আমি তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। কোন একদিন সকালবেলা আমরা কয়জন বাচ্চা-কাচ্চা বাসার সামনে টিলোস্প্রেস(পলানটুকটুক) খেলা খেলছিলাম। হঠাৎ দাদা বললো, “পাগলু, বেড়াতে যাবি নাকি?” আমি খেলা ভুলে দাদা ও ছোট চাচার সাথে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ। ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুর, দূরত্বটা সামান্য-ই। কলেজ প্রাঙ্গনে এসে আমি হতভম্ভ এবং একই সাথে আনন্দিত। এতো বিশাল স্কুল ঢাকায় আছে, আমার জানা ছিল না। আনন্দের কারণ ছিল কলেজের নয়নাভিরাম দৃশ্য, খেলার মাঠের বিশালতা ইত্যাদি। কলেজের অধ্যক্ষ তখন জনাব ‘ক’ সাহেব(নামটা ব্যক্তিগত কারণে দেয়া গেল না); আমার দাদার দোস্ত মানুষ। ছোট চাচাকে অধ্যক্ষ মশাই খুব সম্ভবত জিজ্ঞাস করেছিলেন, “তুমি তো আগের স্কুলে ডে সিফটে পড়তে, এখনে ক্লাস কিন্তু ৭টা ৪০ মিনিটে। এতো সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবে তো?”। উত্তরে ছোট চাচা ‘হ্যাঁ’ বলাতেই তিনি খুব বেশি খুশি হলেন যেন ব্যাপারটা এমন যে; হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ সম্পর্কে এমন এক ধরনের ধারণা নিয়েই আমি চারটি বছর একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে কাটিয়ে ক্লাস থ্রি তে উঠি।
১৯৯৯ সালে আমি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। বাবার অনেকদিনের ইচ্ছা ছেলে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে পড়বে। আমারও কলেজটির কথা ভাবলেই চোখে ভাসতো বিস্তীর্ণ মাঠ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তা, লাল-লাল দালান, বিশাল স্কুল ও কলেজ বিল্ডিং এবং লাল ফুলে ছেয়ে যাওয়া বাগান বিলাস, শিমুল ইত্যাদি গাছগুলোর কথা। একদিন শুনি বাবা ওই স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য ভর্তি ফর্ম নিয়ে এসেছেন। আমি অনেকটা অবাক-ই হই। কেননা আমি তখন পর্যন্ত জানি অধ্যক্ষ মশাই-এর প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ জাতীয় উত্তর দিলেই বুঝি স্কুল-কলেজে ভর্তি হওয়া যায়। যাই হোক, অবশেষে জানতে পারি দাদার বন্ধু এখন আর সেখানে নেই, আছে নতুন এক প্রিন্সিপাল, কর্ণেল কায়সার আহমেদ। ভর্তি পরীক্ষার সপ্তাহখানেক আগে আমাকে একজন স্যার রেখে দেয়া হয়। তিনি আমাকে সাধারণ জ্ঞান ও গণিত পড়াতেন। প্রস্তুতি ভালই ছিলো কেননা আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর বাষিক পরীক্ষায় দশের মধ্যেই ছিলাম। তাই হয়তো লিখিত পরিক্ষায় নির্বাচিত হতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু বাঁধা এল মৌখিক পরীক্ষার সময়। মেডিকেল টেস্টের সময় ডাক্তার বাবু বললেন, “তোমার তো দেখি শ্বাস-কষ্ট আছে, বাবাকে বল ভাল ডাক্তার দেখাতে”। তৃ্তীয় শ্রেণীতে আমার আর সেই কলেজে পড়া হয়নি। আগের কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে আরও দু’বছর কাটিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ওই কলেজের প্রভাতী শাখায় আবারও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেই এবং এবার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার গন্ডি পেড়িয়ে ভর্তির সু্যোগ আসে। কিন্তু মন সায় দেয় না, কেননা প্রভাতী শাখা মানেই হল হোস্টেলে থাকা। দাদা-নানা দুই পরিবারেই আমি ছিলাম সবার