বাক্সবন্দী জীবন-৪

তানভীর হাসান এর ছবি
লিখেছেন তানভীর হাসান [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/১০/২০০৯ - ২:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত কয়েকদিন মাঝে মাঝেই সচলে উকি দিয়ে যাই, কি হচ্ছে, আর অনেক কিছুই ভাবি দেশপ্রেম, রেসিজম, নিজেকে নিয়ে, ভবিষ্যত নিয়ে, ক্যারিয়ার নিয়ে…। তারপর আবার কাজে নেমে পড়ি, প্রব্ললেম সল্ভ করি, বাকি সময় আড্ডা মারি কলিগদের সাথে। ও বলা হয়নি আমি এখন কাবুল, আফগানিস্তান।


ভয়াবহ বাজে নেট স্পীড নিয়ে তার অপটিমাইজিং এর নতুন নতুন থিওরী বের করি। কিংকু চৌধুরীর ইস্নিপ্সের ফোল্ডার থেকে কিভাবে ডাউনলোড করব, দেখি আপডেট আর্সেনাল আর চেলসির খেলায় কে জিতল। চেলসির জয় হলে আর্সেনালের সাপোর্টারদের দেয়ালে চিকা মারি। আবার সময় পেলেই ভাবতে বসি। দেশপ্রেম, রেসিজম, বিয়ে, ক্যারিয়ার, এম এস।
দেক্তে বসি HBO, StarMovies.


দেশে মোটামুটি ভাল অঙ্কের রেমিটান্স পাঠাই। কেন পাঠাই? আমি দেশ প্রেমিক বলে? চিন্তা করে দেখলাম নাহ, পাঠাই টাকাটা দেশে খরচ করব বলে। যখন দেশের চাক্রী ছেড়ে দিয়ে বাইরে আসলাম কামলা দেয়ার জন্য, দেশপ্রেমে দেশ ছেড়েসিলাম বলে মনে হয় না। দেশ ছেড়েসিলাম নিজের জন্য, ভাল চাক্রীর জন্য, পৃথিবী ঘুরে দেখার জন্য, নতুন অভিজ্ঞতার জন্য, নিত্য নিতুন খাবার চেখে দেখার জন্য। তাই বলে আমি ডলার পাঠাই বলে যে ভাব নেই না বন্ধুদের কাছে তা কিন্তু না। ঠিকি মাঝে মাঝে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেই যে, আমি দেশের জন্য অবদান রাখসি, যেখানে তোরা টাকা বাইরে পাঠাচ্ছিস, বিদেশী জিনিশ কিনে, বিদেশে পড়তে গিয়ে টাকা পাঠাচ্ছিস। অর্ধেকের বেশি ফ্রেন্ড দেশের বাইরে। তারা কতজন ফেরত যাবে জানি নাহ। ব্রেইন ড্রেইন।। দেশে এত ব্রেইন যে, কেও ভেবে কুল পাই নাহ এগুলা নিয়ে কি করবে…। সময় পেলেই রাজনীতিবিদদের গনহারে গালি দেই। শালারা দেশ ধংস করে ফেলতেসে। নিজে ঠিকি সুবিধাবাদীদের মত এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়সি যেখান থেকে ৪ বছরে বের হওয়া যায়।

কোন বন্ধুকে রাজনীতিতে ঢুক্তে দেখলে আগ বাড়িয়ে বলেছি, রাজনীতিতে যাস নাহ, তোর ফিউচার শেষ হয়ে যাবে। তারপর বূয়েটের শহীদ মিনারে বসে দেশ চিন্তাই মেতে রাজনীতিবিদদের গালি দেই শালারা সব ধংস করে ফেলতেসে।


রেসিজম। বাংলাদেশের সবথেকে বড় রেসিস্ট মনে হয় নিজেকে মাঝে মাঝে। আমাদের ৩ তলা বাসার নিচতলায় থাকত এক হিন্দু পরিবার। পুজ়োর ভোগ প্রায় আসত আমাদের বাসায়। আসার পর আম্মুর দেখার আগেই যতদুর খেয়ে ফেলা যাই, কারন পুজোর খাবার থালা ফেরত যাবার পরেই ফেলে দিত আম্মু। খালাত বোন কাল হলে মা, খালাদের সাথে কথা শুনে চিন্তা করতাম হায় হায় এর তো বিয়ে হবে নাহ। স্কুলে পছন্দ করতাম সব থেকে ফর্সা মেয়েটাকে কারণ সেই সবথেকে সুন্দর। সারাদিন রোদে ঘুরে বেরানোর পর পাশের বাসার আন্টির চিন্তার সাথে মাঝে মাঝে একাত্ততা ঘোষনা করতাম ছোট বেলার খেলার সাথীর জন্য, কারণ সে কাল হয়ে যাচ্ছে। দেশের একমাত্র মুস্লিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। সেখানে কোন ফরেইনারের উলটা পালটা কাজ দেখলে প্রথম যে গালিটা দিসি সেটা হল “শালা কাল্লু।”


