ছেলেবেলার একটা দিনের কথা মনে হলেই চোখের সামনে অনেক কিছু ভেসে উঠে। একটা সময় ছিল যখন ঈদ মানে ছিল অন্যরকম কিছু একটা। সকালে ঘুম ভাঙ্গতো বাসার পাশের মসজিদ থেকে মোয়াজ্জেমের মাইকিং শুনে। অস্থির হয়ে ঘুম থেকে উঠতাম... চারপাশ দেখতাম। সবকিছুই কেমন যেন নতুন মনে হত। অন্যদিনের আকাশ থেকে সেদিনের আকাশটাকেও একটু অন্যরকম লাগতো। চারপাশ কেউ যেন একটু অন্যরকম করে সাজিয়ে দিয়ে যেত। ছোট-বড় সবাই মনের আনন্দে অদৃশ্য যাত্রাপথে সারাটা বিকেল রিক্সা করে ঘুরে বেড়ায়, দেখতে ভালই লাগতো সেসব।
মাঝখানে অনেক বছর এভাবেই কেটেছে আমার যেভাবে আর দশটা শহুরে ছেলের কাটে। একবার ছাড়া আর কোনবারের ঈদ-ই গ্রামের বাড়িতে করা হয় নি। তাও যেবার গ্রামে ঈদ করা হয় তার পেছনে একটা কারণ ছিল কেননা, সেবার আমার দাদী মারা যান(১৯৯৬ সালের কথা)। মনে পড়ে, সবাই খুব দুঃখ দুঃখ মন নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়ে ঈদ করে এসেছিলাম। সবাই বললে অবশ্য ভুল হবে, দু’একজন চাচী শ্রেণীর মহিলা আর তাদের একান্ত বাধ্যগত স্বামী ঢাকাতেই ঈদ করে অসুস্থতার অজুহাতে। মুরুব্বিরা এতে অসঙ্গতি খুঁজে পেলেও আমার কাছে খুব একটা খটকা লাগার মত কিছু মনে হয়নি। যে রীতি এক কিংবা সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য মানুষের মনকে আবেগগ্রস্থ করে, সেসব নাকি শুরুতেই অস্বীকার করা না-জায়েজ, তা হবে কেন?
প্রথম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে স্কুলে যেতে চাইতাম না, একদম না। নানান অজুহাতে মাকে অতিষ্ট করে ফেলতাম। অবশেষে মা বাধ্য হয়ে আবদার মেনে নিতেন। পড়ালেখায় ব্যাপক ফাঁকিবাজ হলেও দ্বিতীয় শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় গণিত এবং ইংরেজিতে ১০০/১০০ নম্বর পেয়ে অনেকটা অবাক-ই হই। এভাবে পঞ্চম শ্রেণীতেও কাকতালীয়ভাবে ঢাকার একটা নামজাদা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাই। রেজাল্ট মোটামোটি ভালই হচ্ছিল। জীবনটা প্রায় গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। বাবা-মাকেও স্কুল-কলেজ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে দেই নি। বাবা ধরেই নিয়েছে এই ছেলে নিজের পথ ঠিক-ই চিনে নেবে। সেই থেকে অবহেলা। ঢাকার নামকরা একটা স্কুলে পড়লেই যে সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, তা তিনি কষ্ট করে বুঝতে চাইতেন না। টাকা পয়সার কোন কমতি ছিল না, তা স্বত্তেও মাস শেষে গৃহ-শিক্ষকের বেতনের টাকা দেয়ার সময় ঠিকই তিনি একটু বেশি মনোযোগী হয়ে বার-বার করে গুনে দিতেন। মাঝে মাঝে বলেই ফেলতেন কি দরকার এত স্যারের কাছে পড়া, বই পড়লেই তো হয়, হয় না?
