২০০৫ সালে কাজ করতে যেয়ে আমার প্রথম ‘হিজরা’ সম্প্রদায়ের সাথে স্বাভাবিক কথা বলা শুরু। এর আগ পর্যন্ত দূর থেকে এদের দেখে গেছি; আমি মানুষটা খুবই কৌতূহলী কিন্তু কৌতূহল নিবৃত্ত করার বেলায় সবসময় সব পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে থাকেনা। নৃবিজ্ঞানের ছাত্র, সেই সুবাদেও আমাদের ছাত্রাবস্থায় কেউ হিজরাদের নিয়ে কাজ করেছে বলে মনে পড়ছে-না এখন। ১৯৯৯ সালের দিকে ইস্কাটন গার্ডেনে এক ছোটভাইয়ের কাছ থেকে একরাতে প্রথম এদের সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা তৈরি হয়, সেই ছেলে হিজরাদের নিয়ে তখন গবেষণা করছে। ২০০৫ সালে কাজ শুরু করতে যেয়ে আলাদা আলাদা ভাবে তাদের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে, আমি প্রথমদিকে খুবই অবাক হয়েছিলাম এই মানুষগুলোর চিন্তার স্বচ্ছতা, সমাজ কিংবা পৃথিবী সম্পর্কে এদের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি জেনে।
নিজেদের কাছাকাছি ফিরে যাবার পর কিন্তু তাঁরা পুরোই ভিন্ন মানুষ -- মানবিক মানুষ। সবার স্বাভাবিক হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ আছে, আছে গল্প; এইসব মানুষগুলোর গল্প কেবলমাত্র বঞ্চনা, নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা আর শোষণের ইতিহাস; পেছনের কথা বলতে বলতে, হুহু-হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে ফিক করে হেসে ফেলে যখন কেউ বলেছে ‘আপনে কাঁন্দেন কেন?’ তখন টের পেয়েছি আমার দু’চোখ বেয়ে জল নামছে। তাদের ভেতরও বই পড়া’র চর্চা আছে, আছে গান শোনার চর্চা। তাঁরাও বাংলাদেশ নিয়ে প্রবল স্বপ্ন দেখেন -- স্বপ্নের প্রাচুর্য ধারণ করতে কারুরই প্রকৃতি-প্রদত্ত সকল সুবিধা প্রয়োজন হয়-না।
আমাদের ভেতর তাদের নিয়ে একটা ভয় কাজ করে, কারণ আমরা নিজেদের স্বাভাবিক ভেবে যারা আমাদের মত নয় তাদের অস্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতেই অভ্যস্ত। রাস্তাঘাটে হিজরা দেখলে মানুষ দূরে সরে যেতে থাকে, পারতপক্ষে চেষ্টা করে কম ঝামেলায় কিভাবে বেঁচে যাওয়া যায়। হিজরারা রাস্তাঘাটে মানুষকে নাকাল করে, নাস্তানাবুদ করে- এই ধারণা মনে হয় জন্মের পর থেকেই আমাদের ভেতর গেঁথে যায়। রাস্তাঘাটে এইভাবে নাকাল করার কারণ কি, জানতে চেয়েছিলাম একদিন, হেসেই কুটিপাটি সবাই। উত্তরটা খুব সহজ-সরল: রাস্তাঘাটে এই আচরণ না করলে তাদের নিজেদের আঘাতপ্রাপ্ত হবার ভয়! এই আচরণ হচ্ছে রক্ষা-কবজ, মানুষ নামের পশু প্রবৃত্তি যতটা দূরে রেখে বেঁচে থাকা যায় ততই তাদের মঙ্গল -- এটা তাদের আত্মরক্ষা-কৌশল। সমাজ এমনিতেই তাদের কোনধরনের স্বীকৃতি দেয়-না, মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে কিন্তু দেখলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় প্রবৃত্ত সমাজের এই মানুষগুলোই কিন্তু আবার রাতের আঁধারে তাদের কাছে ভিক্ষার থালা হাতে যায়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের কতরকম চেহারার ভেতরের আরও সব চেহারা দেখার কিংবা জানার সুযোগ ঘটে গেছে কাজ করতে করতে-- এইসব অভিজ্ঞতা সুখকর নয়...
