকায় অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে। কিন্তু পাকিস্তান নিজে “জুডিশিয়াল ট্রাইব্যুনাল” গঠন করে এসকল ব্যক্তির বিচারে আগ্রহী যা আর্ন্তজাতিক আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে। [৪৪]
কিন্তু টিক্কাখান পাকিস্তানের সামরিক প্রধান থাকা অবস্থায় পাকিস্তানে এসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ভুট্টর প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত সে বিষয়ে বাংলাদেশ সন্দেহ প্রকাশ করে। [৪৫] ইতমধ্যে স্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে করা সম্ভব না-ও হতে পারে, এটা অনুমিত হতে থাকে।
এমতাবস্থায়, যদি পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যাবাসন করতেই হয়, তবে কয়েকটি বিষয় যেন নিশ্চিত করা হয় তাই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এজন্য বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিতে থাকে যেন ভারত হতে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের হস্তান্তরের আগে অন্তত তিনটি বিষয় নিশ্চিত করা হয়-
১. বাংলাদেশের নিকট যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তানের নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা (দু:খ প্রকাশ নয়);
২. ভবিষ্যতে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ খোলা রাখা; এবং
৩. চীনসহ অন্যান্য দেশে পাকিস্তান যে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারনা অব্যাহত রেখেছে, তার অবসান।
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য] পর্ব ৪
তথ্যসূত্র:
৩৪. “India acts to end p.o.w. deadlock”, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ০৪/০৪/১৯৭৩, পৃ- ৭
৩৫. “India and Pakistan Still Differ, Will Resume Talks in New Delhi” , দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ০১/০৮/১৯৭৩, পৃ- ৪
৩৬. প্রাগুক্ত
৩৭. “India to keep PoWs”, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৩/০৭/১৯৭২, পৃ- ৩
৩৮. দেখুন বেনজীর ভুট্ট (১৯৮৯) “Daughter of the East”, হ্যামিস-হ্যামিল্টন প্রকাশনি
৩৯. “Bengalis Held in Pakistan Long for Home” , দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ০৫/০৪/১৯৭৩, পৃ- ২
৪০. “Mujib Asks U.N.'s Help on Pakistan Ties” , দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ০৯/০৩/১৯৭৩, পৃ- ১০
৪১. “Bengalis and Pakistanis Begin Exchange Today”, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৯/০৯/১৯৭৩, পৃ- ৬
৪২. “600 Bengalis, Pakistanis Freed and Flown Home”, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৪/০৯/১৯৭৩, পৃ- ৯
৪৩. “India to release 90,000 Pakistanis in peace accord”, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৯/০৮/১৯৭৩, পৃ- ১
৪৪. Pakistan Affairs, ১ মে ১৯৭৩, উদ্ধৃত Burke, S.M. (১৯৭৩). “The Postwar Diplomacy of the Indo-Pakistani War of 1971”, এশিয়ান সারভে, ভলিউম- ১৩, সংখ্যা ১১, (নভে ১৯৭৩)পৃ- ১০৪০
৪৫. “Light in South Asia”, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, 27/04/১৯৭৩, পৃ- 36
মন্তব্য
প্রিয় মডু,
৪৪ নং সূত্রের সনটি ১৯৭৩ হবে, ১৯৭১ নয়। সম্পূর্ণ সূত্র:
৪৪. Pakistan Affairs, ১ মে ১৯৭৩, উদ্ধৃত Burke, S.M. (১৯৭৩). “The Postwar Diplomacy of the Indo-Pakistani War of 1971”, এশিয়ান সারভে, ভলিউম- ১৩, সংখ্যা ১১, (নভে ১৯৭৩)পৃ- ১০৪০
ধন্যবাদ
-----------
চর্যাপদ
এবারের পর্ব একটু বেশি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল মনে হচ্ছে। আগ্রহের জিনিস এত কম দিলে মন ভরে না।
তবুও আপনাকে ধন্যবাদ। শেষ পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
কৌস্তুভ
আগামী পর্বে পুষিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি
-----------
"সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে"
-----------
চর্যাপদ
একমত একমত................
পুষিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতিটা আশা করি রাখবেন।
নবীন পাঠক
shahriarsajib@gmail.com
পড়ছি
পড়ছি...
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
বাকীটুকুর জন্য অধীর আপেক্ষায় রইলাম!
পরের পর্বের জন্য অধীর অপেক্ষায়...
পরের পর্বের অপেক্ষায়... চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
-
এই সিরিজটা অনেকের নানা রকম প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম হবে। বিশেষ করে যারা "এতোদিনেও কেনো যুদ্ধাপরাধী ইস্যু মীমাংসা করা হলো না" বলে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেন!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
চলুক। অফলাইনে পড়া হচ্ছে, ভালো লাগছে রেফারেন্সসহ সব কিছু আসছে দেখে। ধন্যবাদ জানবেন।
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
আলোকবাজি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
সিরিজটি থেকে অনেক কিছু জানছি। ধন্যবাদ পুরো বিষয়টিকে একত্রিত করার জন্য। এটা ভবিষ্যতে অনেকেরই কাজে লাগতে পারে রেফারেন্স হিসেবে।
নতুন মন্তব্য করুন