সিসিফাসের শাস্তি এবং আমাদের 'অর্থহীন' জীবন

তানভীর এর ছবি
লিখেছেন তানভীর (তারিখ: শনি, ০১/১০/২০২২ - ১২:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সিসিফাস- হোমারের 'ইলিয়াডে' বর্ণিত গ্রীক পুরাণের একটি চরিত্র। কথিত আছে, সিসিফাস ছিলো প্রাচীন এফিরিয়া বা কোরিন্থের রাজা। অনেকটা দুষ্টু রাজা বলা যায়, নিজের ভাতিঝিকে ফুঁসলানো আর প্রজা ও পর্যটকদের ওপর অহেতুক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য দেবতারা সিসিফাসের উপর ক্ষিপ্ত ছিলো। দেবতাদের রাজা জিউস যখন রাজকুমারী এজিনাকে অপহরণ করে সিসিফাসের কারণে তার বউ হেরা ও এজিনার বাপের কাছে ধরা খেলো, জিউস তখন রেগেমেগে গ্রীক আজরাইল থ্যানাটোসকে সিসিফাসের কাছে পাঠালো। কিন্তু সিসিফাস থ্যানাটোসকে বোকা বানিয়ে মরণের হাত থেকে বেঁচে গেলো। এরপর আবারো সে মৃত্যুর আগে পাতালের রাণী পারসেফানিকে ফাঁকি দিলো। কিন্তু 'দান দান তিন দান'- তৃতীয়বারে আর শেষ রক্ষা হলো না। সিসিফাসের জন্য শাস্তি ঠিক হলো- বিশাল এক পাথর তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে হবে পাহাড়ের চূড়ায়। কিন্তু সিসিফাস যখনই পাথর ঠেলে চূড়ার কাছে পৌঁছায়, পাথর নিচে গড়িয়ে পড়ে। সিসিফাস আবার নিচে নেমে পাথর ঠেলে নিয়ে যায়, আবার সেটা নিচে গড়িয়ে পড়ে। এভাবেই অনন্তকাল ধরে সিসিফাসের শাস্তি চলছে।

সিসিফাসের এই শাস্তির অভিনব এক ব্যাখা দিয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী ফরাসী দার্শনিক ও লেখক আলবেয়ার কামু তাঁর 'দ্য মিথ অফ সিসিফাস' গ্রন্থে, যা Absurdism বা অর্থহীনতা/অসামঞ্জস্যতা নামক ভিন্নধারার এক জীবন দর্শন উপস্থাপন করেছিলো। কিয়ের্কেগার্ড, নিৎশা, সার্ত্রে প্রমুখ অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মতো কামুও জীবনের কোন মানে নেই, একে অর্থবহ করার জন্য আমরাই নানা মূল্যবোধ চাপিয়ে দেই- এই ধারণা পোষণ করতেন (Life has no meaning, we are here to give it one)।

ড্যানিশ দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্ড, যাকে অস্তিত্ববাদী দর্শনের জনক হিসেবে অনেকে গণ্য করেন, তিনি জীবনকে অর্থবহ করার জন্য আমরা যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করি এবং সেগুলোর পেছনে সারাজীবন কাটিয়ে দেই তা দেখে উপহাস করেছিলেন। সোশ্যাল স্ট্যাটাস, ধর্ম, দেশপ্রেম ইত্যাদি নানা বাবল বানিয়ে, সেই বাবলে আমরা বসবাস করি। আমাদের অনেকের কাছেই জীবন মানে পড়ালেখা করে ভালো ডিগ্রি অর্জন করা, ভালো একটা চাকরী যোগাড় করা, পছন্দসই পাত্র/পাত্রী বিয়ে করা, পরকালের রাস্তা সুগম করার জন্য সময়-সুযোগমতো স্রষ্টার উপাসনা করা (আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বা দাওয়াতে গিয়ে যা যা অর্জন করলাম তা নিয়ে ফুটানি মারা চোখ টিপি ) ইত্যাদি। কিয়ের্কেগার্ডের সময়ও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। তাঁর ভাষায়- "

