-১-
আমাদের গবেষণা কেন্দ্রের সাপ্তাহিক সভা হয় প্রতি সোমবার দুপুরে। ‘গবেষণা কেন্দ্রের সাপ্তাহিক সভা’- শুনতে যেমন ভারিক্কী শোনায়, আসলে ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। বরং সপ্তাহের অন্যান্য দিনের চেয়ে এদিনেই আমাদের আনন্দ-ফুর্তি সবচেয়ে বেশি হয়। সভায় মূলত যেটা হয়- কেন্দ্রের পরিচালক বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিভিন্ন প্রকল্পের ওপর হালনাগাদ বিবরণী দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব বিবরণী কিছু সময় পরে অশ্লীল আলাপ-আলোচনার দিকে মোড় নেয় এবং আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি এসব আলাপে পুরুষদের চেয়ে নারী কলিগদেরই উৎসাহ বেশি থাকে! আপনারা হয়ত ভাবছেন গাঁজাখুরি প্যাচাল পারছি, তাই ছোট্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
ইদানীং সেকেন্ড লাইফ নামে একটা ওয়েবসাইট আন্তর্জালে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন বাস্তব জীবনের পাশাপাশি ভার্চুয়াল দ্বিতীয় জীবন এটা। বাস্তবে যেমন স্কুল-কলেজ-হাট-বাজার-ঘর-বাড়ি ইত্যাদি থাকে, এখানেও আছে। এখানে জমি কেনা-বেচা হয়, ঘর-বাড়ি তোলা হয়, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করা যায়- সবই ভার্চুয়ালি। আজকাল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফেইসবুক, মাইস্পেস এগুলোকে তাদের প্রচারণা যন্ত্র বা নেটওয়ার্কিং-এর একটা ভালো পন্থা হিসেবে দেখে। সেকেন্ড লাইফ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন যেহেতু ভার্চুয়ালি একটা পুরো প্রতিষ্ঠানই এখানে গড়ে তোলা যায় এবং অন্যের কাছে সহজে উপস্থাপন করা যায়। যাই হোক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নামেও সেকেন্ড লাইফে এক খন্ড জমি কেনা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাবশালী আমাদের কেন্দ্রেরই এক বুড়ো প্রফেসর সেটা কিনলেন। আমাদের ক্যাম্পাস যেহেতু একটা আইল্যান্ডে তাই একটা আস্ত আইল্যান্ড কেনা হল। এখন বুড়োর কথা হচ্ছে আইল্যান্ড যেহেতু ভার্চুয়াল, তাই এর রিয়েল নাম দেবার কোন মানে নেই- একটা কাল্পনিক নাম দেয়া হোক। সাপ্তাহিক সভায় তিনি আমাদের কাছ থেকে নাম দেবার প্রস্তাব করলেন। আমরা খুশী মনে ডলফিন আইল্যান্ড, সীগাল আইল্যান্ড ইত্যাদি বিভিন্ন নাম দিচ্ছি। কেন্দ্র পরিচালক হঠাৎ দুম করে বলে বসলেন- ‘নাম দাও ‘বুবি আইল্যান্ড’, জোয়ান ছেলে-পিলেরা সব আইল্যান্ডে হুমড়ি খেয়ে পড়বে কি আছে দেখার জন্য’। মহিলাদের আর পায় কে। একজন দুই হাত উঁচু করে তার বুকের দিকে নির্দেশ করে বলল-‘তোমাদের যদি আইল্যান্ডের জন্য কোন অবতারের প্রয়োজন হয়, তবে আমার ছবি ব্যবহার করতে পার’। বাকী কথাগুলো আর লিখলাম না। সাপ্তাহিক সভায় নিয়মিত এ ধরণের আলাপ-আলোচনাই হয়, ফাঁকে ফাঁকে কাজের কথা। আমি একে বিদেশী, তার ওপর সামাজিকভাবে আমরা হয়ত বন্ধু-বান্ধব ছাড়া অন্যদের সাথে এ ধরণের আলাপে অভ্যস্ত নই। তাই এসব আলাপে আমার কিছু বলার থাকে না। তবে শুনতে মজাই লাগে ।
