একাত্তরে বাঙালির উপর পাকিস্তানিদের গণহত্যা নিয়ে যতটুকু কাজ হয়েছে, বিহারীদের প্রতি বাঙালিদের নির্যাতন নিয়ে কাজ হয়েছে তারচে’ কম। যুদ্ধে গণহত্যা নিয়ে যেমন বিস্তর গবেষণা হয়, যুদ্ধের পর [url=http://en.wikipedia.org/wiki/Victor's_justice] বিজিতের উপর বিজয়ীর অত্যাচার [/url] নিয়েও তেমনি অনেক অনুসন্ধানী রিপোর্ট হয়ে থাকে। বিজিতের উপর বিজয়ীর অত্যাচার ভয়ংকর হতে পারে। এমনকি ধর্মের নামেও ইতিহাসে যেসব যুদ্ধ হয়েছে, সেখানেও বিজিতের স্ত্রী-কন্যাদের গনিমতের মাল হিসেবে অধিগ্রহণ করে দাসী বা যৌনদাসী বানিয়ে রাখার প্রচলন ছিল। ফরাসী বিপ্লবের পর গণহারে ‘বিপ্লবের শত্রুদের’ হত্যাকান্ডের বিভৎস বিবরণ ইতিহাসেরই অংশ।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যদের চালিত গণহত্যা এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিজয়ী বাঙালিদের হাতে বিহারিদের অবস্থা—উভয় নিয়েই লেখালেখির পরিমান অনেক কম। হাটে-মাঠে-ঘাটে পড়ে থাকা লক্ষ লাশের ছবিগুলো যেমন পাকিস্তানিদের চালানো গণহত্যার নিরব সাক্ষী হয়ে আছে; তেমনি, যুদ্ধের পর কাদের সিদ্দিকীর 'বিচার কর্মের' ছবিটিও ভিক্টরস জাস্টিস হিসেবে সারা বিশ্বে প্রচার পেয়েছে।
সভ্যতা আর মানবিকতার বিচারে হত্যাকান্ড—হত্যাকান্ডই, তা সে একটিই হোক আর লক্ষটিই হোক। কোন পরিবারই যেন এ ধরনের বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডের স্বীকার না হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরী। ঠিক একারনেই পাকিস্তানি ও তাদের এদেশিয় বাঙালি-বিহারি দোসরদের হাতে লক্ষ লক্ষ বাঙালির গণহত্যার তদন্তের পাশিপাশি, অতি উৎসাহী যেসব বাঙালির হাতে বিহারিরা নির্মম পরিণতির স্বীকার হয়েছিলো, তারও তদন্ত প্রয়োজন। এই অতীত কর্মকান্ডের মূল্যায়ন ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি ঘটাকে বিরত রাখবে।
তবে, এক বা একাধিক মানুষ খুন হলে তা হয় ‘হত্যাকান্ড’, হাজার মানুষ খুন হলে তা হয় ‘গণহত্যা’, আর লক্ষাধিক খুন হলে তা হয় ‘পরিসংখ্যান’। ফলে, তুলনামূলকভাবে ‘হত্যাকান্ড’ সবসময়ই গণহত্যার চেয়ে বেশি আপীল তৈরি করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের গণহত্যা কেবল একটি পরিসংখ্যানই থেকে যায়। পাকিস্তানিদের গণহত্যা যেহেতু বাঙালিদের প্রতিশোধমূলক হত্যাকান্ডের সাথে তুলনীয়ই নয়, সে কারনে অনেকেই বিহারি নির্যাতনের বিষয়টি সামনে আনাকে ভুল পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করেন। কারো কারো মতে, আমরা যদি বিহারি নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করি, তাহলে শর্মিলা বসুরা এটিকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে নতুন প্রপাগান্ডা তৈরি করবে। তবে আমার কাছে বরং বিষয়টি উল্টো মনে হয়— মাত্রা ও বিভিষিকার দিক থেকে বিহারিদের প্রতি নির্যাতন যদি পাকিস্তানিদের গণহত্যার সমকক্ষ না-ই হয়, সেক্ষেত্রে উভয় অন্যায়ের তদন্ত বরং ন্যায়বিচার ও সত্যানুসন্ধানে ইতিবাচক হবে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দীকা একটি ইমেইলের মাধ্যমে শর্মিলা বোসের কল্পকর্মের সমালোচনায় বলেছেন— "আক্রমনকারীর ভায়োলেন্স আর আক্রান্তের ভায়োলেন্স ভিন্ন করে দেখা প্রয়োজন, কারন আক্রমনকারী যদি শুরুতে আক্রমন না করতো, তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তিও হয়তো একই ভাবে সাড়া দিত না"। তবে, যে যেই কারণেই করে থাকুক না কেন, যুদ্ধের সুযোগে যারা হত্যা-নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের কর্মকান্ড কোন ভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। আমাদের ইতিহাসের এই অস্বস্তিকর অংশটুকু আমাদের সততার সাথেই মোকাবেলা করতে হবে।
আবার এটাও ঠিক, দেশের কতিপয় পত্রিকার “ভারসাম্যনীতি”-র ন্যায়, পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালিদের গণহত্যাকে যুদ্ধ পরবর্তী বিহারি নির্যাতনের সাথে এক কাতারে ফেললে সত্যা বা ন্যায়বিচার কোনটিই প্রতিষ্ঠিত হবে না।
এই প্রেক্ষিতেই ব্রিটেনের 'দি গার্ডিয়ান' পত্রিকায় প্রকাশিত ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সনের একটি লেখা এখানে শেয়ার করছি। যুদ্ধের অব্যবহিত পরই পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের ভারতের বিভিন্ন শিবিরে পাঠিয়ে দেবার কথা আমরা জানি, যা পরে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচারের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছিল। আর দি গার্ডিয়ানের এই লেখাটিতে জানা যায়, যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনী বা তৎকালীন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অর্ধেকেরও বেশি শক্তি নিয়োজিত ছিল বিহারিদের নিরাপত্তার জন্য। কাউন্টার ন্যারেটিভ লিখতে গিয়ে আমরা যেন এগুলো ভুলে না যাই—
দি গার্ডিয়ান, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪
বিহারি অপারেশনে পাঁচ ব্যাটেলিয়ন
ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারিবিগত দুই সপ্তাহ ধরে বিহারি জনগোষ্ঠির পাহারা ও নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ আর্মির অর্ধেকেরও বেশি লোকবল নিয়োজিত আছে বলে জনৈক আর্মি অফিসার আজ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের—যা কিনা বাংলাদেশের একমাত্র নিয়মিত বাহিনী- পাঁচ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত বিহারী অধ্যুষিত এলাকায় ঘেরাও ও তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। গত মাসে মিরপুর এলাকায় সংঘর্ষে ৪৬ জন বিহারি ও ৩৫০ জন বাঙালির মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাত্র নয়টি ব্যাটেলিয়ন সক্রিয় রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিসারটি জানান, “আমরা যদি আজ রাতেই এই এলাকা ত্যাগ করি, তাহলে বাঙালিরা এসে বিহারীদেরকে মেরে ফেলবে”।
