বিকেল হলে ছাদের ওপাশটায় ভাড়াটিয়াদের ছেলেপুলে ও তাদের বন্ধুরা ঘুড়ি ওড়ায় অর্থাৎ ঘুড়ি নিয়ে খেলে। মাগরিবের আজান পর্যন্ত চলে তাদের ঘুড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি। কারও কারও মুখ দেখে অনুমান করা যায় যে, বিকালটা তার ভাল কাটে নাই, নিশ্চয়ই ঘুড়ি কাটা পরেছে; অবশ্য এরকম-ই হয় বেশিরভাগ দিনে। কানে সংগীতের যন্ত্র ভরে চুপচাপ বা একটু-আধটু এদিক-ওদিক করে সারাটা বিকেল হয়তো এইসব দেখে কেটে যায় অয়নের। মাঝে মাঝে সেও ঘুড়ি ওড়াবার খেলায় যোগ দেয়। সেসব দিন, চার বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
অয়ন ও তার বন্ধুরা বছর চারেক আগেই অনেক আগ্রহের সাথে প্রত্যেক বছর হাজারিবাগ থেকে নাটাই-সুতা-চুর কিনে নিয়ে আসতো। সুতোয় মাঞ্জা দেয়ার পারদর্শিতায় তাদের বন্ধু মহলে শানুর অনেক সুনাম ছিল। তার কাছে সবাইকে কাটাকাটিতে হেরে যেতে হত। শানু, সাবিদ, ছটকু, জহির, অয়ন সহ যারা দুইশ সাতাশ নম্বর বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়ায় তাদের সবাই একটা গল্পের সাথে পরিচিত। মুরুব্বিরা সাবধান করতে অনেকবার চেষ্টা করেছে, কাজ হয়নি। কোন একদিন নাকি এই বাড়িতে আজিমপুর থেকে আসা এক হুজুর বলেছিলেন যে, দুইশ সাতাশ নম্বর বাড়ির ছাদে রেলিং এর ধার ঘেঁষে জিন-ভূতের চলাচলের রাস্তা। মাগরিবের পর কেউ যদি তাদের চলাচলে বাঁধা দেয়, তাহলে যেকোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। হুজুর মানুষ, একটু-আধটু আধ্যাতিক কথা না বললে কি চলে? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এর বাস্তব প্রতিফলনের জন্য নিশ্চয়ই কেউ প্রস্তুত ছিল না। কোন এক রবিবার সন্ধ্যা বা তার একটু আগে অনেক দূর থেকে কেটে আসা একটা ঘুড়ি দেখতে পেয়ে শানু হাত বাড়ালে সুতার নাগ পাওয়া না গেলে, রেলিং এর ওপার থেকে অপর এক চেষ্টায় চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়। এর পর থেকে আর কোনদিন অয়ন ও তার বন্ধুরা ঘুড়ি ওড়াবার আয়োজন বোধ করে নি।
মালিহা মীরপুরের কোন এক স্কুলে পড়ে, ক্লাস এইটে। অয়নের সাথে তার পরিচয় হয় প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার দিন। বৃত্তি পরীক্ষা দুই দিনে হয় এবং প্রথম দিনের পরীক্ষার বিষয় ছিল ইংরেজী ও বাংলা। বাংলা পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ৩০ মিনিট এর বিরতি। ক্লাস রুমের সবচেয়ে ডানদিকের কলামের প্রথমটা মালিহার আসন, তার পরের আসনটা অয়নের। অয়নের বাংলা পরীক্ষা চলাকালে একবারের জন্যেও মনে হয়নি তার সামনেই কেউ একজন আছে, যাকে দেখলে তার সৌন্দর্য্যের বশে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও হতবাক হয়ে যেতে হয়!
