ঢাকায় ফিরেই যে নাদির আলির মুখোমুখি হবার সুযোগ হবে, তা কখোনই চিন্তা করিনি। পাকআর্মির অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল নাদির আলীকে নিয়ে আমার প্রাথমিক ভাবনা খুবই বিশৃঙ্খল ছিল। গত মাসেই আমি বিস্ময় নিয়ে কুখ্যাত খুনি ডেরেক পেরছি-র কাহিনী পড়ছিলাম। সিরিয়াল কীলার হয়েও কীভাবে একজন খুনি সাজা এড়াতে নিজেকে অপ্রকৃতিস্থ প্রমাণ করে, আর বিবেকের দংশন থেকে বাঁচার জন্য সত্যি সত্যিই জীবনের ভয়ংকর অপকর্মের স্মৃতি মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারে , তা তার কাহিনী না পড়লে জানতাম না। ডেরেক-এর এই কাহিনী যখন পড়ছিলাম, ঠিক তখনই নাদির আলীর লেখাটা পেলাম । ভদ্রলোক একাত্তরে পাকআর্মির মেজর হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর লেখাতেই জানলাম, একাত্তরে পাকবাহিনীর বর্বরতা দেখে তিনি নিজেই অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান। যুদ্ধের দ্বায়িত্ব থেকে সরিয়ে তখন তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। একাত্তরে বাংলাদেশে অবস্থানকালীন সময়ের কিছু অংশের স্মৃতি তিনি তখন পুরোপুরিভাবে হারিয়ে ফেলেন।
পাকবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য হয়েও, একাত্তরে পাকবাহিনীর নৃশংসতা তুলে ধরার জন্য আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ হই। কিন্তু তিনি যখন বলেন, “আমার স্মৃতিভ্রম হয়েছে, কিন্তু আমি জানি যে আমি নিজে কোন খুন করিনি”, তখন বিভ্রান্ত হই। বিবেকের দংশন থেকে মুক্তির জন্য নিজের অপকর্মের স্মৃতি ভুলে যাবার যে ঘটনা আমি ডেরেক পেরছির জীবনীতে পড়ছিলাম, তা আমাকে বিভ্রান্ত করে।
গত ১৬ এবং ১৭ই মার্চে বিডিআই আর ‘১৯৭১ কালেক্টিভ-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত দুই দিন ব্যপী এক ওয়ার্কশপে তাঁর সাথে দেখা। ওয়ার্কশপের প্রথম দিন প্রথম বারের মতো মেহেরজান ছবিটি দেখার ও তা নিয়ে বিতর্ক করার সুযোগ হয়েছিল, তাও আবার ছবির পরিচালক, কুশিলব আর চিত্রসমালোচকদের সাথে (সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে আরেক দিন লিখবো)।
ওয়ার্কশপের দ্বিতীয় দিন ছিল নাদির আলির স্মৃতিচারণ। ভদ্রলোকের মাথা ভর্তি সাদা চুল, মুখে বার্ধক্যের ছাপ। যখন তিনি একাত্তরের স্মৃতিচারণ শুরু করলেন, ছোট্ট কনফারেন্স রুমে নেমে এলো পিনপতন নিরবতা। কাঁপা কাঁপা হাতে নোটগুলো থেকে তিনি একটানা বলে চললেন তাঁর একাত্তরের স্মৃতি। কিছু ঘটনা আগে জানতাম তার লেখা সুবাদে, অনেক কিছুই জানলাম নতুন করে। একাত্তরে নিজের ভুমিকা নিয়ে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন এভাবে-
“একাত্তরে আমি নিজে কোন খুন করিনি। তবে এটা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে যথেষ্ট নয়। এটা শুধু নিজের আদালতে নিজের বিচার—যেখানে আমিই আসামী, আমিই বিচারক। কিন্তু আমার পারিবারিক আবহ এবং আমার বেড়ে ওঠা আমাকে এধরনের বর্বরতা হতে বিরত রাখার কথা। হয়তো সে কারনেই আমি এর প্রতিবাদ করেছিলাম। তবে নিজে খুন করেছি কি করিনি, এটা কোন আত্নপক্ষ সমর্থন হতে পারে না। আর্মিতে আমি অভিন্ন পোষাকই পড়তাম, একই বাহিনীর সদস্য ছিলাম। তাই আমিও পাকবাহিনীর সেই নৃশংসতার সমান অংশীদার”।