অনেক বিহারীই, যারা মুসলিম, গত বছর এখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহোযোগি হিসেবে কাজ করেছিল।
ডিসেম্বরে পাকিস্তান আর্মির পতনের পর আজ প্রথমবারের মতন সাংবাদিকদের এই কলোনী পরিদর্শনের আনুষ্ঠানিক অনুমতি দেয়া হয়। তবে পরিদর্শনে সাম্প্রতিক প্রতিশোধ বা খাদ্যাভাবের কোন চিহ্ন দেয়া যায়নি।
বিহারিরা বলেছে, তাদের খাওয়ানো হচ্ছে, যদিও কিছুটা অনিয়মিত ভাবে। সেখানে গম নিয়ে রেডক্রসের ট্রাক ঢুকতে দেখা যায়। সরকারি রেশন দেয়া দোকানগুলোতেও অনেককে লাইন দিতে দেখা যাচ্ছিল।তখনও (মিরপুর) ১২ নম্বর সেকশনে অস্ত্র তল্লাশির অভিযান চলছিল। কয়েক হাজার বাহারি পুরুষকে একটি মাঠে তল্লাশি শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
সম্ভাব্য লুটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মহিলাদেরকে তাদের মুল্যবান জিনিসপত্র আকঁড়ে ধরে বাড়ি-ঘরের কাছাকাছিই আরেকটি মাঠে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তারা স্বীকার করেন যে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়নি, তবে কিছু পুরুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
একজন আর্মি অফিসার জানান যে, গতকাল ১২ নম্বর সেকশন থেকে (শত্রু বাহিনির) সহযোগি ও অপরাধি সন্দেহে ৪৮০ জন পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন বিহারি অবশ্য গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা গুনে রেখেছে উল্লেখ করে সংখ্যাটি ১৫৫৬ বলে দাবি করে।এক-রুমের বাড়িগুলোর ভেতরে কিছু এলোমেলো ও রাফ তল্লাশির চিহ্ন দেখা যায়, কিন্তু খুব কমই ধ্বংশযজ্ঞের চিহ্ন পাওয়া যায়।
অস্ত্রের তল্লাশি অভিযান আরো কয়েকদিন চলার কথা রয়েছে। এক সপ্তাহ আগে জোর পূর্বক উচ্ছেদের স্বীকার হওয়া প্রায় দশ হাজার বিহারিকে ফেরত আনার পরিকল্পনা তাই আপাতত: স্থগিত করা হয়েছে।
মন্তব্য
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দারুন।
সকাল বিকাল কাউন্টার ন্যারেটিভ *দানো বিশেষজ্ঞরা এটা বুঝলে হতো
-----------
চর্যাপদ
স্বাধীনতার পর পর বিভিন্ন জায়গায় বিহারী ধাওয়া করা হয়েছে সত্য। কিছু খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে হয়তো। কিন্তু পরিস্থিতির তুলনায় ওটাকে নগণ্য বলতেই হয়, কারণ একাত্তরের গনহত্যার বিপরীতে প্রতিশোধের প্রকারটা আরো ভয়ংকরই হবার কথা ছিল।
আমার পরিচিত একটা বিহারী পরিবারের কথা জানি, বাবার বন্ধু যিনি আমার দেখা একমাত্র বিহারী আওয়ামী লীগার যুদ্ধের সময় দুই দিকের ধাওয়ায় সর্বস্ব হারিয়েছিলেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আপনার বাবার বন্ধুর মতন লোকদের কথা আমিও শুনেছি। তাদের জন্য সহমর্মিতা।
-----------
চর্যাপদ
৩০ লক্ষ। ২ লক্ষ।
গনিমত।
ইসলাম।
হায় ইসলাম!
লেখককে ধন্যবাদ বিষয়টি তুলে ধরার জন্য । ৭১ অধিকাংশ বিহারি যেমন পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তা করেছিল তেমনি অনেকে বাঙ্গালিদের জীবন রক্ষাও করেছিল (এদের সংখ্যা হয়তো কম) । আমার নানার বাসায় যুদ্ধকালীন সময় এক বিহারি পরিবার ভাড়া থাকত । মামা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ঐ সময় একাধিকবার ঐ বিহারি পরিবারের কর্তা পাকিস্তানি সৈন্যদের কে এটি তার নিজের বাসা বলে পরিচয় দিয়ে পুরো পরিবারের জীবন রক্ষা করেছিলেন । আবার বিজয়ের পর পাকিস্তান চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঐ বিহারি পরিবার নানার বাসাতেই ছিল । এরকম ঘটনা নিশ্চয়ই আরো অনেক জায়গায় ঘটেছে ।যাই হোক এই দেশে যে সব বিহারি পরিবার আছে তাদের মানবিক বিষয় গুলো আমাদের সরকারকেই দেখতে হবে । বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাই কি বেশি জরুরি না বিহারি হত্যার বিচারের চেয়ে? অনেকে হয়তো এদেশের নাগরিক নন আবার অনেকে হয়তো পাকিস্তান ফিরে যেতে চান এসব বিষয় মীমাংসা করার দরকার আছে ।
ধন্যবাদ। আসলে রাষ্ট্র আসলে একটি মাল্টিটাস্কিং প্রতিষ্ঠান-- রাস্তা-ঘাট করার পাশাপাশি যেমন ইতিহাস চর্চা বা আইন-আদালত চালানো যায়; তেমনি বাহারিদের মানবিক দিকটি দেখার পাশাপাশি বিহারি-নির্যাতনের বিষয়টিও (তা সে বিহারিদেরকে নির্যাতনই হোক, আর বিহারি কর্তৃক নির্যাতনই হোক) আলোচনা করা যায়।
আমরা যদি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তা না করি, তাহলে শর্মিলা বসুরা মনের মাধুরী মিশিয়ে সেটা পুরণ করতে আসবে।
-----------
চর্যাপদ
এসেছে আগেই।
http://www.telegraphindia.com/1060319/asp/look/story_5969733.asp
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
আমি নীড়সন্ধানীর সাথে একমত।আমি আর বিশ্বাস করি,প্রতিক্রিয়া আমরা অনেক কম ই দেখিয়েছি যার কারনে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি মাথা তুলতে পেরেছে!
মানবতার জয় হোক।
এই দিকটা যথাযথ ভাবে সামনে আসা উচিত আমাদের স্বার্থেই। তা নাহলে বানোয়াট অতিরঞ্জিত অভিযোগ দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কালিমালিপ্ত করতে থাকবে সুযোগসন্ধানীরা। আর জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে চাইলে নিজেদের ভুলকে যাচাই করা খুবই প্রয়োজন।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
সহমত।
-----------
চর্যাপদ
মিথ্যা অপবাদের চেয়ে আমাদের নিজেদেরই বিষয়টা নিয়ে তদন্ত করা উচিত যাতে সবাই সত্যিটা কী জানতে পারে। এটা পরবর্তীতে আমাদের জন্যই ভালো হবে।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
ঠিক তাই।
-----------
চর্যাপদ
এব্যাপারে আপনার মন্তব্যটি ঠিক বুঝলাম না। বাঙালি এই লুটেরাদের সম্পর্কে অমি রহমান পিয়ালের একটি পোস্ট পড়েছিলাম। এদের বিজিতের দলে কি কারণে ফেলছেন?
তথ্যসূত্র হিসেবে স্বাধীনতা '71 (কাদের সিদ্দিকী) দেয়া আছে ওখানে।এ ব্যাপারে কোনো ভিন্ন কিন্তু যৌক্তিক কোনো বয়ান কি আছে?
বোল্ড করা বাক্যটির ব্যাপারেও আমার একটা কৌতুহল আছে।ওই লোকগুলা যুদ্ধফেরতা ছিলো নাতো আবার?
