সেবার খুব বন্যা হলো, ১৯৮৮ সাল। বড়’রা সবকিছুতে বেশি বেশি চিন্তা না করতে পারলে খুব সমস্যায় পড়ে যান, ছোটদের চিন্তা করার সময় কোথায়! সারা দেশ বন্যায় তলিয়ে গেল, তলিয়ে গেল প্রায় পুরো ঢাকা শহর; ঢাকা শহরের বড় বড় রাস্তায় নেমে এলো নৌকা, তলিয়ে গেল পাড়া-মহল্লা এবং ছুটি হয়ে গেল স্কুল!
তখন-ও ‘হোম-ওয়ার্ক’ বিভীষিকা হিসেবে আবিষ্কার হয়নি, বরং পড়ার বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই না পড়লে মুরুব্বীরা চিন্তিত হতেন। দুর্যোগের সময় বড়দের সাথে টিভি’তে নয়টার খবর দেখতে বসে গেলে তাঁরা ভ্রু কুঁচকে তাকাতে ভুলে যান, পড়ালেখা আর নিয়ম-শৃঙ্খলার মাঝে একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। তখন লেজেহোমো এরশাদের সময়, সে মানুষের মাথায় তেল চাপিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়ায়, ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজে ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথী হতে আজকের চেষ্টা আমার!’ তখন শুধুমাত্র বিটিভি’র যুগ, সবাই খবরে, খবরের বাইরে এরশাদ’কে দেখে আর গালি দেয়। তখন-ও সব বাসায় বাসায় টিভি আসেনি, মানুষ দলবেঁধে খবর দেখে, নাটক দেখে, গল্প করে --- বাংলাদেশ তখনও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা মানবিকতার সাথে হেঁটে চলেছে ভাঙনের পথে!
বাংলাদেশে তখনও গানের আকাল শুরু হয়নি। ব্যান্ড-সঙ্গীত বলে একটা জিনিস নিয়ে মুরুব্বীরা নানানরকম কথা বলেন। বিটিভি’তে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হয়, সেখানে মাঝে মাঝে একটা দুইটা ব্যান্ড গান করে, তাদের বেশভূষা কিংবা গান গাওয়া আর বাদনভঙ্গী নিয়ে টিটকারি তখনও প্রবলভাবে সংক্রমিত হয় কোথাও কোথাও। এর মাঝে একদিন বিটিভি’তে একটা ব্যান্ড গান গাইতে এলো, গান শুরু হলো, মিউজিক বাজছে কিন্তু গায়কের মুখে বুলি ফুটতে একটু সময় লাগলো, তাই নিয়ে পাশের বাসার চাচা রসিকতা শুরু করলেন। একটু পরে তাদের ভাষায় গান শুরু হলো, গান শেষ হলো, গানের মাঝে গিটার হাতে একটা ছেলে হেডব্যান্ড মাথায় ব্যাপক নাচানাচি করলো দেখে-ও চাচা রসিকতা করলেন। গান’টা গাইলেন দুজন মিলে খুব সম্ভবত আমার সেজ চাচা গানের মাঝখানে শুধু একজনকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই ছেলের গলা ভাল’। গানে নিমগ্ন আমি, গানটা মাথার ভেতর গেঁথে গেল অনেকখানি। গানটির নাম ‘আহ্বান’, ব্যান্ডের নাম খেয়াল করতে পারলাম না।
আমরা কয়েকজন একসাথে স্কুলে যাই, একসাথে খেলতে যাই বন্ধু টিপুর বাসার সামনে, একসাথে গল্পের বই পড়ি, সেই বইগুলো আমাদের সবার বাসায় ঘুরে ঘুরে কথা বলে, গল্প করে। সেখানে যাওয়া বন্ধ, খেলার জায়গা নেই, সব তলিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে নৌকায় করে যাই, গল্প করি। একদিন নৌকায় করে যাচ্ছি, মাঝামাঝি যেতেই গানের আওয়াজ ভেসে এলো, তখন ‘ডেকসেট’ বলে একটা জিনিসে কেউ কেউ ব্যাপক জোরে গান শুনতেন। সেই একই গান।