যুদ্ধের পর বেশ কয়েক বছর লাগে তার সুস্থ হতে। পুরোনো সহকর্মীদের সাথে আবার যোগাযোগ শুরু হয়। তারাই তাকে জানায়, নির্বিচার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানাতে কিভাবে একদিন তিনি পাকবাহিনীর পোষাক ত্যাগ করে ধুতি পড়ে বাহিনীতে হাজির হয়েছিলেন। এরপরই তাকে অপ্রকৃতিস্থ হিসেবে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়।
নাদির আলির দীর্ঘ বর্ণনার কিছু অংশ পাঠকের জন্য অনুবাদ করছি, তার নিজের জবানীতে—
“সত্তরের নির্বাচন অনেকটা নিরপেক্ষ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের ভুল ধারনার কারনে। আইএসআই-র সংগৃহীত তথ্য থেকে ইয়াহিয়ার ধারনা হয় যে তিনিই সংখ্যাগরিষ্টতা পাবেন। কাজেই, নির্বাচনে পরাজয় তাদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। এরপরও, মার্চে যখন সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রহ দানা বাধতে থাকে, তখন পশ্চিমাদের ধারনা ছিল, এ আন্দোলন শুধু ঢাকা কেন্দ্রীক—কঠোর হস্তে দমন করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
“এরপরই তো শুরু হয় যুদ্ধ। আমি তখন মেজর হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছি। এপ্রিলের মাঝামাঝি আমাকে পাঠানো হয় শেখ মুজিবরের দেশের বাড়ি। আদেশ দেয়া হয়, ‘এটা মুজিবের নিজের জেলা, যত বেজন্মা পারো হত্যা করো… আর নিশ্চিত করবে কোন হিন্দুই যেন জীবিত না থাকে’।”
হঠাৎ করেই শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন রাজাকারদের ভুমিকা জানতে চান তার কাছে। কথায় বাধা পেয়ে তিনি সম্ভবত একটু বিরক্ত হন। বলেন, “এই কাহিনীতেই তা জানতে পারবেন”। বলেই তিনি তার মূল বর্ণনায় চলে যান।
“আমি তখন অগ্রবর্তী দল নিয়ে ফরিদপুর চলে যাই। সেখানে একটি ফায়ার বেস তৈরি করে সবদিকে গুলি করতে থাকি। সৌভাগ্যক্রমে আশে পাশে কেউ ছিল না। কিন্তু হঠাৎই কিছু বেসামরিক লোককে দেখি আমাদের দিকে আসছে। আমি সৈন্যদের গোলাগুলি বন্ধ করতে বলি। লোকগুলো কাছে এসে জানায়, তারা ওই গ্রামের লোক এবং তারা এসেছে আমাদের জন্য পানি নিয়ে। আমি সৈন্যদের চা বিরতি দিয়ে বেশ কিছু সময় সেখানে অবস্থান করি।
“এমন সময় মূল বাহিনী পৌছে যায় আমাদের কাছে। এক কণের্ল আমার কাছে এসে জানতে চান, ‘স্কোর কত?” আমি বললাম, ‘এখানে কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হইনি, তাই আমাদের কাউকে হত্যা করতে হয়নি’। কর্ণেল তখন তার হাতের মেশিনগানটি আমাদের জন্য পানি নিয়ে আসা গ্রামের লোকগুলোর দিকে তাক করে গুলি চালানো শুরু করলেন। চোখের সামনেই লোকগুলো মারা গেল। কর্ণেল তখন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দ্যাট ইজ দ্যা ওয়ে, মাইবয়’!”