রব
কাদের সিদ্দিকীর বইটি আমি পড়েছি, কিন্তু বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, কাদের সিদ্দিকীর এই 'বিচার কার্যটি' তখন সারা বিশ্বেই "বিজিতের উপর বিজয়ীর অত্যাচার" হিসেবেই প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু এটি যদি অবাঙালি মেয়েদের উদ্ধারকর্ম হয়ে থাকে, তাহলে আমার উপমাটি বোধহয় যুৎসই হলো না। লাইনটি বদলে দিচ্ছি। ধন্যবাদ তুলে ধরার জন্য।
-----------
চর্যাপদ
শর্মিলা বসুরা নতুন আবিষ্কার নিয়ে খুব উত্তেজিত। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের আগে বাঙালিদের হাতে বিহারিদের গণহত্যা ঠেকাতেই নাকি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। এসব কথাবার্তাকে আসল তথ্য দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।
বিহারিদের অনেকেই একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে মিলে বাঙালি নিধনে মত্ত ছিল। রাজাকার, আল-বদরদের সাথে এই যুদ্ধাপরাধী বিহারিদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
শর্মিলার বর্তমান উদ্যোগ ওই দিকেই। কিন্তু "পঁচিশে মার্চের আগে বাঙালিদের হাতে বিহারিদের গণহত্যা ঠেকানো" তত্ত্বের একটাই সমস্যা-- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হত্যাকান্ড কেন? রাজারবাগ পুলিশ লাইন তো আর বিহারিদের গণহত্যায় নিয়োজিত ছিল না! থাকলে তো সেটা পাকিস্তান সরকারের অদক্ষতা। সেজন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বিচার হওয়া উচিত।
-----------
চর্যাপদ
বিহারীরা দেশের প্রায় সব জায়গাতেই শহরাঞ্চলে নয়তো শিল্পোন্নত অঞ্চলে সেটলমেন্ট বানিয়ে বসবাস করতো। এগুলো তৎকালীন পাকিস্তানী সেনা ইউনিটগুলোর কমান্ড এরিয়াতেই ছিলো। ২৫শে মার্চ রাতে ক্র্যাকডাউনের পর যেখানে সারা দেশের শহরাঞ্চলগুলোতে সশস্ত্র সেনারা ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে বাঙালিরা কীভাবে নিজেদের পেছন না বাঁচিয়ে বিহারী গণহত্যা চালাতে পারতো? বিচ্ছিন্ন কিছু বিহারী হত্যাকাণ্ড অবশ্যই ঘটেছে, কিন্তু সেটাকে পাকিস্তানীরা যে স্কেলে নিয়ে প্রোপাগাণ্ডা চালিয়েছে, সেটা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
১৬ ডিসেম্বরের পর বিহারীদের নিরাপত্তার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেকেও মোতায়েন ছিলো। আদমজী জুট মিলের সমস্ত বাঙালি কর্মীকে ছাঁটাই করে সেখানে অবাঙালি কর্তা ও কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিলো ক্র্যাকডাউনের পর পর, সেখানে ৩০ হাজার বিহারী অবরুদ্ধ ছিলো বাঙালিদের ভয়ে। ভারতীয় সেনারা সেখানে তাদের নিরাপত্তা বিধান করেছিলো।
পাকিদের মাঝে 'বিহারিদের উপর ব্যাপক গণহত্যা' তত্ত্বটি ব্যাপক প্রচার
ও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। আইয়ুব খানের এই লেখায় পুলিশের উপর পাকি-আক্রমণের কারণটি বলা হয়েছে এইভাবে-
রব
আনন্দদায়ক লেখা। আইয়ুব খান ও তার পরিবারের ধারনা ছিল, তিনি ফেরেশতা (অবশ্য, শর্মিলা বসুর চোখে নিয়াজীও তাই)।
কিন্তু পাকিস্তানি অপারেশের একজন সদস্য কর্ণেল (অব:) নাদির আলী নিজেই বলেছেন, তিনি বিহারি-নিধনের কথা শুনে তদন্ত করতে গিয়ে তেমন কোন প্রমাণ পাননি।
-----------
চর্যাপদ
মীরপুরে বিহারী ক্যাম্পের কাছেই কাটিয়েছি বেশ কিছু বছর। আমি একটা বিষয় জানিনা,
বিহারীরা রিফিউজি কেন? আমার জানামতে ১২ বছর স্থায়ীভাবে বসবাস করলেই এদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া যায় - এটা কি ঠিক না, নাকি বিহারীদের জন্য প্রজোয্য না - এরা তো ৪০ বছর ধরে বসবাস করছে।
জন্মস্থান সূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে একটা বিষয় জানতাম। ৪০ এর কম বয়সী বিহারীরা কি জন্মসূত্রেও এদেশের নাগরিকত্ব পায় নাই? না পেলে কেন?
যুদ্ধের সময় পাকিস্থানের পক্ষে যাওয়ার কারণে একঘরে করে রাখা হলে জামায়াতকে একঘরে করা হয় না কেন?
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
-----------
চর্যাপদ
ভালো প্রশ্ন। সেই সাথে এটিও বুঝতে হবে কেন তারা আজও নিজেদের 'আটকে পড়া পাকিস্তানি' বলে এবং পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে প্রত্যাবর্তনের সংগ্রাম করে চলে। বিষয়টি অনেক জটিল-- আমরা যেমন তাদেরকে 'আমাদের' বলি না, তারাও আমাদেরকে 'তাদের' ভাবেনা এবং এই চক্র চলছেই। তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে ইতিহাসের ক্লোজার বা রিকন্সিলিয়েশন হয়তো হবে না, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই প্রলম্বিত-সংকট সমাধান করা জরুরী।
-----------
চর্যাপদ
উত্তর দিব, আরও মন্তব্য করব... কিন্তু খেলা দেখা শেষ করে নেই...।
সত্যিটা বেরিয়ে আসুক।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
লেখকে ধন্যবাদ তার সাহসিকতাপূর্ণ এবং বস্তুনিষ্ঠ লেখার জন্য..... সহিংসতাপূর্ণ আচরন সমর্থন যোগ্য নয় এটা যেমন সত্য আবার ঠিক তেমনি সাফি তার ২৯শে মার্চের মন্তব্যে যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি বিষয় হচ্ছে এখন যেখানে সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে এমন পরিস্থিতীতে বিহারীদের উপর বাংলাদেশীদের নির্যাতনের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব ও মনোযোগ নাও পেতে পারে। তবে তার পরেও আমি বিশ্বাস করি এ বিষয়ে সত্য উন্মোচন করা উচিত এবং তার প্রেক্ষিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া উচিত; সেটা আর্থিক ক্ষতিপূরণ, পূনর্বাসন থেকে শুরু করে দোষীদের শাস্তি পর্যন্ত হতে পারে, আর আমার মতে সেটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর করলে ভালো হবে।
- সুমিত রহমান
অবশ্যই। তাছাড়া, এখানকার রাজাকারদের বিচার করতে পারলে পাকিস্তানের কাছে তাদের সৈন্যদের বিচারের দাবীটিও জোড়ালো ভাবে করা যাবে।
-----------
চর্যাপদ
[খুশি হবো যদি রেস্ট্রিকশন তুলে নেন। তাতে সবার বুঝতে সুবিধা হবে। আপাতত: আমিও রেস্ট্রিক্টেড উত্তর দিচ্ছি-- আপনি সরিয়ে নিলে, আমিও তা উঠিয়ে দেব।]
অনেক ধন্যবাদ প্রশ্নগুলির জন্য। চেষ্টা করছি উত্তর দিতে-
