তানভীর ইসলাম
এম এম আর জালাল
স্থপতি লুই আই কান বলেছিলেন- "A room is not a room without natural light"- প্রাকৃতিক আলো ছাড়া কোন ঘরকে ‘ঘর’ বলা যায় না। ১৯৬১ সালে “Law and Rule in Architecture” শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি ব্যাখা দিয়েছিলেন-
Every space must have natural light, because it is impossible to read the configurations of a space or shape by having only one or two ways of lighting it. Natural light enters the space released by the choice of construction.[১]
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন স্থপতি লুই কানের আলো-ছায়ার কারুকাজের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। একে শুধু বাইরের নির্মাণশৈলী দিয়ে বিবেচনা করলে হবে না, এর ভেতরের প্রতিটি নকশায় রয়েছে লুই কানের আলো নিয়ে চিন্তাশীল কর্মের ছাপ; আছে সংসদ ভবনের প্রতিটি ঘরকে সত্যিকারের ‘ঘর’ হিসেবে রূপান্তরের জন্য তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই, যখন পত্রিকায় (২৩শে জুন, প্রথম আলো) [২] জানতে পারি সরকার জাতীয় সংসদ ভবনের এই নকশা পরিবর্তন করে উত্তর ফটকটি বন্ধ করে সেখানে একটি টেলিভিশন কেন্দ্র তৈরি করছেন। শুধু তাই নয়, লুই কানের নকশা রদবদল করে কাচ ও কাঠের বিভাজন দিয়ে ইতোমধ্যে সংসদ ভবনে অসংখ্য বাড়তি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে এবং জানালা বন্ধ করা হয়েছে, যার ফলে একদা প্রাকৃতিকভাবে আলোকিত এই জায়গাটি এখন দিনের বেলা প্রায় অন্ধকার থাকে।
অথচ এমনটি হবার কোন কথা ছিলো না। আলো নিয়ে স্থপতি লুই কানের বিশদ কাজের ওপরে উরস বাটিকার (Urs Buttiker) “Louis I. Kahn: Light and Space” (১৯৯৪) [৩] শিরোনামে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন।
এ বই থেকে জানা যায় জাতীয় সংসদ ভবনের আলোকসজ্জা নিয়ে স্থপতি লুই কানের কী বিশদ পরিকল্পনা ছিলো। সংসদ ভবনের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে এর এসেম্বলি হল যাকে রিং-এর মতো ঘিরে আছে অন্যান্য কক্ষ এবং অফিসগুলো (নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য)। ১৯৬২ সালে সংসদ ভবনের নকশার দায়িত্ব পাবার পর এই এসেম্বলি হলের ডিজাইনে মূল অনুপ্রেরণা ছিলো আলো। ১৯৬৪ সালে লুই কান লিখেছিলেনঃ
In the Assembly I have introduced a light-giving element to the interior of the plan. If you see a series of columns, you can say that the choice of column is a choice in light. The columns as solids frame the spaces of light. Now, think of it just in reverse, and think that the columns are hollow and much bigger and that their walls can themselves give light. Then the voids are rooms, and the column is the maker of light and can take on complex shapes and be the supporter of spaces and give light to spaces. I am working to develop the element to such an extent that it becomes a poetic entity which has its own beauty outside of its place in the composition. In this way, it becomes analogous to the solid column I mentioned above as a giver of light (Buttiker, p. 171)
আলোর কারুকাজের মাধ্যমে লুই কান আমাদের সংসদ ভবনকে তাঁর ভাষায় একটি ‘পোয়েটিক এনটিটি’ করে তুলতে চেয়েছিলেন। সংসদ ভবনের নকশার কাজ তিনি কতটা যত্ন দিয়ে করেছিলেন তার একটা উদাহরণ হলো এসেম্বলি হলের মাঝখানে ছাতাসদৃশ যে অষ্টভুজাকৃতি ছাদ রয়েছে, শুধু এই ছাদের নকশার জন্যই লুই কান সুদীর্ঘ ১০ বছর সময় ব্যয় করেন এবং এর প্রধান কারণ ছিলো প্রাকৃতিক আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার এখানে কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটা নিয়ে নানারকম গবেষণার পর শেষ পর্যনত এই ডিজাইনটিই তাঁর মনঃপুত হয়েছিলো।
পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী সংসদ ভবনের যে অফিস কক্ষগুলো এখন দিনের বেলা অন্ধকার থাকে, সেগুলো প্রাকৃতিকভাবে আলোকিত করার জন্য ১২৮টি গ্লাস ব্লক বসানো হয়েছিলো নিচের ছবির মতো। সংসদ ভবনের মসজিদ কক্ষটিতেও ছাদ থেকে আলো আসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো।
শুধু জানালা বা ছাদ দিয়েই প্রাকৃতিক আলো আসার ব্যবস্থা করে লুই কান ক্ষান্ত থাকেন নি, সংসদ ভবনের দেয়াল, মেঝে এবং সিঁড়িগুলো থেকেও তিনি আলোর বিচ্ছুরণ ঘটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। ভবনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে নাকি সূর্যের আলো এমনভাবে পৌঁছাতো যেন মনে হতো এর দেয়ালগুলো এবং অভ্যন্তরে সূর্য রশ্মি নদীর মতো বয়ে চলেছে। দিনের বেলায় সূর্যের অবস্থান অনুযায়ী এর ভেতরের পরিবেশও পরিবর্তিত হওয়ার জন্য ব্যবস্থা নকশায় করা হয়েছিলো। বাটিকার জানাচ্ছেন-
Upon entering this intermediate zone, one is overcome by the magnificence in the play of light. Sunlight, entering through glass blocks in the roof, flows like a stream of water over the walls and into the interior. The character and the atmosphere of the common space change the daily progression of the sun (Buttiker, p. 165)
জাতীয় সংসদ ভবন শুধু পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্থাপত্য নিদর্শনই নয়, এটা আমাদের জাতীয় প্রতীক। আমাদের এই প্রতীককে প্রাকৃতিকভাবে আলোকিত করে সত্যিকারের ‘ঘর’ হিসেবে রূপান্তরের জন্য লুই কানের চেষ্টার কোন কমতি ছিলো না, কিন্তু আমাদের সরকার এবং সাংসদদের অবিমৃশ্যকারীতার দরূন আজ তা অন্ধকার এক ভবনে পরিণত হয়েছে। লুই কানের সন্তান নাথানিয়েল কানের তথ্যচিত্র “My Architect: A Son’s Journey” তে স্থপতি শামসুল ওয়ারেস বলেছিলেন “লুই কান আমাদের গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান উপহার দিয়ে এদেশে গণতন্ত্রের যাত্রার সূচনা করেছেন” [৪]।
কিন্তু লুই কান হয়ত ধারণাও করতে পারেন নি যাদের হাতে তিনি প্রিয় এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তারাই একদিন ঘরের শত্রু বিভীষণে পরিণত হয়ে এই ভবনের এত বড় ক্ষতিসাধন করবেন- যে আলোর ঝর্ণাধারা তিনি এই ভবনে সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন, তা ধুলিস্মাৎ করে একে অন্ধকার আবাসে পরিণত করবেন। আমরা জাতীয় সংসদ ভবনকে সব রকম বিকৃতি ও পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা করে অবিলম্বে স্থপতি লুই কান প্রণীত এর মূল নকশায় ফিরিয়ে আনার দাবী জানাই।
তথ্যসূত্রঃ
[১] Louis I. Kahn: The Making of a Room
[২] সংসদ ভবনের নকশায় আবার আঘাত! প্রথম আলো, ২৩ শে জুন, ২০১৩।
[৩] Büttiker U. Louis I. Kahn : Light and space, Whitney Library of Design, New York,
1994.
[৪] TED Video: Nathaniel Kahn- my father, my architect
(পোস্টে ব্যবহৃত ছবিসমূহ Fair use-এর আওতায় ‘Louis I. Kahn : Light and space’ বইটি থেকে নেয়া হয়েছে)
মন্তব্য
আমাদের জনপ্রতিনিধিরা মতিনিধির মতন মশকরা না করে মনে হয় থাকতে পারেন না।
কেন যে এদের ন্যূনতম বোধোদয় হয় না যে চাইলেই যাচ্ছেতাইভাবে সব পরিবর্তন করে ফেলা যায় না!
