নয় মাস শুনতে নয় মাস কিন্তু সরল হিসেবে, বাস্তবিকভাবে ২৬শে মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পযন্ত হয় ২৬৬ দিন। গুনতে শুরু করুন... সেই দিনগুলো মিলে হয় ৬৩৮৪ ঘণ্টা, হয় ৩৮৩০৪০ মিনিট! ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সেকেন্ডের কাঁটা ট্যাংক-কামান-মর্টার-গুলি দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আমরা স্বাধীনতার দামে প্রতিটি মিনিটের বিভীষিকা’র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হার না মেনে মরণপণ লড়াই করতে শিখেছিলাম!
বানরের পিঠা-ভাগ দেখতে দেখতে আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা কিন্তু তার চাইতে বেশি যে প্রাণের দাবী তার কথা ভুলে যেতে হবে কেন? কেন সাপ-লুডু-দাবা খেলার কোচ-খেলোয়াড়-মোসাহেব-দর্শক’রা তাদের চরিত্রের সাথে আমাদের সবার চরিত্র’কে সবকিছুতে মিলিয়ে দেখবে? সংকীর্ণ চক্ষুলজ্জাহীন ছাতার নিচে যত বেশি ব্যাঙাচি থাকে তার চাইতে লক্ষগুণ বেশি মানুষ প্রতিদিন ‘দিন-আনি-দিন-খাই’ নিয়ম করে সুখে-শান্তিতে ঘরে ফেরে স্বাধীনতার তৃপ্তি বুকে নিয়ে, আরও বেশি সংখ্যক মানুষ স্বপ্ন দেখে। একটা ভীষণ কোন ভোর দেখার স্বপ্ন ছাড়তে রাজি ছিলাম-না আমরা কেউ। কেউ ভাবেনি ৫ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগে আগুন জ্বলবে, যারা জ্বালাবে তাদের একাংকিত নির্দিষ্ট কোন দলীয় পরিচয় থাকবে-না। বাংলাদেশে’র মানুষ ক্রিকেট দলের একটা জয়ে সারাদেশে রঙের ফল্গুধারা বইয়ে দেয় কিন্তু ৫ই ফেব্রুয়ারি’র পর বাংলাদেশে’র মানুষ খুশী’তে কেঁদেছে সবচাইতে বেশি।
আমি ভোটের হিসেব নই। দোষ-গুন মিলিয়ে নিজের মত করে একজন সাধারণ মানুষ কিন্তু আমার একটা অ-সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর জাতিগত পরিচয় আছে। সেই পরিচয়ে বিশ্বাস বলে একটা নিরাকার জিনিস আমার ভেতর অবলীলায় বাস করে। কিন্তু জামাত-শিবির নামটি শুনলেই আমার মনে পড়ে যায় যে এরা জাতি’র জন্মলগ্নে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, করেই যাচ্ছে আজ ৪২ বছর। এই মনে পড়ে যায় বলেই আজ একজন জুলেখা বিবি’র বংশধরের সাথে সনাতন ঘরামী’র একজন বংশধর শাহবাগে নিজেদের দেখে খুব বেশি একাত্মতা অনুভব করেন; একজন মা তার ছেলে শাহবাগ যায় বলে নিজেই সেখানে যেয়ে দেখেন সব ছেলেই তাঁর ছেলের মত করে কথা বলে; একজন বাবা সেখানে যেয়ে টের পান তাঁর সব মেয়ে’রা চেতনায় দারুণ সংহত! বোনেরা ভাই-ফোঁটা খুঁজে পায় সর্বত্র, ভাইগুলো সব বাঘের মত গর্জন করে বলে সেখানে দিন কেন, রাতের বেলাতেও কোন হায়েনা-শেয়াল-শকুন যাবার সাহস পায়না। বাংলাদেশ অবমুক্তির প্রায় দ্বারপ্রান্তে!