১. ২৫শে মার্চের আগের ঘটনা মূলত: শর্মিলা বোসেরাই বলে চলেছেন। দু'একজন বাম নেতার কাছে তোফায়েল-সিরাজুল ইসলামদের কিছু কথা শুনেছি, তবে একাত্তর পূর্ব ও পরবর্তী বাম-আওয়ামী বিভাজন তীব্র ছিল, যেকারনে একে অপরের প্রতি তারা অনেক অভিযোগ করতো। তাই এসবের সত্যতা নিয়ে আমি সন্দিহান। পোস্টে এই সময়কালটা নিয়ে তাই কিছু বলা হয়নি।
২. পোস্টটা আরেকবার পড়ুন, তাহলে একই পাল্লায় মাপার প্রশ্ন আসবে না।
৩. আপনাকেই উদ্ধৃত করি- "বিজিতের উপর বিজয়ীর অত্যাচার নিয়ে তো আপনিই পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেফারেন্স দিলেন। স্বাধীনতার পর তেমনটি বা তার কাছাকাছি কিছু ঘটেছিল এদেশে এমন কিছু জানতে পারলে নিজে আলোকিত হতে পারতাম। বিজিতদের প্রটেকশন দেয়ার রেফারেন্স কী পৃথিবীর ইতিহাসে আছে নাকি জানতে ইচ্ছে হয়। রিপোর্ট থেকে দেখেন ক্যাসুয়ালটিতে বিহারীর চাইতে বাঙ্গালীর সংখ্যা অনেক বেশি। ..." ঠিক এই অনুধাবনটির জন্যই তো এই পোস্ট।
-----------
চর্যাপদ
এই লেখাটার দরকার ছিল খুব।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
১।
নিশ্চয়ই সভ্যতা ও মানবিকতার সপক্ষে খুব ভালো হতো যদি একফোঁটা রক্ত ও না ঝরিয়ে স্পার্টাকাস তার সহযোদ্ধা দাসদের নিয়ে বিদ্রোহ করতে পারতেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসী বাহিনীকে প্রতিরোধ করা যেতো কিংবা মানব ইতিহাসের সকল স্বৈরশাসকদের পতন ঘটানো সম্ভব হতো।
ইউটোপিয়ায় তা হলেও হতে পারে কিন্তু বাস্তবে তেমন ভালো খুব একটা ঘটেনি কখনো।
বিষয়টা আরেকটু বিস্তারিত করা যাকঃ- ২৫ মার্চ রাতে পক্ষ দুটি। প্রথম পক্ষ আক্রমনকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী, দ্বিতীয়পক্ষ আক্রান্ত পূর্বপাকিস্তানের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী( পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত বিহারীরা নয়)। পরবর্তীতে আক্রমনকারী পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনী+বিহারী জনগোষ্ঠী+বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ যারা ইসলামী রাজনীতির সমর্থক, আর আক্রান্ত তথা আক্রমনকারীদের প্রতিহতকরা পক্ষে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মুক্তিযোদ্ধা( আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ও ছিলেন)+ ভারতীয় সেনাবাহিনী।
যদি আমার ভুল না হয় তাহলে হিসেব তো এই, তাইনা? বিহারীরা তো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবেই কাজ করেছে যুদ্ধের সময়ে তাহলে বিহারী হত্যা অন্যায় হবে কেনো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, যদি পাক সেনাদের হত্যা করা অন্যায় না হয়? অথবা যুদ্ধকালীন সময়ে বিহারী হত্যা তখনই অন্যায় হয় যখন অন্যায় হয়ে উঠবে পাকিস্তানী সৈন্য এবং রাজাকার-আলবদরদের হত্যা করা!
সভ্যতা ও মানবিকতার সপক্ষে দাঁড়িয়ে কেউ কি তাই বলতে চাইছেন? সাইদ আপনি? যদি হ্যাঁ হয় তাহলে অন্য কথা, যদি না হয় তাহলে আপনার উদ্ধৃত বাক্যের বোল্ড করা অংশের মানে কী?
কিসের তদন্ত চাচ্ছেন আপনি? গনহত্যায় যারা সহযোগী ছিলো তাদেরকে প্রতিরোধ করার অপরাধে মুক্তিযোদ্ধাদের এবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে?
সহধর্মী আরেকটি লেখার লিংক এখানে, যেখানে নিরপরাধ বিহারী হত্যাকারী বাঙ্গালি মুক্তিযোদ্ধা'র অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
২।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিহারীদের উপর নির্যাতন করেনি, করেছে তাদের নিজেদের রাষ্ট্র পাকিস্তান। এদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা ছিলো, পাকিস্তান এটা নিয়ে টালবাহানা করছে গত ৪০ বছর ধরে। বিহারীরা ও আগে বাংলাদেশী হয়ে যাবার জন্য কোন দাবী তুলেনি, না তোলাই স্বাভাবিক- যে রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র অবস্থান ছিলো সেই রাষ্ট্রের নাগরিক হবার জন্য তাদের কোন আবেগী অবস্থান থাকার কথা নয়। বিহারীরা তখনই বাংলাদেশী হবার বায়না ধরা শুরু করেছে যখন বুঝতে পেরেছে পাকিস্তান তাদেরকে আবর্জনা ছাড়া কিছুই ভাবছেনা, এই আবর্জনা পাকিস্তান কোনদিনই ফিরিয়ে নেবেনা।
জন্মসুত্রে নাগরিকত্ব কিংবা একটি নির্দিষ্ট সময় কোন দেশে থাকলেই নাগরিকত্ব পাওয়া- এসব কোন বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু নাগরিকত্বের জন্য বাধ্যবাধকতা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতি নিরংকুশ আনুগত্য।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি বিহারীদের নিরংকুশ আনুগত্য বিষয়ে কেউ কেউ কনভিন্স কোন কারনে?
বাংলাদেশ রাষ্ট্র যদি নির্যাতন করে থাকে তাহলে করেছে তার নিজের দেশের মানুষের প্রতি,জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি।
কিন্তু সভ্যতা ও মানবতার সপক্ষের স্পোকসম্যানরা এই নির্যাতনগুলোর বিষয়ে স্পিকটি নট। হাওয়া থেকে কুড়িয়ে এনে গল্প বানাবেন বিহারী নির্যাতনের কারন এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, একাত্তুরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বন্দোবস্ত করা যায়।
এইসব বুদ্ধিবৃত্তিক মকারদেরকে নিজেদের অজান্তে আমরাই প্রনোদনা যোগাচ্ছি কীনা ভেবে দেখার অনুরোধ থাকলো।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
প্রিয় হাসান মোরশেদ, আপনার সুবিবেচনা প্রসূত চমৎকার মন্তব্যটির জন্য ধন্যবাদ। সত্যানুষন্ধানে আমি আপনার সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি। ধন্যবাদ।
-----------
চর্যাপদ
হাসান মোরশেদের মন্তব্যের ১ নম্বর অংশের বোল্ড করা অংশে একটা জিনিস খেয়াল করলাম,
তিনি "আক্রমণকারীদের প্রতিহতকারী" গ্রুপে রেখেছেন "বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মুক্তিযোদ্ধা", অপর দিকে আক্রমণকারী গ্রপে রেখেছেন সম্পূর্ণ "বিহারী জনগোষ্ঠী"।
কোন একটা জনগোষ্ঠীর সবাইকেই যখন যুদ্ধের একটা পক্ষ হিসাবে ধরা হয়, তখন খুব সাবধানেই করা উচিত বলে মনে হয়। বিহারী জন গোষ্ঠী নিয়ে আমার ধারণা বেশ কম, তবে উইকির তথ্যসূত্র অনুসারে এর সংখ্যা বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখের মত।
আমার প্রশ্ন: ৯ লাখের একটা জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবেই যুদ্ধের একটা পক্ষ ধরে তাদের সম্ভাব্য হত্যাকান্ডকে অন্যায় মনে না করাটা কতটুকু যৌক্তিক আর কতটুকু নিরাপদ আর কতটুকু ন্যায়সঙ্গত?
