রঙ

তাপস শর্মা এর ছবি
লিখেছেন তাপস শর্মা [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১৮/০১/২০১২ - ৩:২৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শেষ পর্যন্ত এই মেয়েটাই ঝুলে গেলো আমার গলায়। আর প্রথমদিন থেকে বয়ে চলছে আমার শবদেহ...

আমি তোমার কে হই।

- জানিনা।

- কেন জানলেনা।

- আমার লজ্জা করে...

যুগে যুগে সব ভালোবাসার কাহিনীগুলি বুঝি একই রকম হয়ে থাকে। আমার বেলাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে কিছুটা বোধ হয় আলাদা হতে চেয়েছিল আমার ভালোবাসা। আর ফেরারি স্বপ্ন। যে স্বপ্নের হাত বেয়ে সমস্ত বিহ্বলতাকে আমি জয় করতে চেয়েছিলাম, হতে চেয়েছিলাম একটা বাস্তবের ইচ্ছেডানা। তোমাকে বলতে গিয়ে তারপর বলতে না পারা অনেক কথা আমার মধ্যে বারবার একটা ব্যবধান গড়ে দেয়। কাঁহাতক আমি এই গণ্ডীর মধ্যে আটকে থাকব, আরও কতদিন...

মণি তুমি এখন কোথায়।
- অফিসে।
- কি করছ।
- অফিসে মানুষ কি করে।
- পাগল।

এরপর তোমাকে বলার মতো কোন কথা খুঁজে পাইনা। কথার ভুল ঠিকানা গুলি খেলাঘর থেকে পালিয়ে যায়। আকাশের রঙ যেন গোধূলির বায়না শুনে। তোমাকে তো বলেছি আমি কথা গুছিয়ে বলতে পারিনা। এই যে তোমার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছি। জানিনা কেন বলছি। কিভাবে বলছি। আমার কেমন যে ভয় হয়। ভয় হারিয়ে যাওয়ার। বেশী অসুখ আমার সহ্য হয়ে গেছে কিন্তু বেশী ভালোবাসা আমার সহ্য হয়না মণি।

আজ আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।
- কী।
- বলব না।
- আরে, না বললে আমি জানব কি করে।
- আমার লজ্জা করে।
- আচ্ছা আমি তোমার সব লজ্জা খেয়ে নিলাম।
- তুমি লজ্জা খাও।
- আসল কথায় আসেন ম্যাডাম। কি স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বলেন।
- বিকেলে আজ আমি একটু ঘুমিয়েছিলাম। তারপর স্বপ্ন দেখলাম – আমি দাঁড়িয়ে আছি, আর পেছন থেকে তুমি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলে।
- তারপর।
- তারপর আমি ঘুম থেকে উঠে গেলাম।

আবার একটা নিস্তব্ধতা আমাকে ঘিরে ফেলে। রাস্তার ব্যস্ত বালিতে দাঁড়িয়ে আমি এতদিন লাঞ্ছিত ছিলাম। তুমি কেন সব কিছুর ভাষা পাল্টে দিলে। আজ তিন মাস ধরে আমি বিছানায় শুয়ে আছি। জানিনা করে রিকভার করবো। আজ আবারও শরীরটা কেমন যেন হলদে হয়ে গেছে। মাথাটা সারাক্ষণ ঝিমঝিম করে। খুব কষ্ট হয় আজকাল। একটু ভাত মুখে দিলেই বমি চলে আসে। তল পেটটাতে ভয়ানক ব্যথা করছে।

আমার ছেলে তোমায় কি নামে ডাকে জান।
- কি
- শিম্পাঞ্জী
- আর কি বলে
- বলে, মা শিম্পাঞ্জীকে আমাদের বাসায় আসতে বল।
- তারপর
- তারপর............। এই শোন, আমি এখন রাখছি। মাকে ওষুধ খাইয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। আবার যদি ওনার অসুখটা বেড়ে যায় তাহলে খুব প্রবলেম হবে। জানোই তো বাবা মারা যাওয়ার পর উনি দু বছর ধরে শয্যাশায়ী। ছেলেটার শরীরটাও এই কদিন ভালো জাচ্ছেনা। আচ্ছা যাচ্ছি। রাতে কথা হবে কেমন, বাই...

তুমি চলে গেলে। আমি চুপ করে শুয়ে রইলাম বিছানায়। বুকটাতে এখনও প্রচন্ড ব্যথা করছে। কি জানি আমার রোগের জন্য নাকি তোমার জন্য। কি করে তুমি এতো কষ্ট বুকে চেপে রাখো মণি। আমার কাছে অবাক লাগে। তুমি ছেলের সাথে খেল, ওর সমস্ত আবদার মেটাও। মার জন্য এমন কোনো কিছু বাদ নেই যা তুমি করনা। তারপর অফিসে হাজারটা ঝামেলা সামলাও। সব এক হাতে। তুমি কি করে এত শক্তি পাও বলতো। আমি যে কেন তোমার মতো হলাম না মণি। আবার ওষুধ খাওয়ার সময় হল আমার।

আজ আমার মন খারাপ
- কেন
- এমনি। জানিনা।
- তা তোমার মন কি বলে মণি।
- আমি জানিনা। তুমি বল।
- আচ্ছা। তুমি বল কি করলে তোমার মন ভালো হবে।
- বা-রে তাও আমি বলে দেবো।
- কি করব।
- তোমার যা খুশি কর।
- একটা চুমো খাই তোমার কপালে।
- যাহ্‌।
- তারপর তোমার চোখে, তারপর একটা আলতো ছোয়ায় তোমার নাকের ডগায়। তারপর তোমার গাল বেয়ে ঠোঁটে। তোমার চুলের গন্ধে, তোমার বুকের প্রতিটি স্পন্দনে মিশে যাচ্ছে আমার সব নিঃশ্বাস। সব কিছুর জড়তা কাটিয়ে তুমি আমার উপর ছেড়ে দিলে তোমার বৃক্ষকে...