-২-
একবার দুই বুড়ো কলিগের সাথে একটা কনফারেন্সে গিয়েছি রাইস ইউনিভার্সিটিতে। রাইসে আমি আগে কখনো যাই নি। বেশ নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি- টিউশন ফি অত্যধিক বেশি। এক বুড়ো আবার রাইসের প্রাক্তন ছাত্র। সে খুব খুশি মনে আমাকে ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাচ্ছে- এখানে আমি একসময় প্রচুর আড্ডা দিতাম, ঐ বাড়িতে আমার প্রথম বাচচা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বলল, এখানে তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ক্যাম্পাসের পেছনে অবস্থিত একটা বার। রাইসের সব বিখ্যাত লোকরা নাকি আসলে এই বার থেকেই পয়দা হয়েছে। ঠিক হল- কনফারেন্স শেষে সন্ধ্যায় আমরা তিন জন সেই বারে ঢুঁ মারব। যাওয়ার পথে গাড়ীতে দেখি দুই বুড়ো একটু পরপরই ‘TRG’ বলে একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠছে। আমি ভাবলাম, বারে যাওয়ার আগেই কী টাল হয়ে গেল নাকি! আরো খেয়াল করলাম- রাস্তায় যখনই কোন মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, তখনই দুই বুড়ো চিল্লান দিচ্ছে। আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে এক বুড়ো বলল, তুমি মনে হচ্ছে খুব কনফিউজড। আমি বল্লাম, অবশ্যই, কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। বুড়ো জানাল- TRG মানে হচ্ছে ‘টিপিক্যাল রাইস গার্ল’। দুই বুড়ো বাজী ধরেছে যে রাস্তায় যেসব মেয়ে জগিং করছে তাদের মধ্যে কে রাইসে পড়ে আর কে পড়ে না সেটা নিয়ে। আমি বল্লাম- এখন পর্যন্ত যতগুলো মেয়ে দেখা গেছে, তার সবগুলোকেই তো তোমরা TRG বলেছ, কেম্নে কী, আমি তো কিছুই আলাদা করতে পারলাম না। সে বলল, অবশ্যই TRG, এ সময়ে রাইসের মেয়েরা ছাড়া আর কেউ হিউস্টনের রাস্তায় জগিং করে না! আমি ভাবলাম, বাহ দুই বুড়া তো হেভি রসিক- এই বয়সেও মেয়ে নিয়ে গবেষণা। রস যে একেবারে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তা একটু পরেই ভালোমত টের পেলাম।
বারে গেলে আমার পানীয় হয় কোক অথবা অরেঞ্জ জুস। যথারীতি বুড়ো আমার জন্য অরেঞ্জ জুসের অর্ডার দিল আর তারা কী কী নিল আমার মনে নাই। রাইসের বুড়ো মদ খায় একেবারে পানির মত- চুক চুক করে চুমুক দিয়ে নিমেষেই তার গ্লাস শেষ হয়ে যায়। হঠাৎ তার চোখ গেল আমার ব্যাগের দিকে। আমার পুরনো ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া ব্যাগ- লাল-কালো লোগো বসানো, আমার খুবই প্রিয়। সে একটু রাগী রাগী ভাব নিয়ে বলল- হ্যাঁ তোমরা বল আমি রাইস নিয়ে বাড়াবাড়ি করি, আর তুমি যে এতদিন এখানে হয়ে গেল, তারপরও তোমার আগের স্কুলের ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াও, এটা কি বাড়াবাড়ি না? আমি চোখ ছোট করে চিন্তা করতে লাগলাম- সে কী টাল হয়ে এ প্রশ্ন করল কিনা, এভাবে আচমকা আমার ব্যাগ নিয়ে পড়ল। আমি উত্তর দেবার আগেই অন্য বুড়ো বলল- আসলে ব্যাগ-ট্যাগ কিছু না, ঐ লাল-কালো লোগোটা দেখলেই ওর কিছু অশ্লীল কথা মনে পড়ে কিনা, তাই তোমাকে চটাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম- লোগোটার কি খারাপ কোন অর্থ আছে নাকি। তখন রাইসের বুড়ো বলল- লোগোতে কিছু নেই, তবে তুমি কি ‘রেড এন্ড ব্ল্যাক ডমিনেট্রিক্স’ টার্মটা শুনেছ? আমি কইলাম- এরকম কিছু আমার এন্টেনায় কখনো ধরা পড়ে নাই। যাই হোক, এর পরে সে এটা নিয়ে বিশাল লেকচার দিল। সারমর্ম যেটুকু উদ্ধার করতে পারলাম তা হল- এটা একটা পর্নোগ্রাফিক টার্ম- নারী আধিপত্য সংক্রান্ত। অন্য ডিপার্টমেন্টের এক মহিলা প্রফেসরকে নিয়ে বুড়োর এ ধরণের একটা ফ্যান্টাসি কাজ করে- মহিলা লাল জামা পড়ে, কালো চাবুক হাতে তার সাথে ইয়ে করছে। একটা নিরীহ লোগোর যে এরকম মারাত্মক ইন্টারপ্রিটেশন হতে পারে শুনে টাশকি খেয়ে গেলাম। আমি আবার অন্যরকম কিছু ভাবতে পারি মনে করে সে হয়ত জানাল- এসব নিছকই ফ্যান্টাসি, বাস্তবে স্ত্রীর প্রতি তারা খুবই বিশ্বস্ত। তবে সেদিনের সেই সন্ধ্যায় শিশুর মত দুই বুড়োকে আমার খুব ভালো লেগে গেল। কিছু কিছু মানুষের বয়স হয়তো কখনো বাড়ে না। এরা সেই রকম। দেখলে মনে হয় তাদের জীবন কেবল শুরু হল, আর আমিই শুধু বুড়িয়ে যাচ্ছি।
-৩-
তবে সবাই যে এরকম আমুদে, তা কিন্তু নয়। আমাদের অফিস স্যুটের মধ্যেই অন্য ডিপার্টমেন্টের আরেক বুড়োর রুম আছে। আমার সাথে দেখা হলে সে কথা বলা তো দূরের কথা, হাই-হ্যালোও করে না। আমি কয়দিন দেখেই তাকে রেসিস্ট বলে সাব্যস্ত করলাম। তার রুমে মাঝে মাঝে উঁকি দিলে দেখি সে সারাদিন কম্পিউটারে ফ্রি সেল খেলে আর বিকট ভলিউমে নানা ভিডিও দেখে। একদিন ভাবলাম তার নামে কমপ্লেন করে দেব। হঠাৎ একদিন শুনলাম- তার স্ত্রীর নাকি ক্যান্সার, কেমোথেরাপী নিয়ে কী জটিলতা চলছে। আমি এতদিনে বুঝলাম- এই লোক কেন সবসময় বিষন্ন থাকে। খুবই অপরাধী মনে হল নিজেকে। না জেনেই একে রেসিস্ট আরো কত কিছু ভেবে ফেলেছি। পরদিন নিজে থেকেই তার সাথে কথা বল্লাম, ‘ গুড মর্নিং ডঃ ম্যাকক্লয়, হাউ আর ইউ ডুয়িং টুডে?’ ‘প্রিটি গুড, হাউ এবাউট ইউরসেলফ?’ এরপর এরকমই টুকটাক কথা হতো প্রতিদিন। বিষন্ন লোকটাকে হাসি-খুশীও দেখতাম মাঝে মাঝে। একদিন আমাকে ডেকে তার রুমের অনেক বই আর ফাইল দিয়ে দিল আমাদের কেন্দ্রে রাখার জন্য। সে রিটায়ার করেছে, এখন থেকে এমিরেটাস হিসেবে কাজ করবে। এমিরেটাসরা সাধারণত নিয়মিত আসে না, কিন্তু তাকে নিয়মিতই আসতে দেখি- সেই ফ্রি সেল, আর ভলিউম বাড়িয়ে ভিডিও দেখা। এখানে আসতে হয়ত তার ভালো লাগে, আমারো এখন তাকে আর খারাপ লাগে না। গত শুক্রবার মিটিং-এ শুনলাম ম্যাকক্লয়কে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আমি ভাবলাম বুড়োকালের কোন অসুখ-বিসুখ হয়তো। দু’দিন আগেই তো তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফ্রি সেল খেলতে দেখেছি। শনিবারে ইউনিভার্সিটি বন্ধ- ক্যাম্পাস ইমেইলে একটা চিঠি আসল- ‘ইট ইজ উইথ স্যাডনেস দ্যাট উই রিপোর্ট দ্য ডেথ অফ ডঃ ম্যাকক্লয়...’-পড়ে আমি হতভম্ব। মানুষের চলে যাওয়া কত সহজ। শুধু মনে হচ্ছে মানুষটার সাথে আমি হয়ত আরেকটু ভালো ব্যবহার করতে পারতাম। হয়ত কোনদিন কাজে ব্যস্ত ছিলাম, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইচ্ছা করে তাকে উপেক্ষা করেছি। তার ভলিউম বাড়িয়ে ভিডিও দেখা নিয়ে রাগ করেছি। সে অযথা কেন ডিপার্টমেন্টে আসে এটা নিয়েও হয়ত চিন্তাভাবনা করেছি। আজ আর কিছুতেই কিছু আসবে, যাবে না।
গুড বাই ওল্ড ফেলা। হোয়্যারএভার ইউ আর নাউ, জাস্ট রেস্ট ইন পিস।
মন্তব্য
আহ্
অসাধারণ!
চলে যাওয়াটা আসলেই সহজ। আমরা কতো কিছুই না ভাবি।
তাইতো বলি আমার মিতা গবেষণাতে কেন এত মনোযোগী !
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
দারুণ চিত্রকল্প। প্রবাসে অনেক অচেনা মানুষও কত চেনা হয়ে যায়!
রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!
সেকেন্ড লাইফ খেলাটা সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছিলাম...
লেখাটি পড়ে ভালো লাগলছিল...কিন্তু শেষে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল...আসলেই একদিন চলে যেতে হবে সবাইকে...
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
এক টানে পড়লাম। দীর্ঘদিন পর লিখলেও খুবই মচমচে হয়েছে, শুধু ম্যাকক্লয়ের কথা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলো। কত কিছু করা বাকি জীবনে, কবে যে ফট করে মরি ...।
হাঁটুপানির জলদস্যু
শুধু মনে হচ্ছে মানুষটার সাথে আমি হয়ত আরেকটু ভালো ব্যবহার করতে পারতাম। [b][i]
অনেক কিছু নিয়েই এভাবনা আমার মনে খুব কাজ করে কিন্তু ব্যাপারগুলো আর শোধরানোর কোন উপায় থাকে না। বিবেকের কাছে মাথা নীচু করে রাখি।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
হরিষে বিষাদ.......
আসলেই তো চলে যাওয়াটাই সহজ। কেননা আমরা সবাই-ই তো এই চলে যাওয়ার রাস্তা ধরেই হাটছি আর হাঁটছি আর একটু একটু করে কমিয়ে আনছি গন্তব্যের ব্যবধানটাকে।
ভালো লাগলো লেখাটা। দূরাগত কষ্টের প্রতিধ্বণি পেলাম। ধন্যবাদ।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
ধন্যবাদ সবাইকে।
= = = = = = = = = = =
ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত
আমরা ঘুচাব তিমির রাত
বাধার বিন্ধ্যাচল।
নতুন মন্তব্য করুন