লা সিয়েতার সৈনিক

তাহসিন রেজা এর ছবি
লিখেছেন তাহসিন রেজা [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৯/০৯/২০১৪ - ২:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের ঘটনা । বেড়াতে গিয়েছিলাম দক্ষিণ ফ্রান্সের ছোট্ট বন্দর লা সিয়েতায় । সমুদ্রের ধারে একটা নতুন জাহাজ ভেড়ানো ছিল, তার পাশেই চলছিল একটা মেলা । মেলার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বেশ উন্মুক্ত স্থানে এসে পড়লাম । ওখানেই দেখতে পেলাম একটা মূর্তি। একজন ফরাসী সৈনিকের ব্রোঞ্জের মূর্তি । মূর্তিটির চারপাশে অনেক মানুষ । আগ্রহী হয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম । এবং সামনে গিয়ে চমৎকৃত হলাম । ওটা একটা জীবন্ত মানুষ ! ধূসর রঙের ওভারকোটে পুরো শরীর ঢাকা, মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ, হাতে বেয়োনেট সহ রাইফেল । ওঁর শরীরের কোন মাংসপেশীই নড়ছে না । পড়ছে না চোখের পলক ।

লোকটির পায়ের কাছে একটা কাঠের ফলক রাখা আছে । তার উপর লেখা আছে বেশ কিছু কথা । আমি ঝুঁকে ওটা পড়তে লাগলামঃ

মূর্তি মানব
-------------
“আমি __ নং রেজিমেন্টের সৈনিক। নাম লুই ফ্রাঁসার্ড। ভেরদুনের উপকূলে জীবন্ত সমাহিত হবার পর সম্পূর্ণ নিথর আর নিশ্চল হয়ে পাথুরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকার এই অভূতপূর্ব ক্ষমতা লাভ করেছি । অনেক বিশেষজ্ঞই আমার এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা পরখ করে দেখেছেন আর এটাকে একটি ব্যাখ্যাতীত এক ব্যাধি বলে রায় দিয়েছেন । অনুগ্রহপূর্বক এই অসহায় লোকটিকে তার পরিবার পরিজনের জন্য কিছু দান করে যান” ।

একটা পয়সা থালায় রেখে সামনের দিকে পা বাড়ালাম । ভাবতে লাগলাম এই সৈনিকের সাজে সজ্জিত লোকটি বহুশত বছরের এক সৈনিকের ধ্বংসাবশেষ ।

এই সেই সৈনিক যাকে নিয়ে রচিত হয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস । এই সেই সৈনিক যার জন্যে আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন অথবা সিজারের বিজয় অভিযান গুলো সম্ভব হয়েছে , যেগুলো আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়ে থাকি এখনো।

এই সেই সাইরাসের তীরন্দাজ, এই সেই ক্যাম্বিসির রথের সারথি , মরুভূমির উষ্ণ বালুকারশি যাকে বিলীন করতে পারেনি । যাকে থামাতে পারেনি সিজারের সেনাবাহিনী, চেঙ্গিস খানের ঘোড়সওয়ারেরা, চতুর্দশ লুইয়ের সুইস গার্ড, পারেনি প্রথম নেপোলিয়নের গোলন্দাজেরা ।

অবর্ণনীয় কষ্ট আর ধ্বংসের বোঝা বইতে সক্ষম এই মানুষটি । মৃত্যুর মুখেও এই মানুষটি থাকে পাথরের মত অটল অবিচল । এই মানুষটিই কালে কালে বর্শার আঘাতে জর্জরিত হয়েছে , এরতাজারেক্সসেস আর জেনারেল লুডেনডরফের শকটের নীচে দলিত মথিত হয়েছে , হ্যানিবাল আর আটিলার হস্তীবাহিনীর নীচে পিষে গেছে তাদের দেহ । কামানের উড়ন্ত গোলায়, ক্যাটাপল্টের ধেয়ে আসা প্রস্তরখণ্ডে, মেশিন গানের গুলিতে ঝাঁজরা হয়েও সে দাঁড়িয়ে থাকে, নির্বিকার । নতুন নতুন ভাষায় সে আদেশ পেয়েছে, নিত্যনতুন মানুষ তার মনিব হয়ে উঠেছে । তবু সে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

সে কখনো জানেনি কেন তার এই দাঁড়িয়ে থাকা , কেন সে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে !

সে জয় করেছে ভূমি, কিন্তু সে ভূমিতে বসবাসের অধিকার সে পায়নি ! সে ভূমি রক্ষা করেছে, কিন্তু ভূমির মালিক হতে পারেনি । এমন কি তার কোমরে কিংবা কাঁধে ঝোলানো অস্ত্রটিও তার নিজের নয় । তবু সে দাঁড়িয়ে আছে । তাঁর মাথার উপর জঙ্গি বিমান , পায়ের নীচে প্রাণঘাতী মাইন, চোরাবালির ফাঁদ, রোগ-শোক-মহামারী, বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস চারদিকে । তাঁর সামনে শত্রুসেনা, আর পিছনে জেনারেল।

কত অগণিত হাত পোশাক বানিয়েছে এই মানুষটির জন্য, বর্ম নির্মাণ করেছে কত হাতুড়ি, বানিয়েছে পায়ের জুতো । ওঁর জন্যই পকেট ভারী হয়েছে কত মানুষের!

এই পৃথিবীর সবগুলো ভাষাতে ওঁর প্রতি উচ্চারিত হয়েছে অনুপ্রেরণার বাণী । পৃথিবীর সব ঈশ্বর তাকে করেছে আশীর্বাদ । তবু এই লোকটি আজ নিঃশেষিত এক নিরাময়ের অযোগ্য ব্যাধিতে। প্রাণহীন নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে !

আমরা ভাবতে লাগলাম “এ কেমন জীবন্ত সমাধি? এই রোগের কারণ কি ?”
কিসের জন্য এই লোকটি এমন একটি দানবীয় আর বীভৎস ব্যাধিতে ভুগছে ?

এই ব্যাধিটিকে কি সারিয়ে তোলা যায় না ?

__________________________________________________________________________________________________________

মূলঃ The Soldier of La Ciotat(Bertolt Brecht)


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

হাততালি
চমৎকার লেখার চমৎকার অনুবাদ। যতিচিহ্নগুলির অনেক জায়গায় ঠিকমত না বসা ছাড়া আর কোন কমতিই চোখে পড়ে নি। আর, সেই কমতিগুলোর জন্য এই সংগ্রহযোগ্য লেখাটিতে তারার সংখ্যা কমার মানে হয়না। অতএব পাঁচে পাঁচ হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তাহসিন রেজা এর ছবি

যতি চিহ্ন নিয়ে কিছু দুর্বলতা আমার আছে, যেমন আছে বানান নিয়ে। কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় আছি।
অনুবাদ আপনার ভালো লেগেছে যেনে খুব অনুপ্রাণিত বোধ করছি, প্রিয় একলহমা দাদা। শুভেচ্ছা নিরন্তর।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গণচীনের কিছু কিছু অনুষ্ঠানে এইরকম সৈনিকের পোষাকে সজ্জিত সম্পূর্ণ নিশ্চল, চোখের পলক না ফেলা, নিঃশ্বাস ফেলা বোঝা যায় না এমন কিছু হতভাগ্য মানুষের দেখা পাবার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তাহসিন রেজা এর ছবি

সব যুগে সব কালের সৈনিকদের গল্প তো একই।

পঠনে কৃতজ্ঞতা প্রিয় পাণ্ডব দা।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

তাহসিন রেজা এর ছবি

সাক্ষী সত্যানন্দের পপকর্ন খাওয়া দেখে আমিও পপকর্ন নিয়ে বসলাম গণচীনের সেই সৈনিকের গল্প শুনব বলে পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম দেঁতো হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অনেক কাল আগে 'পাণ্ডবের চীন দর্শন' নামে একটা সিরিজ লিখতাম। ওটা আর লিখবো না বলে ঠিক করেছি। ছবি-টবি ছাড়া নিছক কচকচানি পাঠক পছন্দ করেন না। আর গণচীনে এতবার যেতে হয়েছে যে এক দফার ভ্রমণের ঘটনাবলীর সাথে আরেক দফার ঘটনাবলী মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

দেঁতো হাসি এবার তবে "চীনের পাণ্ডব দর্শন" হয়ে যাক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

[ আমরা নাহয় খন্দকার মাহবুবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাপ্পর সেই পোস্ট পড়ব চোখ টিপি ]

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ব্রেখটের লেখা সবসময়ই দারুণ শক্তিশালী। এই গল্পটা পড়া ছিলো না, ভালো লাগলো খুব। অনুবাদটাও ভালো লেগেছে। আরো কিছু অনুবাদ হোক ব্রেখট এর।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তাহসিন রেজা এর ছবি

বছর দুয়েক আগে ব্রেখটের গল্প গুলোর ইংরেজি সংকলন হাতে আসে। প্রায় প্রতিটি গল্পই মুগ্ধতার সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল।
আরো দুয়েকটা গল্পের অনুবাদ করার আশা রাখি নজরুল ভাই।
ভালো থাকবেন সবসময়।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।