হয় কি হয় না তা আমার জানা নাই। আমি শুধু জানি কিভাবে ২৫-৩০ দিন পড়ালেখা করে এস.এস.সি-তে জিপিএ-৫ পাওয়া যায়, আমি এও জানি মাস দু’এক চরম পড়ালেখা করে কিভাবে এইচ.এস.সি-তেও একই ফল করা যায়। আমার রেজাল্টের দিন সবার মুখের হাসি আমাকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও হাসায়। আমি হাসি মনের সুখে, আর আমার চারপাশ আমাকে নিয়ে প্রহসন করে। তাদের অট্টহাসিতে দেয়ালে ফাটল ধরে, দেয়াল ভেঙ্গে যায়। সেই ভাঙ্গা দেয়ালে চাপা পড়ে অনেক সাধের লালিত স্বপ্নগুলো।
“হয়না এমনতো হয়না, নদীর বুকে বৃষ্টি ঝরে... পাহাড় তারে সয় না” -(শিরোনামহীন)
কষ্টের বিনিময়ে এতকিছু পাওয়ার পরও যখন নতুন করে সব ভাবনা শুরু করতে হয় তখন তা আর শরীরে সয় না। আবেগগ্রস্থ মন বারংবার ফাঁকি দিয়ে চারপাশ ঘুরে বেড়ায়। আমাকে শেখায় কোথায় গেলে কোনদিন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি পালিয়ে বেড়াই, আমার মনও পালিয়ে বেড়ায়; কখনও গাছের ডালে ডানাহীনভাবে, কখনও আবার সীমাহীন অপ্রাপ্তিতে চাপা কোন ক্ষোভে। অনেক ভাল কিছুর পর খারাপ কিছু অপেক্ষায় থাকে বলে জানি। জানি বলেই সবকিছু মেনে নেই। মেনে নেই অনেক অনেক পরাজয়। আর দশটা ছেলের মত যখন জয়ী হতে পারি না তখন আর দশজন পরাজিত সঙ্গীর প্রসঙ্গ টানি। বাবা জিজ্ঞাস করে, “কি যে হবে তোর! একটা ভার্সিটিতেও তো চান্স পেলি না, এভাবে একটা বছর নষ্ট করলি! কি করবি এখন?”। আমার উত্তরের অপেক্ষায় কেউ কোনদিন ছিল না, সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাবা পাশ থেকে চলে যায়, চলে যায় আরও অনেকে। হয়তো আমার চাহনিতে যে বক্ররেখা আছে তা দেখে সবাই অনুমান করে নিতে পারে আমার অতীত কিংবা ভবিষ্যত। আমার দায়িত্ব চুপ থাকা, আমি শুধু চুপ করে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকি। আমার চাহনি দেখে কারও কারও মায়া হয়, কারও আবার হয় না... এই হয়তো দুনিয়ার নিয়ম।
“তুমি হাসো তোমার উল্লাসে!
আমি একলা এপারে মুখ লুকিয়ে কান্নায় ভাসি-
জমাট বাঁধা ক্রোধে,
শব্দহীন মানুষের বেশে, আমার-ই ছায়ার পাশে।”
টানা একটা বছর আমি আমার ছায়া হয়ে নিজের সাথে রয়েছি... প্রায় একটা বছর। আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরের কথা- ৯/১০ টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যখন জানতে পারলাম কোনটাতেই আমার নামে কোন সীট বরাদ্দ নেই তখন থেকেই নিজেকে অপরিচিত মনে হতে লাগলো। এতদিন যে আমি আমার শরীরে বসবাস করলাম, এ কি সেই আমি! আমার নামের আগে-পরে নানান বিশেষণ যুক্ত হতে লাগলো। দু-একটা ভার্সিটিতে অবশ্য অপেক্ষমান তালিকায় ছিলাম, কিন্তু তা ছিল শুধুই অপেক্ষা। ‘অপেক্ষা’ শব্দটার প্রতি এক ধরনের ভীতি সেই থেকেই। অনেকবার নিজেকে খোলস-বদলানো সর্পের মত ভাবতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারলাম না, কোনভাবেই না। যার খোলস-ই নেই তার আবার বদলানোর প্রশ্ন আসছে কেন। অনেকদিনের বন্ধুত্ব ছিল যাদের সাথে তাদের থেকেও দূরে সরে গেলাম অপমানের ভয়ে। পুরানো ধুলো পরা বই-পত্রের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার প্রয়াস দেখালাম। সবার মনেই সন্দেহ হতে লাগলো; এই ছেলে করছে কি এইসব! পারবে তো?