শাহবাগে ৬ তারিখ বিকেলে আমি প্রথম দেখি তেমন কয়েকজন শাহবাগ থানা আর জাদুঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছেন, কাউকেই চিনি-না। পরদিন আবার দেখলাম, তারপর প্রতিদিন প্রতিবার। শাহবাগে যখনই যাই তখনই তাদের কাউকে না কাউকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, একা নয়, দুইজন-তিনজন -- একটু আবছায়া ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁরা। কাউকেই চিনি-না। হুট করে এক সন্ধ্যায় পরিচিত একজন’কে দেখে এগিয়ে গেলাম, প্রকাশ্যে তাদের সাথে মেলামেশার কারণে রাস্তাঘাটে বেশ কয়েকবার কটু কথা শুনতে হয়েছে, প্রতিবাদ করে হতে হয়েছে নাস্তানাবুদ। শাহবাগে তেমনটা ঘটলো-না। কথা বলতে বলতে সেখানেই বসলাম। সহজ-স্বাভাবিক মানুষের মত তাঁরা সেখানে আসেন, যান, আলাদা কোনরকম সাজসজ্জা থাকেনা, দূর থেকে দেখেন লক্ষ মানুষের আসা-যাওয়া -- সেই স্রোতে তাদের জন্য এতটুকু মানবতার ঘুম ভাঙেনি কোথাও -- এই নিয়ে তাদের ভেতর কোন আফসোস নেই, কোন হাহাকার নেই।
কেন আসেন? তিনি বললেন, ‘কতদিন ধরে এইরকম একটা কিছুর জন্য অপেক্ষা কইরা আছি ভাইজান, না আইসা থাকন যায়?’ তারপর হাসলেন তিনি, সহজ হাসি। আমি আমার এই বিস্তৃত জীবনে এতদিনে একটা জিনিস জেনে গেছি-- কষ্টকর, সমাজের দোষে সমাজের চোখে অপাংক্তেয় জীবন কাটান যারা, তাদের সহজ হাসি’র মত পবিত্র দ্যোতনা খুব কম আছে। আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘আপনে কেন আসেন?’ আমি হাসলাম, তিনিও হাসলেন। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম আমরা দুইজন, নীরবতায় কত কথা হয়ে যায়! তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে ধরা গলায় বললেন, ‘আপনের কি মনে এই অভাগী দেশটা বদলাইব?’ আমি জানালাম আমি সবসময় বিশ্বাস করি বদলাবে। তিনি আমার দিকে একটা চাপা হাসি দিয়ে বললেন, ‘সব বদলাইব?’ তিনি কোন বদলে যাওয়ার কথা বলছেন বুঝতে পারার আগেই আমি বলে ফেললাম, ‘হু, বদলাবে, মাটি জেগে উঠছে, মাটি যখন জাগে তখন ধীরে ধীরে সব বদলায়।’ তিনি বললেন, ‘আচ্ছা ভাইজান, দেশটারে আমরাও ভালবাসি, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাগো মত মানুষও মরছে পাকিস্তানী আর রাজাকারগো হাতে; আমরা নাইলে কোন জায়গায় দাম পাইনা কিন্তু আমরাও আছি ভাইজান!’
আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ। একটু পর তিনি আমার দিকে ঘুরে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালেন, আমি দেখলাম তাঁর চোখ ভর্তি জল। আমিও তাকালাম, তিনি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে যেতে চাপা কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললেন, “আচ্ছা ভাইজান, দেশটা যদি আপনের কথামত বদলায়, সবাই কি আমাগোরে মানুষের মতন সম্মান করবো? আপনের বিশ্বাসে কি কয়!”
