১।
হাতের কাছে কোনো বাংলা ব্যাকরণ বই নেই। তবে ছোটবেলায় বাংলা ব্যাকরণের যে সংজ্ঞা মুখস্থ করতে হয়েছিলো তা হয়তো সবার এখনো মনে আছে-
যে পুস্তক পাঠ করিলে বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায় তাহাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
খেয়াল করে দেখুন- শুধু বাংলায় লেখা-পড়া নয়; যে বই পড়ার ফলে আমরা শুদ্ধরূপে আমাদের ভাষায় কথাও বলতে পারি তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি কেবল তিন-চারশ বছর আগে নয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী হাজার বছর আগে বাংলা ভাষায় লিখিত ‘চর্যাপদ’ আবিষ্কার করেছিলেন। লুইপা, কাহ্নপা, শবরপারা এ ভাষায় সে সময় পদ রচনা করেছেন। অবশ্যই আজকের বাংলা ভাষার সাথে তখনকার চর্যাপদের ভাষার কোনো মিল নেই। না থাকাই স্বাভাবিক। কারণ, ভাষা বিবর্তিত হয়। তবুও সেটা বাংলা ভাষাই। আজ আমরাও যে ভাষায় কথা বলছি তাও একসময় বিবর্তিত হয়ে অন্যরূপ নেবে। কিন্তু তখনো সেটা বাংলা ভাষাই থাকবে।
চর্যাপদ বা তার আগে বা পরে লিখিত বাংলা ভাষার সাহিত্যগুলো কোনো অশুদ্ধরূপে লেখা হয় নি। তখনকার জন্য সেটাই ছিলো শুদ্ধরূপ এবং তা নিশ্চয়ই কোনো ব্যাকরণ মেনে করা হয়েছে। বাংলা ব্যাকরণ রচনার ইতিহাসও তাই হওয়া উচিত অনেক পুরনো।
কিন্তু আমাদের বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাসে তার বদলে লেখা আছে অন্য ঘটনা। বাংলা উইকিপিডিয়ায় আছে-
পর্তুগিজ ধর্মযাজক মানোএল দ্য আসসুম্পসাঁউ (Manoel da Assumpcam) বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন। ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের লিসবন শহর থেকে রোমান হরফে মুদ্রিত তাঁর লেখা Vocabolario em idioma Bengalla, e Portuguez dividido em duas partes শীর্ষক গ্রন্থটির প্রথমার্ধে রয়েছে একটি সংক্ষিপ্ত, খন্ডিত ও অপরিকল্পিত বাংলা ব্যাকরণ। এর দ্বিতীয়াংশে রয়েছে বাংলা-পর্তুগিজ ও পর্তুগিজ-বাংলা শব্দাভিধান। মানোএল ভাওয়ালের একটি গির্জায় ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালনের সময় নিজের ও ভবিষ্যত্ ধর্মযাজকদের প্রয়োজনে এই ব্যাকরণ রচনা করেন; বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটানো তাঁর লক্ষ্য ছিলো না। লাতিন ভাষার ধাঁচে লেখা এই ব্যাকরণটিতে শুধু রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব আলোচিত হযেছে, কিন্তু ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয় নি। এছাড়া পুরো আঠারো ও উনিশ শতকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় এই গ্রন্থটি বাঙালি ও বাংলা ভাষার কোনো উপকারেও আসে নি তখন।
বাংলা ভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণটি রচনা করেন ইংরেজ প্রাচ্যবিদ ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড (Nathaniel Brassey Halhed)। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের (Warren Hastings) অনুরোধে তরুণ লেখক হ্যালহেড বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনায় হাত দেন। তাঁর লেখা A Grammar of the Bengal Language গ্রন্থটি ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। এ ব্যাকরণটি অনেক কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পূর্বের পর্তুগিজ ধর্মযাজকদের মতো নিজ প্রয়োজনে নয়, নিঃস্বার্থ বুদ্ধিজীবী হ্যালহেডের ইচ্ছা ছিল বাংলা ভাষাকে একটি বিকশিত ভাষাতে পরিণত করা|
অর্থাৎ পর্তুগিজ ধর্মযাজক মানোএল বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন এবং ইংরেজ প্রাচ্যবিদ হ্যালহেড সাহেব বাংলা ভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণ রচনা করেন!!! জাতি হিসেবে আমরা এতই অধম যে আমাদের ভাষার ব্যাকরণও বিদেশীদের এসে রচনা করে দিতে হয়!
কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে বিশ্বাসযোগ্য? উইকিতেই আবার লেখা আছে মানোএল “গির্জায় ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালনের সময় নিজের ও ভবিষ্যত্ ধর্মযাজকদের প্রয়োজনে এই ব্যাকরণ রচনা করেন”। অর্থাৎ বাঙালিকে শুদ্ধরূপে লেখা-পড়া করানো বা কথা বলানো তার উদ্দেশ্য ছিলো না। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যেই বাংলা শেখার জন্য তিনি এই ব্যাকরণ রচনা করেন। বিজাতীয় হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই মায়ের পেট থেকে বাংলা ব্যাকরণ শিখে আসেন নি। সেটা তাকে এদেশের মানুষের কাছ থেকেই শিখতে হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা ব্যাকরণের অস্তিত্ব মানোএল রচনা করার আগেই এদেশে ছিলো। বাংলা ভাষাভাষী কেউ না কেউ সেটা রচনা করেছিলেন। হয়তো সেটা কোনো মুদ্রিত বই আকারে ছিলো না; ছিলো হয়তো কোনো বিধি আকারে পণ্ডিতের টোলে বা পাঠশালায় যা এখনো উদ্ধার করা যায় নি। কিন্তু তার জন্য বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনার কৃতিত্ব কোনো বিদেশীর হয়ে যায় না, যেতে পারে না!
