ঘুম থেকে উঠেই আজকের সকালটা কেমন যেন অন্যরকম লাগে পাপনের। প্রতি ঈদেই তার এমন হয়। আচ্ছা, সকালগুলো কি বুঝতে পারে কখন ঈদ আর কখন এমনি দিন?
আজ পাপনের অনেক কাজ। একটু পরেই গোসল করে তাকে নামাজে যেতে হবে। তারপর...? তারপর কী হবে সেটা নিয়ে পাপন একটু চিন্তিত। কাল রাতেই মা তাকে আলাদা করে ডেকে পইপই করে বলে দিয়েছে আজ নামাজ পড়েই যেন সে সোজা বাসায় চলে আসে। আজ তাদের বাসায় কোরবান হবে না। বাইরে ঘোরাঘুরির তাই কোন প্রয়োজন নেই। কোরবান না হওয়া নিয়ে পাপন তেমন দুঃখিত নয়। আসলে কোন কোরবানের ঈদই পাপন তেমন উপভোগ করতে পারে না। রনি, ইমন, খোরশেদ- ওদের বাসায় কী সুন্দর কোরবানের আগেই গরু চলে আসে, ওরা কত মজা করে গরুকে খাওয়ায়; আর পাপনদের প্রতি বছর ভাগে জ্যাঠাব্বাদের সাথে কোরবান করতে হয়, গরু যায় ওদের বাসায়। এটা নিয়ে পাপনের বাবার উপর খুব রাগ। ‘কেন, গরু আমাদের বাসায় একবার আনলে কী হয়!’ বাবা বোঝায়, গরু বাসায় আনলে অনেক ঝামেলা। গরুকে খাওয়াও, নোংরা পরিস্কার কর, তারপর কাটাকাটির হাঙ্গামা- এত ঝামেলায় আমি নাই। পাপন বোঝে, আসলে খরচ কমানোর জন্যেই আব্বা বাসায় গরু আনতে চায় না। আর ওরা তো মাত্র দুই ভাগ শুধু কোরবান করে, জ্যাঠাব্বারা পাঁচ ভাগ। গরু ওদের বাসায় যাওয়াই স্বাভাবিক। এবার আব্বা সেই দুইভাগের টাকাও যোগাড় করতে পারে নি!
জ্যাঠাব্বাদের বাসায় প্রতি বছর কোরবান হওয়ায় এবার পাপনের অবশ্য সুবিধাই হয়েছে। বন্ধুদের কাউকে সে জানায় নি যে তারা এবার কোরবান করছে না। খোরশেদ একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী রে, তোদের গরু কিনসে?’ পাপন ঠোঁট ফুলিয়ে গড়গড় করে মিথ্যা বলে- ‘হ্যাঁ, জ্যাঠাব্বারা তো অনেক আগেই গরু কিনে রাখসে, আমরা ওসব ঝামেলায় নাই, ঈদের দিন সোজা দুপুরে গিয়ে মাংস নিয়ে আসব’। বানিয়ে বানিয়ে গরুর একটা দামও বলে পাপন, চব্বিশ হাজার।
প্রতি বছর ঈদের নামাজ শেষে পাপনরা সবাই দল বেঁধে পাড়ার সবার গরু কোরবানী দেখতে যায়। পাপনের ভালই লাগে। সবার কী বড় বড় সাইজের গরু। এবার তো পাড়ায় আরো জমজমাট অবস্থা। মতি মিয়াদের গরুর ছবি পেপারে এসেছে, লাখ টাকা দামের গরু। ওটার কোরবানী তো অন্তত দেখতে যেতে হবেই। রনিদের সাথে সব প্ল্যান করা আছে। এখন আম্মার কথামত যদি সে নামাজ শেষে সোজা বাসায় ঢুকে পড়ে, রনিরা তাইলে সন্দেহ করবে না? নিশ্চয়ই ভাববে পাপনদের বাসায় এবার কোরবান হচ্ছে না দেখেই তার মন খুব খারাপ।
নামাজে যাওয়ার আগে মা’কে ঢিপ করে সালাম করতেই আম্মা আবার মনে করিয়ে দিল- ‘কী বলেছি পাপন, মনে আছে তো আব্বু, আজ তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো’। পাপন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। আচ্ছা, আব্বাকে কি এখন সালাম করব?- পাপন মনে মনে ভাবে। সকাল থেকেই পাপনের বাবা একটা চেয়ারে থম ধরে বসে আছেন। মার কাছে পাপন শুনেছে আব্বার নাকি আজ মন খুব খারাপ। বাসায় তাড়াতাড়ি ফেরার নির্দেশটা আসলে সে-ই জারী করেছে। পর্দা ফাঁক করে বাবাকে একটু দেখে নেয় পাপন। গত সপ্তাহে টিভিতে ‘ট্রয়’ মুভি দেখিয়েছিল। পাপন ইংরেজী বোঝে না, তবে মুভি দেখতে তার ভালই লাগে। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধে হেরে যাওয়া কোন ট্রোজান যোদ্ধা, সবকিছু হারিয়ে চিন্তিত ও বিমর্ষ। ‘বিমর্ষ’ শব্দটা পাপন নতুন শিখেছে, কিশোর পাশা মাঝে মাঝে এটা ব্যবহার করে। বাবা মনে হয় আজকে নামাজে যাবে না। নাহ, এখন পাপন বাবার মুখোমুখি হতে চায় না। সালাম তাকে পরে করলেও চলবে। দরজা দিয়ে বেরুনোর সময় মা আবার চিৎকার করে মনে করিয়ে দিল তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার জন্য। ‘উফ, মা’টা যে কী! একই কথা কতবার বলা লাগে!’
