প্রথম দিনের পর। চার তারিখ রাতে ফিরে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন অনেক কাজ আছে। সারাদিনের ক্লান্তি এবং প্রসন্ন মন নিয়ে ডুবে গেলাম। পাঁচ তারিখ সকালে উঠেই অনেক ছোটাছুটি করতে হল। কারণ চার তারিখ প্রায় চার মাস পর আগরতলায় যাওয়ার ফলে অনেক পরিচিত স্বজনরা বলছিল পরের দিন যাতে ওদের ওখানে যাই। তবে সবার কথা রাখতে পারিনি! তবে দু জায়গায় যেতেই হল। ২৯ ফেব্রুয়ারী থেকে ১১ মার্চ এর বইমেলায় আমার মাত্র দুইদিন থাকা হল।
দুপুর ঠিক দুইটার মধ্যেই বইমেলায় পৌঁছে গেলাম। গিয়ে খানিকটা খটকাও লাগল। একেবারে বিরান অবস্থা! আকাশের সূর্যটা বইমেলার প্রাঙ্গণে ঢলে পড়লেও বইয়ের ঝাঁপ ঠিকঠাক খোলেনি। আজ তো বই কিনব বলেই স্থির করেছি। তাই এই সময়ে আসা। মাত্র দুই দিনের সময়ে বইমেলার সব স্টল দেখেও উঠা যায়না। কিন্তু কি আর করা যায়। আমি কোন বই কিনব এমন উদ্দেশ্য করে কখনোই বইমেলায় যাইনি। হ্যাঁ, এটা ঠিক কিছু বই এর কথা মাথায় থাকে ঠিকই, তবে একেবারে প্ল্যান করে এই বই কিনব এমনটি আমার হয়না কখনোই। আমার বই কেনার পেছনে কাজ করে হঠাৎ ভালো লাগা কিংবা এটা কিনতে হবে ব্যস কিনে নিলাম। তবে এই বছর কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল।
প্রসঙ্গে একটু বলি এই বছর লিটল ম্যাগের চত্বরটা দেখে খানিকটা আঘাত পেলাম। কেমন জানি ছন্নছাড়া ভাব। পরিচিত কিছু পুরোনো মানুষ বাদে নতুনরা কেউ আসেনা। আসলে কেমন যেন একটা উদাসীনতা। এক বয়স্ক সাহিত্যিককে বলতে শুনলাম – একদিন প্রকাশকরা থেকে যাবে কিন্তু লেখার মতো লোক কিংবা বিষয় হয়তো থাকবে না। শুনে চমকে উঠলেও অবিশ্বাস করার মতো কিছুই নয়। সত্যি অবস্থা খুব বেশী ভালো নয়। বিশেষ করে এই রাজ্যের প্রকাশকদের। গুণগত মান নিয়ে কথা উঠবে পরে, আগে তো একটা নির্ভরযোগ্যতা তৈরী হওয়া দরকার! সেটা কোথায়? এক সময় ( গত পাঁচ বছর আগেও) লিটল ম্যাগের চত্বরটা গিজগিজ করত নব্য কবি কিংবা উঠতি সাহিত্যিকদের ভিড়ে। গত কয়েক বছর ধরে তা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছিল, কিন্তু এই বছর তা একেবারেই ‘নেই’ এর পর্যায়ে চলে গেলো। নতুন কোন ম্যাগাজিন থাক দূরের কথা, পুরোনোগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। আমি নিজে যে ছোট কাগজটা করতাম, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন সংকটে। হয়তো অনেকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। হয়তো এখন আর কেউ সেই প্যশন ফিল করেনা ক্ষুদে বই নিয়ে.........