একই কথা হ্যালহেডের ব্যাকরণের ক্ষেত্রেও খাটে। আমাদের ব্যাকরণ বইগুলিতে সম্ভবত হ্যালহেডের ব্যাকরণকেই বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ হিসেবে উল্লেখ করা আছে। যতদূর মনে পড়ে আমি হ্যালহেডের ব্যাকরণের কথাই পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে প্রথম জেনেছিলাম। সেখানে নানাভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে বাংলা ভাষায় হ্যালহেড ও উইলিয়াম কেরির অবদানের কথা বিবৃত ছিলো।
এই উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের একটা কৌশল ছিলো এখানকার মানুষগুলোকে হীনমন্য করে রাখা, যেন আমরা মনে করি ইংরেজরা ছাড়া আমরা অচল। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হয়েছিলো বিদেশী প্রভুদের পদলেহী মেরুদণ্ডহীন কিছু অনুচর তৈরীর জন্য, যার পরিবর্তন আমরা আজো করি নি। আমাদের মেরুদণ্ডহীন শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা যুগ যুগ ধরে পড়ে যাচ্ছি হ্যালহেড সাহেবের ব্যাকরণই বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ- এ আর আশ্চর্য কী। একবার চিন্তা করে দেখুন যদি কোনো জার্মান বা ফ্রেঞ্চ আপনাকে বলে যে তাদের ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেছে একজন ব্রিটিশ- সেটা কেমন অবাস্তব শোনাবে। এটা যেমন অবিশ্বাসযোগ্য একটা কথা, তেমন একটি জাতির জন্য অপমানজনকও। কিন্তু আমাদের গায়ের চামড়া যেমন মোটা, তেমনি আমাদের মেরুদণ্ডহীন শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা শিখেছি আমাদের ভাষা, আচার-আচরণ, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুর পেছনেই আছে ইংরেজদের অবদান। তারা আসার আগে আমরা নিতান্তই অসভ্য ছিলাম। আমাদের মাননীয় বিচারপতিরা অনেক কিছুতে বিব্রত হন, কিন্তু ইংরেজদের অনুকরণে জবরজং পোশাক পরে এদেশের মানুষের বিচার করতে তাদের বিব্রত হতে কখনো শুনিনি। বরং এই পোশাক-আশাক নাকি আমাদের বিচার ব্যবস্থার আভিজাত্যের প্রতীক!
২।
বাংলা ব্যাকরণ তো গেলো, এবার দেখি একটু বাংলা উপন্যাসের দিকে। একসময় যখন এক-আধটু কুইজ করতাম তখন দু’একটা প্রশ্নে এসে একটু ধন্ধে পড়ে যেতাম। এরকম একটা প্রশ্ন ছিলো- বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস কে লিখেছেন? বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস একজন বাঙালি লিখবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না, আমাদের মতো এমন উদার জাতি মনে হয় পৃথিবীতে আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস রচনার কৃতিত্বও আমরা একজন বিদেশীনিকে দিয়ে বসে আছি, 'ফুলমণি ও করুণার বিবরণ' নামে যিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন- ১৮৫২ সালে যা প্রকাশিত হয়।
এই ইংরেজ ভদ্রমহিলার নাম হানা ক্যাথেরিন মুলেন্স। মিস মুলেন্সের স্বামী কোলকাতায় ডাক্তার হিসেবে কাজ করতেন (একজায়গায় লেখা আছে ম্যাজিস্ট্রেট) আর তিনি কোলকাতার ব্রিটিশ মিশনারীর সাথে এদেশে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের কাজে জড়িত ছিলেন। ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বইয়ের মূল দুই চরিত্র ফুলমণি ও করুণা ছিলেন এদেশীয় দুই খ্রীষ্টান যাদের সাহচর্য মিস মুলেন্স পছন্দ করেছিলেন এবং তাদের বিবরণ প্রচারের মাধ্যমে এদেশীয় মহিলাদের মধ্যে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে মিস মুলেন্স তার এই বই লেখার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন-
ধর্ম্মপুস্তক পাঠ করিলে আমরা দেখিতে পাই যে পরমেশ্বর প্রাচীন ধার্ম্মিক লোকদের চরিত্র বর্ণনাকরণ দ্বারা আপন মণ্ডলীস্থ লোকদিগকে বিশেষরূপে শিক্ষা দেন, তাহাতে যেন তাহারা ঐ ধার্ম্মিক ব্যক্তিদিগকে নিদর্শন স্বরূপ জানিয়া তাহাদের ন্যায় সদাচারী হইতে চেষ্টা করে। ইহা জ্ঞাত হইয়া আমি বিবেচনা করিলাম যদি উক্ত খ্রীষ্টিয়ানদের চরিত্রের বিষয়ে কিঞ্চিৎ লিখি তবে ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদে বঙ্গদেশস্থ ভগিনীরা তাহা পাঠ করিয়া পারমার্থিক লাভ ও সন্তোষ পাইতে পারিবে। এই অভিপ্রায়ে আমি এই ক্ষুদ্র পুস্তক রচনা করিতেছি।- ফুলমণি ও করুণার বিবরণ, হানা ক্যাথেরিন মুলেন্স, ১৮৫২।
অর্থাৎ বঙ্গদেশের মহিলাদের মধ্যে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশেই তিনি এই ক্ষুদ্র পুস্তক রচনা করেছিলেন। কোনো সাহিত্য রচনার জন্য নয়।
বইয়ের বিভিন্ন অংশে মুলেন্স বাইবেলের বাণী উদ্ধৃত করে ফুলমণি ও করুণার ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যেমনটা বিভিন্ন ধর্মপ্রচারণামূলক গ্রন্থে আমরা দেখে থাকি। এদের মধ্যে ফুলমণি ও তার পরিবার ছিলো আদর্শ খ্রীষ্টান। অন্যদিকে করুণা ছিলো ‘মন্দ’ খ্রীষ্টান। ফুলমণির আদর্শ ও মুলেন্সের প্রভাবে করুণা কীভাবে ‘সত্য’ খ্রীষ্টান হয়ে ওঠে বইটিতে মুলেন্স তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। বইয়ের এক পর্যায়ে ফুলমণির পরিবার সম্পর্কে মুলেন্স লিখেছেন-
বাঙ্গালাদেশে যদ্যপি এই পরিবারের মতো সকল খ্রীষ্টিয়ান লোক ধার্ম্মিক হইতো, তবে দেব পূজকদের মধ্যে আমাদের ধর্ম্ম অবশ্য সুগ্রাহ্য হইতে পারিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে অনেক ভক্ত খ্রীষ্টিয়ান লোকেরা হিন্দু মুসলমানের ন্যায় মন্দ আচার-ব্যবহার করিয়া খ্রীষ্টের নামে কলংক দেয়।
হিন্দু মুসলমানের ন্যায় মন্দ আচার-ব্যবহার করিয়া খ্রীষ্টের নামে কলংক দেয়!! কী দুষ্টু
‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বইয়ের দু’টি ইংরেজী ভার্সন আছে। প্রথমটি প্রকাশিত হয়েছে ১৮৬৫ সালে লন্ডন থেকে। নাম- Faith and victory: a story of the progress of Christianity in Bengal.