মন্তব্য
এই পরিবর্তনটার দরকার আছে। এই বিষয়ে আরো সচেতনতার প্রয়োজন আছে।
আপনার মন্তব্যে সহমত। একটা দারুণ আলোয় সবকিছু ঠিক হয়ে যাক! ধন্যবাদ মুর্শেদ ভাই।
- তাদের ধর্ম কি?
জা.ই আর হে.ই এর মতে এরা কি খোদার গজব ?!
জা.ই আর হে.ই এর মতে- তেনারা ছাড়া বাকি সব খোদার গজব!
হ্যাঁ, সমাজে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন দরকার।
প্রতি মাসে একটা 'হিজড়া' গ্রুপ আমাদের এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ আসে চাঁদা নিতে। আমি কখনও সখনও তাদের সাথে কথা বলেছি। সমাজে তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে একটা লেখা দেবার ইচ্ছা অনেকদিনের।
আপনি লিখলেন, খুব খুশি হলাম। লেখাটার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
একটা দারুণ আলোয় সবকিছু ঠিক হয়ে যাক!
এই কামনা করি তামিম ভাই।
তাই হোক!
মানুষ হিসেবে ওদের প্রতি যে অপরাধটা আমি করে চলেছি শত শত বছর ধরে, সেই দায়ভারে মাথা নিচু হয়ে আসে প্রতিবার। শুধু আশা রাখি, মাটি জেগে উঠলে একদিন না একদিন সব বদলে যাবে। আমি যদি বদলাতে পেরে থাকি, একদিন না একদিন আরও কোটি মানুষও পারবে।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
নিজের বদলাতে হবে সবার আগে, সেই বদলে যাওয়া প্রথমালুর বদলে যাউউ বদলে দাউ নয় কিংবা রবির ট্যালকম মাখা দেশপ্রেমিক নয়। এই দেশের মানুষের ভণ্ডামি কতদূর বিস্তৃত তা চিন্তার বাইরে। এই ৪৩ বছরে বাঙ্গালী আর কিছু না হতে পারুক ভণ্ড হয়েছে সবচাইতে বেশি।
তখন এইচ/আইভি নিয়ে কাজ করি। পুরুষের সৃষ্ট সমাজে পুরুষের পেশী আর টাকার উপর ভিত্তি করে যে কমার্শিয়াল সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়টেশন তার কোন দায় পুরুষ নিতে নারাজ -- ব্রথেলে, হোটেলে, বাসা-বাড়ী’তে যারা যায় তাদের সবাই পুরুষ কিন্তু সব দোষ নারী’র। যে পুরুষ সেখানে যায় সেই পরদিন সকাল বেলা মানুষ’কে সৎ পথে থাকার পরামর্শ দিতে আসে। নচিকেতা’র ‘বার টাকা’ গানটার কথা মনে পড়ে গেল!