বই মেলায় ঢুকেই গেলাম বাংলাদেশ থেকে আসা একমাত্র স্টল পারিজাত প্রকাশনীর দিকে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম স্টলের ঝাঁপ এখনো খুলেনি। ইতিউতি একটু ঘুরে চলে এলাম ন্যাশান্যাল বুক ট্রাস্ট এর স্টলের দিকে। কাল ওদের ক্যাটালগটা নিয়ে গেছিলাম। কিছু বই দেখেও রেখেছিলাম। তাই এখান থেকেই শুরু করলাম। কিনলাম - ‘নন্দলাল বসু। ভারত শিল্পের পথিকৃৎ’ - দিনকর কৌশিক, ‘হিন্দু ধর্ম কী’ – মহাত্মা গান্ধী ( পরে এই বইটি দেখে আমার এক বন্ধু আঁতকে উঠে বলেছিলঃ তুই কবে থেকে? কারণটা বলে ওকে আশ্বস্ত করেছিলাম! শুনে সে একচোট হাসল), ‘একুশটি বাংলা গল্প’ – সম্পাদনা অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘আদবনের নির্বাচিত গল্প সংগ্রহ’ – সঙ্কলক ইন্দিরা পার্থসারথি, ‘কেমন করে সিনেমা তৈরী হয়’ – খাজা আহম্মদ আব্বাস, ‘এভারেস্ট আমার শিখর যাত্রা’ – বাচেন্দ্রী পাল, ‘এস আমরা নাটক করি’ – উমা আনন্দ, ‘হিব্রু ছোটগল্প সংকলন’ – হায়া হফম্যান। আরও কয়েকটা বই পছন্দের তালিকায় ছিল তবে পকেটের দিকে তাকিয়ে এখানেই ইতি টানলাম।
অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। চক্কর দিয়ে পারিজাত প্রকাশনীর দিকে গেলাম। গতকাল ওদের কিছু বই দেখেছিলাম। আসলে আমারই জানার ভুল হবে কিংবা সেইসব লেখকদের সঙ্গে পরিচিত নই সেটাও হবে কিন্তু আমার তেমন ভালো লাগেনি। বাংলাদেশের বিপুল সাহিত্য ভান্ডার নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা অনেক কম। বলতে গেলে সেই তুলনায় কিছুই পড়িনি। এখন জানার চেষ্টা করছি। ওরা শুধু ওদের প্রকাশনীর নয় অন্য বইও এনেছে সাথে, বিশেষ করে হুমায়ুন আজাদ। কিনলাম ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’, আমার ছোট ভাইটি ‘নারী’ কিনল তাই আমি আর সেটি কিনলাম না। ওদের কাছে জানতে চাইলাম হুমায়ুন আজাদ রচনা সমগ্র পাওয়া যাবে কিনা, কারণ একটি একটি বই করে কিনলে খুব ব্যয় সাপেক্ষ হয়। ওরা বলল ওদের কাছে নেই। এছাড়া ওদের কাছে আজাদের কবিতার বইগুলি ছিল, ইন্টারনেটের কল্যাণে আজাদের অনেক কবিতাই পড়ে ফেলেছি বলে সেটা আর কিনলাম না। বেড়িয়ে আসার মুখে সেই প্রকাশনীর একটা লোক আমাকে ডাকলেন। ফিরতেই তিনি ঢাকা বইমেলা নিয়ে ওদের করা কিছু কাগজ আমাকে দিলেন, নতুন পুরোনো মিলিয়ে প্রায় পাঁচ বছরের গোটা দশটি সংখ্যা। আমি টাকা দিতে গেলে তিনি হাসি মুখে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। অনেক বললেও তিনি কাজগগুলির মূল্য নেননি। ভালো লাগল এই আন্তরিকতা। বললেন আগামী বছরও আসার ইচ্ছে রাখেন। উনাকে বললাম ওদের প্রকাশনীর বাইরেও যাতে অন্য বই নিয়ে আসেন। উনি কথা দিলেন অবশ্যই আনবেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই আমার ইচ্ছে ছিল হাসান আজিজ এর সমস্ত গল্পগুলি একসাথে কেনার। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। খুঁজতে খুঁজতে এক পরিচিতকে জিজ্ঞসা করতে সে বলল কোলকাতা থেকে একটা স্টল এসেছে সেখানে বাংলাদেশের অনেক বই পাওয়া যাচ্ছে। গেলাম সেই স্টলে। পেয়ে গেলাম দুই খন্ডে ‘হাসান আজিজুল হকঃ গল্প সমগ্র’, প্রকাশক নয়া উদ্যোগ।
এরপর খানিকটা চা বিরতি। অনেকেই পৌঁছে গেছে পরিচিত বইখোরের দল। ওদের সাথে মিলে কয়েকটা চক্কর মারলাম এবং খানিকটা ক্যামেরা ক্লিকালাম।
[ একগুচ্ছ জীবন গাঁথা। ]
[ এসো হাত ধরি। ]
[ খবর থেকে বিনোদন ]
[ পড়াশুনা পার্টির লোক ]
[ নূতনের উল্লাস ]
[ একটু পাশাপাশি হাঁটাহাঁটি ]
[ বইঘরে যাত্রা ]
[ পারিজাত এর স্টলে ]
