এ সময়ের খ্যাতনামা দার্শনিক 'স্কুল অফ লাইফের' সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যালেইন ডি বটন (Alain De Botton) ভালোবাসা ও রোমান্টিসিজম নিয়ে বেশ কিছু লেখা ও বক্তৃতা আমাদের উপহার দিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস "The Course of Love"- যেখানে রাবিহ খান ও কার্স্টেন ম্যাকলেল্যান্ড এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে ভালোবাসার গতিপ্রকৃতি বটন দারুণভাবে চিত্রিত করেছেন। মানুষ যেহেতু ভালোবাসার আইডিয়াগুলো গল্প-উপন্যাস থেকে পায় বলে বটন মনে করেন, মূলত সে কারণে 'ভালোবাসা' নিয়ে তিনি এই উপন্যাস লিখেছেন বলে জানিয়েছেন। বটনের "জীবন স্কুলে"র একজন উৎসুক অনুসারী হিসেবে ভালোবাসা নিয়ে বটনের দৃষ্টিভঙ্গী জানার প্রচেষ্টা থেকে এই লেখা।
শুরুতে রোমান্টিসিজম (Romanticism) নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। রোমান্টিসিজম ইউরোপে ১৮ শতকের প্রায় শেষ দিকে আরম্ভ হওয়া একটি শৈল্পিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা যা মূলতঃ মানুষের আবেগ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে উঠেছিলো। বটন তাঁর বিভিন্ন লেখা ও বক্তৃতায় দাবী করেছেন, গত আড়াইশ' বছর ধরে শিল্প, সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের বহুল চর্চ্চা 'ভালোবাসা' সম্পর্কে নানারকম 'মিথ' আমাদের স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়েছে, যা ভালোবাসা বিনষ্ট করতেও ভূমিকা পালন করছে। সতের শতকের ফ্রেঞ্চ দার্শনিক রশফুকোর উক্তি বটন বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করে বলেছেন- "কিছু মানুষ 'ভালোবাসা' বলে যে একটা জিনিস আছে যদি কখনো না শুনতো, তারা কখনো প্রেমে পড়ত না!"
There are some people that would have never fallen in love if they had never heard there was such a thing. ~ Francois La Rochefoucauld.
বটনের মতে পৃথিবীর সব মানুষ এখন রোমান্টিসিজমের উত্তরসূরী। ভ্যালেন্টাইন'স ডে বা ভালোবাসা দিবসকেও রোমান্টিসিজমের বাইপ্রডাক্ট বা নির্দিষ্ট করে বাণিজ্যিক উপজাত বলা যায়। এই রোমান্টিসিজম 'ভালোবাসা' নিয়ে যেসব মিথ তৈরি করেছে বলে বটন দাবী করেছেন তার কয়েকটি এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো-
১) আগের দিনে বিয়ে হতো মোটামুটি প্র্যাকটিক্যাল কারণে, বটন যাকে বলেছেন ম্যারেজ অফ রিজন (Marriage of Reason)। দুই পরিবারে মধ্যে সম্পদ,জায়গা-জমি নিয়ে কলহ, মেয়ের বাবা বিশাল প্রভাবশালী বা ধনাঢ্য ব্যক্তি অথবা দুই পরিবার একই ধর্মীয় ব্যাখায় বিশ্বাসী- এগুলো ছিলো মূলত বিয়ের অনুঘটক। আমাদের দেশের অ্যারেঞ্জড ম্যারেজগুলোও আবহমানকাল থেকে এভাবে হয়ে এসেছে। বটন বলছেন, এসব বিয়েতে সঙ্গীকে ভালোবাসতে হবে এমন কোন দায় ছিলো না। কিন্তু রোমান্টিসিজম আমাদের শিখিয়েছে পৃথিবীতে একমাত্র আদর্শ বিয়ে হলো ভালোবাসার বিয়ে। এই সমাজে এখন আপনাকে বিয়ের আগে একজন সৌলমেইট