অন্যটি আমেরিকার প্রেসবাইটেরিয়ান চার্চ কমিটি প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক ও ফিলাডেলফিয়া থেকে ১৮৬৭ সালে- ‘Life by the Ganges, or, Faith and victory’
‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ যে একটি ধর্মপ্রচারণামূলক বই, কোনো সাহিত্যগ্রন্থ নয় ইংরেজি নাম দুটো থেকে আরো পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। এ বইটি বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি পেলে ‘মক্কা-মদীনার পথে’ বা ‘শ্রী শ্রী অনুকূলচন্দ্রের বিবরণ’ জাতীয় বইগুলোকেও উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন।
৩।
আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এমন আরো অনেক বর্জ্য মিশে আছে যা অপসারণ করা জরুরী। ভাষার মাসে সব শহীদদের জন্য রইলো শ্রদ্ধা।
মন্তব্য
আমি রিজোনিংটা বুঝতে পারছি না।
প্রথমত ভাষার অস্তিত্ব ছিলো এটা নিয়ে তর্ক চলে না। কিন্তু ভাষা থাকা এবং সেটার একটা লিখিত ব্যাকরণ নীতিমালা থাকা কিন্তু ভিন্ন জিনিস। ব্রিটিশদের আগে এটার অস্তিত্ব ছিলো এরকম প্রমান পাওয়া যায়নি। এখন যেহেতু প্রমান নেই সেহেতু আগে কিছু ছিলোই এরকম মনে করা যায় না। ব্যাকরণ বই ছাড়াও গদ্যপদ্য রচনা করা খুবই সম্ভব।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ব্যাকরণ আদপেই ভাষার অনেক পরে আসে। যেমনভাবে কথ্য ভাষার অনেক পরে লিখিত ভাষা আসে। উপন্যাস বস্তুটা ঠিক কি ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে তার ওপরেই নির্ভর করছে কাকে প্রথম উপন্যাসকার বলা যাবে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ব্রিটিশদের আগে পর্তুগীজ ধর্মযাজক মানোএল বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছেন এটা উইকির সূত্রে পোস্টেই উল্লেখ করা আছে।
রিজনিংটা জটিল কিছু না। পর্তুগীজ ধর্মযাজক যদি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলা শেখার জন্য রূপতত্ত্ব-বাক্যতত্ত্ব সম্বলিত বাংলা ব্যাকরণ বই লিখে যেতে পারেন, তবে তার আগে শত শত বছর ধরে যারা বাংলা সাহিত্যচর্চা করেছেন তারা কেউ ব্যাকরণ জানতেন না বা ব্যাকরণ মেনে সাহিত্য রচনা করেন নি বা কেউ ব্যাকরণ লিখে যান নি এমনটা বিশ্বাসযোগ্য না। ইতিহাসবিদ/নৃতত্ত্ববিদরা বাংলাভাষী রচিত কোনো ব্যাকরণ উদ্ধার করতে পারেন নি বলে প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনার কৃতিত্ব কোনো বিদেশীকে দিয়ে দেওয়া যায় না।
আর ব্যাকরণ শুধু শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে পারার বিষয় নয়। সংজ্ঞামতে শুদ্ধরূপে বলতে পারারও বিষয়। বিদেশীরা এসে ব্যাকরণ রচনা করার অর্থ হচ্ছে তারা বাংলা ব্যাকরণ রচনা করার আগে এদেশে কেউ শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষায় কথাও বলতে পারতো না!
শাফি।
তথ্যবহুল লেখা। ভালো লাগলো।
প্রথম বাংলা ব্লগটা কার লেখা? এই প্রশ্ন জাগছে মনে।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
প্রথম কমিউনিটি ব্লগ সামহয়্যার ইন। সেখানে প্রথম লেখা সম্ভবত এর অন্যতম ডেভেলপার ইমরানের, তবে তারও আগে আরো অনেকে ব্লগস্পটে বাংলা লিখেছে।
না। ইমরান তখনো সম্ভবত সামুতে যোগ দেয়নি। হাসিন ছিলো তখন। প্রথম ব্লগটা ছিলো দেবোরা'র [সৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে]।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
কীসের মধ্যে কী!
