পড়ুয়ার ডায়েরি ২ঃ প্যাত্রিক মোদিয়ানোর দুটি বই

তাহসিন রেজা এর ছবি
লিখেছেন তাহসিন রেজা [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৪/০১/২০১৬ - ৯:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"The more things remain obscure and mysterious, the more they interest me. I even try to find mystery in things that have none."-

Patrick Modiano

____________________________________________________

প্যাত্রিক মোদিয়ানো নোবেল পাবার পর আর সবার মতো তাঁকে নিয়ে একটি স্বাভাবিক আগ্রহ অনুভব করেছিলাম আমিও। কিন্তু ফরাসী জানি না আর এযাবৎ মোদিয়ানোর বই ইংরেজিতে মাত্র পাঁচ খানা অনূদিত হয়েছে । বইয়ের মুদ্রণ সংখ্যাও খুব আশাপ্রদ নয়। তবে শেষ পর্যন্ত তিনখানা বই হাতে পেয়েছি। দুইটা শক্ত বই আর একটা নরম বই।

প্রথমেই পড়ে ফেললাম তাঁর অন্যতম আলোচিত বই “মিসিং পারসন”। এই বইটি ফ্রান্সের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার Prix Goncourt লাভ করে। বইটি শুরু করে এক বসাতেই পড়ে ফেলেছিলাম।

“মিসিং পারসন” (Rue des boutiques obscures) নামের ডিটেকটিভ নভেলের গোয়েন্দাটির নাম গি রোঁলা! আর মিসিং পারসনের হারিয়ে যাওয়া মানুষটি গি রোঁলা নিজেই। এমনকি এই ‘গি রোঁলা’ নামটিও তাঁর নিজের নয়! হারিয়ে যাওয়া এই মানুষটি তাঁর জীবনের সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে।
দশ বছর আগে তাঁকে স্মৃতিভ্রষ্ট অবস্থায় খুঁজে পায় উতে নামের এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ। গি নামটি তাঁরই দেয়া। দশ বছর ধরে গি গোয়েন্দা উতের সাথে মিলে অন্য সব মানুষের জীবনের রহস্য উন্মোচন করেছে। কিন্তু নিজের পরিচয়ের সুত্রটুকু হারিয়ে ফেলেছে বিস্মৃতির কালো পর্দার আড়ালে। আজ দশ বছর পর সে ফিরে এসেছে নিজের কাছে। অতি সামান্য এবং অনির্ভরযোগ্য সব সুত্র ধরে সে উদ্ধার করতে চায় তাঁর পূর্ব জীবনের সূত্রটুকু।

নিজের পরিচয় জানতে সে প্যারিসের আলো এবং অন্ধকারে প্রেতাত্মার মত ঘুরতে থাকে। নিজের আত্মপরিচয়ের রহস্যে ঢাকা অংশটুকু অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে গি’র সাথে দেখা হয় নানারকম মানুষের। কেউ হয়ত তাঁকে দেখেছে অন্য কোন মানুষের সাথে। সেই মানুষটির কাছে গিয়ে আবার অন্য একটি সুত্রের সন্ধান পায়।

একেক সময় গি’র মনে হয় এই ‘মানুষটিই’ বোধহয় সে! কখনো তাঁর মনে হয় সে হয়ত একজন রাশিয়ান ইমিগ্রান্ট। কখনো সে আবিষ্কার করে সে হয়ত ‘ফ্রেডরিক হাওয়ার্ড ডি লুজ’ নামের একজন মানুষ যার সাথে হলিউড অভিনেতা জন গিলবার্ট এঁর বন্ধুত্ব ছিল। কখনো তাঁর সামনে নিজের পরিচয় রূপে হাজির হয় পেদ্রো ম্যাকঅ্যাভয় নামের ডোমিনিকান কূটনীতিকের সত্ত্বা। কিন্তু প্রতিবারই নির্মম হতাশা আচ্ছন্ন করে ফেলে আমাদের গোয়েন্দাটিকে। হাতে থাকা সুত্রের জিগস স পাজল গুলি মেলে না কিছুতেই। তবু নতুন ভাবে বুনো হাঁসের পালকের পিছু ছুটতে থাকে গোয়েন্দা গি রোঁলা।

