গ্রাম্য শীতের সকালের কেমন যেন একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। হালকা কুয়াশায় সেই গন্ধ মিশে থাকে। মিশে থাকে মেঠো রাস্তার উপর পড়ে থাকা হলদেটে সবুজ পাতায় লেগে থাকা শিশিরে। এই গন্ধ ভর করে ফসলের ক্ষেতে কাকতাড়ুয়ার মাথার উপর বসে থাকা দোয়েল অথবা লেজ ঝোলা ফিঙের ডানায়। ভোরের প্রথম আলোতে যে কৃষক পরম মমতায় হাত বুলায় তাঁর সাধের ফসলে, এই গন্ধ মিশে থাকে তাঁর ধূসর রঙের চাদরে। এই গন্ধ বসত গাড়ে বাঁশ ঝাড়ের শিশিরে ভেজা পাতায় আর তার নিচে বসে কাঠ কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে থাকা কিশোরীর বেণীতে।
ক্রমশ যখন বেলা বয়ে যায় এবং আরামদায়ক রোদের উত্তাপ যখন বাড়তে থাকে তখন এই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র লোকালয়ে, উত্তপ্ত কড়াইয়ে ফুটতে থাকা খেজুর রসের গুঁড়ের সুগন্ধের মত।
আজ কতদিন পর এমন একটা সকালে ফিরে এলাম এই জনপদে! একটা সময় ছিল যখন প্রতি শীতে অতিথি পাখির মত আমরা বারবার ফিরে ফিরে আসতাম এইখানে। হাসিতে আনন্দে কেটে যেত স্বপ্নের মত কয়েকটা দিন। সারা বছর তো এই সময়ের জন্যই ব্যাকুল হয়ে থাকতাম। অপেক্ষা করতাম ওদের জন্য-- বাঘ, ভাল্লুক, পেঁচা, ফিঙে, টুনটুনি, ইন্তিড়ি, বিন্তিড়ি, তিন্তিড়ি...... আমার নানী ওইসব নামেই ডাকতেন আমাদের।
মনে পড়ে সবাই এসে পৌঁছানো মাত্রই আমরা বেরিয়ে পড়তাম রঙচঙে সব জামাকাপড় পরে হুল্লোড় করতে করতে। সারা গ্রাম আমাদের চিৎকার চেঁচামেচি, দৌড়ঝাঁপ আর দুরন্তপনায় মুখরিত হত কয়েকটা দিন।
আমরা দস্যিদল সারাটা দিন টো টো করে চষে বেড়াতাম এদিক ওদিক। সারাদিন ঘুরতে ঘুরতে এক বাড়িতে বিন্নি ধানের খই, তো আরেক বাড়িতে চিঁড়ের মোয়া কিংবা নলেন গুঁড়ের পাটালি বা বাহারি নকশাকাটা একগাদা পিঠে উপঢৌকন হিসেবে পেতাম। যে বাড়িতেই যেতাম সেই বাড়ির নানী, খালা, চাচী এঁরা বলে উঠতেন-“ ও মা! কত বড় হয়ে গেছ তুমি!” সেই সময় কেউ আমাদের বড় বললে আমরা খুব খুশি হয়ে উঠতাম।
মনে পড়ে আমরা মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে লোকালয় ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে যেতাম। যেখানে সূর্য অস্ত যেত সেইখানে! আমাদের এক পিচ্চি বোনের বিশ্বাস ছিল সূর্য অস্ত যায় সরিষা খেতের মধ্যে। সেই জন্যেই না সরষে ফুল এতো সোনারঙা হলুদ! আমরা সবাই সরষে খেতের ভেতর দিয়ে হাঁটতাম পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে মার্চ করে। যখন বের হয়ে আসতাম আমাদের চুলে, গালে, পিঠে সারা গায়ে লেগে থাকতো সরষে ফুল আর সরষে ফুলের ঘ্রাণ......... সূর্যের সোনারঙা হলুদ।
আগুনে ঝলসানো কাঁচা ছোলা কিংবা মটরশুঁটির স্বাদ এখনো ভুলতে পারিনা। আশপাশ থেকে জোগাড় করা শুকনো পাতা, কাঠে প্রথমে আগুন ধরিয়ে দিতেন মামা। তারপর সেই আগুনের উপর কাঁচা ছোলার কান্ড রেখে ঝলসানো হত সেটি। এরপর খোসা ছাড়িয়ে সেই ছোলা খাওয়া হত ভীষণ মজা করে। ছোলার খোসায় লেগে থাকা কালি আমাদের মুখে লেগে যেত। খাওয়া শেষ হবার পর একেক জনের চেহারা ভূতের মত হয়ে যেত। তবু আমরা ওই ভূতমুখো চেহারা নিয়েই ঘুরে বেড়াতাম সবখানে।
ফসলের মাঠ ছিল আমাদের সবচে আনন্দের জায়গা। কারণ পুরো ফসলের মাঠ জুড়ে তো ছড়ানো ছিটানো আনন্দের গুপ্তধন, টুকরো টুকরো সুখ। এই দেখো পাশের বাড়ির মতি মামা জমিতে লাল শাকের বীজ ছিটাচ্ছে, ওই দেখো ফুলকপি ক্ষেতে পাশা দাদু মাটির কলসিতে করে পানি দিচ্ছে, নিবারণ জ্যাঠা তার বেগুনের জমিতে মুখে গামছা বেঁধে কীটনাশক দিচ্ছে, নুরু চাচা খেজুর গাছে ভাঁড় ঝুলাচ্ছে কিংবা নামাচ্ছে!