প্রথম বৈদেশিক চাক্রী নাইজার। সেখানে উপলব্ধী করলাম, কালোরাই বোধহয় আমাদের সবথেকে সম্মান করে। শুধু গায়ের রঙের কারনে উপলব্ধী করলাম, ঠিক সলুশান দেয়ার পরও আমারটা গৃহিত হোল নাহ। নতুন করে উপলব্ধী হোল।

মিশরে চাক্রীর সময় আবার নতুন করে উপলোপধী করলাম কিভাবে তারা বাংলাদেশিদের দেখে। শুধু বাংলাদেশিদের ভিসা দেয়া বন্ধ পুরো মিডল ইস্টে। দুবাই, সৌদী, বাহরাইন। কারণ আমরা বাংলাদেশি। আমরা লেবার। দুবাই এ কোন হোটেল ভিসা প্রসেস করে নাহ বাংলাদেশী শুনে।


সারাজীবন শুনে এসেছি তালেবানরা খারাপ অথবা আমেরিকা খারাপ। কাবুল একটা সেরা শহর ছিল ২৫ বছর আগেও। আজ বোধহয় শুধু কংকাল্টাই পড়ে আছে। লোকাল কলিগদের জিজ্ঞেস করলাম, তালেবান্দের তোমরা প্রটেস্ট কর নাহ কেন? উত্তরতা বড় অদ্ভুত লাগল। তালেবান বলে যাদের সাথে ফাইট করসে আমেরিকা তা আসলে বিভিন্ন ওয়ারলর্ড। একেক্টা প্রোভিন্স একেকজন দখল করে বসে আছে। একেকজন কে মদদ দিচ্ছে একেক্টা দেশ। আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর পিছে আছে ইরান। হোসেইনির পিছনে ইরান।


আবার কাজ করি, আবার মুভি দেখি, প্রেমিকার সাথে গল্প করি, আবার ভাবতে বসি, দেশচিন্তা, রেসিজম, ফেসবুকিং করি, আবার সচলে আসি ঘুরে ফিরে, মন্তব্য, প্রতিমন্তব্য দেখি, হাসি, মন খারাপ করি, তবু আসি। দেখি বেশ ভাল কিছু চিন্তা ভাবনা, কিভাবে দেশকে সামনে নিয়ে যাওয়া যায়, কেম্নে রাজনীতিবিদদের গালি দেয়া যাই, দেখি কোন শাড়িটা পছন্দ করলো, নতুন কি কি জবের সার্কুলার আস্ল। নতুন ম্যুভি রিভিউ। শেয়ার মার্কেটের কত লস খেলাম। নতুন আই ফোনটাকে কবে হাতে পাব।

জীবনে বোধহয় এমন একটা জায়গায় চলে গেসি, যেখান থেকে বলা যায়…
‘nothing else matters”


এই লেখাটা লেখার সময় দরজাটা ভীষনভাবে কেপে উঠল। পরে একটা জোরালো আওয়াজ শুনলাম। নিরাপত্তা বাহিনী খবর পাঠাল আজকে হোটেল থেকে বের হওয়া যাবে নাহ, ইন্ডিয়ান এম্ব্যাসী আক্রান্ত। খবর শুনলাম, আবার কাজে নেমে পড়লাম, কোন কিছুতেই কিছু এসে যায় নাহ। বেচে আছি, এইটাই বড় কথা। আর উপলব্ধি করলাম, ঠিক তেমনি ভাবেই রেসিজম, দেশ নিয়ে আমরা যত চিন্তা, মারামারি, গলাগলি করি, তাতে কিছুই এসে যাবে নাহ কাল মেয়ের বিয়ের চিন্তাই কপালে ভাজ পড়ে যাওয়া বৃদ্ধের অথবা মাসের শেষের সেই ছাত্রের যার প্রধান চিন্তা কবে টিউশানীর টাকাটা পাওয়া যাবে। অথবা সেই প্রবাসীর যে ১০ বছর পর ঢাকাতে এসে জামে আটকে বলবে “ This city has expired”

জীবন চলবে তার নিজের গতিতেই…

০৮-১০-২০০৯


মন্তব্য

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

ভাল্লাগছে ।পার্থের গানের লাইন মনে পড়ে গেল "তবু জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে"-

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

অবাঞ্ছিত এর ছবি

চলুক

__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...

__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...

তানভীর হাসান এর ছবি

গানটা এবং ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। ধন্যবাদ মানিক ভাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

তানভীর ভাই
একে বারে সত্য কথাটা বলছেন

‘nothing else matters”