যে মানুষগুলির সাথে গি রোঁলার দেখা হয় তাঁদের প্রত্যেকেই একেকটি গল্প বলে তাঁকে। গল্পের সাথে সাথে রোঁলা তাঁদের কাছ থেকে পায় নানারকম স্মারক। পুরনো ছবি, চিঠি, ম্যাগাজিন, বই ইত্যাদি। এইসব টুকরো টুকরো স্মারক আর মানুষের বয়ান কাজে লাগিয়ে গি রোঁলা তাঁর একটি নিজস্ব অবয়ব তৈরি করতে চেষ্টা করে। কখনো কখনো বিদ্যুৎচমকের মত পুরনো কোন স্মৃতি উঁকি মারতে শুরু করে রোঁলার মানসপটে। কিন্তু পাঠক কখনোই নিশ্চিত হতে পারেনা এগুলি রোঁলার স্মৃতি নাকি নিজের পরিচয় পেতে উন্মুখ একজন মানুষের অতিকল্পনা।

কি অসাধারণ আর অদ্ভুত একটি রহস্য গল্প! যেখানে মূল চরিত্র নিজেই ডিটেকটিভ, নিজেই ক্লায়েন্ট, নিজেই ভিকটিম আবার নিজেই উইটনেস! প্যাত্রিক মোদিয়ানোর এই রহস্যোপন্যাসকে কোন ভাবেই গতানুগতিক রহস্য গল্পের কাতারে ফেলার উপায় নেই। তবে এই গল্পে রহস্য গল্পের অপরিহার্য অনুষঙ্গ ‘গতিশীলতা’ পুরো মাত্রায় বিদ্যমান! মোদিয়ানোর স্বচ্ছ গদ্য দারুণ সার্থকতার সাথে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ড্যানিয়েল ওয়েইসবোর্ট( Daniel Weissbort)।

আমার পড়া মোদিয়ানোর দ্বিতীয় বইটির নাম “হানিমুন”(Voyage de noces)। এই গল্পটিও হারিয়ে যাওয়া দুটি মানুষকে নিয়েই। ফিল্মমেকার জ্য ব গ্রীষ্মের একটি উত্তাপ ছড়ানো দিনে মিলান শহরের একটি হোটেলের পানশালায় বসেছিল প্যারিসগামী ট্রেনের অপেক্ষায়। সেখানেই সে শুনতে পায় এক সুন্দরী ফরাসী মেয়ের আত্মহননের খবর। জ্য ব কোনভাবে বুঝতে পারে অনেক বছর আগে এই মেয়েটিকে সে চিনতো।

প্যারিসে ফিরে এসে জ্য ব’র যাবার কথা ছিল রিও ডি জেনিরো। কিন্তু জ্য ব রিও যাবার বদলে তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে ইচ্ছে করে উধাও হয়ে যায় তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে, বন্ধুদের কাছ থেকে। তাঁর পুরনো জীবন থেকে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। জ্য ব ইনগ্রিড টায়ারসেন নামের সেই রহস্যময়ীর জীবনের অবগুণ্ঠনে ঢাকা অংশটুকুর অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। একজন উধাও হয়ে যাওয়া মানুষ আরেকজন উধাও হয়ে যাওয়া মানুষের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। মোদিয়ানোর উপন্যাসের আরো অনেক অনুষঙ্গের মত এই মিরর হল ইফেক্টও আমাকে চমৎকৃত করেছিল।

প্যাত্রিক মোদিয়ানোর বইগুলি পড়তে পড়তে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি বারবার। বইয়ের ঘটনার সাথে আমার বিন্দুমাত্র কোন সংযোগ নেই তবুও মোদিয়ানোর বর্ণনা পড়ে কেমন একটা দেজা-ভু’র অনুভূতি হয়। মোদিয়ানো টুকরো টুকরো স্মৃতি নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন।

প্যাত্রিক মোদিয়ানো নোবেল পাবার পর অনেক সমালোচনা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন একজন গোয়েন্দা গল্প লেখককে মাথায় তোলা হল। কেউ বললেন মোদিয়ানো একজন মাঝারি গোছের লেখক। তবে যাই হোক নোবেল কমিটির কল্যানে আমি একজন অসাধারণ লেখকের সন্ধান পেয়েছি যার সবগুলি বই আমি পড়তে চাই। নোবেল পাবার পর নিশ্চিত তাঁর আরো বই ইংরেজি এবং বাংলায় অনূদিত হবে। সেই অপেক্ষায় রইলাম।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

মিসিং পার্সন বইটা পড়তে হবে। পাত্রিক মোদিয়ানোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

তাহসিন রেজা এর ছবি

সময় করে বইটি পড়ে ফেলুন, হিমু ভাই। ভালো লাগবে আশা করি হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

দময়ন্তী এর ছবি

ভাল লাগল|
মিসিং পার্সন অনেকদিন ধরে আমার ট্যু রীড লিস্টে আছে| দেখি কবে পড়ি|

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

তাহসিন রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ।
পড়ুন সময় করে হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।