সামহোয়্যার তৈরি হওয়ার আগে থেকেই আমার ব্লগস্পস্টে একটা ব্লগ ছিল। শুধু আমার না এইখানে যারা প্রাগৈতিহাসিক ব্লগার তাদের প্রায় সবারই ছিল।
যুবরাজের ব্লগের কথাও ভুলিনি।
তাসনীম ভাই
তথ্যবহুল লেখা। ভালো লাগলো।
facebook
আরেকটা ব্যাপার হয়তো পোস্টে উল্লেখ করা দরকার ছিলো। গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন ১৪৪০ সালের দিকে। এই মুদ্রণযন্ত্র ইয়োরোপীয়ানদের মাধ্যমেই এদেশে আসে এবং তা এদেশীয়দের হাতেও আসে অনেক পরে। যে ব্যাকরণ বইগুলোর কথা আমরা জানি বা ব্যাকরণ বইয়ে পড়ি সেগুলো ছিলো মুদ্রিত ব্যাকরণ গ্রন্থ। প্রথম মুদ্রিত ব্যাকরণ এক্ষেত্রে বিদেশীদের হাতে রচনা হওয়া স্বাভাবিক যেহেতু মুদ্রণযন্ত্র তাদের কাছে বেশি সহজলভ্য ছিলো। কিন্তু মুদ্রণ মাধ্যম আসার আগে এদেশে ব্যাকরণের যে চর্চা ছিলো তার উল্লেখ কোনো ব্যাকরণ বইয়ে বা আমাদের ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায় না, যেটা থাকা উচিত ছিলো।
ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে জানতে পারলাম পৃথিবীতে প্রথম ব্যাকরণ রচনার ইতিহাস শুরু হয়েছে এ অঞ্চলেই। ব্যাকরণবিদ পাণিনি খ্রীস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে প্রথম সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করেন। একই সময়ে গ্রিসেও শুরু হয় প্লেটোর মাধ্যমে। [The first attempts to study grammar began in about the 4th cent. B.C., in India with Panini's grammar of Sanskrit and in Greece with Plato's dialogue Cratylus. সূত্র]
বাংলা ভাষা/লিপি যেহেতু সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত, কাজেই আদি বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃত ব্যাকরণের কাছাকাছি ছিলো বা সংস্কৃত ব্যাকরণ মেনে চলত এমন ধারণা করা যায়। হ্যালহেড বা মানোএলের ব্যাকরণকে তাই বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বলার কোনো কারণ দেখি না।
এভাবে চিন্তা করে দেখেন বস। ব্যাকরণের অস্তিত্ব, আর ব্যাকরণ গ্রন্থের অস্তিত্ব দুইটা আলাদা জিনিস। ব্যাকরণ শুধু ভাষার নিয়মগুলোকে সাজাতে চেষ্টা করে, যেসব জিনিস সাজানো যায় না, সেগুলোকে বেয়াড়া হিসেবে ক্লাসিফাই করে। বাংলা ভাষা যেহেতু ছিলো, সেই ভাষার নিয়মও ছিলো, শুধু সেই নিয়মগুলো গ্রন্থিত ছিলো না। এখন আপনি যদি বলেন, ইয়োরোপীয়দের আগেও লিখিত ব্যাকরণ গ্রন্থ ছিলো, আপনাকে লোকে বলবে, থাকলে তুমি নাম বলো। কিংবা দেখাও। থাকতে পারে, সে সম্ভাবনা তো অবশ্যই প্রশস্ত, সে নিয়ে গবেষণাও করা উচিত। কিন্তু যতদিন খুঁজে পাওয়া না যাচ্ছে, ততদিন পাদ্রিবাবাজিদের গ্রন্থটা প্রথম গ্রন্থের মর্যাদা পাবে।
বাংলা ভাষা ঠিক সংস্কৃতের সরাসরি জাতক না। বেশ দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তবে বাংলায় তৎসম অংশ রয়েছে। সংস্কৃত ব্যাকরণ কিন্তু খুবই খতরনাক এবং ভিন্ন কিসিমের।
ইংরেজিও ল্যাটিনের কাছে নানাভাবে ঋণী। কিন্তু ইংরেজি ব্যাকরণ আর ল্যাটিন ব্যাকরণে প্রচুর তফাত আছে (আমি দুইটাই এককালে শেখার চেষ্টা করেছিলাম দেখে বলছি, আন্দাজে না)। এখন ল্যাটিন ব্যাকরণ দেখিয়ে সেটাকে ইংরেজি ব্যাকরণের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে দেখানো যায় না।
পোস্টের মূল কথা আসলে এটাই। আমরা যা জানি, আমাদের যা জানানো হয়েছে তার বাইরে আরো কিছু থাকতে পারে, থাকা উচিত এবং সেটা নিয়ে যাদের গবেষণা করা উচিত তারা উদাসীন বলেই আমাদের পাদ্রীবাবাজিদের নাম নিতে হয়।
বাংলা ভাষা সংস্কৃতের সরাসরি জাতক না হতে পারে। কিন্তু যতদূর জানি প্রাচীনকালে বাংলা শেখার বিষয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিলো। তার বদলে সংস্কৃত শেখার চল ছিলো। বাংলা শিখলে বা এ ভাষায় কথা বললে "রৌরব নরকে যেতে হবে" এমন ধরনের কথাবার্তাও কোথায় যেন পড়েছি। তাই ধারণা করছি প্রাচীনকালের বাংলা ভাষাভাষীরা টোলে সংস্কৃত ব্যাকরণ অধ্যয়ন করতেন এবং বাংলায় যে যৎসামান্য সাহিত্য রচনা হতো তাতে সংস্কৃত রীতিনীতিই প্রয়োগ করতেন। তবে পুরো ব্যাপারটাই যেহেতু অনুমান, নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না; তবে ব্যাকরণের চর্চা যে ছিলো তা পাদ্রিবাবাজিরা পয়দা করে নি, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