বা অন্তরের সাথী অবশ্যই খুঁজে পেতে হবে। সৌলমেইট হলো সেই যাকে দেখে আপনার মনে ফিলিং বা অনুভূতি জাগ্রত হয়। এই ফিলিং আপনাকে হাটে-মাঠে-ঘাটে খুঁজে পেতে হবে। তাও যদি না পান খুঁজতে হবে ফেসবুক, টিন্ডার, ইন্সটাগ্রামে। তারপর বিয়ে- বটন যার নাম দিয়েছেন ম্যারেজ অফ ফিলিং (Marriage of Feeling)। রোমান্টিসিজমের উপহার এই ম্যারেজ অফ ফিলিংয়ে বিয়েতে আগে যে প্র্যাকটিক্যাল বা অর্থনৈতিক কারণগুলো ছিলো সেগুলো এখন ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে। ম্যারেজ অফ রিজনে ভালোবাসার অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন জটিলতার উদ্ভবে ম্যারেজ অফ ফিলিংয়ের প্রসার ঘটলেও, এখানে প্র্যাক্টিক্যালিটির অভাব রয়েছে বটনের মতে।
২) কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন, 'অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!' পৃথিবীতে এর চেয়ে কোন সত্যভাষণ উচ্চারিত হয়েছে কিনা জানা নেই। কিন্তু আবুল হাসানের মতো আমাদের সবারই সেটা জানতে দেরি হয়ে যায়। কারণ, রোমান্টিসিজম আমাদের শিখিয়েছে আপনি যদি সৌলমেইট পেয়ে যান, আপনার সব একাকীত্ব নিমেষে দূর হয়ে যাবে। অন্তরের সাথী আপনাকে অন্তর দিয়ে বুঝতে পারবেন। সারাক্ষণই আপনি তার সাথে কলকাকলীতে মুখর থাকবেন। কিন্তু বটন বলেছেন, যে মানুষ নিজেই নিজেকে বুঝতে পারে না, সেখানে অন্য আরেকজন তাকে সম্পূর্ণভাবে বুঝে ফেলবে, তার সর্বক্ষণের সাথী হবে- এমন রোমান্টিক ভাবনা অবান্তর। মানুষকে একাকীত্বের ভার সারাজীবন বয়ে যেতে হবে।
৩) রোমান্টিসিজম আমাদের ধারণা দিয়েছে ভালোবাসার কাছে সৎ হতে হবে, মানে হলো সমস্ত উজাড় করে দিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, সবকিছু উজাড় করে দেয়ার পর, সেখানে আর নতুনত্ব কিছু থাকে না। চতুর্দশ শতকের ইংরেজ কবি জেফ্রি চসার (Geoffrey Chaucer) সেই কত আগে ১৩৮৬ সালে দ্য ক্যান্টারবেরি টেইলসে লিখে গিয়েছিলেন- "Familiarity breeds contempt" (Tale of Melibee). বেদ ও ঈশপের গল্পেও একই কথা বলা আছে। আপনি যত নিজেকে অন্যের কাছে এক্সপোজড করবেন, তত একজন বোরিং মানুষে পরিণত হবেন। বটনও তাই বলেছেন, হানিমুন পিরিয়ডে যা ভীষণ আনন্দময় মনে হয়, কিছু সময় পরে সে আনন্দ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
সমস্ত উজাড় করে দিলে কী হতে পারে তা মনে হয় বেশ বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 'দুর্বোধ' কবিতায় তাঁর আকুতি-
"তুমি মোরে পার না বুঝিতে?... দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা, তাই মোরে বুঝিতে পার না?" ব্যাখা দিয়ে কবি আরো বলেছেন, যদি এটা মণিমুক্তো হতো তবে এক একটা করে গেঁথে গলায় হার পরিয়ে দেয়া যেত, বা যদি শুধু ফুল হতো তবে তুলে এনে কালো চুলে পরিয়ে দেয়া যেত।
কিন্তু, "এ যে সখী, সমস্ত হৃদয়। কোথা জল, কোথা কূল, দিক হয়ে যায় ভুল, অন্তহীন রহস্যনিলয়।"
অবশেষে অভিমানে হার মেনে কবি বলেছেন,
" নাই বা বুঝিলে তুমি মোরে!...