আসলেই সত্য

রেশনুভা এর ছবি

চমৎকার। লেখা দিয়ে তো আমাদেরই কাঁপায় দিলা। দেঁতো হাসি

মামুন হক এর ছবি

ভালো থেকো ভাই। লেখা ভাল্লাগ্লো। সাবধানে চলাফেরা কোর।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আপনার লেখা কিন্তু অনেক সুন্দর। যেভাবে অবলীলায় ভাবপ্রকাশ করলেন- খুব সহজিয়া সুরে, সহজ কাজ না সেটা...।

আর আমরা সকলেই বর্ণবাদী, এটার থেকে উত্তরণ আদৌ সম্ভব নাকি জানা নাই। ভালো থাকেন...।

---------------------------------------------------------------------------

মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক

তানভীর হাসান এর ছবি

@ অবাঞ্ছিত, অতিথি ধন্যবাদ
@মামুন ভাই ... সাবধানেই আছি... যতটা থাকা যায়
@রেশনুভা ভাই---- দেঁতো হাসি
@সুহান- ধন্যবাদ

রায়হান আবীর এর ছবি

সুপার লেখা। জয় আইইউটি দেঁতো হাসি


পুচ্ছে বেঁধেছি গুচ্ছ রজনীগন্ধা

তানভীর হাসান এর ছবি

আবার জিগস... চোখ টিপি

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

চলুক ...


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- কুষ্টিয়াতে নাকি চট্টগ্রামে আছে না একটা 'ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়'! তাইলে আইইউটি একমাত্র মুস্লিম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামনে হয়?

বাক্সবন্দী জীবনের কথা শুনতে ভালোই লাগে। আমার এক ফ্রেণ্ড আছে, আফগান। আমরা বলি পাঠানের পো। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। যাইহোক, গোল্লাগুল্লি না থাকলে কাবুল যাওয়ার পিলান আছে। আপনে কয়দিন থাকবেন?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তানভীর হাসান এর ছবি

মুস্লিম বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বুঝিয়েসি যেখানে শুধুমাত্র মুসল্মানেরাই পড়াশনা করতে পারে... কুস্টিয়াতে অমুস্লিম্রাও পড়তে পারে শুনেছি।

আফগান আছি ২ মাসের মত। চলে আসেন... দেঁতো হাসি

Rifat Sanjida এর ছবি

ধুগো দা ,চট্টগ্রামেরটি "আর্ন্তজাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়"(Int'l Islamic University Chittagong) বে-সরকারী...তবে এখানেও অমুসলিমদের ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধ নেই| ধন্যবাদ!

রেজওয়ান এর ছবি

ভাল লাগল। নিয়মিত লিখবেন আর সাবধানে থাকবেন।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

তানভীর হাসান এর ছবি

ধন্যবাদ...

_প্রজাপতি এর ছবি

চমৎকার লাগে আপনার লেখাগুলো ।
সাবধানে থেকেন আর বাইরে ঘুরাঘুরি না করে বেশী বেশী সচলে লেখা দেন দেঁতো হাসি
----------------------------------------------------------
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...

তানভীর হাসান এর ছবি

ধন্যবাদ পড়ার জন্য। আর সাবধানেই আসি... দোয়া করবেন...

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

বেশ ঝরঝরে লেখা। চলুক

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

তানভীর এর ছবি

ওহে আমি তো নাম দেইখা নিজেই কনফিউজড..চলেন একটা গুরুপ খুলি...থার্ডু গেছে কই?

মূলত পাঠক এর ছবি

আফগানিস্তানে গেছেন নাকি? জানি এখন খুবই ভয়ানক অবস্থা, তবু শুনলেও মুজতবা আলী মনে পড়ে। অবশ্য শবনমের যুগেও গোলাগুলি বন্ধ ছিলো না।

সমুদ্র [অতিথি] এর ছবি

সাবাশ বেটা। অনুভূতির প্রকাশ ভালা হইছে। চালায় যা!

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার বাক্সগুলো বেশ ভাল লাগে।দেশে আসেন, লম্বা সফরে(দক্ষিণাঞ্চল ভ্রমণ) যাব আপনার সাথে।আরও অনেক বাক্স খুঁজে পাওয়া যাবে আশা করি।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ব্যস্ততার কারণে দেরিতে পড়া হলো। খুব ভালো লাগলো লেখাটা। শুধু একটু বানান সামলে, ব্রাদার... হাসি

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

ভালো লাগলো! দেঁতো হাসি

----------------------------
ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মেতৎ চলিষ্যতি।।

- ললিতবিস্তর

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

ময়না পাখি, বেঁচে আছো? দেঁতো হাসি
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...

প্রবাসিনী এর ছবি

বেঁচে আসে।
শুধু কি তাই? দেশের হাওয়া-বাতাস গায়ে লাগায় বেড়াচ্ছে।
________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

দেশে গেসে নাকি? হিংসা রেগে টং
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...

প্রবাসিনী এর ছবি

আমিও হিংসায় জ্বলতেসি।
________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।