স্বপ্ন মানুষের জীবনে মাঝে মাঝেই দেখা দেয়। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সেই স্বপ্নের হাতছানিতে অনেক দূর চলে যেতে চায়, চলে যেতে পারে; হয়তো বা দিগন্তের ধারে কিংবা এমন কোথাও যেখানে গেলে দূরত্ব ঠাহর করা যায় না। স্বপ্নবিলাসী সেইসব মানুষ আর তাদের নোনা কথন কোনদিন কারও মনে ঠাঁই পায় না, এমনকি তাদের কথা শোনারও কেউ আগ্রহ দেখায় না। গায়ের পাশে যে ছোট্ট নদী বয়ে চলে অবিরাম, তার কথা কয়জনেই বা মনে রাখে? রাখে না; খুব কম, তবে যারা রাখে তারা তাদের অস্তিত্বের স্বাদ খুঁজে পায় সেখানে। দরিয়ার মাঝি সবাই হয় না, হয় সে একজনাই, তবে সেই দরিয়ায় প্রতিদিন কতই না মানুষের যাতায়াত।
পাহাড়ের বিশালতা যদি বুঝতেই পারি তবে আর নিজেকে বড় মনে হয় না। মনে হয়, মনে হয় যেন পাথর বাগানের ছোট্ট একটা ফুল আমি, হয়তো ঝোরে পড়বো এই এখনি। কিন্তু আমি তো ফুল হতে চাই নি, ঝোরে পড়া কতই না গোলাপ রোজ সকালে ফোটে আমার বাগানে। বাগানের মালিক সেই আমি কিভাবে আমারি বাগানের ফুল হলাম, কবে হলাম আমি নিজেই জানি না। অতঃপর একদিন আমি আবার সেই বাগানের মালিকও বনে গেলাম। দুনিয়ার রীতিনীতি আজ কেমন যেন আজব লাগে।
দুনিয়ার নিয়মের বাইরে আমি কত কিছুই না করতে চেয়েছিলাম, করেছিও... কিন্তু শেষে এসে দেখি অংকের শুরুতেই বিরাট গোঁজামিল, দেখি ব্যাকরণের কতই না নিয়ম, কত অনিয়ম; র-ফলা/য-ফলা আরও কত কি! হয়তো আমার কাজের কোন কিছুই আজ ব্যাকরণের নিয়মে পড়ে না, সূত্রের বাইরে আরও কত সূত্রই না দিন-কে-দিন আবিষ্কার হচ্ছে তার খোঁজ যেদিন পেয়েছি সেদিন নিজেকে সত্যিকার অর্থে চিনতে পেরেছি। ফাঁকা বুলির বিনয়জাত অতিশয়োক্তি কেবল বাক্যকে দারুণ উপাধিটুকু দিতে সক্ষম কিন্তু অন্তরের অগ্রযাত্রায় তা কোনদিন সার্থকরূপে শামিল হতে পারে না। তাছাড়া মানুষ জানে না সে কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যদি কখনও কেউ তা জানতে পারে তবে সে আর মানুষ থাকে না। মানুষের ছায়ায় অন্য কোন জীবিত জড় কিংবা জীবের ন্যায় আচরণ করে মাত্র। তার বাহিরে তাকে কেউ মানুষ হিসেবে চিনতে পারে না। আমিও একদিন হয়তো অনেকের মতই মানুষ ছিলাম; অনেকের মত না হোক কারও কারও মত তো হতেই পারি, এ আর নতুন কি! অতঃপর যতই দিন কাটলো আমি আর অনেকের মত রইলাম না। আমার চার-দেয়ালের বাহিরে কার কি হচ্ছে, কে কেমন আছে তা আমার দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গেল। আমি তখন আর পূর্ণিমা দেখতে পারলাম না, অনেক দিনের শখ জাগানো জল-জোছনায় আমার আর সাঁতার কাটা হয়ে উঠলো না। আমি বুঝতে পারলাম আমি আর আগের মত নেই, আমার মাঝে অনেক পরিবর্তন। দেয়ালের ওপারে চাঁদ অথচ আমি একটিবারও তা উপলব্ধি করি নি, একথা যেদিন মনে হল সেদিন থেকে হয়তো আমি আর মানুষ রইলাম না। কেননা এই আমি একদিন জোছনা দেখতাম দু’চোখ দিয়ে, নদী তীরে অর্ধ-ডোবা নৌকার