[ সাজানো বই বাগান ]
[ পাক সার জমিন সাদ বাদ ]
[ অবগাহন, ক্রেতাহীন ]
[ বালিকাদের ছবি তুলতে অনুমতি দরকার হয় ! ]
[ ওরা কাজ করে ]
[ ঝাল দিয়ে দিলাম ]
[ আহ্বান, একদিন গিয়েছিলাম ]
[ শুরুর শেষ কিংবা শেষের শুরু ]
বসন্তের বিকেল ঘেমে গিয়ে সন্ধ্যাতারা দেখা দিয়েছে আকাশে। ভ্যাপসা গরম। ততক্ষণে মেলায় ভিড় জমতে শুরু করেছে। যদিও সোমবার, সপ্তাহের প্রথম দিন তাই গতকালের তুলনায় ভিড় কম। সন্ধ্যের পর আমাকে একটা কাজে বেড়িয়ে যেতে হবে তাই বন্ধুদের বলে কয়ে দ্বিতীয় খেপে বেড়িয়ে পড়লাম। এনবিটি থেকে গ্রাম্য এডিশনটা কিনেছিলাম, অখন্ড সংস্করণটা কিনবনা বলে। কিন্তু লোভ সামলাতে পারলাম না, কিনলাম ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’ (অখন্ড সংস্করণ) – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। আগেই লিটল ম্যাগ চত্বর থেকে সবকটা নতুন পুরোনো কাজগ উঠিয়ে নিয়েছিলাম। পকেটের অবস্থা খুব বেশী ভালো নেই। একটা সমগ্র কেনা বাকি আছে। তাড়াতাড়ি সেটা কিনে নিলাম, তিন খন্ডে ‘শরৎ রচনা সমগ্র’।
প্রতি বছরই রাজ্যের নতুন পুরোনো লেখকদের কিছু না কিছু বই কেনার চেষ্টা করি। কিন্তু এইবার আমার ভাঁড়ার একেবারেই শূন্য, তবুও একটি বই কিনলাম। কবি নকুন রায় এর ‘বৃক্ষ পারাপার’। এরপর যে বইটি কিনলাম বিথি চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস ‘কুপ্রস্তাব’। একেবারের ফেরার পথে যা কিনলাম, প্রিয় গানওলার বই – ‘নিশানের নাম তাপসী মালিক’। কবীর সুমনের এই বইটি দিয়েই এইবারের বইমেলায় বই সফরের ইতি টানলাম।
রাজধানীর শিশু উদ্যানে ততক্ষণে সন্ধ্যার আঁধার ঘন হয়ে এসেছে। আরও কিছুক্ষন ইতিউতি ঘুরে কাটিয়ে দিলাম। এবার চলে যাবার পালা। ভালো লাগছিল আবার খারাপও লাগছিল। ভালো লাগছিল এই কারণে যে এই বছর বইমেলায় যেতে পারবো কিনা এই নিয়েই আমার সন্দেহ ছিল। তবুও আসলাম। আর খারাপ লাগছিল চলে যেতে হবে বলে। আগরতলা বইমেলার একটা কথা সবাই বলে যারা অন্য বইমেলায় ঘুরে এসেছেন, এখানকার বইমেলার মতো ঘরোয়া বইমেলা আর কোত্থাও নেই। ক্রেতা – বিক্রেতার বাইরেও একটা আলাদা জগত আছে এখানে। সবচেয়ে মজার ব্যপার মেলায় প্রতি আট কিংবা দশ জনে একজন কি দুজন পরিচিত মানুষই থাকে। এটা ভীষণ মজার। আসলে আগরতলা এখনো কর্পোরেট বই এর জগত হয়ে উঠেনি। লেখকরা নিজেদের তাগিদের সারা বছর দৈনিক কাগজ এর সাহিত্যের পাতায় কিংবা মাসিক সাহিত্য পত্রে লিখে যান। বইমেলায় কিছু কিছু লেখকদের বই আসে, তাও মূলত নিজের তাগিদেই। কিছু কিছু উচ্চমানের প্রকাশনাও যে আসেনা তা নয়। হয়, সেটাও কিছু ভালো প্রকাশকের দৌলতেই আসে। কিন্তু সারা বছর বই এর প্রকাশকরা একটা সুপ্ত ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন। এর মূল কারণ হল বাজার। মাত্র চল্লিশ লাখ মানুষের এই রাজ্যটিতে সাহিত্যের বাজার এতোটা ভালো নয়। মোটামুটি পর্যায়ে চলে যায়। তাই হাতে গোনা কয়েকজন প্রকাশক গোষ্ঠী বাদে সারা বছরই অন্যান্যরা নিষ্ক্রিয় থেকে যান।
তবুও বইমেলা সবার জন্য। সবার ভালোবাসার প্রকাশ, লেখকদের মনের সিঞ্চন, প্রাণের আঙিনা। একমাত্র বইমেলার সময়ই লেখকরা উম্মুক্ত পাখি হয়ে যায়। ভালো লাগে। আবার এমন নয় যে আঁতেলরা নেই, আছে। কিন্তু ওদের হুজুগে টেটনামি অন্তত গোটা বইমেলাকে চেপে যেতে পারেনা। বই নিয়ে বেড়িয়ে এলাম বইমেলা থেকে। এবং রাতের কাজের শেষে শুয়ে শুয়ে বই এর গন্ধ নিলাম। একটা কথা এখানে বলে যাই, যদিও হাসির কথা, নতুন বই এর যে একটা গন্ধ আছে তা কেমন লাগে?