আধো প্রেম, আধখানা মন--
সমস্ত কে বুঝেছে কখন?"
৪) মানব-মানবীর সম্পর্ক একটা পবিত্র ব্যাপার এমন ধারণা সমাজের আদিযুগ থেকে নানা উপায়ে মানুষকে দেয়া হয়েছে। রোমান্টিসিজম যুগের আগে বিবাহ-বহিভূর্ত সম্পর্ক নিয়ে ধর্মীয় ও আইনি বাধ্যবাধকতা ছিলো এবং অনেক জায়গায় এখনও আছে। যেমন- দোররা বা পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা ইত্যাদি। বটন বলেছেন, রোমান্টিসিজম ধারার শিল্প-সাহিত্য এর সাথে ইমোশনাল প্রেশার বা মানসিক চাপও যুক্ত করেছে। ফরাসি উপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লবার্ট রচিত মাদাম বভারি (Madame Bovary) অথবা লিও টলস্টয়ের অ্যানা কারেনিনা এর অন্যতম উদাহরণ। ম্যাডাম বভারিতে রোমান্টিকতা নিয়ে আপ্লুত এমাকে এক বোরিং ডাক্তার চার্লস বভারি বিয়ে করে, কিন্তু দৈনন্দিন দাম্পত্যজীবনের একঘেঁয়েমিতে আক্রান্ত মিসেস এমা বভারি রোমান্টিকতার খোঁজে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে নানারকম জটিলতা দেখা দেয় এবং শেষমেষ এমাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। এরকম উদাহরণ আমাদের চারপাশে অসংখ্য রয়েছে, বটন যার দায়ভার রোমান্টিসিজমকে দিয়েছেন।
৫) প্রেম-ভালোবাসা সবসময় খুব সুন্দর, রোমান্টিক পরিবেশে হবে রোমান্টিসিজম এমন একটা চিত্র আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময়, সমুদ্রের বালুকাবেলায় কিংবা সুন্দর কোন রিসোর্টে কোটি কোটি যুগল ছবি বা সেলফি তোলা মানেই এখন প্রেম। বটন বলছেন, রোমান্টিকতার জন্যে ব্যাকগ্রাউন্ডে যে এই সুন্দর দৃশ্যপট থাকতে হবে রোমান্টিসিজমের যেসব শিল্পী বা সাহিত্যিক এই ধারণা গড়ে তুলেছেন বাস্তব জীবনে এরা প্রায় সবাই ছিলেন বেকার অথবা আনএমপ্লয়েবল। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে তো আর কবি-সাহিত্যিকদের মতো রোমান্টিক বেকার থাকা সম্ভব না। কাজেই, এখানেও মূলত প্র্যাকটিক্যালিটির অভাবে ভালোবাসা নিয়ে একটা মিসকনসেপশন গড়ে উঠেছে।
৬) বটন বলেছেন- আমরা প্রকৌশলী, চিকিৎসক, অধ্যাপক, পুলিশ, ব্যবস্থাপক ইত্যাদি নানা কিছু হই দীর্ঘদিনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। কিন্তু আমরা প্রেমিক/প্রেমিক হয়ে যাই কোন শিক্ষা প্রচেষ্টা ছাড়া শুধুমাত্র 'ফিলিং' অবলম্বন করে! বটন ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছেন- "love is a benevolent process whereby two people try to teach each other how to become the best versions of themselves." কিন্তু এই শিক্ষাব্যবস্থায় সতর্কবাণীও দিয়েছেন, একজন ওস্তাদ শিক্ষকের ক্লাসে কোন শিক্ষার্থী চলে গেলে শিক্ষক তার তোয়াক্কা করে না। কিন্তু ভালোবাসার শিক্ষাদানে বিপত্তি ঘটলে শিক্ষার্থী মানে প্রেমিক/প্রেমিকা ভেগে যেতে পারে।
মোটাদাগে এগুলোকেই বটন রোমান্টিসিজমের তৈরি ভালোবাসার মিথ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে বটন একটা ছোট চেকলিস্টও দিয়েছেনঃ