গলুইয়ের উপর পা দুলিয়ে বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মতন করে কাশের মাথা চিবাতাম, হয়তো এই আমিই একদিন হৈমন্তীর মতন কোন নারীকে ভালবাসার কথা শোনানোর অপেক্ষায় থাকতাম। হঠাৎ একদিন অপরিবর্তিত পরিবর্তন আমার মাঝে দেখা দিল। আমি আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকলাম। উচ্চতর উদ্ভিদ থেকে প্রাণীতে পরিণত হলাম, কিংবা তারও আরও পরে অমানুষে পরিণত হলাম। এভাবেই দিন বদলের ঝাপটায় তাবৎ দুনিয়ার মানুষের কাছে নতুন নামে পরিচিত হতে হল আমাকে। কেউ আমাকে এখন আর আগের নামে চিনতে পারে না, কেউ আর আমাকে আগের মত প্রশ্ন করে না, বলে না “কেমন আছ তুমি”।
আমি একটি ঝরণার গল্প শোনাতে চেয়েছিলাম, আমি একটি পাথরের গল্প শোনাতে চেয়েছিলাম; হতে পারে সেই ঝরণায় জলের ধারা অবিরাম বয়ে যায়, হতে পারে সেই পাথর অনেক উঁচু কোন পাহাড় থেকে ছিঁটকে পরা কোন এক টুকরো পাথর। কিন্তু তবুও আমি আজ একটি ঝরণা ও পাথরের গল্প শোনাতে চেয়েছিলাম। আমি এক জীবনে আরও অনেক কিছুই চেয়েছিলাম। অপরিপূর্ণতায় পরিপূর্ণ আমার সেসব চাওয়া এখন শ্বাসকষ্টে ভোগে, না পাওয়ার অভিশাপে প্রতি মূহুর্তে দহন জ্বালায় জ্বলে। যা বলতে চেয়েছি, যা হয়তো বলার ছিল, এই অবেলায় তা আর বলা হয়নি আমার; হয়তো হবেও না কোনদিন। অদৃশ্য এক ছায়ার ভরে আমি দিনকে-দিন কথা বলা তোতায় পরিণত হচ্ছি। আমাকে যা শেখানো হয়, যা শেখানো হচ্ছে আমি অনর্গল তা বলে যাচ্ছি বিরামহীন। আমার নিজস্ব কোন কথা নেই, নিজস্ব কোন ইচ্ছে নেই। কেন যেন মনে হয় শিরোনামহীন কিছু বইয়ের পাতায় আমার ভাগ্য লেখা রয়েছে, পুন্যবান কোনো মানুষের চোখ দিয়ে যা হয়তো দেখা যাবে। কিন্তু আমি তো এখন আর মানুষ নই, আমি তো দেখতে পাই না সেসব লেখা; কে আমাকে পড়ে শোনাবে সেই প্রতীক্ষিত আশার বাণী? আমি ডানে খুঁজেছি, বামে খুঁজেছি, আশেপাশের সর্বস্থানে তন্যতন্য করে অনেক খুঁজেছি, তবুও দেখা পাই নি কোন পুন্যবান মানব সন্তানের। তবে কি আজ পৃথিবীতে মানুষ বলে কিছু নেই, সবাই কি আমার মতই কথা বলা তোতা! আমি জানি আমার এসব প্রশ্নের উত্তর আমি কোনদিন পাব না; এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ কাউকে দেয় না, আমি জানি। আমি নদীকে জিজ্ঞাস করি, আমি ঝরণাকে জিজ্ঞাস করি, আমি সূর্য ডোবা আকাশকে শুধাই, আমি গাছের ডালে বাসা বাঁধা পাখির কাছে উত্তর জানতে চাই; তারা সবাই আমার সব প্রশ্নের উত্তর জানে। তারাই আজ আমার প্রকৃত বন্ধুর মত কথা বলে, তারাই আমাকে পথ দেখায়। তবে কি কোন মানুষ আজ মানুষের উপকারে আশে না? নাকি আজ অবধি কোন মানুষ অন্য মানুষের উপকারে আশে নাই। রহস্য, সংশয় আর অপ্রাপ্তির মধ্যে মানুষের এই যে বেচেঁ থাকা এটাকে আদৌ বেচেঁ থাকা বলা যা কিনা আমি জানি না।