দয়া করে কেউ ভুল বুঝবেননা, ধরে নিতে পারেন, আমাদের অবস্থানকে আমি পুরোপুরিই ন্যায়সঙ্গত দেখতে চাই, তাই আমার এই প্রশ্ন, আর এই ধরনের প্রশ্ন কোন বিপদ ডেকে আনবে কিনা সেটা আপাতত দূরে সরিয়ে রেখে।
আশা করি
আপনি যে পয়েন্টটা তুললেন ঠিকই আছে। একটা জনগোষ্ঠীকে (তার শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ) যুদ্ধের অংশ ধরাটা নিয়ম নয়। টাইপো হতে পারে, হাসান মোরশেদই এর উত্তর ভালো করতে পারবেন।
তবে, ওনার মন্তব্যে যে বিষয়টি উঠে এল, সেটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। বিহারী জনগোষ্ঠীর একটা অংশ যে সশস্ত্রভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, সেটা তো ঠিক। এখন সেই যুদ্ধে যখন একজন সশস্ত্র বিহারী মারা গেল, সেটার সাথে একজন পাকিস্তানি সেনা বা আল বদর মারা যাবার কি পার্থক্য? এইসব আলোচনাগুলো আসলে আমাদের বোঝাবুঝিকে পরিষ্কার করতেই সাহায্য করছে। কোনটাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করছি, আর কোনটাকে করছি না, সেটা বোঝার সময় এসেছে। হাসান মোরশেদ কোনটা অন্যায় আর কোনটা অন্যায় না, সেই প্রশ্ন এনেছেন। কয়েকটা দৃশ্য কল্পনা করি।
সাঈদ আহমেদ যখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা বলছেন, তখন কোনগুলোকে এর ভেতরে ফেলছেন? এগুলো হয়তো আমরা আরও পরিষ্কার করতে পারব।
যুদ্ধের সময় সকল হত্যাকাণ্ড বিচারযোগ্য অপরাধের মধ্যে ধরার নিয়ম না বলেই আমার ধারণা। একটা গোটা জনগোষ্ঠীকে যেমন যুদ্ধের পক্ষ ধরার নিয়ম না। যারা ধরে, তাদের সেই ধরার ফলাফলগুলো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। যেমন, পাকিস্তান গোটা বাঙালি জাতিকেই বিপক্ষশক্তি ধরেছিল, জার্মানি ধরেছিল গোটা ইহুদিজাতিকে।
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনগুলো ঘেঁটে কেউ জানাতে পারেন উপরের দৃশ্যকল্পে কোনগুলো বিচারযোগ্য।
তবে, এই আলোচনা যে আমরা করছি, সাঈদ আহমেদ যে বিষয়টি তুললেন, এটা যথেষ্ট দরকারি ছিল। আমরা যদি এখন এই বিষয়গুলো বোঝাপড়া করে না রাখি, এগুলো নিয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকারের মানুষের অভাব হবে না। প্রস্তুতির অভাবে উত্তর করার সুযোগটাও আমাদের থাকবে না। সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার হাতে সশস্ত্র বিহারী নিহত হলে সেটাকেও ’বিহারীনিধন' হিসেবে যুক্ত করে দেয়ার সুযোগ অনেকে পেতে পারে, যদি আমাদের বোঝাপড়া যথেষ্ট না থেকে থাকে বিষয়টি নিয়ে।
নিরীহ বিহারী হত্যার দুয়েকটা ঘটনা হয়তো ঘটেছে, অস্বীকার আমরা করবো না। নয় মাসের যুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধার ভীড়ে জয়নাল হাজারির মত যুদ্ধের আগে মধ্যে পড়ে দুর্বলের উপর অত্যাচার করা মুক্তিযোদ্ধার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার হীনমন্যতাবোধ করার প্রয়োজন আমাদের পড়ে নি। অপরাধ হিসেবে সেটা গণ্য হলে এদের বিচার করতেও আমাদের বাঁধবে কিসে? কিন্তু পাকিস্তানী সরকার আর তাদের দোসররা যে স্কেলে এটা দাবি করে আসছে, তার ধারেকাছে সেটা ঘটার সুযোগ এমনকি যুদ্ধ শেষ হবার পরেও যে ছিল না, সে কথাটিই এই লেখায় উঠে এসেছে। এটা না ঘঁেটে বের করলে তথ্যের অপব্যবহারই হত। সাঈদ আহমেদকে এজন্য সাধুবাদ!
ধ্রুব বর্ণন ও দিফিও-1 এর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে চেষ্টা করছি উত্তর দিতে--
১. ধ্রুব যে চারটি প্রেক্ষিত তুলে ধরলেন, তার মধ্যে যুদ্ধে হতাহতের ঘটনা এবং নিরাপরাধ ব্যক্তিদের হত্যার ঘটনা--দুটোই আছে। আমার জানামতে, যুদ্ধে দুই পক্ষের যোদ্ধাদের যে হতাহতের ঘটনা ঘটে, তা সাধারনত: বিচার্য না। নৈষাদ যুদ্ধের পর "পকেট অব রেজিস্টেন্স" এর কথা বলেছেন। এই রেজিস্টেন্স প্রতিহত করাকেও আমি যুদ্ধের অংশই মনে করি।
কিন্তু এক পক্ষ কর্তৃক অন্যপক্ষের নিষ্ক্রয় ও নিরাপরাধ ব্যক্তিদের হত্যা-- অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত।
২. মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, কিন্তু সুযোগ বুঝে যুদ্ধের পর লুটতরাজ চালিয়েছে, বাঙালিদের মধ্যে এমন ব্যক্তি থাকতেই পারে (শুনেছি লোকসম্মুখে রাজাকার ছিল না এমন কিছু লোকও লুটতরাজ আর গণহত্যার শিকার বাঙালিদের কঙ্কাল বিক্রি করে বড়লোক হয়ে এখন দেশের প্রভাবশালি ব্যক্তিত্ব!)। তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানেই মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নয়। বাঙালিদের কেউ কেউ নিরাপরাধ বিহারিদের আক্রমণ করেছে (কাদের সিদ্দিকী তার যুদ্ধপরবর্তী বিচারকর্মে এদের কথা বলেছেন)। আবার, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে রাজাকারদের বিচার না করে বরং পুনর্বাসন করেছে, এমন ব্যক্তিও কি আমাদের দেশে ছিল না? তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানেই মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নয়। কিছু সুযোগ-সন্ধানীকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেই কেউ যদি মনে করে মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে, তাহলে বুঝতে হবে একাত্তরের সকল মুক্তিযোদ্ধাকেই সে সুযোগ-সন্ধানী ভাবছে- যেক্ষেত্রে আমার তীব্র আপত্তি আছে।
রাজাকাররা যে কারনে "মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ভাগ করার কী দরকার" বলে সাধারণ নাগরিকদের সাথে মিশে যেতে চায়; ঠিক একই কারনে সুযোগ-সন্ধানীরাও "মুক্তিযোদ্ধা আর সুযোগ-সন্ধানী ভাগ করার কী দরকার" বলে দলভুক্ত হতে চায়। কিন্তু অল্প কিছু সুযোগ-সন্ধানীর অপকর্মের দায় মুক্তিযোদ্ধারা কেন নিবে?