তামিল ব্যাকরণ আরো পুরোনো হওয়া উচিত। লিঙ্ক পেলে জানাবো।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
পেলাম। খ্রীষ্টপূর্ব কোনও শতকে লেখা তামিল ব্যাকরণ বই তবে এটা নিয়ে বিতর্ক আছে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ইন্টারেস্টিং। ধন্যবাদ।
এই সংজ্ঞাটাকে আমার সঠিক বলে মনে হয় না। কোন ভাষার ব্যাকরণ বই পড়লেই সেই ভাষা শুদ্ধ করে লিখিতে, পড়িতে ও বলতে পারার কোন নিশ্চয়তা নেই। বরং বলা যেতে পারে, "যে বইয়ে কোন ভাষা শুদ্ধরূপে লিখিবার, পড়িবার ও বলিবার নিয়মাবলী থাকে তাকে ওই ভাষার ব্যাকরণ বলে"। এটাও প্রেসক্রিপটিভ গ্রামার হয়ে যায়, সবচেয়ে ভালো হত, যদি বলা হত, "যে বইয়ে কোন ভাষার নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ থাকে, তাকে ব্যাকরণ বলে"।
ভাষার নিয়মগুলো আগে থেকেই ছিলো, সেটা মানুষের মনে। এভাবে বলা যায় ডেসক্রিপটিভ গ্রামার (ভাষাটা যেমন) আগে থেকেই ছিলো। প্রেসক্রিপ্টিভ (ভাষাটা যেভাবে বলতে হবে) গ্রামার বিদেশীদের হাতে লিখিত হতেও পারে। কিন্তু ডেসক্রিপ্টিভ গ্রামার নেটিভ স্পিকারের আগে অন্য কারো পক্ষে পাওয়া সম্ভব না।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
সংজ্ঞা আপনারটাই হয়তো সঠিক। কিন্তু আমাদের ব্যাকরণ বইগুলোতে সম্ভবত অমন কিছুই লেখা আছে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
'ফুলমণি ও করুণার বিবরণ' এইখান থেকে সবাই ডাউনলোড করতে পারবেন। পইড়া আপনাদের মতামত জানান।
ইন্টারমিডিয়েটে ঠাডায়া মুখস্ত করে বাংলা দ্বিতীয় পত্রে ৭৬ পাইছিলাম।
বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাস, পাতিহাস, নিয়মকানুনের কিছুই আমি জানি না।
৭৬ তো প্রায় লেটার মার্ক! খাইছে
তথ্যবহুল এবং ভাবনা উসকে দেওয়া লেখা ।
ভালো লাগল ।
বাংলা ভাষা বিষয়ক এরকম আরও কিছু লেখা চাই ।
ভালো থাকবেন ।
যদি বুঝে থাকি তাহলে একদমই একমত নই। কন্টেন্ট এবং টোন দুটোতেই।
আমার মতে স্রেফ জাতীয়তাবাদী আবেগ দিয়ে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য বদলানো যায় না - এবং সেটা বদলানোর দরকারও নেই। বদলাতে হলে নতুন তত্থ্য-প্রমান লাগে, লজ্জাবোধ যথেষ্ট নয়।
১। হাজার বছর আগেও বাংলা ছিল বলে তখন থেকেই লিখিত ব্যাকরনের অস্তিত্ত্ব থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। ব্যাকরন ভাষার অনেক অনেক পরেও আসতে পারে। ব্যাকরন ভাষার কিছু নিয়ম-কানুনের বিশেষায়িত বিবরণ, যে নিয়ম-কানুন কোন বিদেশি একটা ভাষা শিখে নিয়ে তারপর তার প্রথম লিপিবদ্ধকারী হতেই পারেন - আমি তাতে অসম্ভব কিছুই দেখছি না। এতে কিন্তু একথা মোটেই বলা হয় না যে তিনিই ঐসব নিয়ম-কানুন উদ্ভাবন করেছেন!
আমার তো মনে হয় পৃথিবীতে আজো এমন ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে যার কোন লিখিত ব্যাকরন নেই বা অন্য কেউ তৈরি করে দিয়েছে। অনেক ভাষা আছে যাদের এমনকি নিজস্ব বর্ণমালাও নেই, কিংবা অন্য কারো কাছ থেকে থেকে ধার করা বর্ণমালা দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশেই মনে হয় আছে। খোদ ইংরেজি বর্ণমালাই রোমান বর্ণমালা থেকে নেয়া, যেটা কিনা আবার গ্রীক ঐতিহ্য থেকে পাওয়া, যেটা আবার সম্ভবত এশিয়াবাসী ফিনিশীয়দের বর্ণমালাভিত্তিক। ইউরোপের বেশির ভাগ ভাষার বেলাতেই এটা সত্য। এতে আমার জানা মতে কেউ ক্ষুব্ধ নয়, কারন আমরা কেউই বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ বা গ্রহ নই - শেষমেশ সবাই বিশ্বব্যাপী মানবসভ্যতার বিবর্তন ও মোজ্যাইকের অংশ। এটা লজ্জার নয়। গর্বের বলেও মনে করা যেতে পারে।
২। ম্যানোয়েল আর হ্যালহেডের কীর্তি বড়জোর খানিকটা আফসোসের বিষয় হতে পারে যে আমরা আগেই এই কাজটা কেন করলাম না, কিন্তু তারা বিদেশি হয়ে এটা করে ফেলার কারনে তা কোনমতেই আমাদের জাতি হিসেবে 'অধম' বলে প্রমাণ করে না। পৃথিবীর সব জাতি আর সভ্যতাই ইতিহাসের ধারায় বহু লেনদেন, ধারদেনা আর গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় তো ফরাসী সহ ইউরোপের অনেক ভাষারই অপূরণীয় অবদান রয়েছে - তো সেই জন্য কি ইংরেজরা লজ্জায় অধোবদন হয়ে সেই সব অবদান ছুঁড়ে ফেলে দেয় নাকি অস্বীকার করে, নাকি বর্জন করে রোমান বর্ণমালা? ইংল্যান্ড তো একসময় রোমান সাম্রাজ্যের উপনিবেশ ছিল - তো সেই জন্য কি তারা তাদের সংস্কৃতিতে গ্রেকো-রোমান ঐতিহ্য/অবদান অস্বীকার করে নাকি তাতে লজ্জা পায়?