এরপর ঘুরে তাকান প্রশ্নকর্তার দিকে-- "আপনি কোলাবরেটরদের কথা জানতে চাচ্ছিলেন না? এই হলো তাদের পরিণতি"।
প্রশ্নোত্তর পর্বে কেউ একজন জানতে চাইলেন, হত্যাযজ্ঞের ব্যাপকতা নিয়ে। তিনি বললেন—
“কিছুটা অতিরঞ্জন আসলে সব মহলেই হয়েছে। বাঙালি কর্তৃক বিহারীদের হত্যার যে হিসাব পাকিস্তান দেয়, তাও তো অতিরঞ্জিত। যুদ্ধের সময়েই আমি খবর পেলাম চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় ব্যপক বিহারী নিধন হয়েছে। আমি তখন সেখানেই ছিলাম। আমি ঘুরে ঘুরে সেই এলাকা দেখেছি তখন, অনেকের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু সেই হত্যাকান্ডের কোন নজির পাইনি। আবার, কিছুদিন আগেও তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক সদস্যের সাথে কথা হলো। হত্যাকান্ডের ব্যাপকতা নিয়ে বাংলাদেশের দাবি কতোটা অতিরঞ্জিত, তা নিয়েই যখন কথা হচ্ছিল, তখন সে অনেকটা গর্বের সাথেই বললো- ‘কিন্তু স্যার, আমি নিজেইতো অনেক বাঙালি মেরেছি’!”
নাদির আলি প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকেন। নিষ্ঠুর সব হত্যাকান্ডের কথা বলতে থাকেন একে একে, যা তাকে এক সময় পুরোপুরি অসুস্থ করে ফেলে।
নাদির আলির কথা শুনে মনে হলো, পাকিস্তানে সম্ভবত একাত্তর নিয়ে তৈরি হওয়া সরকারী আবরণ ভেঙে পড়ছে—শুধু হামীদ মীর -ই নয়, অনেকেই একাত্তরে পাকিস্তানের ভুমিকা নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। একাত্তরে পাকিস্তানি সুশীল সমাজের নিরবতাকে সমালোচনা করে করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ জাফর আহমেদও একটি প্রবন্ধ পাঠ করলেন। পাকিস্তানের কোন বুদ্ধিজীবি কখন কী লিখেছেন তার বেশ দীর্ঘ একটি রিভিউ দিলেন। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কামরান আসদর আলীও একাত্তর নিয়ে পাকিস্তানি কম্যুনিস্ট দলগুলোর ভুমিকার সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ পাঠ করলেন।
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, হামীদ মীরেরা দীর্ঘ দিনের নীরবতা ভঙ্গ করে একাত্তর নিয়ে সরব হচ্ছেন। বাংলাদেশে যখন একাত্তর নিয়ে ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ বিতর্ক চলছে, পাকিস্তানে কি তখন সরকার-প্রতিষ্ঠিত মেটা-ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে নীরবে শুরু হয়েছে আরেক ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’?
একাত্তরে পাকবাহিনীর বর্বরতার খুব অল্পই হয়তো আমি জেনেছি। ওই অতটুকুই আমার মধ্যে যুক্তিহীন কিছু বিষয়ের জন্ম দিয়েছে--আমি পাকিস্তানি পণ্য কিনি না, খেলায় পাকিস্তানকে সমর্থন করিনা (এমনকি 'খেলা আর রাজনীতি ভিন্ন' ধরনের আলোচনাকেও অসহ্য লাগে)।
আমার সন্দেহবাতিক মন তাই প্রশ্ন করে, ‘পাকিস্তানের দোসর বলে আমরা কী এইসব নাদির আলিদের প্রত্যাখ্যান করবো; না-কি তাদের রাজসাক্ষী করে আর্ন্তজাতিক আসরে শর্মীলা বোসদের মিথ্যাচারের জবাব দেব?’ আমি উত্তর খুঁজি না। কারন আমি জানি, দেশের মানুষই জানে কোনটা ঠিক পথ।
মন্তব্য
নাদির আলিরা সব একসাথে সত্য উচ্চারণ করলে শর্মিলা বসুরা যাবে কোথায়?