বাংলাদেশের ব্যান্ডজগতের ইতিহাস লিখতে গেলে একদিকে যেমন ‘রেইনবো’ আরেকদিকে তবুও ‘সারগাম’... বেশ কিছুদিন পর একটা অ্যালবাম বাজারে নিয়ে এলো সারগাম সেই একই গান সহ, ১৯৮৯ সালে। ব্যান্ডের নাম 'নোভা', অ্যালবামটির নাম ‘আহ্বান’। ব্যান্ড সদস্যদের নাম: ফযল, ভাল, টলো, ময়, শাকিল খান... এই নামগুলো নিয়ে কথা হতো, যতদূর মনে পড়ে গবেষণার ফলাফলে জেনেছিলাম যে ব্যান্ডটি মোহাম্মদপুর কেন্দ্রিক। নোভার কনসার্ট-ও দেখতে গিয়েছিলাম মনে আছে।
বাংলাদেশে তখনও নেশার আঁধারে ডুবে যাওয়া শুরু করেনি কিন্তু সেই সময়টায় ‘হেরোইন’ বলে একটা জিনিস নিয়ে সংবাদপত্রে লিখা শুরু হয়েছে, মুরুব্বীরা তাই নিয়ে কথা বলেন, আশংকা প্রকাশ করেন। এরশাদ আমলেই বাংলাদেশে ‘হেরোইন’ গ্রাস করে নেওয়ার শুরু, আমি তখন এবং তার পরেও অনেককেই এই ধ্বংসের শুরুর এবং এর পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এরশাদ’কে সরাসরি দায়ী করতে শুনেছি; এরশাদ সম্পর্কে যতটুকু জানি এবং বুঝি, তাতে আমি নিজেও এই ধারনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারি না। সেই সময়টাতে ‘প্রাণের প্রদীপ’ জ্বালিয়ে নেশার করাল গ্রাসে ‘তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া’ থেকে মুক্ত থাকা এবং ‘বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তর জুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার’ আহ্বান জানিয়ে গাওয়া হয়েছিল ‘আহ্বান’ গানটি।
নোভার ‘আহ্বান’ অ্যালবামটির টাইটেল ট্র্যাকটির সাথে সাথে ‘দুখু’, ‘রাখাল ছেলে’, ‘সজনী’, ‘দ্যুতি’ গানগুলো আমাদের মুখে মুখে ফিরত। নোভা’র পরবর্তী এলবাম এর নাম ‘রাজাকারের তালিকা চাই’; অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাক, ‘রাজাকারের তালিকা চাই’ গানটি তুমুল পছন্দের পিংক ফ্লয়েড এর ‘ওয়াল’ গানটির অনুকরণে গাওয়া। এই গানটি যখন বের হয় ততদিনে এরশাদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় জামাত-শিবিরের প্রবল উত্থান ঘটে গেছে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে কিন্তু এরশাদ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত। বাংলাদেশে জামাতের অগ্রযাত্রায় এই গানটি একটা প্রবল প্রতিরোধের কথা বলে গিয়েছিল, শক্তি জাগিয়েছিল বহু মানুষের। এর আগে এইভাবে ‘রাজাকারের তালিকা’ চাওয়ার কথা সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দাবী করেনি, বাংলাদেশে জামাত-শিবির-রাজাকার বিরোধী আন্দোলনে নোভা’র এই অবদান মনে রাখতে হবে।
আজকে আপিসে দুপুর পর্যন্ত কাজের চাপ একটু কম, গত কয়েকটা সপ্তাহ কাজের নামে ঝড় গিয়েছে; গান শুনতে যেয়ে নোভার আহ্বান অ্যালবামটা পেয়ে গেলাম, শুনতে শুরু করলাম। বহুদিন সচলায়তনে দূর থেকে ঘুরে যাওয়া হয়, বহুদিন লিখা হয়নি, লিখতে পারিনা। গান শুনতে শুনতে লিখতে শুরু করলাম, শুধুমাত্র পোস্টটি দেয়ার জন্য লগইন করলাম খ্যাপাটের মত।
যারা নোভার গান কোনদিন শোনার সুযোগ পানিন তাদের আহ্বান করবো শোনার জন্য, তারপর আহ্বান করবো ‘রাজাকারের তালিকা চাই’ গানটি শোনার জন্য।
কিছুদূর অম্লান আহ্বান ব্যতিরেকে বেঁচে থাকায় আমাদের আর কোন শপথ বাকি থাকেনি কোনদিন!