৩। ম্যানোয়েল আর হ্যালহেডের আগে বাঙালির লেখা বাংলা ব্যাকরন পাওয়া যায়নি বলেই তাঁদের পুরোধার সম্মান দেয়া হচ্ছে। কোন ইচ্ছাপূরণের কল্পনা দিয়েই তাঁদেরকে এই জায়গা থেকে সরানো যাবে না - প্রমাণ লাগবে!
৪। আমি যদ্দুর জানি আমাদের আইন ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে ইংলিশ কমন ল। ভারতসহ বেশির ভাগ সাবেক বৃটিশ উপনিবেশই স্বাধীনতার মুহূর্ত থেকে এই ভিত্তিটাকে বহাল রেখেছে - এবং সেটা এমনি এমনি, হেলাফেলা বা কোন প্রচণ্ড গোলামি মানসিকতার কারনে না! তাছাড়া আমার ধারনা অপ্রয়োজনে এক ধাক্কায় চাকা নতুন করে আবিষ্কার করার কোনও প্রয়োজনও নেই। কমন ল-র মূল কথা মনে হয় প্রিসিডেন্স ও ট্রাডিশন। আমাদের বিচারকরা এখনো বিচার করতে গিয়ে শত বা শতাধিক বছর আগের বৃটিশ বিচারকদের রায়ের প্রিসিডেন্স টানেন বা টানতে পারেন। এটা পারেন কারন সেই ধারাবাহিকতাতেই তাদের আইনব্যাবস্থা স্থাপিত এবং এটা জরুরী। এত কিছুর পর আমার মনে হয় না সামান্য পোষাক নিয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে খুব বেশি কিছু অর্জিত হবে। যাহোক আমি আইনবিদ না - সুতরাং এবিষয়ে বেশি কিছু বলতে গেলে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী হয়ে যেতে পারে। মোদ্দা কথা বিচারকদের পোষাকটা এই মুহূর্তে আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন ইস্যু বা জাতীয় মর্যাদা অবমাননাকারী কিছু বলে মনে হচ্ছে না।
৫।
কথাটা মনে হয় পুরোপুরি ঠিক না। সস্তা কুইজ বই থেকে শুরু করে স্কুলের পাঠ্যবই হয়ে সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে বই পর্যন্ত আমি অন্তত আজ পর্যন্ত সব জায়গাতেই প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালকেই এই কৃতিত্ত্ব দিতে দেখেছি। এই মুহূর্তে সেসব রেফারেন্স হাতের কাছে নেই বলে আপাতত দিতে পারছি না। তবে আপাতত নেটের এইসব জায়গাতে দেখুন - ১, ২। বাংলাপিডিয়া এই কৃতিত্ব দিচ্ছে ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায়ের 'নববাবুবিলাস' (১৮২৫)-কে। কেউ কেউ কালীপ্রসন্ন সিংহকেও দেন। আবার অনেকে স্ট্রেইট বঙ্কিম থেকেই শুরু করতে চান। আবার আপনি যেটার কথা বলেছেন সেটারো উল্লেখ দেখছি কোন কোন জায়গায়। মোদ্দা কথা এটা কোন চন্দ্রসুর্যের উদয়াস্ত বা মাধ্যাকর্ষনের মত সায়েন্টিফিক ফ্যাক্টের বিষয় না, বরং সাহিত্যিক বিতর্কের বিষয় - সুতরাং মতভেদ থাকবেই। আছেও। এবং সবগুলি পয়েন্ট অফ ভিউই এক্ষেত্রে কমবেশি ভ্যালিড। এটা ক্ষোভের কোন বিষয় হতে পারে না।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হল - 'উপন্যাস' (novel) নামক আঙ্গিক/ঘরাণাটাই তো আমরা ইউরোপীয়দের থেকে আমদানি করেছি। প্রথম বাংলা উপন্যাসের কৃতিত্ব দিয়ে এটা তো ঢাকা যাবে না। এমনকি বাংলা গদ্যও প্র্যাক্টিকালি বৃটিশ যুগের ও প্রভাবের অবদান - এমনকি কমা পর্যন্ত! হ্যাঁ, সামান্য 'কমা'-ও আমরা ধার করেছি এইমাত্র ২০০ বছর আগে মনে হয়। তো? আমরা অধম হয়ে গেলাম তাতে ? নাকি এই স্বীকৃতিগুলি দিয়ে ফেল্লেই আমরা অধম হয়ে যাব? উত্তম হতে হলে অস্বীকার করতে হবে? বৃটিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মানরা নেয় নাই গ্রীস আর রোম থেকে? গ্রীস আর রোম নেয় নাই ইজিপ্ট, ফিনিশিয়া, লেভান্ট, মেসোপটেমিয়া থেকে? তারা অধম হয়ে গেছে তাতে করে? নাকি তারা লজ্জিত এজন্য ? এসব নেয়ার কথা তারাই বরং বড়মুখ করে আমাদের জানাচ্ছে মুক্তকণ্ঠে! তাদের গবেষকরা এগুলি না বের করলে অনেক ক্ষেত্রে আমরা জানতেও পারতাম না, বা দেরি হত অনেক। তারা কি হীণমন্য হয়ে গেছে এতে করে?
উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে নতুন প্রানের সঞ্চার ও কথিত 'বঙ্গীয় রেনেসাঁ' প্রায় পুরোপুরিই ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান আর শিল্পসাহিত্যের প্রভাবে ও অনুপ্রেরণায়। এই প্রভাবটা কোন-না-কোন ভাবে না থাকলে আমরা সম্ভবত অনেক দিন পর্যন্ত উপমহাদেশীয়-মধ্যযুগেই আটকে থাকতাম - নিদেনপক্ষে রামমোহন রামমোহন হতেন না, ইশ্বরচন্দ্র ইশ্বরচন্দ্র হতেন না, মাইকেল মাইকেল হতেন না, বঙ্কিম বঙ্কিম হতেন না আর রবীন্দ্রনাথও ঠিক 'রবীন্দ্রনাথ' হতেন না! আর এই রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আমাদের পরবর্তীকালের এবং এখনকার ভাষা ও সাহিত্যের চেহারাটা ঠিক কেমন হত তা মাথায় আসছে না কিছুতেই। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বীকারে কোন কুন্ঠা বোধ করেননি, এবং তাতে তার রবীন্দ্রনাথত্ব কিছুমাত্র কমে যায়নি ।
আর শুধু ভাষা-শিল্প-সাহিত্যে প্রভাব কেন, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে আধুনিক সব রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আদর্শ - জাতীয়তাবাদ, কমিউনিজম ও গণতন্ত্র সমেৎ সবকিছুই তো প্রায় ইউরোপ থেকে নিয়েছি আমরা (বিজ্ঞানের কথা এ প্রসঙ্গে নাহয় বাদই দিলাম!!! আর্কিমিডিস থেকে শুরু করে স্টিফেন হকিং পর্যন্ত সবই তো ওদের!)। এমনকি মায় যে 'জাতিরাষ্ট্র' বাংলাদেশে আমরা এখন বসবাস করি সেই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ধারণাটা পর্যন্ত। তো সামান্য ব্যাকরণের বই বা প্রথম উপন্যাসের কৃতিত্ব নিয়ে আমাদের যদি "অধম" হতে হয়, তাহলে এতকিছুর পরে তো আমাদের রীতিমত মরেই যাওয়া উচিত লজ্জায় আর হীণমন্যতাবোধে !
কিংবা পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞানবিজ্ঞান-শিল্পসাহিত্য যার সুফল আমরা ভোগ করি বা করতে চাই সেসবের ইতিহাস পালটে দিয়ে সেখানে বাঙালির নাম ঢুকিয়ে দিয়ে নতুন ইতিহাসের (বা মীথের) বই রচনা করা উচিত - আমাদের জাতীয় মর্যাদাবোধ ও মেরুদণ্ড রক্ষার খাতিরে।
আমার তরফ থেকে আমি এটুকু বলতে পারি যে - আমি এরকম 'মর্যাদা' চাই না। আমার মনে হয় এইরকম আত্নমর্যাদা বাদ দিয়েও আত্নমর্যাদাশীল হওয়া যায়, মেরুদণ্ডবান হওয়া যায়। অতীতের কোন অপ্রিয়, অনাকাঙ্খিত বা অপ্রত্যাশিত সত্যকে অস্বীকার করার মাধ্যমে নয়, বরং সেরকম কিছু থাকলেও সেটা স্বীকার করে নিয়েই উজ্বলতর ভবিষ্যত নির্মানের মাধ্যমেই সেটা কেবল সম্ভব। অন্য কিছুতেই সেটা সম্ভব না। তাছাড়া সব প্রভাব ও অবদান স্বীকার করে নিয়েও ভাষা ও সাহিত্যে আমাদের নিজস্ব অনেক অর্জন তো আছেই - কোনকিছুতেই সেগুলি বাতিল হয় না এবং "তারা আসার আগে আমরা নিতান্তই অসভ্য ছিলাম" এটাও প্রমান হয় না। যে দেশের কবি সেই মধ্যযুগেই, বৃটিশরা আসার ব-হু আগেই বলতে পারেন - সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই - সেই দেশকে মনে হয় না অত সহজে "নিতান্তই অসভ্য" বলা যাবে!