কতকিছু করা দরকার, কোনকিছুতে তাদের কোন গা করার লক্ষণ নাই, হতভাগা সংসদ ভবনকে বস্তি না বানালে আর চলছে না
সত্যি কথা হচ্ছে কি, এর পেছনে একটা ছোটলোকিও আছে। দু'পয়সা কামাই করার পর যখন খায়েশ মেটাতে সংসদের মতন জায়গাতে বসতে পারেন তাঁরা, তখন তাদের মনে হয় "আমরা দেশের মাথা, আমরা কড়কড়ে বৈদ্যুতিক আলো ছাড়া থাকলে ক্যাম্নেকী!"
শুভবুদ্ধির জয় হোক।
স্থাপত্য মুক্তি পাক
------------------------------------
সময় এসেছে চল ধরি মোরা হাল,
শক্ত কৃপাণে তুলি বরাহের ছাল।
হ। বৈদ্যুতিক আলো, টিভি কেন্দ্র, অফিস ঘর, কবরস্থান সবই হতে হবে এখানে!
জাতীয় সংসদ ভবনকে সব রকম বিকৃতি ও পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা করে অবিলম্বে স্থপতি লুই কান প্রণীত এর মূল নকশায় ফিরিয়ে আনার দাবী জানাই।
টু পাইস কামাবার ধান্ধা ছাড়া আর কিছুই না, কিন্তু ক্ষতি হবে আমাদের, ক্ষতি হবে শিল্পের
facebook
সংসদ সংশ্লিষ্ট আবালগুলো যদি লুই কানের থিওরি বুঝতো তাইলে তো তাদের আবাল বলা লাগতো না। এরা আদতে কিছুই বুঝে না যে কারনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন পড়ে হয়ে যান টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী! এই না বোঝার খপ্পরে পড়ে ভালো কিছু জিনিসের বাঁশ হয়ে যায়। এরা এইটা টের পান না যে কারনে রামপালে সুন্দরবনের কোনায় এদের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করলে নয়।
সংসদ ভবনের উপরে এদের নেক নজর অনেক আগে থেকেই পড়েছে। এখন আবার মেট্রোরেইল হবে সংসদের উপর দিয়ে। ভালো তো ভালো না।
মেট্রোর এই রুটটা বাতিল হয়েছে শুনেছিলাম। নিশ্চিত নই।
সংকট টা কালচারে। সাংসদদের থেকে দেশের অন্যান্য মানুষকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই খুব একটা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব স্থাপনার আমরা বােরাটা বাজিয়েছি, বাজাচ্ছি। যা হোক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
জাতীয় সংসদের পুরোনো ডিজাইনে ফিরিয়ে আনা হোক।
স্বয়ম
সবকিছু থেকে খালি পয়সা কামানোর ধান্দা খোজে তারা! শিল্পকর্ম আর তাদের নিজেদের রেড লাইট এলাকার মধ্যে যে আকাশ পাতাল ফারাক, সেটা তারা কেউ তো বোঝেই না, উল্টে কেউ বোঝাতে গেলে তাদের নড়া ধরে নেড়ে দেয়া হয়। যতসব জীবন্মৃতের দল!
আপনার জন্য -
আজেবাজে সিদ্ধান্তগ্রহঙ্কারীদের জন্য -
লুই আই কান এর জন্য -
---------------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
আমাদের এটা তো নগন্য কোন ঘর নয়, এটা ভবন! সংসদ ভবন!! ঘরের থিয়োরী এখানে চলবে না।
আব্দুল্লাহ এ এম
জুক কর্লেন কিনা বুঝতে পাল্লাম না!
অকুতোভয় বিপ্লবী'র মত করেই বলতে চাই- স্থাপত্য মুক্তি পাক!