মসজিদে পেছনে বসে পাপনরা ভালই মজা করল। নামাজ শেষে সবার সাথে কোলাকুলি। রনি বলল, ‘চল, মতি মিয়ার গরুটা আগে দেখে আসি। ওখান থেকে খোরশেদদেরটা, তারপর আমাদের কোরবানী হবে’। পাপন অস্ফুট স্বরে বলল, ‘চল’। পাড়ার মসজিদে হুজুর একজনই, তিনি ঘুরে ঘুরে সব বাসায় গিয়ে গরু জবাই করেন। আজ সব বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় পাপনের সারাদিন লেগে যাবে। বাসায় গিয়ে মায়ের কাছে কী পরিমাণ বকুনি খেতে হবে সেটা ভেবে পাপন একবার চোখ বন্ধ করল, তারপর রওনা দিল।
বাসায় ফিরতে ফিরতে পাপনের প্রায় বিকেল হয়ে গেল। অন্য পাড়ায় আরেকটা বিশাল গরু কোরবানী হচ্ছিল, রনিদের সাথে সেটা দেখতে গিয়েছিল। আম্মার কাছে আজ নির্ঘাত মার খেতে হবে- কলিংবেল চেপে সারাদিনের ধুলিধূসরিত, ক্লান্ত পাপন যখন ভাবছে, এমন সময় দরজা খুলে অত্যাশ্চার্যভাবে মায়ের হাসিমুখ দেখা গেল। ‘কী ব্যাপার আম্মা, তুমি হাসছ!’। ‘আর বলিস না, তোর জ্যাঠাব্বার বাড়ি থেকে বিশাল এক ডেগচি মাংস পাঠিয়েছে, প্রতি বছর আমরা যে মাংস পাই, তারচেয়েও অনেক বেশি, এখন আমরা সব বাসায় মাংস দিতে পারব’। পাপন শুনে ঠোঁট উল্টালো। ‘ইস, ওরা কি আমাদের দয়া করে এতগুলো মাংস পাঠালো? তাহলে, আমাদেরকে ওরা কোরবানে সাথে নেয় নি কেন?’ পাপনের মনে হল তেমন হলে তো বন্ধুদেরকে আর এমন করে তার মিথ্যা বলা লাগত না। সারাদিন কী টেনশনেই না গেল। এই বুঝি কেউ ফস করে বলে- ‘তোদের বাসায় নাকি এবার কোরবান হচ্ছে না’।
বিকেলে ঘুম ভেঙে পাপন শুনতে পেল লাগোয়া ড্রইং রুমে মা যেন কার সাথে কথা বলছে। ছোট মামা এসেছে! চুপিচুপি জানালায় এসে দাঁড়াল পাপন। শুনতে পেল, মা বলছে- ‘পাপন ছেলেটা ক্লাস থ্রিতে উঠল। অথচ একটুও বুঝতে শিখল না। কাল থেকে ওকে কত করে বললাম, আমরা এবার কোরবান করছি না। তোমার আব্বার অবস্থা এখন খারাপ। তুমি নামাজ শেষে সোজা বাসায় চলে এস। কিন্তু সে আজ সারাদিন বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করে পাড়া বেড়িয়েছে। ওর আব্বা দেখে খুব কষ্ট পেয়েছে’। শুনে পাপনের চোখ ভিজে উঠল। মামা বলল, ‘পাপন কোথায়? বাসায় আছে নাকি? পা –প – ন’। ‘জ্বি মামা, আসছি’। পাপন আবার তার রুমে ঢুকে সেখান থেকে দৌড়ে ড্রইংরুমে এল। মামাকে ঈদের সালাম করতেই মামা পাপনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘পাপন, তুই তো এখন অনেক বড় হয়ে গেছিস। সবকিছু বুঝতে শিখেছিস। তোদের বাসায় এবার কোরবান হয় নি। সামনের বার হবে। তোর বাবার অবস্থা কি সবসময় এমন খারাপ থাকবে? তুই এমন অবুঝ হলে কী করে হবে, সোনা? তোকে তোর মা বলেছিল তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে। সেটা