৪. তাহলে এই প্রশ্ন এখন আসছে কেন? আসছে, কারন যেসব বিহারি মনে করেন তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অংশ না নিয়েও এই সব সুযোগ-সন্ধানীদের হাতে অপদস্থ হয়েছেন, তাদের কথা আমরা খুব একটা বলি না। শুভাশীষ দাশের পোস্টটি দেখলেই বুঝবেন, কাউন্টার ন্যারেটিভ রচনায় শর্মিলা বসু তথ্য-উপাত্ত না দিয়ে, বরং অনুমান ব্যবহার করেন। কারন, আমাদের না বলাকেই শর্মিলা বসুরা 'ইতিহাসের শূণ্যস্থান' দাবি করে কল্প কাহিনী বিক্রি করে চলেছেন। আমরা যদি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলেই শর্মিলাদের মোকাবেলা করা যাবে।
কোন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাই? কোন সত্য এই পোস্টে উঠে এসেছে?
ক. বিহারি নির্যাতনের পৃষ্ঠোপোষকতা
বিজিতের উপর বিজয়ীর নির্যাতনে উদাহরন আমি পোস্টের শুরুতে দিয়েছি। ইতিহাসের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়েছে সরাসরি বিজয়ী কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। এমনকি চলমান পশ্চিমা আগ্রাসনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, নিরীহ ইরাকি বা আফগান নাগরিকদের নির্যাতনে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে।
অথচ, একাত্তরের যুদ্ধের পরপরই জেনেভা কনভেনশনের আওতায় সমস্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের রক্ষার কথা বলে তাদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হলো; দেশের নিয়মিত বাহিনীর অর্ধেকেরও বেশি নিয়োগ দেয়া হলো বিহারিদের রক্ষার জন্য। পশ্চিমা মিডিয়াতে যদি এমন রিপোর্ট আসে, তাহলে তা আমরা প্রচার থেকে কেন বিরত থাকবো? কাদেরকে ঘোলা-পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ দেবার জন্য আমরা এসব সত্য লুকিয়ে রাখবো?
খ. বিহারি নির্যাতনের স্কেল
আমার আগের পোস্টে নাদির আলির জবানিতে জানিয়েছি-- বিহারি নির্যাতনের যে স্কেল শর্মিলা বসুরা দাবী করেন, তা ঠিক নয়। দি গার্ডিয়ানের যে রিপোর্টটি এই পোস্টের বিষয়বস্তু, তা কী নির্দেশ করে? রিপোর্ট বলছে "গত মাসে মিরপুর এলাকায় সংঘর্ষে ৪৬ জন বিহারি ও ৩৫০ জন বাঙালির মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল।" এ ধরনের তথ্য প্রচারের প্রতিবাদ করে যারা সত্য গোপন করতে চান, তারা কি পাকিস্তানি কর্তৃক বাঙালিদের গণহত্যা আর সুযোগ সন্ধানী বাঙালিদের হাতে কিছু বিহারির নির্যাতনকে এক কাতারে ফেলার শর্মিলাবসুয়ীয় প্রচেষ্টাকে চালু রাখতে চান?
-----------
চর্যাপদ
শর্মিলা বসু যা করছেন তা প্রতিরোধের ধরন যদি হয় এরকম- বিহারী মরেছে ৪৬ আর বাঙ্গালী মরেছে ৩৫০, সুতরাং বিহারীর চেয়ে বাঙ্গালীই মরেছে বেশী সেটা প্রমান করে সহানুভূতি আদায়, তাহলে খুব একটা কার্যকর কিছু হয়না বরং আসল সত্যটা প্রতিষ্ঠিত করা দরকার- নয় মাস বিহারীরা কি করেছে?
হিমুর দেয়া স্ন্যাপশট রিপোর্টেই আছে, মার্চের মিলিটারী ক্র্যাকডাউন এর পর পাকিস্তান আর্মি তাদের বেশীর ভাগ সহযোগী সংগ্রহ করেছিলো এই বিহারীদের মধ্য থেকে। সুতরাং যুদ্ধের পর ছিঁটেফোটা কিছু যদি ঘটে থাকে তা আফটার এফেক্ট মাত্র, মুল দায় বিহারীদের নয়মাসের অপকর্ম।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
এখানে সহানুভূতি আদায় করা হচ্ছে না, বড় আকারে বিহারীনিধনের মিথকে রিফিউট করা হচ্ছে। এই রিফিউটেশান অ-ত্য-ন্ত দরকারি! এর বদলে পুরো বিহারী জনগোষ্ঠীকে যুদ্ধের পক্ষ হিসেবে দেখলে কি লাভ হচ্ছে সেটা এখন মূল প্রশ্ন। ঘটনাচক্রটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে -
- শর্মিলা বসু বলছে বড় আকারে বিহারী নিধন হয়েছে
- সাঈদ আহমেদ বলছে, এটা একটা মিথ এবং তথ্য দিয়ে সেটা উনি রিফিউট করা শুরু করেছেন
- আপনি বলছেন, পুরো বিহারী জনগোষ্ঠী যুদ্ধে আমাদের বিপরীত পক্ষ ছিল এবং ফলত তাদের নিধন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অপরাধ হিসেবে গণ্য নয়। মানে সাঈদ আহমেদকে আপনি কন্টেস্ট করছেন, শর্মিলা বসুকে নয়; আপনার বক্তব্য বরং শর্মিলাদের রসদই যোগাচ্ছে ("বড় আকারে বিহারী নিধন সম্ভব ছিল")।
উঁহু। শর্মিলা বোস এবং সাঈদ আহমেদ দুজনের তথ্যেই একটা ভ্যাকুয়াম থেকে যাচ্ছে।
শর্মিলা বলছেন বড় আকারে বিহারী নিধন হয়েছে।
সাঈদ আহমেদ তথ্য দিয়ে প্রমান করছেন শর্মিলার দাবীকৃত 'বড় আকারের' নিধন সত্য নয়, তবে নিধন হয়েছে এবং তিনি এর তদন্ত চাচ্ছেন।
আমি যে জায়গায় স্থির থাকছি সেটা হচ্ছে বিহারীরা বাঙ্গালী গনহত্যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, শর্মিলা এই সত্যটা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
নিধন বড় হয়েছে না ছোট হয়েছে তারচেয়ে জরুরী হচ্ছে গনহত্যায় বিহারীদের ভূমিকাকে প্রকাশ করা। এই প্রকাশ নিশ্চয় শর্মিলাদের রসদ জোগাবেনা, কি বলেন?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
১. অবশ্যই রসদ যোগাবে, যদি শর্মিলা বোসের "ব্যাপক বিহারি নিধন তত্ত্বের" উত্তরে, আপনি বলেন, "তা আফটার এফেক্ট মাত্র, মুল দায় বিহারীদের নয়মাসের অপকর্ম।" কিন্তু যদি বলেন, যা ঘটেছে তা "ছিঁটেফোটা কিছু", তাহলে রসদ যোগাবে না।
-----------
চর্যাপদ
মন্তব্য ৩৮। দিফিও-1
২৫শে মার্চ রাতে যখন গনহত্যা শুরু হলো তার টার্গেট কিন্তু পুরো বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী। অপারেশন সার্চলাইটের পোড়ামাটি নীতি তাই বলে। ২৬শে মার্চ থেকে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ ঘোষিত হলো, তা বাঙ্গালী জ়নগোষ্ঠীর ম্যান্ডেট নিয়েই। সুতরাং ২৬শে মার্চ থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবেই যুদ্ধের একটা পক্ষ হিসেবে ধরে নেওয়া নিশ্চয়ই অযৌক্তিক নয় ( সাত কোটির মধ্যে কয়েক হাজার দালালকে আমি ব্যতিক্রম হিসেবে ধরছি, এরা সমগ্র জনগোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব করেনা)
এবার আসেন অপরপক্ষ- পশ্চিম পাকিস্তানী জনগোষ্ঠির সম্পূর্ণকে আমরা যুদ্ধের পক্ষ হিসেবে ধরতে পারি কিনা? আমার পালটা প্রশ্ন কেনো নয়? যখন কেউ একটা যুদ্ধকে সমর্থন জোগায়, সে কি যুদ্ধের পক্ষ নয়? পশ্চিম পাকিস্তানী জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য কোন অংশ যুদ্ধচলাকালীন সময়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অবস্থান নিয়েছিলো- এরকম একটা উদাহরন কি দেখাতে পারবেন? বরং যুদ্ধ শেষে জুলফি ভুট্টোর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছে পশ্চিম পাকিস্তানে ( দুচারজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রতিবাদকে, জনগোষ্ঠীর আলোচনায় টেনে আনার দরকার নেই)
প্রেসিডেন্ট বুশ ও দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছিলো ঠিক কিন্তু ইরাক যুদ্ধবিরোধী সবচেয়ে বড় সমাবেশ, প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রেই হয়েছিলো।
এবার আসা যাক বিহারী প্রসঙ্গে। নয় মাসে ধরে চলতে থাকা যুদ্ধে নয় লাখ বিহারী'র অবস্থান কি বিচ্ছিন্ন ছিলো? যার যেমন খুশী? কেউ পাকিস্তানীদের পক্ষে, কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, কেউ নিরপেক্ষ? নাকি বাঙ্গালী ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের মতো তাদের ও কোন গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্ত ছিলো?