কেন সবাই বিক্রি হয় ধরেই নিতে হবে? কেন ধরেই নিতে হবে সবার সবকিছু বারবার কেনা যায়? দিতে দিতে পায়ের তলার মাটি’তে এখন মাঝে মাঝে শর্ষে-ফুল দেখি! আমাদের মাথার উপর চালের বস্তার দাম বাড়ে, বিদ্যুতের দামে কিনতে হয় আলো, আলো’র দামে কিনতে হয় ঋণ, সরলতার দামে কিনতে হয় জটিলতা -- আমাদের জীবনের সব তৈজসপাতি বিক্রি হয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটুকু হারাতে আমরা রাজি নই। ঢের হয়েছে।
জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে ‘শিবির ধর, জবাই কর’ স্লোগান দিলে বহু মানুষের গাত্রদাহ ঘটছে ইদানীং কিন্তু এই ঝিকমিকে মানুষগুলো সত্যিকারের জবাই দেখে মুখ ফিরিয়ে থেকেছে যুগের পর যুগ। এই স্লোগান দিয়ে কোনদিন একটা জামাত-শিবির জবাই করেছি আমরা? এইসব স্লোগানের ইতিকথা ইতিহাস খোঁজে কেউ রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে? ৫০ বছর এর উপর বয়স-সীমার বাংলাদেশের লোকজন হৃত মনোবল আর ধৃত আস্কারা দেখিয়ে যখন চৌবাচ্চার গল্প শোনায় তখন আমি আর শুনতে নারাজ। যাদের দৃঢ়তা আছে তারা সবাই শাহবাগের দিকে না তাকিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজ নিজ দায়িত্ব বুজে নিচ্ছেন-না কেন? তারুণ্য’কেই কেন সবকিছু করতে হবে সবসময়? করতেও হবে তারপর শুনতে হবে পুরাতন ব্যাকরণে ভর্ৎসনা, কোন কারণ ছাড়াই চিল-চিৎকার? কেন? কেন এই এখন চোখ কুঁচকে আপনাকে ভেবে নিতেই হবে পোস্টের লেখক’ও ধামা ধরেছে? নিজের জামার উপরে ধামা সবাই বেছে নেয়-না সবকিছুতে।
সবাই সবকিছু যখন বোঝেন, সবকিছু’তে মতামত দেবার অধিকার রাখেন, পারেন সমালোচনা করতে তখন নিজের সমালোচনা করুন আগে। প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন কেন? নিজের কাছে উত্তর আছে, নিজের কাছে উত্তর দিন। সব দল নিয়ম করে চাঁদাবাজি করে ক্ষমতায় গেলে একবার, কিন্তু জামাতের চাঁদাবাজি হয় ধর্মের নামে, বারবার; সব দলে জামাত ঘাপটি! সব-দল চুরি করে ব্যবসা করে, তাদের পাণ্ডারা দম্ভ দেখায় যত্রতত্র; আর জামাত ব্যবসা করে ডাকাতের মত জিঘাংসায়, দম্ভ করার টাকা আনে বিদেশ থেকে, আর রাহাজানি করে বিদেশে পাঠায় তহবিল চাহিদা। সবকিছু’তে প্রশ্ন করে শুধু জামাত-শিবির-মৌলবাদ’কে ছাড় দিতে হবে কেন? সবাই খুনোখুনি করে, সেইসব খবর পত্রিকায় আসে, একজন বিশ্বজিৎ কেন, বর্বর হত্যাকাণ্ড সব আমলে ঘটেছে, কোনটা মেনে নিতে সায় দেয় আমাদের মন? কিন্তু জাতি’র জন্মলগ্নে যে বিচারহীনতার শুরু তার বিচার হতে হবে সবার আগে। একদম কড়ায়-গণ্ডায় বিচার। ট্রাইব্যুনাল যখন তাদের সামর্থ্যের জন্য, একটু সহায়তা’র জন্য নিয়ম মেনে সাহায্য চেয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে তখন যেসব মাননীয় মন্ত্রী, উপদেষ্টা কিংবা ‘প্রত্যুৎপন্নমতি’ মানুষের কানে ব্যথা ছিল- তাদের শাহবাগে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, কাজ করুন, আমাদের দেখতে দিন যে আপনারা চরিত্র বদলেছেন; শাহবাগে আপনাদের দেখার জন্য কেউ যায়-না, টিভি’তে আপনাকে দেখার জন্য বসে থাকেনা কেউ, আপনাদের কারণে বরং শাহবাগের দিকে চোখ কুঁচকে তাকানোর সুযোগ পায় বহু মানুষ। শাহবাগ’কে তাঁর নিজ আত্মপরিচয়ে থাকতে দিন সবাই মিলে।