আমি আকাশ ছোঁ’ব, আমি স্বপ্নকে ছোঁ’ব, পৃথিবীর যত না বলা সত্য আমি তার সবকিছু জানবো। আমিও একদিন তোমাদের মত মানুষ হব। আমার কেন যেন মনে হয় এই বুঝি সকাল হল, রাত্রি ফুরালো, সন্ধ্যা তাঁরা বুঝি এই জ্বলে উঠলো ধূসর আকাশে। আমার সব ভাবনা-ই তো মিথ্যে হতে পারে না, কোনভাবেই না। আমি এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারি। আমার আসা-না আসা, চলে যাওয়া-না যাওয়া, টিকে থাকা কিংবা অস্তিত্বের বাঁধন সবকিছুই মোহাচ্ছন্ন পরিবেশে ধূসর গোধুলীতে গা-ঢাকা শহরে কুয়াশার ভেতর ঢাকা পড়ে। আমি চিনতে পারি না, আমি কোন কিছুই চিনতে পারি না। আমি আমার নিজেকে হারাই, নিজের মাঝে এক ধরণের অস্থিরতা অনুভব করি। স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন ভেবে আমার যতটুকু পথচলা ছিল সেগুলো জীবন থেকে মুছে দিলে আমি তো সেই আগের মতই একজন মানুষ, মানুষ না? কেন যেন দু’চোখ দিয়ে আজ শুধু নিজের জৌলস্ দেখতে ইচ্ছে হয়। আমি পারি না, আমি পারি না অনেক কিছুই ছুঁয়ে দেখতে, পারি না অনেক কিছুই মেনে নিতে। আমার দু’বাহুতে আজ রাজ্যের অসারতা। দুনিয়ার এতটুকু যদি আমার নাগালের মধ্যে থাকতো, আমি তাই দিয়ে আজ এক অন্য ভুবন গড়ে তুলতে চেষ্টা করতাম যেখানে একটি ঝরণা থাকতো, একটি পাহাড় থাকতো, সাদা পালকের কিছু পাখি থাকতো। আমি আমার কল্পিত রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। আমি একটি পাথর বাগানের কল্পনায় নিজেকে দেখতে পাই। শুভ্র-রঙ্গিন আকাশের এক ফালি চাঁদের কাছে আজ আমার অনেক কিছু বলার আছে, অনেক কিছু জানার আছে, আছে অনেক মিনতি।
আজকাল অনেকেই আমাকে চিনতে পারে না। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে “তুমি কে?”। আমি নিজেও হয়তো জানি না আমি কে। তবে এতটুকু জানি যেদিন জানতে পারবো আমি কে, সেদিন আমি তোমাদের সত্যি সত্যি একটি ঝরণা ও পাথরের গল্প শোনাবো; যে গল্প হয়তো আজই বলার ছিল কিন্তু কোন এক কারণে বলা হয়নি।
“আজকাল অনেকেই আমাকে চিনতে পারে না
অনেক পরিচিত মুখ অপরিচিতের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে
মাঝে মাঝে মনে হয়
আমার ছায়ায় আমি ভিন্ন কেউ
আমার নাকি পরিবর্তন, চাল-চলনে, কথা বলার ধরণে সবকিছু
কি করে না চেনা একজন মানুষে পরিণত হলাম
হয়তো আমি নিজেও জানিনা, কিংবা হয়তো জানতেই চাইনি কখনও।
এ শহরে ঘরে ঘরে তোমার-আমার চেনা-অচেনা মানুষের বসবাস
তোমার হাসি, তোমার হাত-ইশারা, তোমার চাহনি, তোমার মুখ লুকিয়ে বসে থাকা,
সবকিছুই আমার জানা, আমার দেখা
এতো কিছুর পরও আমি অপরিচিত কেউ!”
মন্তব্য
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
থ্যাংক ইউ!
ফারহানা সিমলা
দিনান্তের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল, পশ্চিম সাগর তীরে
কে তুমি?
মেলেনি উত্তর।
ফারহানা সিমলা
এতো কিছুর পরও আমি অপরিচিত কেউ!”
সবাই তাই
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ঠিক তাই
-এতো কিছুর পরও আমি অপরিচিত কেউ
নতুন মন্তব্য করুন