------------------------
[শেষ]
===========================================
আমার শহর।
মার্চ। ০৯। ২০১২ ।
মন্তব্য
পড়তে বেশ ভাল লাগল।
ছবিগুলোও দারুন হয়েছে।
আপনি তো মশাই ত্রিপুরায় যাবার লোভ লাগিয়ে দিলেন।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ।
আসুন, অবশ্যই আসুন। আমার পার্বতী ত্রিপুরা আপনাকে স্বাগত জানায়। ভিসা পাসপোর্ট এর নিয়ম নীতির বালাই না থাকলে তো বাংলাদেশ এবং ত্রিপুরা দুই হাত দূরেই আছে।
ডাকঘর | ছবিঘর
নতুন বইয়ের গন্ধ ,এর তুলনীয় আর আছে কি ?
যাবার ইচ্ছা রইল আগরতলা বইমেলায়।
সত্যিই তুলনা হয়না।
আসবেন। অবশ্যই আসুন। আসবার আগে জানাবেন।
ডাকঘর | ছবিঘর
facebook
থ্যাঙ্কু ভায়া।
ডাকঘর | ছবিঘর
নতুন বই এর গন্ধ নিয়ে বই পড়ার মজাই আলাদা, যেটা আমি ইবুকে পাইনা। এইবার দেশে গিয়ে আচ্ছামত বইমেলায় ঘুরে এসেছি,কিছু বই ও কিনে আনলাম।
খুব ভালো।
ডাকঘর | ছবিঘর
আমার কাছে নতুন এমন একটা বইমেলার খবর পেলাম ।
দেখি পরের বছর যাবার চেষ্টা করব ।
আসুন। অবশ্যই আসবেন।
ডাকঘর | ছবিঘর
ছবিগুলো খুব পরিচিত। যেন আমাদের একুশে বইমেলারই এক অলস দুপুর। যদিও স্টলের ভিতরের সজ্জা অন্য রকম। যদি কোনদিন সম্ভব হয়; আমিও যাব। আপনারও আমন্ত্রণ রইল আমাদের পরের একুশে মেলায়।
ধন্যবাদ।
। আসবেন, অবশ্যই আসবেন। আমিও একুশে মেলায় আসার প্রবল ইচ্ছে রাখি।
ডাকঘর | ছবিঘর
'পড়াশুনা পার্টির লোক' ছবিটা সম্পর্কে জানতে চাইছি। ওখানে কি নোট-গাইড বিক্রী হচ্ছে?
বাংলাদেশের বইমেলার স্টল সজ্জা আর পশ্চিম বঙ্গীয় স্টল সজ্জা ভিন্ন। ওখানে স্টলের ভেতরে ঢোকা যায়,
আমাদের এখানে যায় না। শুধু পাঠক সমাবেশ সব সময় স্টলের ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা রাখে।
হ্যাঁ। এই স্টলটা ঐ জাতীয়ই ছিল। তবে টিপিক্যাল নোট-গাইড জাতীয় বই এর স্টল নয়। এখানকার বিভিন্ন প্রথম সারির পরীক্ষায় বসার জন্য প্রস্তুতির রেফারেন্স সুলভ বই।
স্টলে ঢুকা যাবেনা কেন? এটা বুঝলাম না।
ডাকঘর | ছবিঘর
নতুন মন্তব্য করুন