বড় নাতি। ছোটবেলায় তাই আদরের কমতি ছিল না। তবুও সবকিছু ত্যাগ করে ভর্তি হয়ে যাই স্বপ্নের ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে। কলেজ নং ৮০৯১, জয়েনুল আবেদিন হাউস। রুম নম্বর খুব সম্ভবত ১০৭। মালপত্র নিয়ে বিকেল ৪:৪৫ মিনিটে হাউস প্রাঙ্গনে হাজির হই এবং সাথে আনা জিনিস-পত্রের হিসাব মিলিয়ে দেখার পর হাউস ম্যাট্রন ভেতরে যাবার অনুমুতি দেন। ভেবেছিলাম ভেতরে জামা-কাপড় রেখে এসে বাবা-মার সাথে দেখা করে তাদের বিদায় জানাবো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই এসে তাদের আর কোনো দেখা না পেয়ে বুকটা হঠাৎ হু-হু করে কেঁপে উঠেছিল। জীবনে প্রথম সেদিনই হয়তো উপলব্ধি করতে শিখি বাবা-মা কি জিনিস! অতঃপর খুব একটা অসুবিধা ছাড়াই দিন কাটতে লাগলো। নতুন পরিবেশ, নতুন সব বন্ধু, নতুন বইপত্র ইত্যাদি নিয়ে দিনগুলো খারাপ ছিল না।
হোস্টেল জীবনের প্রথম দিনটির কথা হয়তো সবার-ই একটু বেশি মনে থাকে, আমারও তাই আছে। আমার যতটুকু মনে আছে, শুরুতেই আমি এক অদ্ভুত কান্ড ঘটাই। হাউসে উঠার সময় সবার নেভি-ব্লু কালারের হাফ প্যান্ট পড়ে আসার কথা থাকলেও আমি সাদা হাফ প্যান্ট পড়ে উপস্থিত হই। সেই সাথে কলেজের ফর্দ অনুযায়ী ৬টা-৬টা সার্ট-প্যান্ট ইত্যাদি না আনায় আমাকে ভেতরেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছিলো না। যাই হোক পরবর্তীতে ভেতরে যাই এবং দেখতে পাই সবার জন্য সিঙ্গেল খাট আর ছোট্ট একটা লকার রয়েছে। বিকালে জামা-কাপড় ও বিছানাপত্র গোছানোর পর আশেপাশের রুম থেকে বড় ভাইরা আসে আমাদের সাথে পরিচিত হতে, আমরাও একে-অন্যের সাথে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে তুলি। অতঃপর মাগরিবের নামাজ আদায়ে মসজিদে লাইন করে যাওয়া, নামাজ থেকে এসে চা দিয়ে বন-রূটি খাওয়া, রাতে নাইট ক্লাস, রাতের খাবার এবং তারপর ঘুম। সব-মিলিয়ে দিনটি খুব ভাল কাটে।
প্রথম দিন-ই আমাদেরকে বলা হয়েছিল আমরা যেন রাতে তাড়াতাড়ি করে ঘুমিয়ে যাই কেননা, সকাল ৫টা ৩০মিনিট থেকেই শুরু হবে মর্নিং ওয়াক! আমরা প্রায় তাজ্জব বনে যাই। এতো সকালে আর কারও কথা জানি না আমি মনে হয় কোনদিন উঠি নাই। তবে নিয়ম বলে কথা, হোস্টেলে যখন এসেই পড়েছি- এইবার ঠেলা বুঝো। যথারীতি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত তখন প্রায় ১টা বাজে, ঘুম ভেঙ্গে গেল পাশের বেড-এ থাকা আমার এক বন্ধুর(বিজন) ডাকাডাকিতে। সে বলে কিনা তার খাটের নিচে নাকি একটা বিড়াল ডাকছে। মিউ মিউ, আমিও শব্দটা শুনতে পাই। কি আর করা, দুই বন্ধু মিলে বিশাল সেই রুমের একটা বাতি জ্বালিয়ে সেই হতচ্ছাড়া বিড়ালটাকে বিদায় করে আবারও ঘুম দেই। অতঃপর আমার দ্বিতীয়দফায় ঘুম ভাঙ্গে বন্ধু বিজন-এর ডাকাডাকিতেই। এবার সে বলে যে, বাহিরে কাক ডাকাডাকি করছে সুতরাং সকাল হতে আর বাকি নাই; কাজেই আর ঘুমিয়ে কাজ নেই। আমিও জানালা দিয়ে একবার বাহিরে তাকাই। আকাশ মোটামোটি ফর্সা। দেখলাম কলেজের ল্যাম্পোস্টগুলোও হালকা আলোয় জ্বলছে। দুই বন্ধু মিলে ১০৭ নম্বর রুমের সবাইকে ডেকে তুলি। কেউ কেউ বলে তারা নাকি মাত্র গভীর ঘুমটা দিয়েছিল, এতো তাড়াতাড়ি সকালটা হল কিভাবে? অনেকের-ই একি কথা, ‘মাত্রই তো ঘুমাইলাম’। বিজনের একটাই কথা, “তবে যে কাক ডাকছিল?”। বড় এক ভাই তার বালিশের নিচে ঘড়ি দেখে জানালো ‘এখন রাত আড়াইটা বাজে! ঘুমা তোরা’। হায়! হায়! বিজন বুঝি এবার মাইর না খায়? সেদিন আমরা কোন মতে গণধোলাইয়ের হাত থেকে রেহাই পাই।
