লুই কান এবং বাংলাদেশ

তানভীর এর ছবি
লিখেছেন তানভীর (তারিখ: শনি, ১২/০১/২০০৮ - ৫:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

small

২০০৪ সালের কোন এক সকাল। ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে ল্যাবে যাচ্ছি। সাধারণত বাইরে প্রচন্ড গরম কিংবা ঠান্ডা থাকলে আমি ভবনের অভ্যন্তর দিয়ে যাওয়ার এই রাস্তাটা ব্যবহার করি তাপানুকূল পরিবেশের জন্য। স্টুডেন্ট ইউনিয়নের এক পাশেই রয়েছে ইউনিভার্সিটি থিয়েটার। থিয়েটারের পাশ দিয়ে আনমনে যেতে যেতে দেয়ালে সাঁটা একটা পোস্টারে আচমকা চোখ আটকে গেল। পোস্টারে বিল্ডিং-এর ছবিটা আমার খুব পরিচিত। আগেও কোথাও দেখেছি। আর সবচেয়ে বেশী অবাক হলাম বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়ানো ছোট বাচচাটা-কে দেখে। এ যে হাফ প্যান্ট পড়া একটা ছোট্ট বাংলাদেশী বাচচা! ভালো করে বিল্ডিং-টার দিকে আবার তাকালাম। আরে, এটা তো আমাদের সংসদ ভবনের ছবি। এই ছবি এখানে এল কি করে? পোস্টারটা ভাল করে পড়ে দেখলাম। একটা অস্কার নমিনেশন পাওয়া তথ্যচিত্র দেখানো হবে লুই কানের ওপরে, নাম- “মাই আর্কিটেক্টঃ এ সন’স জার্ণি”। লুই কানের ছেলে নাথানিয়েল কান এ ছবির নির্মাতা। তারিখ আর সময়টা দেখে নিলাম। এটা তো আমাকে দেখতেই হবে।

small

লুই কানের জন্ম এস্তোনিয়ার এক দরিদ্র ইহুদী পরিবারে ১৯০১ অথবা ১৯০২ সালে, যেটা তিনি নিজেও কখনো জানতে পারেন নি। ভাগ্যের অন্বেষণে তাঁর পরিবার আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরে এসে আস্তানা গাড়ে। ছবি আঁকাতে লুই কানের ছিল সহজাত প্রতিভা। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করে রোজগার করতেন। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারে পেন্সিল কেনার সামর্থ্যও তাঁর ছিল না। কিন্তু তাতে তিনি থেমে থাকেন নি। চারকোল কয়লা আর খড়িমাটি দিয়ে চলত তাঁর আঁকাআঁকির কাজ। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর অসাধারণ প্রতিভার জোরে ১৯২৪ সালে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া থেকে লুই কান স্থাপত্যবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে লুই কানের ছিল দ্বৈতজীবন। বিবাহিত স্ত্রী এবং সন্তানের পাশাপাশি তার জীবনে আরো দুইজন নারী এবং তাদের গর্ভের সন্তানরা ছিল, যাদের কথা তাঁর মৃত্যুর পরই মূলত প্রকাশ পায়। ছবির কাহিনী আসলে এখান থেকেই শুরু। নাথানিয়েল কান- যিনি এ ছবির নির্মাতা, তার মা আদৌ লুই কানের স্ত্রী ছিলেন না। অজানা এবং প্রায় অদেখা পিতাকে জানার জন্য এ এক সন্তানের যাত্রা। পিতাকে জানতে পিতার রেখে যাওয়া কর্মের সাথে পরিচিত হতে চেয়েছেন নাথানিয়েল কান। তাই তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রান্তে যেখানে তার পিতার কর্ম কীর্তিকে বহন করে চলেছে। নাথানিয়েল কান ছবিতে তার এই মর্মস্পর্শী যাত্রার চিত্র তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশ ছিল ছবির শেষ অংশে। লুই কানের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বাংলাদেশের সংসদ ভবন ও শেরে বাংলা নগর। এ কীর্তি তিনি দেখে যেতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর ৯ বছর পরে সংসদ ভবনের কাজ শেষ হয়। ১৯৭৪ সালে পেনসিলভেনিয়া স্টেশনে নিসংগ অবস্থায় বিপুল ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে লুই কান মৃত্যুবরণ করেন। ছবিতে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংসদ ভবনের অসম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ দেখে পাকিস্তানী সৈন্যরা কোন ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ মনে করেছিল। তাই, তারা সেখানে হামলা করে নি। নাথানিয়েল কান বলেছেন, তার পিতা আছেন এ বাংলাদেশের মাটিতেই। যে পিতার সন্ধানে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন তাকে তিনি সম্পূর্ণরূপে পেয়েছেন এই দেশে এসে। তার এই যাত্রা তাই সার্থক।