নোভার এ্যালবাম সমূহ:
আহবান
রাজাকারের তালিকা চাই
স্কুল পলাতক মেয়ে
ভাইসো
ঠিকানা
রিটার্ন অফ দ্য নোভা
মন্তব্য
এককালের প্রিয় ব্যান্ড 'নোভা'কে নিয়ে লেখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কিছুদিন আগে একটা টিভি চ্যানেলে আহমেদ ফজল করিমকে দেখলাম। চেনা যায় না, সেই গলাও আর নেই। কী কারণে যেন পাবলিক ফজলকে পছন্দ করতো না। কিন্তু আমার ভালো লাগতো। এখনো সেই আমলের ফজলকে ভালো লাগে। তার এক্সপেরিমেন্ট করার সাহস ভালো লাগে। শাকিলের রোমান্টিক কণ্ঠ ঐ আমলে মন্দ লাগতো না। গ্রুপটা অকালে ভেঙে যাওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলাম।
লেখাটাতে কিছু তথ্য বিভ্রান্তি আছে। (১) বন্যায় ঢাকা ডুবেছিল ১৯৮৮ সালে, ১৯৮৬ সালে নয় (২) নোভার প্রথম অ্যালবাম 'আহবান' বের হয়েছিল ১৯৮৯ সালে (৩) নোভার দ্বিতীয় অ্যালবাম 'রাজাকারের তালিকা চাই' বের হয়েছিল ১৯৯১ সালে (এরশাদের আমলে নয়)।
- এই কথাটা কি ঠিক হলো? রেইনবো আমাদেরকে আশি-নব্বইয়ে ওয়েস্টার্ন মিউজিক শুনতে শিখিয়েছে সেটা ঠিক, তবে বাংলাদেশের ব্যান্ডসঙ্গীত আন্দোলনের ইতিহাস আরও পুরনো। সেটা তো আপনার অজানা থাকার কথা না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনার মন্তব্য সবসময় আরও কিছু প্রাপ্তি যোগ করে। আমি সময়কাল ঠিক করে নেবো, এই মুহূর্তে মোবাইল থেকে মন্তব্য করছি।
১) ওয়েব সার্চ দিয়ে পেয়েছিলাম আহ্বান ১৯৮৮ সালে, উইকিতে তাই লিখা।
২) ব্যান্ড সঙ্গীত এর সামগ্রিক ইতিহাস ব্যাপক। রেইনবোর আরেকটা বিষয়ের উপরও আলোকপাত করতে চেয়েছি, ব্যান্ডজগতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ রেইনবো কেন্দ্রিক আড্ডায় সামিল হতেন, এখান থেকে কিছু ব্যান্ডের ভাঙাগড়াও হয়েছে বলেও জানি। তবে হ্যাঁ, আপনার কথায় আমি একমত, এই জায়গাটিতে আরও কয়েকটা কথা সংযোজন করবো
৪) ফজল আমারও খুব পছন্দের; গান শুনতে শুনতে একটা লাইভ প্রোগ্রামে তাঁকে কথা বলতে শুনলাম, গানের সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলছিলেন তিনি- সবাই সবকিছু ভাবতে পারে না কিংবা ভাবতে চায় না, যারা ভাবেন তাদের জন্য সবসময় শ্রদ্ধা!