আর আমরা এইসব দেখতে দেখতে যখন এগিয়ে যাচ্ছি হয়ত পরাণ দাদু হাঁক দিলেন-“ ও দাদুরা, এইদিকে এইসো। নতুন রস নামাইছি গাছ থেকি। খাইয়ে যাও”। আমরা সোল্লাসে সেই দিকে এগিয়ে গেলাম। কিংবা সামনে যদি দেখি লাল গাজর কি কচি শাদা মুলো কিংবা মিষ্টি শাকালু তাহলে তো আর কথাই নেই!
কখনো দেখতাম গ্রামের দুরন্ত ছেলেরা আলু খেত থেকে আলু নিয়ে আলু পুড়িয়ে খাচ্ছে। আমরাও আনন্দে যোগ দিতাম ওদের সাথে। বন্ধুত্ব হয়ে যেতে সময় লাগতো না এক মিনিটও! একসাথে সারাদিন ধুলো খেলায় ওরাও মেতে থাকত। আমাদের কোন এক অর্বাচীন বোন হয়ত শালিক পাখি দেখে বলে উঠত-“ ওয়াও, ভাইয়া দেখো কি সুন্দর পাখি”। ওরা হেসে বলত-“ সোন্দর না কচু। অইডা তো গুইয়া শালিক, গু খায়!”। হয়ত আমাদের চলার পথে পথহারা কোন লাল লেজওয়ালা শেয়াল এসে পড়ত। আমরা ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়তাম। ওরা হিহিহি করে হেসে বলত-“ শ্যাল দেইখে ভয় পাওয়ার কি আছে?”। বলেই একটা মাটির ঢিল ছুড়ে মারত ওটার দিকে। লেজ গুটিয়ে শেয়ালটা লুকিয়ে পড়ত পাশের কোন ঝোপঝাড়ে।
এমন করে চরকির মত ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেতাম সূর্যটা একটা মস্তবড় একটা লাল বল হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই ওটা টুপ করে লুকিয়ে পড়বে দিগন্ত বিস্তৃত সরিষা খেতের ভেতর। আমরা বুঝতে পারতাম বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে। মাঠঘাট, বন বনানী, মেঠো পথ সব পেছনে ফেলে যখন আমরা বাড়িতে পা রাখতাম তখন সন্ধ্যে হয়ে আসত।
রাতটাও নেমে আসতো কেমন ঝুপঝাঁপ করে। নানীর হাতে রান্না অমৃত খেয়ে আমরা শুতে যেতাম টালির ছাদ দেয়া দহলিজ ঘরে। সারিসারি বিছানা করে আমরা শুয়ে থাকতাম পাশাপাশি। খুনসুটি চলতো ওর ভেতরেই। আমি তাকিয়ে থাকতাম টালির ছাদের দিকে। টালির ছাদের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যেত। আকাশে ফুটে থাকতো লক্ষকোটি তারা কিংবা মস্তবড় চাঁদ। নানী এসে বলতেন-“ আমার নানু ভাইদের চোখ দেখি তারা হয়ে গেছে! এইবার তোমারা ঘুমিয়ে পড়ো”। তারপর উনি মশারি টানিয়ে দিয়ে চলে যেতেন। আর আস্তে আস্তে কখন যে আমাদের চোখের তারা অস্ত যেত আমরা টেরও পেতাম না।
আজকে এই শীতের সকালে এই জনপদে নিজেকে কেমন বেমানান মনে হয়। অথচ আমিই তো ছিলাম, এই কিছুদিন আগেও এইখানে এলে সব কেমন নিবিড় আদরে আমাকে জড়িয়ে ধরত! এইখানে তো আমি আমার হৃদয়ের কিছু অংশ রেখে গিয়েছি, আমার সবচে সুখের মুহূর্ত গুলো এইখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গিয়েছি। তবু কেন নিজেকে আগন্তুক মনে হয়!
এই লেখা যখন লিখছি তখন আমার সমগ্র অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে একটুখানি ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। আর তখনই আমি অনুভব করলাম এইখানে আমি আগন্তুক নই.........
“আমি কোন আগন্তুক নই
আসমানের তারা সাক্ষী, সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী পুবের পুকুর...
...দুপাশে ধানের ক্ষেতে সরু পথ, সামনে ধুধু নদীর কিনার আমার অস্তিত্বে গাঁথা”।
আমি এইখানে আগন্তুক নই, বেমানান নই।
মন্তব্য
আমার গ্রামে থাকা দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিলেন ভাই।
ধন্যবাদ, সুলতান।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
শীতকাল মানেই ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। শহর ছেড়ে দূরে চলে যাওয়া।
নিন এই শীতের খেজুরের ।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ যেদিন হত তার আগে থেকেই নানারকম প্ল্যান করে রাখতাম কি করব। কি যে মধুর ছিল সেই দিনগুলি। এখন আর ফাইনাল পরীক্ষাও নেই ছুটিও নেই।
অনেক শুভকামনা, শাব্দিক।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
আহা, শীত সকালের কি নরম বর্ণনা! ভালো লাগলো কাচা-সোনা রোদের মতন!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
এই কবিতাটা আমার যে কি অসম্ভব প্রিয়।
প্রিয় লেখকের ভালো লেগেছে যেনে খুব খুব ভালো লাগছে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
হ্যাঁ, এরকমই সুখের দিন আমারও ছিল বটে তা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। এখন আমি সেখানে সত্যিই আগন্তুক তবে বেমানান হয়তো নয়।
লিখুন না সেই দিনগুলি নিয়ে কিছু।
পঠনে কৃতজ্ঞতা
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
নতুন মন্তব্য করুন