সত্যি কথা। তবে সেসব করা দরকার শক্ত তথ্য-প্রমান আর যথাযথ গবেষনার মাধ্যমে, শুধু আবেগের মাধ্যমে নয়। তবে এই ভাষা আন্দোলনের মাসে আমাদের মহান ভাষা সৈনিকদের কাছ থেকে একটা উল্লেখযোগ্য শিক্ষা নেয়া উচিত, আর সেটা হল - আমাদের রাষ্ট্রভাষার দাবীটা কিন্তু অন্য কারো কৃতিত্ব, অবদান, প্রাপ্য, অধিকার, ইত্যাদিকে অস্বীকার করা বা স্বীকার করতে লজ্জা পাওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। ছিল না কোন রকম এথনিক শভিনিজম বা হীণমন্যতার উপর। এমনকি এটা উর্দু বা ইংরেজির বিরুদ্ধেও ছিল না! ছিল স্রেফ নিজের স্বাধিকারবোধ ও আত্নমর্যাদাবোধের উপর। সে জন্যেই তাঁরা তৎকালীন পাকিস্তানে মাত্র ৭%-এর নেটিভ ভাষা উর্দুর বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৪% জনগনের ভাষা বাংলা হওয়া সত্বেও বাংলাকে একমাত্র নয়, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবেই দাবি করেছিলেন শুধু। আমাদের জন্য আজও এইটুকু আত্নমর্যাদাবোধ বা মেরুদণ্ডই যথেষ্ট।
মন্তব্যের ঘরে এত বড় রচনা লিখে ফেলার জন্য দুঃখিত।
****************************************
ভিন্নমতের জন্য ধন্যবাদ। তবে আপনার তুলনাগুলো মনে হয় ঠিকঠাকমতো হলো না।
১। ইংরেজী বর্ণমালা যেমন রোমান বর্ণমালা থেকে এসেছে আমাদের লিপিও তেমনি সংস্কৃত থেকে পাওয়া, আবার এদের সবগুলোর শেকড় একই জায়গায়। ইংল্যান্ড রোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো সে বহুযুগ আগে। তত আগে রোমান থেকে তারা যা পেয়েছে তা তারা নিতেই পারে। আমরাও কি প্রাচীন সভ্যতাগুলো থেকে অনেক কিছু নেই নি? কিন্তু এদেশে ইংরেজ এসেছে কেবল ১৭৫৭ সালের আশেপাশে। এতপরে এসে তারা সবকিছুর প্রথম দাবীদার- ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক এটাই পোস্টে বলতে চেয়েছি।
২। আমাদেরকে 'অধম' হিসেবে তুলে ধরাই ছিলো ইংরেজদের লক্ষ্য- এখন সেটা আপনি হয়তো নাও ভাবতে পারেন। তাতে কিছু এসে যায় না।
৪। আমেরিকাও একসময় ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিলো। কিন্তু এখানে কেউ ইংরেজের জবরজং পোশাক পরে বিচার করে না বা কোর্টে 'মাই লর্ড' 'মাই লর্ড' বলে চেঁচায় না। ব্যাপারটা হলো ঔপনিবেশিক মনমানসিকতার।
৫। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম তথ্য দেয়া আছে। সবর্শেষ বিসিএস প্রশ্নমালায় লেখা আছে- "বাংলা কথ্যভাষার আদি গ্রন্থ কোনটি?"
(ক) প্রভু যিশুর বাণী (খ) কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ (গ) ফুলমণি ও করুণার বিবরণ (ঘ) মিশনারি পটিয়া
আমার বক্তব্য ছিলো এখানে 'ফুলমণি ও করুণার বিবরণ'কে কি আদৌ উপন্যাস বলা যায় যেটা অনেক জায়গাতেই প্রথম বাংলা মুদ্রিত উপন্যাস হিসেবে বলা হচ্ছে। বইয়ের লিংক দেয়া আছে উপরে। পড়ে নিজেই যাচাই করে দেখুন না
বিশাল মন্তব্যের জন্য আবারো ধন্যবাদ
ধৈর্য সহকারে বিশাল মন্তব্যটা পড়ে জবাব দেয়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ। তবে আপনার কাছে আরেকটু ধৈর্য চেয়ে নিচ্ছি শেষ একটা প্রতিমন্তব্যের জন্য।
১। প্রাচীণকালে কিছু পেলে সেটা গ্রহণযোগ্য আর আধুনিককালে পেলে গ্রহণযোগ্য না বা নিতে পারব না - এমন যুক্তি আমার কাছে ঠিক গ্রহণযোগ্য মনে হল না। তাছাড়া প্রাচীণকালও প্রাচীনকালে আধুনিককালই ছিল। আপনার যুক্তি মতে সেসময়ও তাহলে মানুষের অন্য সংস্কৃতির কিছু গ্রহণ করা উচিত ছিল না। এই চিন্তা করলে আজকে আমাদের হতো কোন বর্ণমালাই থাকত না। মূল কথা, যেটা নেই সেটা আমরা নিতেই পারি। যে কোন সময়।
২। ইংরেজরা সবকিছুরই প্রথমত্বের দাবিদার এমনটা তো আমি কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আপনিও কোন রেফারেন্স দেননি। আপনি ব্যাকরনের যে উদাহরণ দিয়েছেন - সেটা বাস্তব তথ্যপ্রমানের ব্যাপার, ভিন্নতর প্রমান থাকলে ওদের কোন দাবিদাওয়াই এখানে কখনই হালে পানি বা পালে বাতাস পাবে না। ম্যানোয়েল আর হ্যালহেডের আগে কোন বাঙালির লেখা বাংলা ব্যাকরনের বাস্তব প্রমান/নমুনা আবিষ্কার করতে পারলে তখন আর কিছুই লাগবে না। তার আগে পর্যন্ত ওদের উপর হাজার রাগ/অভিমান করেও কোন লাভ হবে না। আর এসব দাবি ওদের না - আমাদের গবেষকদেরও।
উপন্যাসের ব্যাপারটা তো অনেকখানিই দৃষ্টিভঙ্গিগত এবং উপন্যাসের কে কোন সংজ্ঞা গ্রহণ করে তার উপর। এটা ঠিক তথ্যের ব্যাপার না। তার উপর দাবিটা মনে হয় আমাদের গবেষকদেরই, তাই না? সাহিত্যের ব্যাপারে এমন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি কারো থাকতেই পারে। সেটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। এ্মন আলোচনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশেষজ্ঞের মতামতই মনে হয় শুধু গুরুত্বপূর্ণ। "কথ্যভাষার আদি গ্রন্থ" বলতে কেবল 'উপন্যাস' বোঝায় না।
****************************************
"প্রাচীণকালে কিছু পেলে সেটা গ্রহণযোগ্য আর আধুনিককালে পেলে গ্রহণযোগ্য না বা নিতে পারব না " - এমন কিছু এখানে বলা হয় নাই। কী বলা হয়েছে সেটা আমার ধারণা আপনিও বুঝতে পেরেছেন।
নতুন চিন্তার উদয় হল মনে
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
চিন্তার উদ্রেক করার জন্যই এই পোস্ট
নতুন মন্তব্য করুন