বিএনপি চেতনার জায়গায় সর্বশেষ তলানি স্পষ্ট করেছে। একটা ছেঁদো হাপিত্যেশ দলে পরিণত হয়েছে বলে শাহবাগে যাওয়া তাদের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা দলবেঁধে সেখানে যেতে পারেন-না তবু যান, সশরীরে কিংবা মনে মনে- চেতনার কাছে থেকে যেতে হয় সবারই; দলীয় নেত্রী যখন ফুল ছুড়ে ফেলে দিয়ে রাজাকারের দলিল হাতে নিয়ে জাতি’র উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়ে প্রশ্ন করার আগে চলে যান তখন স্বীকার করেই নেয়া শ্রেয় যে আপনার নিজের কাছে স্পষ্ট থাকা উচিত, আড়ালে আরও বহুকিছু আছে। শাহবাগ তখন-ই দলীয় যখন আপনি দলীয় চোখ দিয়ে সেটাকে দেখেন। শাহবাগ ততদিন মহান যতদিন কুমেরু’র চিন্তা নিয়ে মানুষের মনুষ্যজন্মের সার্থকতা না আসে।
কোন জুজুবুড়ীর ভয়ে এমনকি শব্দের অধিকার ছেড়ে দিতে রাজি নই, কোন হিমশীতল পৈশাচিকতার কাছে বর্গা দিতে রাজি নই আমার নাতিশীতোষ্ণ সত্ত্বা, কোন যান্ত্রিক বকধার্মিকের কাছে শান্তির দামে ছাড় দিতে রাজি নই আমার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের সনাতন অধিকার। কেড়ে নিতেও দেবোনা, দিতে হলে শুধুমাত্র দেশত্যাগের ছাড়পত্র দিতে পারি- বিচার সমেত। এবং শাহবাগ আর তাঁর প্রজন্মের চেতনার আগুন দেখে টের পাই বাংলাদেশ বেঁচে আছে! জয়তু হে তরুণ প্রজন্ম সবিশেষ!
মন্তব্য
সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আত্মিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়েই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের মদদে জামাত শিবির বার বার এই চেতনায় আঘাত করেছে।মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা না পর্যন্ত এ যুদ্ধ শেষ হবে না।আপনি ঠিক বলেছেন,এই লড়াই বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে।
রসি মজুমদার
সম্ভব হলে নয় মাসের হিসেবটা আরেকবার দেখবেন।
__________________
জানি নিসর্গ এক নিপুণ জেলে
কখনো গোধূলির হাওয়া, নিস্তরঙ্গ জ্যোৎস্নার ফাঁদ পেতে রাখে
ধন্যবাদ ভাই, তাড়াহুড়ো করে লিখা হলেও এই বিষয়ে আরও সচেতন থাকা প্রয়োজন ছিল। ঠিক করে দিয়েছি।
ধন্যবাদ ভাই। চমৎকার লিখছেন।
আগুন জ্বালো নিয়েও একি অনুভুতি - আমরা জ্বালাই মোম এ - শিবির জ্বালায় ট্রেনে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমরা জ্বালাই মোম এ - শিবির জ্বালায় ট্রেনে।
প্রচুর বিখ্যাত, কোমল-স্বভাব লোকজনের ভেতর হুট করে জামাতানুভূতি আহত হচ্ছে আজকাল
রসি মজুমদার, আইলসা, রাতঃদা, বনজোছনা, প্রৌঢ় ভাবনা, সাদিক চৌধুরী, সাফিনাজ আরজু, শামীমা রিমা এবং ধুসর জলছবি -- সবাইকে মন্তব্য করার জন্য আলাদা আলাদাভাবে ধন্যবাদ।
জিততে হবেই!
বাংলাদেশ বেঁচে ছিলো, আছে এবং থাকবে। আর বেঁচে ছিলো ও আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সেইসব বেনিফিশিয়ারীজ যাদের হিউম্যানিটির শীশ্ন 'জবাইয়ের' শব্দে উত্থিত হয়ে পড়ে কিন্তু বাস্তবের জবাই দেখলে নেতিয়ে যায়। এখনই সময়, সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই শ্রেণী বাংলাদেশে থাকবে কি থাকবে না!
লেখায়
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
....ঢের হয়েছে ।আর নয় ।.. কোন বকর্ধামিকের কাছে শান্তির দামে ছাড় দিতে রাজি নই আমার স্বাধীনতা । কেড়ে নিতেও দেব না , দিতে হলে শুধুমাত্র দেশত্যাগের ছাড়পত্র দিতে পারি - বিচার সমেত ।
এ লড়াইয়ে জিততেই হবে। আমার সন্তানকে যেন তার দাদা আর বাবার মত বার বার স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে যুদ্ধ করতে না হয়।
এই লড়াই বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে !
লেখায়
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
আমাদের জীবনের সব তৈজসপাতি বিক্রি হয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটুকু হারাতে আমরা রাজি নই।
এই লড়াইয়ে জিততেই হবে ।
নতুন মন্তব্য করুন