পলাশীর যুদ্ধের পরে ১৭৬০ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর এক সন্ধির শর্ত অনুসারে নবাব মীর কাশিম বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে চট্টগ্রাম জেলা সমর্পন করতে বাধ্য হন। তারপর চট্টগ্রামের তৎকালীন শাসক নবাব রেজা খাঁ মিঃ হেরিভেলেটের হাতে চট্টগ্রামের শাসনভার অর্পণ করেন বলে জানা যায়। তখন থেকে ইংরেজরা চট্টগ্রামের উপর চেপে বসে।
তারপর থেকে ১৯শ শতাব্দীর আরম্ভ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা জানা যায় না। পলাশীর যুদ্ধের ঠিক একশ’ বছর পরে ১৮৫৭ সালে সংঘটিত অভ্যুত্থানকে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করলেও তা ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় হিন্দু-মুসলিমের প্রথম সংঘবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ আন্দোলনে চট্টগ্রামের ভূমিকার কথা প্রথম পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
সিপাহী বিদ্রোহ ইংরেজরা কঠোর হাতে দমন করার পর ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন বেশ কিছুদিন স্তিমিত ছিল। বিংশ শতকের প্রারম্ভে ১৯০৫ সালে বাংলায় যখন ‘স্বদেশী আন্দোলন’ শুরু হয়, তার ঢেউ এসে চট্টগ্রামের বুকেও লাগে। এ সময় চট্টগ্রামে যামিনী সেনের উদ্যোগে ‘চট্টল হিতসাধিনী সভা’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়, যার আমন্ত্রণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চট্টগ্রাম সফর করেন স্বদেশী আন্দোলনকে বেগবান করতে। এ সময়কার ‘স্বদেশী আন্দোলন’ ও ‘বংগভংগ রদ আন্দোলন’ সম্পর্কে এখানে সময়াভাবে বিস্তারিত আর কিছু লিখছি না। তবে এসময়ই কলকাতায় ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’ নামে দুটি গোপন বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে, যার শাখা পূর্ব-বাংলায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য জেলায় গঠিত হয় এবং চট্টগ্রামে এভাবেই প্রথম বিপ্লবী দলের কার্যক্রম শুরু হয়। চট্টগ্রাম বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোধা সূর্য সেন পরোক্ষভাবে অনেক দিন থেকেই বিপ্লবী দলের সাথে যোগাযোগ রাখলেও ১ম মহাযুদ্ধের শেষ দিকে অর্থাৎ ১৯১৬-১৭ সালের দিকে প্রত্যক্ষ বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। সূর্য সেন এবং আরেক প্রধান বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী (যিনি সূর্য সেনের একই থানার পাশাপাশি গ্রামের ছাত্র হিসেবে পরস্পরের পূর্ব-পরিচিত) এবং তাদের বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে আমরা পরের পর্বে বিস্তারিত জানব। এ পর্বের মূল আলোচ্য বিষয় অসহযোগ আন্দোলন এবং তাতে চট্টগ্রামের ভূমিকা।
অসহযোগ আন্দোলন, ১৯২১
===============================
১৯১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ জোট জয়লাভের পর ১৯১৯ সালে সম্পাদিত ‘ভার্সাই চুক্তির’ মাধ্যমে তারা তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়। খিলাফতের মর্যাদা রক্ষার জন্য এসময় মুসলমানরা উপমহাদেশে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আন্দোলন শুরু করেন যা ‘খিলাফত আন্দোলন’ নামে পরিচিত। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল ইংরেজরা পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে জনসভার উপর মেশিনগানের গুলি চালিয়ে নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় স্বাধীনতার সবরকম আন্দোলন ও দাবীকে দমাবার জন্য ইংরেজরা ‘রাউলাট আইন’ পাশ করেছিল, যার প্রতিবাদে সেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। জালিয়ানওয়লাবাগ হত্যাকান্ডের পরপরই মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ব্যারিস্টারি ছেড়ে ভারতে এসে কংগ্রেসে যোগ দেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ বর্বরতার প্রতিবাদে সারা ভারতে যে প্রবল গণবিক্ষোভ জাগ্রত হয়, তার ফলে কলকাতায় ১৯২০ সালে ভারতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়। এতে চট্টগ্রাম থেকেও বিশাল একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেয় যার সদস্য ছিলেন কাজেম আলী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শেখ-এ চাটগাম (উপাধি) কাজেম আলী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ। ঐ কংগ্রেসে চরমপন্থীরা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংসের জন্য আশু সক্রিয় কর্মপন্থা দাবী করে। সেজন্য মহাত্মা গান্ধী এক বছর সময় নেন।
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী ভারতে ‘এক বছরে স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠার দাবীতে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ইংরেজের আদালতে আমরা বিচার প্রার্থী হব না, সরকারী বিদ্যালয়ে আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়বে না, সরকারী চাকুরী আমরা করব না- এই হল ‘অসহযোগ’। এসব ব্যাপারে ধর্মঘট, মিছিল, সভা ইত্যাদির উপর পুলিশের সব অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে হবে, পুলিশের লাঠি-গুলীর বদলে হিংসাত্মক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না- এই নীতি নিয়ে গান্ধীজির নেতৃত্বে ১৯২১ সালে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।
অসহযোগ আন্দোলনে চট্টগ্রামবাসী ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। গান্ধীজির আহবানে সাড়া দিয়ে অসংখ্য মানুষ সরকারী চাকরী ছেড়ে দেয়, ছেলে-মেয়েদের সরকারী স্কুল থেকে ছাড়িয়ে দেয় এবং আন্দোলনে প্রচুর অর্থ দান করে। চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (যার নামে রহমতগঞ্জের যেএম সেন হল) ব্যারিস্টারী ছেড়ে আন্দোলনে যোগ দেন, চট্টগ্রাম কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল নৃপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় এবং আরো অনেকে পদত্যাগ করেন। চট্টগ্রাম শহরের পথে পথে তখন বিলাতী কাপড় পুড়িয়ে দেশী কাপড় পড়ার জন্য গান গাওয়া হত,
‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই,
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশী আর সাধ্য নাই’।
১৪৪ ধারা অমান্য করে মানুষ তখন সভা-মিছিল করেছে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করার জন্য। সে সময় চট্টগ্রাম জেলে এত লোক জমে যায় যে সরকার ১৪৪ ধারা উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়। চট্টগ্রামের আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও শক্তি দেখে মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘তরুণ ভারত’ সাপ্তাহিকে চট্টগ্রামকে অভিনন্দিত করতে গিয়ে বলেছিলেন “চট্টগ্রাম সবার আগে” (Chittagong to the fore!).
মন্তব্য
বহু আগে পড়া বিনোদ বিহারী চৌধুরীর 'অগ্নিযুগের চট্রগ্রাম' -ছবি ও বর্ননা সহ একটি প্রামান্য দলিল ।
আপনার এই ধারাবাহিকটা ও গুরুত্বপুর্ন হয়ে উঠছে ।
----------------------------------------
সঙ্গ প্রিয় করি,সংঘে অবিশ্বাস
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
বিনোদ বিহারীর বইটি পড়ার সৌভাগ্য হয় নি। মিলিয়ে পড়া গেলে দারুণ হতো। এ বইটিতেও ছবি আছে। তয় লাইব্রেরীতে গিয়ে স্ক্যান করা ম্যালা ঝামেলা
========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"
মুগ্ধ হয়ে অপেক্ষায় আছি পরবর্তী পর্বের।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
সদয় মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"
চলুক।
হাঁটুপানির জলদস্যু
নতুন মন্তব্য করুন