- আমার শরীরটা কাঁপছে।
- আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখো।

সারারাত জেগে আছি। ভয়, সংশয়, আঁধার। শ্মশানের ডাক, দ্বিপ্রহরের আজান। সব কিছুতে হারিয়ে যাওয়ার রঙ। অযথা স্বপ্ন দেখতে রাতপাখিরা উড়ে যায়। নিরব পরশের নাম। আমরা নিরবে বয়ে চলছি একে অপরকে। রাত আরও বেশী করে গভীর হতে থাকে। তুমি থেকে যাও আমার পাশে। আমার আদরে। আজ আবারও বৃষ্টি নামলো আমার শহরে। আবারও সজীব হয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে আজ, ভীষণ ভাবে।

তুমি কবে ভালো হয়ে উঠবে।
-খুব শিগগির
-আমার ভালো লাগেনা।
-আমারও।
- আহ্লাদি একটা।
- হুম।
- কাল রাতে ঘুম হয়েছে।
- উঁহু...
- আচ্ছা। আর দুষ্টুমি করবো না, ঠিক আছে।
- আজ তোমার শরীরটা কেমন লাগছে।
- আগের থেকে একটু ভালো।
- তোমাকে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠতে হবে, প্লিজ। তারপর তুমি আমার কাছে আসবে। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
- জানি। তবু কেমন জানি লাগছে।
- কি। খুব মন খারাপ।
- হুম।
- কি চাই বলেন।
- একটা কবিতা। আমার প্রিয়টা।
- আচ্ছা।
তারপর......
“ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত...............
শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।”

আমি বিহ্বল হয়ে শুয়ে আছি। এক দশকের নিরবতা ভেঙে তুমি আবার কবিতা পড়তে শুরু করলে মণি। শুধু আমার জন্য। এতো ভালোবাসো আমায়। আমি যে কিছুই করতে পারিনা। আমি জানিনা এই অসুখ পার করে, জীবন আর সভ্যতার নোংরামি ভেদ করে তোমার কাছে আসতে পারবো কিনা। আমি কি সত্যিই ধরতে পারবো তোমার হাত। এই সমাজ এই দুনিয়া তোমার আমার কথা কোন দিনও বুঝতে চাইবেনা। স্বপ্নের রঙ বুঝি তাই নীল হতে চেয়েছিল। আজ সবই সুন্দর। তুমি, আমি, আমার ভাঙা জীবন আর এই অদৃশ্য পরশ। আমার গাল ছুঁয়ে মিশে থাকে কান্নার রঙ।


মন্তব্য

উচ্ছলা এর ছবি

খুব দরদ, কষ্ট আর ভালোবাসা নিয়ে লেখাটা। পড়লাম, অনুভব করলাম, ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম।

তাপস শর্মা এর ছবি

হাসি । ধন্যবাদ ম্যাডামজী।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ কবি... থাকেন কো? উপন্যাস দ্যান তাত্তারি।

মেঘরং_ এর ছবি

জানিনা কেন এতো ভালো লাগলো! আর বুকের ভেতরটায় চিনচিন একটা ব্যথা টের পেলাম...

তাপস শর্মা এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ মেঘরং_

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ কবির দাদা।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া ভাললাগা জানিয়ে গেলাম।

দ্যা রিডার এর ছবি

তাপস দা , অনুভূতির এত চমৎকার প্রকাশ , খুব ভাল লেগেছে আপনার পোস্ট টা ।

তাপস শর্মা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ নিয়েন।

তাপস শর্মা এর ছবি

সমীরণ দাদা আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে আর কিছু বলতে চাইনা। ভালো থাকুন।

Samiran Ray, KOLKATA এর ছবি

"বেশী অসুখ আমার সহ্য হয়ে গেছে।। কিন্তু বেশী ভালোবাসা আমার সহ্য হয় না মনি।।"
অসাধারন উপলব্ধি, তাপস।।
পড়া শুরু করার পরে আর চেয়ারে হেলান দিতে দাও নি, তাপস।।
গোগ্রাসে শেষ লাইন গিলে তারপর দম নেবার ফুসরত পেলাম।।
মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষনে তোমার মুন্সীয়ানা তারিফ করার মতই।। দিন দিন তা যেন পরিনতির শিখরে ধাবিত হচ্ছে।। নির্বাক মুগ্ধতায় ভরে গেল মন, তাপস।। তোমার তপস্যা সিদ্ধ হোক, আমার এই শুভকামনা তোমার নিত্যসঙ্গী।। নির্ভয়ে পা ফেলে শুধুই এগিয়ে চলো।।

কল্যাণ এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ কল্যাণ ভাই ।

রোখশানা রফিক এর ছবি

ভালবাসার পংক্তিমালার ঠাসবুনোটে লেখা অসাধারন আবেগঘন গল্প। ভাললাগা,ভালবাসা,দুঃখ-কষ্ট সবকিছু মিলিয়ে অভূতপুর্ব রসায়নের সমাহার।.................................সার্থক তোমার লেখনি, তাপস।

তাপস শর্মা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।