ক'দিন আগেই ডন পত্রিকায় লিবিয়া প্রসঙ্গে বিদেশী শক্তির দেশের বাইরে "মানবিক প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ" বিষয়ে একটি লেখা দেখলাম যাতে পাকিস্তানী সেনাদের আচরণের নিন্দা করা হয়েছে।
পাকিস্তানের মিডিয়া আগের তুলনায় এখন বিষয়টা নিয়ে অনেক খোলাখুলি আলোচনা করে ও নিজের দেশের কার্যকলাপের যথেষ্ট নিন্দা করে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
লেখাটার টোন এমন যেনো পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধে বাংলাদেশ পয়দা হয়ে গেছে।
হ
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত কর্নেল নাদির আলীর সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে দিচ্ছি -
গোলাম আযম-ফ কা চৌধুরীরা মুক্তি বাহিনী আ'লীগ ও হিন্দুদের হত্যার তাগিদ দিত
'৭১ সালে পাকিস্তানি কমান্ডো কর্নেল নাদির আলীর সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : সুভাষ সাহা ও বিভূতিভূষণ মিত্র
'গোলাম আযম, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মাওলানা ফরিদ আহমেদসহ শীর্ষস্থানীয় জামায়াত ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ মাঝে মধ্যেই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী, আওয়ামী লীগার ও হিন্দুদের ওপর অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা হাজির করতেন এবং তারা এসব অপারেশন জরুরি ভিত্তিতে সম্পন্ন করার তাগিদ দিতেন। এভাবে বেসামরিক ব্যক্তিদের পরামর্শে কাজ করতে হচ্ছে বলে একজন সেনা কমান্ডো হিসেবে নিজেকে খুব ছোট মনে হতো। কিন্তু এটাই ছিল তখন ওপরের নির্দেশ। সিলেটে এদের পরামর্শে পরিচালিত একটা অপারেশনের কথা মনে আছে। ওই অপারেশনে অনেক সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।' ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের কমান্ডো বাহিনীর কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) নাদির আলী গত শনিবার ঢাকার ব্র্যাক ইনে সমকালের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে উলি্লখিত মন্তব্য করেন। ঢাকায় তিনি এক অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে শনিবার সস্ত্রীক ঢাকা ত্যাগ করেন।
বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান কমান্ডো বাহিনীর যে ইউনিটটি পঁচিশে মার্চ কালরাতে বন্দি করে পরে সেটি তার অধীনে ছিল। কমান্ডো বাহিনী সরাসরি পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের অধীন ছিল। সে কারণে অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ সাক্ষী এই সাবেক কমান্ডো কর্নেল। তবে তিনি কখনোই সরাসরি বাঙালি নিধনযজ্ঞে অংশ নেননি। বরং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সঙ্গী সামরিক কর্মকর্তারা এবং জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ নেতারা হত্যা, লুটপাট, বাড়িঘর জ্বালানো ও ধর্ষণসহ যেসব বিধ্বংসী এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ বা ইন্ধন জোগাতেন, তার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। এসব কর্মকাণ্ড তার পক্ষে সহ্যের অতীত ছিল। সে কারণেই তিনি শেষ পর্যন্ত স্মৃতিভ্রংশের শিকার হন। যুদ্ধের একেবারে শেষ দিক থেকে পরের কয়েক বছর এ জন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয় তাকে। হাসপাতালে তার অবস্থা স্বচক্ষে দেখে তার বৃদ্ধ পিতা সেখাইে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি কবিতা ও গল্প লেখায় আত্মনিয়োগ করেন। ২০০৭ সালে বিবিসি উর্দু সার্ভিসে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ও সাধারণ মানুষের দুর্দশার বিবরণ তুলে ধরেন।
তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন সহযোগী বাহিনীগুলোর কাছে নির্দেশ আসত : হিন্দুদের কতল কর ও নিশ্চিহ্ন করে দাও। এ ধরনের নির্দেশ তার কাছেও বিভিন্ন সময়ে এসেছে। তবে লোক দেখানো ছাড়া তিনি তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে থাকা ইউনিটকে জনস্বার্থবিরোধী কাজে ব্যবহার করতেন না।
তরুণ ক্যাপ্টেন থেকে মেজর পদে উন্নীত হওয়া নাদির আলীর নেতৃত্বাধীন কমান্ডো ফোর্সকে ১৯৭১ সালের মধ্য এপ্রিলে গোপালগঞ্জ-ফরিদপুরে পাঠানো হয়। তখন তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়, 'যত পার বাস্টার্ড হিন্দুদের হত্যা করবে, দেখবে একজন হিন্দুও যাতে জীবিত না থাকতে পারে।' তখন তিনি এর প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, 'স্যার, নিরস্ত্র কোনো ব্যক্তিকে আমি হত্যা করতে পারব না।' এ জন্য তাকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। তিনি জানতেন এ ধরনের নির্দেশ প্রত্যেক সেনা কর্মকর্তার কাছেই গেছে। মধ্য এপ্রিলে গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর এসে তিনি দেখলেন, এলাকা শান্ত হয়ে এসেছে। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। অথচ এই মানুষরাই যখন ফিরছিল তখন অদূরে অন্য বাহিনী সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হন। সাধারণ মানুষকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে বলে জেনেছি।
এরপরের গন্তব্য ছিল বরিশাল।
'আমি যদিও প্রত্যক্ষভাবে কোনো হত্যাযজ্ঞে অংশ নেইনি। তবে অনেক অপারেশনের কাহিনীই আমার কানে এসেছে বিভিন্ন বৈঠক ও ফেলো কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শোনার কারণে।'
৬ জুন তিনি ছিলেন বিলোনিয়া সীমান্তে ফেনীতে। সেখানে কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি তার বাহিনী। বরং সাধারণ মানুষের আতিথেয়তা পেয়েছিলেন তারা।
চট্টগ্রামেও তিনি থেকেছেন। সেখানে তৎকালীন ইপিআর বাহিনীর এক পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে বাঙালিরা হত্যা করে। এ ঘটনার পর বাঙালি কর্মকর্তারা প্রায় সবাই পালিয়ে যান। কিন্তু তাদের অধিকাংশের পরিবার-পরিজনকে তখনও পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের পরিবার-পরিজনকে শিশুসহ লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। 'একটি বাহিনীর কর্মকর্তা ও সিপাহিদের পরিবার-পরিজনকে এভাবে হত্যা করার ঘটনা আমার হৃদয়কে আলোড়িত করে। এ ঘটনা আমার মনে স্থায়ী দাগ ফেলে দেয়।'
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিবরণ দিতে গিয়ে সুদীর্ঘকাল পরও তিনি বারবার বিমর্ষ হয়ে পড়ছিলেন। অনেক সতীর্থ সেনা কর্মকর্তা কীভাবে বাঙালিদের হত্যা করতেন, তার বিবরণ দিতেন। তার দম বন্ধ হয়ে আসত এসব বর্বরোচিত ঘটনার বিবরণ শুনে। অনেক সময় সেনা কর্মকর্তা, এমনকি সিপাহিরা পর্যন্ত বাঙালিদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে এক গুলিতে কতজন মারা যায় তার প্র্যাকটিস করতেন। আসলে বাঙালি নিধনটা ছিল পাকিস্তানি অনেক সেনা কর্মকর্তার কাছে খেলার মতো। অনেক সময় সাধারণ মানুষকে দৌড় দিতে বলে লম্বা একটি দলের ওপর নির্বিচার গুলি চালানো হতো। একবার একদল লোককে ধরে এনে সারি করে দাঁড় করিয়ে তাদের ওপর নির্বিচার গুলি চালানো হয়েছিল। সবাই মরে গেছে মনে করে গুলিবর্ষণকারী বাহিনীর সদস্যরা চলে গেলে দেখা যায় এদের মধ্যে ভাগ্যক্রমে দু'জন বেঁচে আছেন। ওই দু'জনকে তিনি মুক্তি দেন বলে উল্লেখ করেন। মাসকারেনহাস তৎকালে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানোর যে বিবরণ তুলে ধরেন তা যথার্থ বলে পাকিস্তানি এ কমান্ডো স্বীকার করেন।