যদি না থাকে তাহলে তাদের সকলকে যুদ্ধের একটা পক্ষ হিসেবে আমি ধরবোনা। কিন্তু তাদের সংশ্লিষ্টতার মাত্রা এতো তীব্র, আমার জনগোষ্ঠির জন্য এতো ভয়ংকর ছিলো যে তাদেরকে যুদ্ধের পক্ষ হিসেবে না ধরার মতো জোরালো কোন যুক্তি পাওয়া যাচ্ছেনা।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানী জনগোষ্ঠি যুদ্ধের পক্ষ হলে তাদের শিশু নারী বৃদ্ধ যারা ওই জনগোষ্ঠির অংশ তাদের হত্যা করা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে একটা পাকসেনা হত্যার সমান নাকি সমান না? যদি সমান না হয়, তাহলে যুদ্ধের পক্ষ বলতে কি বোঝায়?
আবার বলছি, যারা অন্যায় যুদ্ধ চাপায়, তারা একটা গোটা জনগোষ্ঠীকে বিপক্ষ বানাতে পারে, কিন্তু এভাবে আমাদের দেখতে বলা সৎ পরামর্শ নয়। এটা নীতিগতভাবে অন্যায়। আইনগতভাবে কোন জনগোষ্ঠীকে (হোক তার অধিকাংশ পুরুষ বিপক্ষে ছিল) সম্পূর্ণভাবে ও বিরূপভাবে আলাদা করে বিবেচনা করা অপরাধ। একটা জনগোষ্ঠীর কথা বললে, তাদের শিশুদের কথা চলে আসে, নারীদের কথা চলে আসে, বৃদ্ধদের কথা চলে আসে, প্রতিবন্ধিদের কথা চলে আসে। আপনি যখন সম্পূর্ণ গোষ্ঠীকে বিপক্ষ বানাচ্ছেন, তখন এদেরকেও বানাচ্ছেন। জনগোষ্ঠীর যে কাউকে হত্যা করা সম্মুখ যুদ্ধে পাকসেনা হত্যার সমান জায়েজ থাকলে এদের যে কাউকেও হত্যা করাও জায়েজ হয়। আমরা এগুলোকে আলাদা করছি। ঘোলাকে পরিষ্কার করছি।
আপনার সাথে প্রবল দ্বিমত জানালাম, এবং আপনার চিন্তাভাবনার ধারায় বেশ অবাক হলাম।
কোন সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে যুদ্ধের একটা পক্ষ ধরা কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? আপনার কথামত তো দেখা যাচ্ছে যে বিহারী শিশু, বৃদ্ধ সবাই যুদ্ধের একটা পক্ষ, তাই তাদের সম্ভাব্য হত্যাকান্ডও একটা সম্মুখ যুদ্ধের হতাহতের ঘটনামাত্র!
এই যুক্তির সাথে তো পাকিস্তানী জেনারেলদের যুক্তির কোন তফাত দেখছিনা---বাঙালীরা সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে, তো মারো সব কটাকে! আপনার ৩৬ নম্বর মন্তব্যে "বিহারী"র জায়গায় বাঙালী বসিয়ে দেখুন, খুব সুন্দর কিছু যুক্তি পাবেন। বরং আমিই বসিয়ে দেই দেখুন
অবাক হবার কিছু নেই। নারী এবং শিশুরা যুদ্ধের বাইরে- এটা আজকের নর্মস না, প্রাচীন কাল থেকেই মেনে আসা হচ্ছে যদিও পাকি/বিহারীরা শুরু থেকেই এটা মানেনি।
সুতরাং এখানে যুদ্ধের একটা পক্ষ হিসাবে বিহারী জনগোষ্ঠীকে উল্লেখ করা মানেই তাদের নারী ও শিশু ছাড়া বাকী সবাই, সেটা আলাদা করে ভাঙ্গিয়ে বলার দরকার আছে বলে মনে হচ্ছেনা।
কিন্তু শর্মিলা বোস ও তদীয় অনুসারীরা 'নিরীহ' বিহারী বলতে বিহারী নারী ও শিশুদেরই বুঝিয়েছেন- এমন আপ্তবাক্যে ও আমি ভরসা রাখতে আগ্রহী নই।
আরেকটা কথা বলি, ৪০ বছর পর নিরাপদ দূরত্বে থেকে আমরা তত্বীয় তর্ক করতে পারি- মুক্তিযোদ্ধারা কেনো যুদ্ধের মাঠে আরো মানবিক, আরো সভ্য হলোনা কিন্তু একটা চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ মোকাবেলা করতে গিয়ে নিরস্ত্র মানুষগুলো সশস্ত্র হতে হতে তাদের মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিলো সেটা বিবেচনায় না এনে যেনো আমরা তাদের কাঠগড়ায় ঠেলে না দেই।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
"মুক্তিযোদ্ধারা কেনো যুদ্ধের মাঠে আরো মানবিক, আরো সভ্য হলোনা"-- এটা তো আপনিই তুললেন, আর তো কেউ বলছে না!
শর্মিলা বসু হয়তো কাছাকাছি কিছু একটা দাবী করছে, কিন্তু আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করছি, বড় কোন হত্যাকান্ড ঘটেইনি। যা ঘটেছে, তা সুযোগ-সন্ধানীদের কাজ এবং জাতি হিসেবে আমরা অনেক মানবিকতার পরিচয় দিয়েছি।
অথচ এই বিতর্কের সূত্রে আপনি বলছেন "নিরস্ত্র মানুষগুলো সশস্ত্র হতে হতে তাদের মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিলো সেটা বিবেচনায় না এনে যেনো আমরা তাদের কাঠগড়ায় ঠেলে না দেই।"
আপনার কেন মনে হচ্ছে বিহারিদের উপর "ছিঁটেফোটা" যা কিছু "আফটার এফেক্ট" হয়েছে, তা আসলে এদেশের "নিরস্ত্র মানুষগুলো সশস্ত্র হতে হতে" মানসিক অবস্থার একটি পর্যায়ে পৌছে এসব করেছে?