“As I grew up I opened my eyes and saw the real world, and I began to laugh and I haven’t stopped since. I saw that the meaning of life was to get a livelihood, that the goal of life was to be a High Court judge, that the bright joy of love was to marry a well-off girl, that the blessing of friendship was to help each other out of a financial tight spot, that wisdom was what the majority said it was, and that the fear of God was to go to communion once a year. That’s what I saw. And I laughed.” ― Søren Kierkegaard, Either/Or: A Fragment of Life (1843)

আমাদের হতাশার সাগরে ডুবিয়ে কিয়ের্কেগার্ড আরো বলেছিলেন- জীবন 'এক দিল্লী কা লাড্ডু'- যাই করো না কেন পস্তাতে হবে, বিয়ে করলে পস্তাবা, না করলেও পস্তাবা, চাকরি করলে পস্তাবা, না করলেও পস্তাবা; এমনকি বেঁচে থাকলে পস্তাবা, আত্মহত্যা করলেও পস্তাবা। এই 'Either/Or' উভয়সংকট উপস্থাপন করে কিয়ের্কাগার্ড প্রশ্ন রেখেছিলেন- "সত্তর-আশি বছর ধরে এই অর্থহীন জীবন বয়ে বেড়ানোর কী প্রয়োজন, তাৎক্ষণিক সাঙ্গ হলে ক্ষতি কী?"

আলবেয়ার কামু 'দ্য মিথ অফ সিসিফাসে' মূলত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন- "Is this life worth living?" কামু বলেছেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু সেটার জন্য এই বিশাল, নিরুত্তর মহাবিশ্বে জীবনের অর্থ খোঁজা বা নানাভাবে অর্থ আরোপ করাটাও মিনিংলেস। এই অর্থহীন বিশ্বে মানুষের নানাভাবে জীবনের অর্থ খোঁজার এই অসামঞ্জস্যতাকেই তিনি 'এবসার্ড' বলেছেন "The absurd is born of this confrontation between the human need (for meaning) and the unreasonable silence of the world." নাসার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের যে ছবি আমাদের দেখিয়েছে তাতে কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝে পৃথিবী একটা ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো। এই ক্ষুদ্র বিন্দুতে নিজেকে বড় বা গুরুত্বপূর্ণ বা কোন একটা আইডিওলজি বা ধর্ম শ্রেষ্ঠ সেটা জাহির করার মতো হাস্যস্পদ ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। কার্ল সেগান 'পেইল ব্লু ডটে' বেশ গুছিয়ে এটা ব্যাখা করেছিলেন- "Our posturings, our imagined self-importance, the delusion that we have some privileged position in the universe, are challenged by this point of pale light. Our planet is a lonely speck in the great enveloping cosmic dark."

কিয়ের্কেগার্ডের কথায় ফেরত আসি। জীবনকে শেষ পর্যন্ত তিনি হেসে উড়িয়ে দিতে পারেন নি। ড্যানিশ সমাজের প্রথা ও প্রথাগত ধর্মকে ঘৃণা করলেও, শৈশবে পিতার কাছে শেখা গসপেলের সহজিয়া বাণী তিনি ভালোবাসতেন। তাঁর ক্ষণস্থায়ী জীবনের শেষ দিনগুলিতে যীশুর বাণী তথা ধর্মকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন এবং 'Leap of faith' নামক উদ্ভট এক তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন, যেখানে বলেছিলেন 'স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক খাটানোর কোন প্রয়োজন নেই, আমাদের ত্রুটিপূর্ণ যৌক্তিকতা ও বোধবুদ্ধি বন্ধ করে স্রষ্টাই 'সম্পূর্ণ সমাধান' এই বিশ্বাস মনেপ্রাণে গ্রহণ উচিত।" বলেছিলেন, "To have faith is to lose your mind and to win god" - The Sickness unto Death (1849)