অয়নের সাথে মালিহার চোখাচোখি হয় প্রথম পরীক্ষা অর্থাৎ বাংলা পরীক্ষার পর ত্রিশ মিনিটের বিরতিতে। সে দেখতে পায় গল্পের নায়িকা স্কুল ভবনের এক পাশে হাতে একখান বই নিয়ে বিড়বিড় করে পড়ছে আর তার মা পাশ থেকে মেয়েকে খাবার মুখে তুলে দিচ্ছে। ডানপাশের ছোট মেয়েটা হয়তো মালিহার ছোট বোন হবে, কেননা চেহারার দিক থেকে অনেকাংশে মিল রয়েছে। অনেকক্ষন ধরে অয়ন সেই দৃশ্য দেখে অতঃপর অয়নের মা তাকে খুঁজতে ওপাশটায় আসে তাই সে নিজেও খেতে চলে যায়।
ইংরেজী পরীক্ষা চলাকালে সামনে বসা মেয়েটিকে খুব পরিচিত মনে হতে লাগলো অয়নের। মেয়েটিকে কোথায় যেন দেখেছে তাই চেনা চেনা লাগছে। কিছুক্ষণ পরেই মনে পড়ে স্কুল ভবনের পাশে দেখা সেই মেয়েটিই তো এই মেয়ে! দুই ঘন্টার বাংলা পরীক্ষার সময় একবারও খেয়াল করা হয়নি তা। অয়নের তখন জানতে ইচ্ছা করে মেয়েটির নাম কি? প্রশ্নপত্র পাওয়ার পর কিছুক্ষণ সেখানে চোখ বুলায় সে; প্যারাগ্রাফ, রচনা কমন। মেয়েটি হঠাৎ পেছনে ফেরে, জিজ্ঞাস করে রচনা কমন পড়েছে কিনা? অয়ন বলে হ্যা, রচনা কমন এসেছে। কিছুটা সংকোচ নিয়ে মালিহা অয়নের কাছে জানায় তার রচনা কমন আসে নাই, সে একটু সাহায্য চায়; অর্থাৎ রচনা কমন না আসায় গল্পের নায়িকাকে রচনা দেখাতে হবে। অতঃপর অয়ন রাজি হয়। অয়নের সহজ স্বীকারোকিতে সে নির্ভয়ে লেখা শুরু করে।
স্কলারশিপ পরীক্ষার দিনে এমন একটা ঘটনা ঘটবে তা কারও জানা ছিল না। দুইদিনের পরীক্ষা একদিনেই দিয়ে খতম। ইংরেজী পরীক্ষার সময় পরীক্ষক সামনের মেয়েকে দেখানোর অপরাধে বিশ(ষ) মিনিট খাতা আটকিয়ে রাখায় অয়নের ফেল প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়, তাই পরদিন মাকে ভুল-ভাল বুঝিয়ে সে একা-একা পরীক্ষা দিতে বাড়ি থেকে বের হয়। পরীক্ষা হলে প্রবেশ করে... এবং নিজের আসনে বসে মালিহার জন্য অপেক্ষা করে। কোন এক কারণবশত মালিহা দ্বিতীয় দিনে অয়নকে আর কোনভাবেই চিনতে পারে না।
আমাদের দেশে মেয়েরা তাদের ব্যাপারে অনেক কথাই মানতে না চাইলেও একটা কথা মেনে নিতে জানে আর তা হল, পরীক্ষা হলে এক মেয়ে-আরেক মেয়েকে কখনও কোন ব্যাপারে সাহায্য করে না; এ কথার সাথে তারাও একমত! এমনকি তারা কিছু ক্ষেত্রে ভুল উত্তর বলে নিজের অবস্থান ঠিক রাখে। এদিকে, আমি আজ পর্যন্ত এমন কিছু শুনি নাই যে কোন ছেলের কাছে অপরিচিত মেয়ে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাক্ষাত হয়েছে। অয়নের কাছে সেই থেকেই এক ধরনের জেদ কাজ করে। গল্পকথকের ভাষ্য মতে, সে এর পর আর কোনদিন কোন মেয়েকে পরীক্ষার সময় কোন রকম খাতির করে নাই। কেননা সে ভুলের মাসুল একবারই দিতে শিখেছে, বারবার না।
অয়ন-ঘুড়ি-মালিহা এই ঘটনাগুলোকে এক ছকে আঁকতে ইচ্ছে হল অনেকদিন পর। ঘুড়ি প্রসঙ্গটা এসেছিল কেননা অয়নের বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফলের পর সে অনেকদিন মালিহাকে মনে রেখেছে। অয়ন সেবার বৃত্তি না পেলেও তার মাকে খুশি করতে পেরেছিল স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফলের কারণে। ভাল ছাত্র হতে হলে নাকি ফাইভ-এ,এইট-এ বৃত্তি পাওয়া লাগে, নয়তো সে নগণ্য কেউ। এই কথার কোন ভিত্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। রোজ বিকেলে অয়ন ও তার বন্ধুরা যখন ঘুড়ি ওড়াতো তখন অয়নের প্রায় সবগুলো ঘুড়িতে কিছু না কিছু লেখা থাকতো। সে জানতো এই ঘুড়িগুলো কেটে দূরে কোথাও চলে যাবে; যা হয়তো অয়নের থেকে অনেক অনেক দূরে কিন্তু মালিহার খুব কাছাকাছি। সে লিখতো- "মালিহা, হয়তো তুমি ভুলে গিয়েছো, আমি ভুলি নাই। তোমাকে পরীক্ষাতে ন্যাশনাল পয়েট অফ বাংলাদেশ দেখিছিলাম, মনে পড়ে?? না পড়ার-ই কথা...হা! হা! হা!"
