সেই সুদূর শৈশব থেকে ‘ইচ্ছামিঠা’ নামের এই বাঁওড়ের কোল ঘেঁষে হেঁটে যেতে যেতে তাদের কত কথা হয়েছে কথা না বলে! আজ পড়ন্ত বিকেলে তার চাইতেও পড়ন্ত বেলায় রহমত মাতুব্বর টের পান বাঁওড়ের জল কচুরিপানায় সয়লাব, পাড়ের গাছগুলো বাতাসের অভাবে নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে, তিনি ফিরে তাকান তাঁর বন্ধুর দিকে, ‘যুদ্ধ একদিন শেষ হয় নীলাম্বর---’, নীলাম্বর অধিকারী চুপ করে থাকেন...
বাঁওড়ের যেখানে শেষ সেখানেই কুল বহতা নদী, পাশ ঘেঁষে কৈবর্ত পাড়া, এই সেদিনও সেখানে মানুষগুলো ধবল-সবল ছিল, বাঁওড় আর নদীকে জলমহাল বানিয়ে ইজারা দেয়ার সাথে সাথে মানুষগুলোর-ও পাইকারি বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। কৈবর্তদের একসাথে করে আন্দোলন করার চেষ্টায় বন্দুকের ক্রমাগত গুলি, এগারোটা লাশ, বিস্তর টাকা, জজকোর্ট-হাইকোর্ট করতে করতে সবাই কেমন যেন ভুতের মত হয়ে গেছে! তারা হাঁটতেই থাকেন।
‘কিছু একটা কও’, নীলাম্বর অধিকারী টের পান তাঁর বন্ধুর গলায় মিনতি, তিনি হাসেন, ‘কিছু একটা কইতে গেলে কি সব কথা বলা যায়, গেলবার যখন আগুন জ্বলল, আমরা কত চেষ্টা করলাম নিভাতে, নিভছিল?’
রহমত মাতুব্বর জানেন, যারা আগুন জ্বালায় তারা সে আগুনে সর্বস্বান্ত হয় না, এবার তিনি চুপ করে যান। নীলাম্বর অধিকারী বলতে থাকেন, ‘ব্রিটিশ দেখি নাই একটাও কিন্তু স্বরাজ পাইছি, ভূ-ভারত দেখলাম, নাঙা তলোয়ার-কৃপাণ দেখলাম, পাকিস্তান দেখলাম, মাদার-ইন্ডিয়া দেখলাম, জিন্নারেও টুপি পড়তে দেখলাম আর নেহেরুরে দেখলাম গান্ধীজীর পিঠে সওয়ার হয়ে মাউন্ট এর ব্যাটন হাতে নিতে!... মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে আর এইখানে দেখ মওদুদি মুনাফেক ছাড়াও কতরকম বিভক্তি মুসলমানে মুসলমানে, এতসব কুতর্ক আর লাঠালাঠি, হানাহানি! তাদের ফতোয়া ছাড়া তোমার বাড়ীর মসজিদ-ও অচল হবে আর দুইদিন পর!’
রহমত মাতুব্বর মনে মনে হাসেন, এই কথাগুলো তিনি একদিন নিজেই তাঁর বন্ধুকে বলেছিলেন। কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক নীলাম্বর অধিকারী’কে যেন কথায় পেয়েছে, ‘হবেনা, বুঝলা, হবেনা! আমরা হয়ে যাবে হয়ে যাবে ভাবতে ভাবতে এতদূর আসছি, পৃথিবীর সব জায়গায় ধর্মের চাইতে ধর্মে না বলা গায়ের জোর এখন জিতে গেছে, মানুষ সবাই জোর করে স্বর্গ না হইলে বেহেশতে যাইতে চায়, তুমি আমি মানবতার কথা বলে নরক গুলজার করলেও কি লাভ হবে?’
রহমত মাতুব্বর জানতে চান, ‘লোকসানটা কি শুনি?’ নীলাম্বর অধিকারী’র মেজাজ চড়ে যায়, ‘লোকসানটা কি শুনি! লোকসানটা কি শুনি! তুমি মরার পর, আমি তোমার কবরে গিয়া দাঁড়ায়ে থাকলে লোকে জীবিতকালে তুমি নাফরমান ছিলা এইটা ভাবতে পারে অথবা আমাকে সেখানে দেখে মানবে না। আর আগুনে পোড়ানোর পর আমার জনম-পোড়া ছাই তুমি দেখতে চাইলে মরার পরেও আমি যবনের গলাছিলা হনুমান, পঞ্চভূতে ম্লেচ্ছ!’ নীলাম্বর অধিকারী তিক্ত মুখে বলেন, ‘ব্রিটিশ ব্রিটিশ!’ রহমত মাতুব্বর সজোরে হেসে উঠেন, ‘আমারে বললা নাকি?’, উত্তর আসে, ‘হুহ!’ রহমত মাতুব্বর তাঁর বন্ধুর দিকে তাকান, হাসতে হাসতেই বলেন, ‘এখনও হাঁটতে পারতেছ, এইভাবে চিন্তা করতে শুরু করলে মাজায় জোর পাইবা না।’ নীলাম্বর অধিকারী বলেন, ‘বুকে বল নাই যার তার আবার মাজায় জোর---’
ফিরতি পথে সন্ধ্যা নেমে আসে...
উপরে সাংবৎসরিক চাঁদ ওঠে, চাঁদের এপিঠ-ওপিঠে স্তব্ধতায় গ্রহ-নক্ষত্রের পরিসমাপ্ত ছায়া পড়ে, আর নীচে সমস্ত প্রাণীজগৎ নিজ নিজ বিহ্বল-বাসনা নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে শ্বাস ফেলে; প্রাণীজগতের ভিড়ে মানুষের শুধুমাত্র শ্বাস নয়, তার সাথে আরও ঝরে, ঝরতেই থাকে বিভক্ত চৈতন্য...
মন্তব্য
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
সেটাই।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ধন্যবাদ।
...এই বাঁওড়ের কোল ঘেঁষে হেঁটে যেতে যেতে তাদের কত কথা হয়েছে কথা না বলে!...
ধন্যবাদ।
শক্তিশালী গল্প ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
ধন্যবাদ।
গল্পটি ভালই লেগেছে।
আঃ হাকিম চাকলাদার
ধন্যবাদ।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়
ভাল লাগল গল্পটা।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
ভালো লাগলো। শুধু ভালো বলায় কমিয়ে বলা হয় যদিও।
স্বয়ম
খুব ভালো গল্প।
ধন্যবাদ তানিম এহসান।
ভালো থাকবেন।
-------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
ধন্যবাদ পলাশ ভাই
নতুন মন্তব্য করুন