ছবিতে বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্থপতি শামসুল ওয়ারেস নাথানিয়েল কানকে বলেছেন, লুই কান কোন রাজনৈতিক নেতা নন। তবু তিনি বাংলাদেশকে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছেন, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান উপহার দিয়ে এ দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করেছেন। তার এ অবদান অসামান্য। তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় এবং ব্যয়বহুল প্রজেক্ট পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশে করার সাহস দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ লুই কান এবং তার কীর্তির জন্য গর্বিত।

লুই কানের কথা বলতে গিয়ে শামসুল ওয়ারেস কেঁদেছেন। ছবি শেষ হওয়ার পর হল ভর্তি অনেকের চোখেই আমি পানি দেখেছি। ছবিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে, সংসদ ভবন, বুড়িগঙ্গা, ঢাকার রাস্তার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে- হল ভর্তি বিদেশীদের মাঝে বসে এসব দৃশ্য দেখে আমার চোখেও পানি এসে পড়েছে। হয়তো আমার কান্নার সাথে ওই বিদেশীদের কান্নার কোন মিল নেই। লুই কান, নাথানিয়েল কানের দুঃখকে ছাপিয়ে আমার দেশকে নিয়ে গর্ব, দেশকে নিয়ে দুঃখ-ই আমাকে কাঁদাল। হায়, এমন কান্না যদি প্রতিদিনই কাঁদতে পারতাম!

(১৭ই এপ্রিল, ২০০৪-এ প্রথম আলো উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত। ঈষৎ পরিবর্তিত। বেশ কয়েক মাস আগে সামহোয়ারইন-এ দিয়েছিলাম।)


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

অতীব চমৎকার! মন ছুঁয়ে গেল।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

তানভীর এর ছবি

গুরুজী, আপনার মন ছুঁয়েছে জেনে আমিও প্রীত হলাম।

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

প্রথম আলোতেই পড়েছিলাম। আবারও পড়া হলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

তানভীর এর ছবি

কষ্ট করে দু'বার পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ছবিটা খুবই ফাইন। ন্যাথানিয়েল চমৎকার কাজ দেখিয়েছে। আর শেষ ২০ মিনিটের জবাব নেই। সংসদ ভবনে বসে বাংলাদেশী আর্কিটেক্টের কথাগুলা খুব মনে লাগে। রিভিউ-এর জন্যে ধন্যবাদ। সব দেশীদের একটু সময় করে এই ছবিটা দেখা।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

তানভীর এর ছবি

এটা ঐ অর্থে ঠিক রিভিউ হিসেবে লেখা না। ছবিটা দেখে এসেই খুব লিখতে ইচ্ছে হল। তাৎক্ষণিক অনুভূতিটুকু ধরে রাখা যাকে বলে। তখন তো আর বাংলা ব্লগ ছিল না। তাই প্রকাশ পেতে সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

আরিফ জেবতিক এর ছবি

ছবিটা দেখিনি । এখানে ডিভিডি পাওয়া যায় নি । দেখি আবার খোঁজ করে দেখবো ।.

...ইয়ে , আমরা যে লুইকানের পাওনা টাকাটা দেই নি, এটা নিয়ে ছবিতে কিছু বলে নি তো ?