ক) ভালবাসতে গেলে সবাই নরমাল, পার্ফেক্ট মানুষ খোঁজে। বটন বলছেন, পৃথিবীতে এ ধরনের কোন মানুষ নেই। মানুষকে আপাতদৃষ্টিতে বাইরে থেকে ভদ্রস্থ দেখা গেলেও প্রতিটি মানুষই আসলে উন্মাদ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এটাই মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। কাজেই বটনের মতে ডেটিং এর প্রথম বাক্য হওয়া উচিত "How are you crazy?" নিজেদের ঘাটতি স্বীকার করে নেয়া মানুষেরাই দীর্ঘমেয়াদে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারে।
খ) ভালোবাসার মানুষের সাথে ধ্যান-ধারণা সবকিছু মিলবে, সবকিছু বুঝতে পারবে, একাকীত্ব দূর হবে- এমন ভাবনা অবান্তর। বটন বলছেন এমন মানুষের কোন অস্তিত্ব নেই। বরং নিজেদের মধ্যে পার্থক্যগুলো যারা বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার সাথে বুঝে চলতে পারে, তারাই একে অন্যের সাথে বেশি মিলতে পারে। The person who is truly best suited to us is not the person who shares our tastes, but the person who can negotiate differences in taste intelligently and wisely. রিলেশনশিপে কারো একাকীত্বের মাত্রা যদি ৪০% এর আশেপাশে থাকে, তবে বটন বলেছেন সেই রিলেশনশিপ সফল।
গ) ভালোবাসায় প্র্যাকটিক্যালিটি থাকতে হবে। অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিকগুলো খোলামেলা আলোচনা করতে হবে, শুধু 'ফিলিং' দিয়ে ভালোবাসা বেশিদিন টিকে থাকবে না। প্রবাদে আছে, 'অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়'।
ঘ) সবশেষে, বটন ভালোবাসাকে ফিলোসফি অফ পেসিমিজম বা হতাশাবাদিতার দর্শন থেকে দেখতে আহবান করেছেন। ভালোবাসার শুরুতে আমাদের এক্সপেক্টেশন অনেক বেশি থাকে- পার্টনার খুব পার্ফেক্ট হবে, মুখে কিছু না বললেও সবকিছু বুঝে নিতে হবে, কখনোই কোন যন্ত্রণার কারণ হবে না, ইত্যাদি। কিন্তু একটা সময় পরে দেখা যায় শুরুতে এই এক্সপেক্টেশন পূরণ হলেও, কিছুদিন পরে আর হচ্ছে না। তখন মতবিরোধ শুরু হয়, অনেকে নতুন পার্টনার খোঁজে। বটন বলছেন এই প্যাটার্ন ইউনিভার্সাল। এর সমাধান হচ্ছে হতাশাবাদিতার দৃষ্টি থেকে দেখা যে এমনটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঘটবেই। বটন এই পেসিমিজমকে বলছেন- a form of kindness that you can give to your partner. তিনি আরো বলেছেন, হাতভাঙা একটা অচেনা লোককে দেখলেও আমরা দয়ার্দ্র হই, তার জন্য দরজা ধরে দাঁড়াই। আপনার পাশে ভাঙা হৃদয় নিয়ে যে আছে, তাকে কেন দয়া দেখাবেন না? মানুষকে অবাধ্য শিশুর সাথে তুলনা করে বলেছেন, দেখতে বড়ো দেখালেও মানুষ আজীবন শিশুই রয়ে যায়।
কবিগুরু বলেছেন, 'আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান'। রোমান্টিসিজমের তৈরি ভালোবাসার বিষ পান করতে চাইলে সেটা জেনেশুনেই করুন।
বিজ্ঞাপন/আমিষুলপনাঃ
মাতৃভাষায় আমার প্রথম বই "আমেরিকার গল্পঃ ব্লেস ইয়োর হার্ট" পাওয়া যাচ্ছে একুশে বইমেলা জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর ১২ নং প্যাভিলিয়নে
এবং অনলাইনে বাতিঘর ও রকমারিতে।
গুডরিডস রিভিউ
মন্তব্য
৫ম পয়েন্ট টা সেই ছিল !
ভাল লাগল ।
নতুন মন্তব্য করুন