নতুন আলোয় ভরে যাক দেশ, মানুষের আলোয়। যে আলোতে লিঙ্গ-ধর্ম-বর্নে কোন বৈষম্য থাকবে না। সে আলোতে শুধু থাকবে দেশের জন্য ভালবাসা।
সুন্দর লেখা তানিম ভাই।
নতুন আলোয় ভরে যাক দেশ, মানুষের আলোয়। যে আলোতে লিঙ্গ-ধর্ম-বর্নে কোন বৈষম্য থাকবে না। সে আলোতে শুধু থাকবে দেশের জন্য ভালবাসা। সাথে থাকবে কেবলমাত্র মানুষের জন্য ভালবাসা
তানিম ভাই, ভাল একটা লেখা লিখলেন। হিজরাদের নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম, ' ভারতের হিজড়ে সমাজ '। হিজরাদের ব্যাপারে ধর্মীয় বিধি-নিষেধগুলো কী জানতে ইচ্ছে করে। মহাভারতে শিখন্ডি নামের এক চরিত্রের কথা পড়েছিলাম যার সামনে গেলে পান্ডব-কুরু বংশের মাণ্যজন বীর ভীষ্ম অস্ত্র ত্যাগ করতেন। হিজরেরা মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতিতে তাদের সৎকার হয় কিনা বা আদৌ তারা স্বর্গ-নরক পাবে কিনা ব্যাপারগুলো জানতে ইচ্ছে করে।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
আমার এই বিষয়গুলো জানা নেই সুমাদ্রী’দা। গুগল করে হিজরা’দের ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে যে লিংকগুলো পেলাম তার সব সামু’র, ক্লিক করতে ইচ্ছে করলো-না।
ভীষ্ম স্ত্রীলোকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতেন না। যতদূর মনে পড়ে, শিখন্ডী প্রথম জন্মে স্ত্রী ছিলো (নাম মনে করতে পারছিনা), তাদের দুই বোনকে ভীষ্ম ধরে এনেছিলো ভাই এর সাথে বিয়ে দিতে। শিখন্ডীর (আমি এই নাম ই লিখছি) একজনের প্রতি অনুরাগ রয়েছে সেকথা ভীষ্মকে জানাতে ভীষ্ম তাকে মুক্ত করে দেয় কিন্তু হৃত কন্যা সমাজে গৃহীত না হওয়ায় প্রেমিক এবং পিতা উভয়ের কাছ থেকে তাজ্য হয়ে সে দেহ ত্যাগ করে এবং ভীষ্মের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহ্ণ করে, তখন তার নাম হয় শিখন্ডী। কিন্তু ভীষ্ম শিখন্ডীকে মেয়ে হিসেবে গণ্য করে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করত না।
ছোটবেলাতে এদের খুব ভয় পেতাম কোন কারন ছাড়াই। এর কারন আমার কাছে মনে হয় আমাদের সমাজ, পরিবার কখনোই এদের প্রতি ইতিবাচক কোন তথ্য দেয়নি। ছোটবেলাতে মনে পড়ে ছোট ভাইয়া, বা বোনের জামা বাইরে রোদে শুকান হত না, পাছে "হিজড়া" রা দেখে ফেলে বাড়িতে এসে হাঙ্গামা করবে, এই ভয়ে।
মহাকাল নাট্যগোষ্ঠীর একটি নাটক দেখে প্রথম ভাবতে শিখলাম এরা আমার সময়ের অংশ, এদেরকে বাদ দিয়ে সমাজ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। মানবিক অনুভূতিই সবথেকে গুরূত্বপূর্ণ, শারিরীক সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে মানুষের, কেউ সাধ করে সীমাবদ্ধ হয় না।
সেই থেকে ভয়ের বদলে এদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা তৈরী হয়েছে। জীবনকে দেখার নতুন দৃষ্টি পেয়েছি আমি।
লম্বা মন্তব্য করে ফেললাম
মানবিক অনুভূতিই সবথেকে গুরূত্বপূর্ণ।
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সবার কাছে একটা প্রশ্ন রাখছি। আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে হিজরা সম্প্রদায়ের জন্য কি কোন বিধান আছে? সে সব ধর্মের ধর্মগ্রন্থে তাদেরকে নিয়ে একটি বাক্যও কি আছে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পাণ্ডব’দা, আপাতত এটা পেলাম উইকি’তে। http://en.wikipedia.org/wiki/Transgenderism_and_religion
অসাধারণ লেখা।
কদিন আগে তালাশ নামের টিভি পোগ্রামে একটা এপিসোড ছিল হিজরাদের নিয়ে
facebook
ধন্যবাদ প্রিয় উড়ন্ত ঘুড়ি।
ধর্ম যার যার দেশ সবার হোক!
নতুন মন্তব্য করুন