কামু তাঁর পূর্বসূরি কিয়ের্কেগার্ডের এই বোধবুদ্ধির চর্চ্চা বন্ধ করে স্রষ্টা বা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরার এই সমাধানকে ''ফিলোসফিক্যাল সুইসাইড'' বলে আখ্যা দিয়েছেন। আত্মহত্যা যেমন দৈহিক, তেমনি আমাদের মনোজগতেও হতে পারে। এই পৃথিবীতে 'শুধু দিনযাপনের, শুধু প্রাণধারণের গ্লানি' বহন করাও অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিদিন বহু লোক যেমন বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে না পেয়ে শারীরিক আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, তেমনি আরো বহুগুণ লোক জীবনকে অর্থবহ করার জন্য বোধবুদ্ধির দরজা বন্ধ করে 'বিশ্বাস'কে আঁকড়ে ধরে মানসিকভাবে আত্মহত্যা করে। আমাদের চারপাশে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে মূলতঃ উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নিজ নিজ ধর্মকে "একমাত্র সত্য" হিসেবে বিশ্বাস করে এই 'মানসিক' আত্মহত্যায় শামিল (নিৎশা এই মানসিকতাকে বলেছিলেন "Herd mentality"; ভেড়ার পাল যেমন একজন যেদিকে যায়, বাকীরা তাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে- মানুষও অন্যান্য পশুর মতোই আরেকজনের দেখানো পথ অন্ধভাবে অনুসরণ করে)। কামু আরো বলেছেন, সব ধর্ম বা বিশ্বাসের মূল বক্তব্য হচ্ছে "Obey"- কোন প্রশ্ন না করে বাধ্যগতভাবে নির্দেশ পালন করা, অর্থাৎ নিজের চিন্তাভাবনা বিসর্জন দিয়ে অন্যের দাসানুদাস হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়া।

শারীরিক বা মানসিক আত্মহত্যা কোনটাই যদি যৌক্তিক সমাধান না হয়, তাহলে উপায় কি? কামুর মতে, সমাধান হচ্ছে সিসিফাসের মতো হওয়া। কামু তাঁর গ্রন্থে সিসিফাসকে "Absurd Hero" হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন, যে দেবতাদের মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে, মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে, প্রতিদিন পাথর সরানোর মতো তুচ্ছ একটা কাজ (হাসিমুখে) করে যায় এবং সে জানে এই মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে এই কাজের কোন অর্থ নেই, তবু এই তুচ্ছ কাজটাই তার কাছে মহত্তর। সিসিফাস বিদ্রোহী, সে স্বাধীন, এবং কামু বলেছেন, তার হৃদয় এই তুচ্ছ ও অর্থহীন কাজ করেই পরিপূর্ণ। এই জীবন দর্শনই 'Absurdism'।

“I leave Sisyphus at the foot of the mountain. One always finds one's burden again. But Sisyphus teaches the higher fidelity that negates the gods and raises rocks. He too concludes that all is well. This universe henceforth without a master seems to him neither sterile nor futile. Each atom of that stone, each mineral flake of that night-filled mountain, in itself, forms a world. The struggle itself toward the heights is enough to fill a man's heart. One must imagine Sisyphus happy.” - The Myth of Sisyphus, p. 78

সিসিফাসের মতোই আমরা প্রতিদিন একাকী ফিরে যাই যে যার প্রস্তরখণ্ডের কাছে। "On this rock I'll build my church"- খেয়ালী বিধির বক্ষ বিদীর্ণ করে, বিদ্রোহী ভৃগুর মতো ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে- এই নিঃসঙ্গতা, এই তুচ্ছতা, এই অর্থহীন প্রস্তরেই তবে আমাদের জীবনের মন্দির রচিত হোক। মহাবিশ্বের ধুলিকণায় মিশে যাওয়ার আগে সিসিফাসের মতো 'তুচ্ছ দিনের গানের পালায়' সবার হৃদয় পরিপূর্ণ থাকুক।

"এই যে এ-সব ছোটোখাটো পাই নি এদের কূলকিনারা,
তুচ্ছ দিনের গানের পালা আজও আমার হয় নি সারা।
... মজেছে মন, মজলো আঁখি-- মিথ্যে আমায় ডাকাডাকি,
ওদের আছে অনেক আশা, ওরা করুক অনেক জড়ো--
আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই নে হতে আরো বড়ো।"


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।