তানভীর এর ছবি

এটার ডিভিডি রিলিজ হয়েছে (http://www.amazon.com/My-Architect/dp/B000787Z12)। বাংলাদেশেও অবশ্যই পাওয়া যাওয়ার কথা।

পাওনা টাকা নিয়ে ছবিতে কিছু বলে নি। আসলে সংসদ ভবনের কাজ শেষ হয়েছে তো লুই কান মারা যাবার অনেক পরে। তাই মনে হয় টাকার কোন দাবীদার ছিল না।

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

১৯৮০ সালে সংসদ ভবন আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার জেতে। পুরস্কারের সেই দলিল অনুযায়ী ৭৪ সালে কানের মৃত্যুর পর সংসদ ভবন নির্মান কাজ তদারকির দায়িত্ব নেয় David Wisdom and Associates নামের আর্কিটেকচার প্রতিষ্ঠান। ফিলাডেলফিয়ার ফার্ম - এরা কানের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত ছিল - ইন ফ্যাক্ট দলিলে এদের ঠিকানা আর কানের ঠিকানা একই। কানের পাওনা টাকার কথা কোথাও উল্লেখ পেলাম না, তবে একেবারে অসম্ভব কিছু না।

খারাপ লাগলো অন্য জায়গায়। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় বসে কান এই কথাগুলো লিখেছিলেন (Design Concept Description) -

"The architecture of the Second Capital is inspired by the nature of spaces that characterize legislative assembly, the accompanying spaces where men study, discuss and argue, and where they privately live and reflect on their ways and those of other men. Architecture as the thoughtful making of spaces can inspire the transcendence required of the acts of men assembled, gathered from all corners of the nation for the making of the laws that give them the basis for a way of life for East Pakistan."

গুণীজনদের কতভাবেই না আমরা অবমাননা করতে জানি। কানের স্বপ্নের সাথে বাস্তবের কি ফারাক। তার এই সংসদ ভবনে বসে আমাদের সাংসদরা যেই inspiration পেয়েছেন, তা হলো নিজেদের জন্যে শুল্ক মুক্ত গাড়ি আমদানী করা। সেটা দেশে এনে আবার চড়া দামে বিক্রি করে লাভ হিসাব করা। আরো শত কুকর্ম চলেছে।

বুড়ো মরে গিয়ে ভালোই করেছিলেন। এসব দেখতে শুনতে হয় নি।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

নামবিহীন এর ছবি

ডিভিডি অরিজিনাল এবং কপি করা পাইরেটেড - দুইটাই রাইফেলস আর বসুন্ধরা সিটিতে পাওয়া যায়।

মাশীদ এর ছবি

অসাধারণ একটা ডকিউমেন্টারি। ভীষণ মনছোঁয়া। শেষ দৃশ্যে শামসুল ওয়ারেস চাচার (ছোটবেলার পাড়ার চাচা হিসেবে এখনো নামটা উঠলেই চাচাটা চলে আসে, যদিও আফসোস যে কোন যোগাযোগ নেই) কথাগুলো চমৎকার। সংসদ ভবন যে আমাদের কাছে কত বড় সেটা খুব সুন্দর করে ফুটে ওঠে। ওনার কান্নাটা আমাদের মাঝেও তানভীরের মত একই কারণে সংক্রমিত হয় দেশপ্রেমে। ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থ হলেও লুই কান যে আমাদের আরো অনেক বেশি কিছু দিয়ে গেছেন যাত্রাশেষে তার ছেলে যে সেটা ঠিকমতো বুঝতে পেরেছে সেটাই বড় কথা।


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

সৌরভ এর ছবি

পড়লাম। আগে পড়েছিলাম।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ধ্রুব হাসান এর ছবি

আমার দেখা অসাধারন প্রামান্যচিত্রগুলো মধ্যে নাথানিয়েল “মাই আর্কিটেক্টঃ এ সন’স জার্ণি” অন্যতম; কারণ একজন সন্তান তার অদেখা অচেনা বাবাকে যে ভাবে খুজেছে যে প্রক্রিয়ায় তা অনন্য। অসমান্য প্রতিভাবানদের প্রায় দেখা যায় ব্যক্তি জীবনে সোকল্ড সফলতা না পেতে কিন্তু নাথানিয়েল তার এই ব্যক্তিজীবনে নিঃসংগ বাবাকে ঘৃনা না করে ইগনোর না করে যেঢঙ্গে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে তার জন্য তাকে স্যালুট।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

কালকে বসে বসে পুরাটা দেখলাম। ধন্যবাদ।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।