পারবে না, হয়তো পারবে না আমার মত অনেক ছেলে, পারবে না দ্বিতীয় বার চেষ্টায়ও প্রিয় ভার্সিটিতে ভর্তি হতে। প্রশ্ন করি, কেন? চারপাশ নিরবতায় স্তব্ধ হয়ে আসে। হা! হা! হা! আবারও সেই অট্টহাসির শব্দ আসে অপরিচিত মুখে। তারা বলে সুযোগ নাকি বারবার আসে না, তাই দরজা-জানালা-কান সর্বদা খোলা রাখা বাঞ্চণীয়। হয়না, আমার শরীরের দরজা-জানালা-কান খোলা রাখা কখনই সম্ভব হয় না। হয়তো দেহের প্রতিটা দরজা-জানালায় আজ ঘুণে ধরেছে; আর ধরবেই বা না কেন? চারপাশের জগত, যার জন্য এতো আয়োজন করি, প্রয়োজনে তাকে কি কোনোদিন কাছে পেয়েছি? ধরবেই তো ঘুণ। চোখ বুজে সারাটা জীবন কল্পনা করে যাব যা খুশি তা, এটাই মন্দের ভাল। কল্পনায় যার-তার সাথে ঘুরে বেড়াবো, হাত ধরবো, আলো-আঁধারের গান গাইবো বেলা-অবেলায়; কার কি আসে যায়? একজন রজত দাশ গুপ্ত কিংবা ফজলে রাব্বি কিংবা খালিদ হাসানের মত না হলে কি বা আসে-যায়? তাই বলে কেন জীবন থেমে থাকবে, কেন কাছের মানুষগুলো দূরে সরে রবে, কেন বন্ধুত্বে প্রকারভেদ সৃষ্টি হবে... এর উত্তর আমার জানা নেই। রজত দাশ গুপ্ত কি জানে? কিংবা জানে কি ফজলে রাব্বি, আবু শাহির মোহাম্মদ খালিদ হাসানের মত মেধাবী আমারি বন্ধুরা??
দ্বিতীয় কিস্তির অপেক্ষায়...
মন্তব্য
ভালো লাগলো আপনার লেখাটা পড়ে।
এটা কি আপনার নিজের জীবনের ঘটনা, না কাল্পনিক?
আপনার ভাল লাগলো জেনে খুশি হলাম।
আর এটা আমার নিজের জীবনের ঘটনা, কাল্পনিক না।
যষ্টিমধু চেনেন?শুরুটা যার মৃদু মিষ্টতা, কিন্তু শেষটায় এসে একটু তেতো? আপনার এই লেখাটা তাই মনে করিয়ে দিল।
এই ছোট পরিসরে আপনি বোঝাতে পেরেছেন আপনার ব্যাকুলতার কথা। ধরে নেই, এই কথাগুলো সত্য, আপনার জীবনেরই কথা, গল্প নয়। যদি তাই হয় তাহলে বলি যে শুধু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাছাই প্রকৃয়ার কাছে হার মেনে যাবেন না।
জীবনটা কিন্তু শুধু কতগুলো হার আর জীত এর সংকলন নয়। এখানে আরো অনেক কিছু আছে। তবে হ্যা, আপনি যে বয়সের, মানে আপনার লেখা থেকে যতটুকু আন্তাজ করা গেছে, উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ন, এই সময়ে পড়াশুনো থেকে যতদূরে থাকবেন, পথ ততই পিচ্ছিল ও ঢালু হতে থাকবে, সামনের অন্ধকার বাড়তেই থাকবে। তাই হাতের কাছে যা পান, তাতেই ঢুকে নিজেকে পড়াশুনোয় ব্যাস্ত রাখুন।
আপনি মেধাবী। আপনি পারবেন।
এই কথাটুকু মনে করিয়ে দেয় আমার পূর্বেকার সাফল্যের কথা।
অবশ্য এখন যেমন সময় কাটছে তাও খুব উপভোগ্য। অন্ততঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাছাই প্রকৃয়ার কাছে হার মানা থেকে রেহাই পেয়েছি। ঢাকা ভার্সিটির ভর্তি এ মাসের-ই ১৪ তারিখের দিকে। আপাতত সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি।
জীবন মানে তো অনেক কিছু... এই অনেক কিছুর মধ্যে আবার কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে হয়তো। আমার বিগত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে অনেকটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে। আশা করি সামনের দিনগুলোতে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে পথ চলবো।
অনেক ধন্যবাদ 'দুর্দান্ত' ভাইয়া আপনার মূল্যবান শব্দ-সমষ্টির জন্য। ভাল থাকবেন।
অনেকদিন পর লিখলেন...
দ্বিতীয় কিস্তি আসুক তাড়াতাড়ি।
হ্যা অনেকদিন পর...
এই কয়দিন সচলে এসে আপনাদের লেখা পড়ে যেতাম, কিন্তু লেখা হয়নি। এখন থেকে আশা করি আবারও নিয়মিত হতে পারবো।
ভালো থাকপেন!
নতুন মন্তব্য করুন