এদেশের মানুষগুলোর মানসিক অবস্থা কেমন ছিল জানতে চান?
-- 'চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ মোকাবেলা করতে গিয়ে' কাদের সিদ্দিকী অবাঙালী দুটি মেয়েকে অপহৃত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন;
-- বাংলাদেশ তার অর্ধেকের বেশি শক্তি নিয়োগ করেছিল বিহারিদের রক্ষায়।
এতোটা মানসিক শক্তি, মানবিক শক্তি ইতিহাসে খুব একটা পাবেন না।
এইসব সত্য ভুলে, শর্মিলা বসুর "ব্যপক বিহারি নিধনতত্ত্বের" জবাবে দেশের মানুষের মানসিক অবস্থাকে দায়ী করবেন না দয়া করে। কিছু সুযোগ-সন্ধানীর দায় পুরো জাতির নয়।
-----------
চর্যাপদ
সেটাই! বিহারীদের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতা এসেছিল বটে এবং এদের মধ্যে অপরাধীদের বিচার হওয়াতে সমস্যাও তৈরি করে নি সাঈদ আহমেদের তথ্য ও যুক্তি। কিন্তু তার বিপরীতে সমগ্র বিহারী জনগোষ্ঠিকে বিপক্ষ হিসেবে দেখার আবিষ্কৃত তত্ত্বটা বরং ৪০ বছর পর নিরাপদ দূরত্বে থেকেই বানানো হল। একাত্তরের যুদ্ধের মাঠে মুক্তিযোদ্ধারা এই তত্ত্ব ধারণ করতো এমন কোন প্রমাণ নেই। সাঈদ আহমেদের প্রদত্ত তথ্য থেকে বরং উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে যারা দায়িত্ব নিতে জানত, তারা ঠিকভাবে ভাবতেও জানতো। সে জায়গায় একটা আবিষ্কৃত অমানবিক ও অনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিনা প্রমাণে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর চাপিয়ে দেয়া ঘোরতর অন্যায়।
বিহারী যদি নিরস্ত্র বাঙালি মেরে থাকে বা বাঙালি যদি নিরস্ত্র বিহারী মেরে থাকে, তাদের বিচারে কুণ্ঠা নেই। এদের কেউ আমার আপনার মামা, চাচা, ফুপা, জ্যাঠা, বাবা হলেও নেই। নিরস্ত্রকে হত্যা যদি অপরাধ হয়, তাকে রক্ষা করার সুযোগ কারও থাকার উপায় নেই।
কিন্তু বটমলাইন হল, বড় আকারের বিহারীনিধন একটা মিথ। বিহারী যারা অপরাধী ছিল, তাদের বিচারের প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। বিপক্ষ ধারণকারী বিহারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যে সশস্ত্র যুদ্ধ তাকেও তো এখানে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রশ্নই আসে না, আসে নি। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় নিরস্ত্র-বিহারী-হত্যাকারী দুয়েকজন সুযোগসন্ধানী বাঙালিকে আমরা বিচার করবো নাকি ওই দুয়েকজন সুযোগসন্ধানী অপরাধী বাঙালিকে রক্ষা করার জন্যে সমগ্র বিহারী জনগোষ্ঠিকে বিপক্ষ দেখিয়ে বড় আকারে বিহারীনিধনের সুযোগ ও মনস্তাত্বিক পরিস্থিতি বলবৎ থাকার তত্ত্বে রসদ জুগিয়ে তার দায় সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার ঘাড়ে চাপাবো? সুযোগসন্ধানী শয়তান বাঙালিরা যখন নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে তখন সে রাজাকার হলেও, নিরস্ত্র বিহারী হত্যা করলে সে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়, এটাই কি যুক্তি নাকি?
আমাদের উপর যুদ্ধটা চাপানো ছিল। আমাদের সংগ্রামটাও মানবিকভাবে অত্যন্ত বলীয়ান ছিল। কথায় কথায় বিভিন্ন ইস্যুতে মানবিকতার বিরোধিতা আর মানবিকতাকে তাচ্ছিল্য করতে করতে এখন আমরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মানবিক ও নৈতিক অবস্থানকে অস্বীকার করা শুরু করছি। এভাবে নিজেদের মানবতারহিত দৃষ্টিভঙ্গি তাদের প্রতি চাপানো তাদের জন্যে ঘোরতর অসম্মান ও অন্যায়। একে প্রতিহত করা একান্ত অপরিহার্য দায়িত্ব। সময় এসেছে আমার সিগনেচারখানি ফেরত আনার।
~~সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা মানুষের মুক্তির জন্যে সংগ্রামের সময় অপরাধীর অধিকারের কথাটাও ভুলে যায় না।
অনেকদিন এই সিগনেচার বহন করেছি। আমি সঠিকই ছিলাম। অর্ধেকের বেশি মুক্তিযোদ্ধা নিয়োজিত ছিল বিহারীদের রক্ষায়, সেই একই বিহারীরা, যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নিরস্ত্র বাঙালি হত্যায়, তথা অপরাধে লিপ্ত ছিল। নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের রক্ষার জন্যে পর্যাপ্ত মানবতার অভাব মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না।
ব্যপক গোলমাল
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
একটা পুরনো লেখা শেয়ার করি, যদিও পাঠকের কাছে আমাকে কন্ট্রাডিক্টরী মনে হবার ঝুঁকি আছে।
ঘৃনা করি তাকে-যদি ও সে বীরের প্রতীক
অনেক পুরনো আরেকটি লেখা
বিষবৃক্ষের করুণ শাখা
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আপনার এই লেখার চেয়ে, লেখার নিচে দেয়া আপনার মন্তব্যগুলোই বেশি ভালো লাগলো।
আপনি এখানে বললেন "নিধন বড় হয়েছে না ছোট হয়েছে তারচেয়ে জরুরী হচ্ছে গনহত্যায় বিহারীদের ভূমিকাকে প্রকাশ করা।"
এখন আমি যদি আপনার যুক্তির লাইন ধরে অগ্রসর হই, তাহলে উল্টো প্রশ্ন করতে পারি-- কী উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি পাকিস্তানি কবি আর বিহারি মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব নিয়ে মেতে উঠলেন? "একজন বিহারি কী করেছে, তারচেয়ে জরুরী হচ্ছে গনহত্যায় বিহারীদের ভূমিকাকে প্রকাশ করা?" শর্মিলা বসু আর মেহেরজানও তো খুঁজে খুঁজে "ভালো পাকিস্তানি" বের করছে, তাইনা? এগুলো হচ্ছে কুযুক্তি।
আমার মত জানতে চাইলে বলি-- আপনার এই মন্তব্যটি আমার অসাধারন লেগেছে- "জাতীয়তাবাদের নামে এরকম কিছুর সাথে আমি মাদ্রাসা পাশ হুজুরদের ইহুদী নাসারা বিদ্বেষ কিংবা ভারতীয় বজরং দলের মুসলিম বিদ্বেষের কোন পার্থক্য দেখতে পারিনা"।
-----------
চর্যাপদ
লেখাটা মিস হয়ে গিয়েছিল। এখানে সাধুবাদ জানাই! আমি আপনার এধরনের লেখার সাথেই বেশি পরিচিত। আপনার মন্তব্যগুলো খুব ভালো লাগলো। আপনাকে উদ্ধৃত করি ওখান থেকে
কন্ট্রাডিক্টরি মনে হবার ঝুঁকি বোধগম্য।
নতুন মন্তব্য করুন