যুদ্ধ-পূর্ব পরিস্থিতি সংক্ষেপে তুলে ধরতে গিয়ে তার স্মৃতির মণিকোঠায় ভেসে ওঠে অনেক অশ্রুত ঘটনা। বাঙালিরা এক পর্যায়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ষাটের দশকের প্রথম দিকে তার সঙ্গী অনেক বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার মধ্যেই তিনি পাঞ্জাবি বা পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা অবনমনের জ্বালা দেখেছেন। জিয়া, খালেদ মোশাররফ, তাহের, জিয়া উদ্দিন এক সময় তার সতীর্থ ছিলেন বলে উল্লেখ করেন কর্নেল নাদির আলী। তখন বাঙালি অফিসাররা একজন অন্যজনকে জেনারেল বলত। নাদির আলী এবং তার সহকর্মীরা তখন এটাকে তামাশা বলেই মনে করতেন। আসলে এটা যে তামাশা ছিল না, বাঙালি কর্মকর্তাদের মনের লালিত ক্ষোভের প্রকাশ ছিল, সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
সিমলা চুক্তির মধ্য দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের জেলে আটক থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণকারী সদস্যদের পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়ার সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের পাকিস্তান বিচার করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও তাদের বিচার কেন সম্পন্ন করা হলো না সে ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, '৭১ সালের পর পাকিস্তানের ক্ষমতায় ভুট্টো এলেও মূলত তখনও প্রকৃত ক্ষমতার মালিক ছিল সেনাবাহিনী। তারা কি তাদের বাহিনীর অপকর্মের বিচার করবে? তদুপরি সাধারণ পাকিস্তানিদের মধ্যে বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো বা গণহত্যা চালানোর জন্য সেনাসদস্যদের বিচারের দাবি জোরদার হয়নি কখনও। প্রায় গোটা পাকিস্তানই এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিল।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করতে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সদস্যদের বিচারের বিষয়টি সামনে আসবে উল্লেখ করায় সাবেক কমান্ডো কর্নেল এ ব্যাপারে সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, অভিযুক্ত অনেকেই এখন মৃত। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তার জানা নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তবে তিনি সে সময়ের ঘটনাবলির জন্য পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন।
এ অঞ্চলের শান্তি ও উন্নতির জন্য এক সময় একই রাষ্ট্রের অধীন এবং পরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতকে একসঙ্গে কাজ করা উচিত বলে বলে মনে করেন তিনি। সবশেষে তিনি বাংলাদেশের শুভ কামনা করে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
তাড়াতাড়ি লিখেন !
মনমাঝি
গতকালই পড়েছিলাম। কী মন্তব্য করা যায় বুঝতেছি না।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
shobaike onek dhonnobad lekhata dhoirjo dhore porar jonno. amar apatoto "nai telephone, naire pion" obostha, tai comment post kortey parchi na. ochirei ei obosthar oboshan hobe, ashakori
-----------
চর্যাপদ
আমরা চাইলেও কি তিনি বা তাঁদের মতো আর কেউ রাজসাক্ষী হতে রাজি হবেন? বুদ্ধিটা কিন্তু নেহাৎ মন্দ নয়।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
http://www.pashtunforums.com/political-talk-11/genocide-pakistan-army-government-bangladesh-7103/
এই লিঙ্কে গিয়ে দেখুন। মাথা মোটা পাকিস্তানি কি চিন্তা করছে, আর বাকিরা কি ভাবছে। শর্মিলা বোস আমাদের কিভাবে ক্ষতি করছেন সেটাও বোঝা যাবে এখানে।
আলু মিয়া
নতুন মন্তব্য করুন