আমরা লুই কানের এই নকশা আসলে ডিজার্ভ করি না। সংসদ ভবন হওয়া উচিত ছিলো একটা গার্মেন্টস কারখানার মতো।
মনে হয় জজেও মানবে। গরীবের মেয়ের কানে সোনার দুল বাঁচান - কঠিন, বড়ই কঠিন।
হ গার্মেন্টস। ঐখানে অনেক বৈদ্যুতিক আলো।
এভাবে ধীরে ধীরে পুরো ভবনটিকেই চতুষ্পদ প্রানিবান্ধব করে গড়ে তোলা হবে !
আগেকার কলোনীগুলোর হাত থেকে বেরিয়ে আসা দেশগুলোর একটা সাধারণ সমস্যা হচ্ছে কি রাখব আর কি ফেলব সেটা সম্বন্ধে কোন গোছান ধারণা না থাকা। অবধারিত যে এই শূণ্যতা আর দোলাচলে যেটা সহজে গোছান যায় সৃজনশীল মনগুলি সেই দিকেই গড়িয়ে যায় - নানান কিসিমের আখের গোছান। আর বাণিজ্য বায়ু বড়ই ক্ষমতা ধরে। তার নোনা ধরিয়ে দেওয়ার হাত থেকে বাঁচতে গেলে যে বিভিন্ন পুরু প্রতিরোধের আস্তর লাগাতে লাগে - চিন্তার, চেতনার, শিক্ষার, দীক্ষার সে কি সহজ কাজ! তার মধ্যে শিক্ষা আবার এক ভয়ানক দুদিকে কাটা তরবারী। বেশীরভাগ সময় প্রথমেই সে কাটে গরীব আমজনতার যে সমাজ তাকে শিক্ষিত করে তুলেছে সেই সমাজে তার নিজের শিকড়-টাকে। না হলে সে উড়বে কি করে! যে যত (অ্যাকাডেমিক) শিক্ষা যোগাড় করে, সে তত গভীরে শিকড় কাটে। আর তত সহজে উপড়ে যায় বাণিজ্য বায়ুর ধাক্কায়। কোন অনুপম স্থাপত্যকে যখন বদলে ফেলা হয়, টাকা কামানোর জন্য করছি বললে সেই বদলটা করা যায় না। তার জন্যও অনেক ‘সুচিন্তিত’ ‘সুশিক্ষিত’ যুক্তি-নীতি-অনুমিতি ইত্যাদির সাহায্য নিতে লাগে, নেওয়া হয়। এই ভয়ানক আক্রমণগুলো থেকে বাঁচার, বঁচানোর অস্ত্রটার নাম - রাজনীতি। আর আমরা কি আন্তরিক ভাবেই না সেটাকে ঘেন্না করি! যখন রাজনীতিকদের আচরণে হতাশ হই, ক্ষুব্ধ হই, গালাগালি করি একটা করুণ সত্য আড়ালে চলে যায় যে একটা অত্যন্ত জটীল, কঠিন অবশ্যকরণীয় কাজ থেকে আমরা যত্ন সহকারে সরিয়ে রাখি নিজেদের, নিজের উত্তরসুরীদের - রাজনীতি করা। সেই রাজনীতি যা বারে বারে হেলে যাওয়া সমাজকে সিধে করে।
- একলহমা
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
চুদুরবুদুর চর্চা চালানোর অন্ধকারই ভালো!
চুদুরবুদুর ডট কম এখনো চালু আছে দেখলাম!
হিমুভাইয়ের কথাই ঠিক। বাদর কিভাবে জানে মুক্তার কদর!
হ
আপনি চতুস্পদী নির্বাচন করবেন আর তাদের কাছে দ্বিপদীর আচরণ প্রত্যাশা করবেন, তাতো হয়না! এটা আপনার বড়ই অন্যায় দাবী। চতুস্পদী, ষড়পদী বা অষ্টপদীদেরকে যত বড় প্রাসাদেই রাখুন না কেন, তারা সেটাকে নিজেদের উপযুক্ত খোয়াড়েই পরিণত করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এটা তাদের 'প্রাণীজ অধিকার'-জনিত 'ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাট'-এর অধিকার। এই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত অধিকার মেনে নিন। আর নয়তো খুঁজেপেতে দ্বিপদী নির্বাচন করুন।
****************************************
হুম। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন