==১==
সৈয়দ মুজতবা আলী এর নাম দিয়েছিলেন মৌন শিখর।মানুষ মরলে সাধারণভাবে কবরে সমাহিত করা হয় বা পোড়ানো হয়। কিন্তু মাটি, পানি, আগুন এগুলো জোরোয়াস্ট্রিয়ান পার্সিদের কাছে অতি পবিত্র। তাই নাপাক দেহের সৎকারে এগুলোর ব্যবহার পার্সিদের জন্য নিষিদ্ধ। এ থেকে পরিত্রাণে তারা এক অভিনব পদ্ধতি বের করেছিলো। যেসব জায়গায় পার্সিদের বসতি রয়েছে, সেখানে লোকালয় থেকে কিছু দূরে পাহাড় চূড়া বা বনে তারা একটা স্তম্ভ বানায়। কেউ মারা গেলে পার্সিরা সেই স্তম্ভের ওপরে মৃতদেহ রেখে আসে। নিমেষে তা শকুন, চিল আর বাজপাখির খাদ্যে পরিণত হয়- টাওয়ারে শুধু কঙ্কাল পড়ে থাকে। পার্সিদের এই স্তম্ভের নাম ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’; হিন্দিতে বলে ‘চিল ঘর’ আর পার্সিরা ডাকে ‘দাখমা’।
==২==
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে ঢাকায় যেসব সিপাহী জড়িত ছিলেন তাঁদের শায়েস্তা করার জন্য ব্রিটিশরাও অনেকটা একই পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলো। পুরান ঢাকায় এখন যেখানে বাহাদুর শাহ পার্ক, তখন এর নাম ছিলো আন্টাঘর ময়দান। সেখানে সাহেবরা বিলিয়ার্ড খেলতে যেতেন। বিলিয়ার্ড বল দেখতে ডিমের মতো। মূর্খ, নেটিভরা তাই একে ডাকত আণ্ডা খেলা। আণ্ডা খেলার ঘর- আণ্ডাঘর, সেখান থেকে আন্টাঘর ময়দান। এই আন্টাঘর ময়দানে ব্রিটিশরা বিদ্রোহী সিপাহীদের সবাইকে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছিলো। তবে এখানেই শেষ নয়। মৃতদেহের সৎকারের পরিবর্তে তারা দিনের পর দিন সিপাহীদের দেহগুলি ময়দানে ঝুলিয়ে রেখেছিলো যতদিন না তারা শকুনের খাদ্য হয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিণাম কতখানি ভয়াবহ হতে পারে তারা সেদিন মানুষকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলো। বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে গেলে আমার এখনো মনে হয় এখানকার মাটিতে মিশে আছে রক্তের ছাপ, বাতাসে ভেসে আসে পচে যাওয়া মৃতদেহের গন্ধ, এই পার্কের গাছে গাছে ঝুলে আছে অসংখ্য সিপাহী আর শকুনেরা তা ঠুকে ঠুকে খাচ্ছে- এমন একটা দৃশ্য এখনো আমাকে তাড়া করে।
==৩==
ব্রিটিশদের তুলনায় আমাদের দয়ামায়া অনেক বেশি। পাকিস্তানিদের তুলনায় তো বটেই। আমরা ভুলে গেছি বাহাদুর শাহ পার্কের কথা, আমরা ভুলে গেছি মিরপুর, রায়েরবাজার, অগণিত বধ্যভূমির কথা। আমাদের ত্রিশ লক্ষ স্বজনকে হত্যা করার পরও আমরা পাকিস্তানিদের কিছু করতে পারি নি। আজ স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে যখন পাকিস্তানিদের সহযোগী রাজাকার-আলবদরদের বিচার হচ্ছে তখন এদের নেতা গোলাম আযমকে আমরা দয়াপরবশ হয়ে তার ‘বয়স’ বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে দিয়েছি! শুনেছি গোলাম আযম এখন হাসপাতালে পোলাও-কোর্মা-বরই আচার খেয়ে ভালোই দিন যাপন করছে।
পার্সিদের ‘মৌন শিখর’ নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম “Towers of Silence: Zoroastrian Architectures for the Ritual of Death”।এটা দেখে মনে হলো যদি আমাদের মেরুদণ্ড থাকতো তবে আমরা হয়ত এই রাজাকারদের জন্য একটা ‘ঘৃণার শিখর’ বানাতাম। রাজাকারদের যখন মৃত্যু হতো তখন পার্সিদের মতো এই টাওয়ারে তাদের রেখে আসতাম শকুনের খাদ্য হিসেবে। যে বাংলার স্বাধীনতা তারা অস্বীকার করেছিলো, তার মাটি অপবিত্র করার কোন অধিকার তাদের থাকতে পারে না। এই শিখর হোক বা না হোক, আমি আজীবন অন্তরে এদের জন্য একটা ‘ঘৃণার শিখর’ পুষে যাব।
মন্তব্য
আমাদের আগামী প্রজন্ম নিশ্চয়ই তা করতে ভুল করবে না !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
বেশি আশাবাদী নই।
আগামীর জন্য সব রাখলে চলবে কি করে??? আমরাই করি আসেন।
"যে বাংলার স্বাধীনতা তারা অস্বীকার করেছিলো, তার মাটি অপবিত্র করার কোন অধিকার তাদের থাকতে পারে না।"
- একলহমা
মাভৈঃ মাভৈঃ
আমি আর কিছু না পারি, আমার পরিবার, আমার সন্তানদের মনের ভেতর আসমুদ্রহিমাচল ঘৃণা তৈরী করতে পেরেছি।
ঘৃণা কাদের জন্য? আবার জিগায়!!
-------------------------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
আমি চাই সবগুলো রাজাকারকে একই জায়গায় পুতে একটা ঘৃনার স্তম্ভ বানানো হোক,যেখানে বছরে একদিন গিয়ে আমরা থু থু দিয়ে আসবো,কিংবা ছেড়া জুতো মেরে আসবো।এমন ঘৃনার স্তম্ভ করতে পারলে আগামি প্রজন্মেরশিশুরা জানবে আমরা ওই পশুগুলোর জন্যে কতটুকু ঘৃনা পুষে রেখেছিলাম,আজো আছি,চিরকালি থাকবো।আমাদের এই ঘৃণা দেখে তারা ইতিহাস জানতে আগ্রহী হবে,এবং একদিন তারাও এর চেয়ে বেশি ঘৃণা প্রদর্শন করবে আর দেশটাকে ভালোবাসতে শিখবে।
মাসুদ সজীব
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে গেলে আমার এখনো মনে হয় এখানকার মাটিতে মিশে আছে রক্তের ছাপ, বাতাসে ভেসে আসে পচে যাওয়া মৃতদেহের গন্ধ, এই পার্কের গাছে গাছে ঝুলে আছে অসংখ্য সিপাহী আর শকুনেরা তা ঠুকে ঠুকে খাচ্ছে- এমন একটা দৃশ্য এখনো আমাকে তাড়া করে।
পারসীক ধর্ম নিয়ে একটা লেখা আছে, ধর্মসার- (৪) জরথুস্ত্র ও পারসীক ধর্ম
হ্যাঁ, রাজাকরদের জন্য এটাই উপযুক্ত ব্যবস্থা।
সিরিজের কয়েকটা লেখা পড়েছিলাম আগে। এটা চোখে পড়েনি। ধন্যবাদ।
সঠিক উচ্চারণ কি 'ডখমা' হবে?
আন্টাঘর নামকরনের ইতিবৃত্ত জেনে খুব ভালো লাগলো।
আসলেই আমরা গোল্ডফিশ মেমোরীর জাতি। না হলে চার দশকের উপরে সময় লাগাই একটা অত্যাবশ্যক কাজ শুধু শুরু করতে! আর আমরাই বোধহয় শুধু পারি দয়া দেখানোর নাম করে নিজেদের পশ্চাদ্দেশ উন্মুক্ত করে দিয়ে প্রমাণিত হায়নাদেরকে পাশবিক আমন্ত্রণ জানাতে।
বলিহারি যাই।
____________________________
একমত
সহমত।
আর লেখায়
শেয়াল শকুনের খাদ্য হবারই যোগ্য এইসব নরাধমেরা।
১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০...% সহমত
সাথে আছি।
গো আযমদের কোনো শাস্তিই আমার মনপুত হয়না। সব রকমেই মনে হয় কম হয়ে যাচ্ছে। লেখার সাথে সহমত।
স্বয়ম
শকুনের মত উপকারী প্রাণীদের এরকম অপকারী ঘাতকের মৃতদেহ না খাওয়ানোই ভালো।
আন্ডাঘরের নামকরণটা মজার লাগলো।
শকুনেরা খাদ্য পেয়ে তো খুশিই হওয়ার কথা।
মনে রাখা দরকার একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরেকটা সৎকার। প্রকাশ্য মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা বা কাটা মুন্ডু ঝুলিয়ে রাখা শাস্তি হিসেবে অনেকে আগে থেকেই প্রচলিত।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
অনেক আগে থেকে প্রচলিত হলেও মধ্যযুগের পরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তেমন দেখা যায় নি। সুসভ্য ব্রিটিশরা যাদের কাছ থেকে আমরা অনেকে মনে করি সভ্যতা শিখেছি তারা এইসব আদিম কাজ-কারবার উনিশ-কুড়ি শতকেও বহাল রেখেছিলো। আন্টাঘর ময়দানে দিনের পর দিন মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখাটা অবশ্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার চেয়েও বেশি ছিলো। তখন এই বাহাদুর শাহ পার্ক আর সংলগ্ন অঞ্চল ছিলো ঢাকা শহরের কেন্দ্রবিন্দু। এমন ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়ে মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখার সভ্যতাটা যতটা না সিপাহীদের জন্য শাস্তি হিসেবে করা হয়েছিলো, তার চেয়ে বেশি করা হয়েছিলো ঢাকাবাসীকে মানসিক নির্যাতনের জন্য। এমনকি এর আশেপাশে পোগজ স্কুল বা যেসব স্কুল তখন ছিলো, বাচ্চারাও স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে এই সিপাহীদের ঝুলে থাকতে দেখত। যাই হোক, বিটিশদের সাম্প্রতিক সভ্যতার নমুনা দেখলাম তারা পাবলিক প্লেসে গায়ের চামড়া দেখে দেখে লোকজনের কাগজ-পত্র তল্লাশী করছে। ইল্লিগাল হলেই দেশে-ফেরত।
মাসুদ সজীব ভাইয়ার কমেন্টটাই আমি কপি করলাম-
-এস এম নিয়াজ মাওলা
নতুন মন্তব্য করুন