না করে তোর এমন করে বাইরে ঘুরে বেড়ানো তো ঠিক হয় নি, আব্বু’। পাপনের বুকে তখন হু হু ঝড়। কত কথাই না তার ছোট্ট মনে খেলা করছে- ‘আমি তো চলে আসতেই চেয়েছিলাম, মামা। কিন্তু আমি যদি অমন করে চলে আসি আমার বন্ধুরা তো বুঝে ফেলবে কিছু একটা হয়েছে। ওরা তখন আমাদেরকে ছোট ভাববে। আমি তো জানি, আমার আব্বা সৎ, তাই আমাদের বেশি টাকা নেই। সেজন্য এবার আমাদের কোরবান হয় নি। কিন্তু আমার বন্ধুদের কাছে আমি কীভাবে আব্বাকে ছোট করি, তাই তো আমি ওদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি। আর তোমরাও কিনা এজন্য আমাকে ভুল বুঝলে!’।
পাপনের কিচ্ছু বলা হয় না। শুধু তার অভিমানী ছোট্ট শরীরটা মামার কোলে কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠে।
মন্তব্য
ফাটাফাটি গল্প!
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
ধন্যবাদ। প্রথম লেখা হাবিজাবি গল্প এবং মনে হয় এটাই শেষ।
দুর্দান্ত গল্প, তানভীর ভাই। মেসেজটা মারাত্মক।
আচ্ছা, শব্দটা 'কোরবান', নাকি 'কোরবানী/কুরবানী', নাকি দুটোই?
ধন্যবাদ প্রহরী। আরবী মনে হয় 'কুরবান', সেখান থেকে বাংলায়- কোরবান/কোরবানী/কুরবানী ইত্যাদি।
গল্প লেখা থামাবেন না কিন্তু। নিয়মিত লিখুন।
****************
শাহেনশাহ সিমন
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
ধন্যবাদ শাহেনশাহ সিমন। নামখানা তো জটিল
মাল্যবান, আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমার কাছে মোটেও গল্প মনে হয়নি। এরকম একটা জীবন্ত গল্প আমি নিজ চোখে দেখেছি খুব কাছের মানুষের জীবনে। প্রান ছুঁয়ে গেল লেখাটা।
আবারো ধন্যবাদ।
একটা ছোট ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য আবার মন্তব্য করতে ঢুকলাম। গল্পটার চাঁদ দেখা অংশটিতে একটু অসংগতি আছে। কোরবানীর চাঁদ দশদিন আগে ওঠে। কিন্তু গল্পের শুরুতে রোজার ঈদের চাঁদের কথা বলা হয়েছে। এটুকু ঠিক করে দিলে বাকীটা দারুন।
ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। এটা কখনো খেয়াল করি নি তো এখন দেখি প্যাচ লেগে গেল। লাইনগুলো বাদ দিলাম আপাতত।
এটা শেষ গল্প হলেতো সেটা খুবি দুঃখজনক হবে তানভীর ভাই। আরো গল্প চাই আপনার।
মন ছুঁয়ে গেলো আপনার প্রথম গল্পটা।
----------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আপনার মন্তব্য পেয়ে খুব খুশি হলাম (দাঁত বের হয়ে পড়েছে)
তবে আপাতত আর গল্পের ধার মাড়াচ্ছি না। ও বাব্বা ভয় (এটা আমার ১ বছরের ভাগ্নীর ডায়লগ)
অসাধারন গল্প ! খুব ভাল লাগল ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
ধন্যবাদ এনকিদু।
নতুন মন্তব্য করুন