আবারও ধন্যবাদ
আহ্বান ১৯৮৮ সালের অ্যালবাম হতে পারে। আমি এটা ১৯৮৯ সালের মাঝামাঝি শুনতে পেয়েছিলাম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
[url=https://en.wikipedia.org/wiki/Nova_(Bangladeshi_band)]উইকি [/url]বলছে আহ্বান ১৯৮৮ এবং রাজাকারের তালিকা চাই ১৯৮৯ সালে বের হয়।
উইকির লিঙ্ক থেকে দেখছি বলা হয়েছেঃ Ahoban (1988), Rajakarér Talika Chai (1990)। বিনয়ের সাথে বলছি, উইকিতে উল্লেখিত তথ্য ভুল।
'আহ্বান' অ্যালবামে পতিত সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন নিয়ে একটা গান ছিল - 'রোখে আলাদীন'। আর এরশাদের পতনের পর 'রাজাকারের তালিকা চাই' অ্যালবামে ছিল ঐ গানের সিক্যুয়েল - 'খায় জেলে ভাত'। ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বরের আগে এরশাদ জেলের ভাত খাচ্ছে একটা wishful thinking, বাস্তব নয়। আমি 'আহ্বান' অ্যালবামের প্রকাশকাল ১৯৮৯ - এই মতে আবার ফেরত গেলাম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
একমত হলাম।
গুড ওল্ড ডেইজ। এলিফ্যান্ট রোডে আরেকটা দোকান ছিল সুরবিতান (?) নামে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ফজল আর নোভা দুটোই পছন্দের ছিলো। তখনকার প্রমিথিউস আর বিপ্লবকেও ভালো লাগতো।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
তখনকার গান শুনতেই ভাল লাগতো, যারা বাজাতো তাঁরা জানতেন স্টাফ নোটেশন বলে একটা বিষয় আছে, যা ইচ্ছা তাই করা যায় না।
প্রমিথিউস এর প্রথম অ্যালবাম খুব পছন্দ হয়েছিল।
আপনি বোধ হয় মাত্রা'র (স্কেল) কথা বলতে চাচ্ছেন। স্টাফ নোটেশন সুর লেখার একটা তরিকামাত্র।
আমি খুব কম জানি এই বিষয়ে। আমি দুটোই বলতে চেয়েছি, গান নিয়ে কাজ করা (ব্যাণ্ড) যাদের সংস্পর্শে একটা সময় এসেছি তাদের স্টাফ নোটেশন নিয়ে কথা বলতে শুনেছি, সেখান থেকেই লেখা।
সৈয়দ সাহেবের ভূত, আপনাকে ধন্যবাদ
নোভা আমার বিটিভিতে দেখা প্রথম ব্যান্ড। 'রাজাকারের তালিকা চাই' এ্যালবামটা সেই সময়ের কথা বিবেচনা করলে আসলেই একটা দুঃসাহসিক প্রযোজনা ছিল, এবং তৎকালীন কিশোর/তরুনদের মধ্যে রাজাকারদের বিচারের বিষয়ে সোচ্চার হবার পিছনে অমূল্য অবদান রেখেছিল বৈকি!
নস্টালজিক লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
আপনাকে-ও ধন্যবাদ।
নোভা ব্যান্ড এর "ভাইসো" নামে চমৎকার একটা অ্যালবাম ছিল । এই অ্যালবাম এর কথা কেউ বলেনা। মনে হয় অনেকে জানেও না।
'স্কুল পলাতক মেয়ে' নামে একটা অ্যালবাম ছিল না!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নোভার এ্যালবামগুলোর নাম আমি এরকমটা মনে করতে পারি
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
রিটার্ন অফ দ্য নোভা, উইকি বলে। ধন্যবাদ হাসিব ভাই।
অ্যালবামগুলোর নাম লেখাতেই সংযুক্ত করে দিলাম।
নতুন মন্তব্য করুন