ঘটনা বা দুর্ঘটনা যাই হোক না কেন, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের হোস্টেলে আমার খুব বেশিদিন থাকা হয়নি। সতেরতম দিনে আমাকে কলেজের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ম্যালেরিয়া জ্বরের কারণে। এগারো দিন সেখানে কাটে আমার। দিনের বেলা যখন কিছুই করার থাকতো না আমি হাসপাতালের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মিরপুর রোডের গাড়ি গুনতাম আর জানালার সামনে গাছে বাসা বাঁধা একজোড়া কাঠ-ঠোকরা পাখির অপেক্ষায় থাকতাম। অতঃপর উত্তপ্ত শরীর আমার স্বাভাবিক হয়ে এলে আমাকে ৭দিনের জন্য বাসায় ছুটি কাটিয়ে আসার অনুমতি দেয়া হয়। হয়তো আমার শুকিয়ে যাওয়া শরীর ও মলিন চেহারার দিকে তাকিয়েই হয়তো আমাকে আর হোস্টেলে পাঠানো হয় না। আমি হই অনাবাসিক ছাত্র, আর এর পর থেকে আমি বাসা থেকেই কলেজে আসা-যাওয়া করি এবং এখানেই আমার হোস্টেল জীবনের ইতি ঘটে।
...
প্রথম কিস্তির সমাপ্তি।
মন্তব্য
হোস্টেল জীবন বোধহয় মানুষকে অনেক সহ্যশীল করে তোলে।
থাকি নাই কখনো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
আমিও মাত্র ১৭ দিন ছিলাম... না থাকার মতই বলতে পারেন।
চান্দু, তুমি তো দেখি দুধের শিশু অবসথায় ভরতি হয়েছ। আমি পাস করেছি ১৯৯৭-১৯৯৮ সেষন এ। কায়সার বেটা এসেছিল ১৯৯৬ এ, আমরা তখন কেবলে ২য় বরষে পরি। বহুত জালাইছে। আমাদের আমলে ক্লাস ১ থেকে স্কুল শুরু হতো। আমার স্কুল এবং কলেজের কাউকে পেয়ে ভালো লাগলো।
প্রত্যেকেরই হোস্টেল-জীবনের অভিজ্ঞতার দরকার রয়েছে। বিশেষ করে বাকি জীবন যারা বাদাইম্যা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আর বাদাইম্যা না হলে অনেক কিছুই হওয়া হয় না !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
খাঁটি কথা বলেছেন। হোস্টেল-জীবনের অভিজ্ঞতা বিরাট এক অভিজ্ঞতা।
জ্বি হ্যাঁ বড়ভাই আমারও অনেক ভাল লাগলো ।
কায়সার আহমেদ কে আমার গ্রেট প্রিন্সিপাল মনে হয়েছে। সে না থাকলে আজকের দিনেও কলেজের মাঝখান দিয়ে মিনিটে মিনিটে ট্রাক চলাচল করতো। আমি যতটুকু জানি হাই স্যারের সময় নাকি তাই হত, কলেজের মাঝখান দিয়ে বাহিরের গাড়ি চলাচল করতো।
ইদানিং কলেজে ভয়াবহ অবস্থা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাঝে ব্যাপক রাজনীতি চলছে... হাস্যকর!
আরে...রেসিডেনসিয়াল দেখা যায়! আমিও!
কিন্তু আমি ছিলাম ডে শিফটে।
---------------------------------------------------------------------------
No one can save me
The damage is done
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
ব্যাপার না... ডে-মর্নিং ভাই ভাই।
কলেজ জীবনে ডে-সিফট এ নোমান স্যারের ক্লাস যদি পেয়ে থাকেন তাহলে ভাই আপনি বিরাট ভাগ্যবান।
লেখা পড়তে বেশ লাগল৷
ইয়ে, আমি একটু কনফিউজড হয়ে গেলাম৷ স্কুলের নাম "কলেজ'?
----------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ঠিক বলেছেন, স্কুলের নামই কলেজ!
তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত।
স্কুল + কলেজ দুটোই আছে; এক্ষেত্রে নাম 'স্কুল এন্ড কলেজ' হতে পারতো। কিন্তু মূল নামে 'কলেজ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
আর কোন কনফিউশন থাকার কথা না।
নতুন মন্তব্য করুন