রাস্তাঘাটে মাঝে মাঝে 'মালিহা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর', 'মালিহা ফুড কর্ণার", "মালিহা পরিবহন" ইত্যাদি চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে অয়নের খুব জানতে ইচ্ছা করে মালিহা নামের কোন মেয়েকে সেইসব মানুষ চিনে কিভাবে? সেই মালিহা কি ক্লাস এইটের পরীক্ষায় অয়নের সামনের বেঞ্চে বসা মালিহা, নাকি অন্য কেউ। আজ অনেক বছর কেটে গেল মালিহা নামের কারও সাথে অয়নের পরিচিয় হয় নি, হবেও না হয়তো। গোল পৃথিবীর সূত্র অনু্যায়ী অয়নের সাথে তার পুনরায় দেখা হবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সময় চলে এসেছে... অয়ন তার বন্ধুদের থেকে বিদায় নিচ্ছে। অনেক চেষ্টার পরও তাকে হয়তো আর বাঁচানো সম্ভব হবে না। ভ্রুন ক্যান্সারের কারণে তার প্রতি পৃথিবীর বিদায় ঘন্টা বেজে গিয়েছে, এখন শুধুই যাবার পালা। হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবে সে। হাসপাতালের অলস দুপুরগুলোতে অনেক কথাই মনে পড়তো অয়নের। তার মনে প্রশ্ন হয়, মালিহা কি তার একটাও ঘুড়ির উত্তর দিতে পারতো না? এতো স্বার্থপর হয় কি করে মানুষ?
কাল রাতে অয়নের বন্ধুরা ফোনে জানালো টাকা জোগাড় হয়ে গিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি বিদেশ যাওয়া সম্ভব হবে। অয়নের পাসপোর্ট হয়ে গিয়েছে, খুব সুন্দর লাগছে তাকে ছবিতে। দেখে বোঝার কোন উপায় নেই এই ছেলে এতো অসুস্থ! তারপর একদিন সত্যি তার ফ্লাইট চলে আসে। অয়নের বন্ধুরা তাকে বিদায় দিতে হাসপাতালের বারান্দায় জড় হয়। সেই সময় রাতুলের একটা ফোন আসে। সে স্পষ্ট শুনতে পায় রাতুল ফোনে মালিহা নামের কোন এক মেয়েকে বলছে যে, তাদের এক সহপাঠী অসুস্থ তাই সে এ কয়দিন ক্লাসে আসতে পারে নাই। অয়নের খুব জানতে ইচ্ছে হয়- এই মালিহা কি সেই মালিহা যার সাথে ক্লাস এইটে পরীক্ষার দিন তার শেষ দেখা হয়েছিল? সে কি অয়নকে মনে রেখেছে? হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না মালিহার সাথে অয়নের... তার সাথে দেখা হলে বলে দিও অয়ন ভাল আছে, সুখে আছে, অজানা কোন এক দূরের দেশে।।
শেষ কথা-(কাল্পনিক চরিত্রের মাঝে গল্পের বহমান দৃশ্যের নামধারী কারও সাথে আমার কোন পরিচয় নাই এবং এটা সম্পূর্ণরূপে কল্পিত গল্প)
মন্তব্য
ট্যাগে কাল্পনিক গল্পতো লেখাই আছে। শেষ কথা না দিলেও হতো।
যাই হোক,
গল্প পড়তে ভাল্লাগলো
-------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি
সাবধানতা অবলম্বন করেছি, আর কিছু না। তাই শেষ কথায় নতুন করে "কাল্পনিক" কথার উল্লেখ আছে। নয়তো দেখা যাবে "মালিহা" নামের কেউ মনঃকষ্ট পেয়ে আমাকে হারিকেন দিয়ে খুঁজবে।
ভাল লেগেছে জেনে খুশি হইলাম!!
আসলে সচলে এসে তিনটি গল্প পড়লাম, এটা শেষটা; শেষ ভালো যার সব ভালো তার। ভাললাগা জানাই।
==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
আপনার অশেষ মেহেরবান!
নতুন মন্তব্য করুন