মেঘলা মানুষ, একলা আকাশ...

তাপস শর্মা এর ছবি
লিখেছেন তাপস শর্মা [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২২/০৬/২০১২ - ৩:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খুব ছোটবেলায় যখন বৃষ্টিকে প্রথম অনুভব করতে শিখেছিলাম সেই প্রথম অনুভূতির স্মৃতিগুলি এখন ডিলিট হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও স্মৃতির পাতা ঝেড়ে সেই দিনটির কথা মনে আনতে পারি না। সেই দিনটিকে আমি আজও খুঁজি, যতবার বৃষ্টি দেখি ততবার আমি অবচেতনের ডেস্ক হাতড়ে বেড়াই। নামটা বৃষ্টি। বাংলা এই শব্দটাতেই যেন অজস্র বিন্দু স্মৃতি-বিষ কেউ ঢেলে দিয়ে গেছে। তাই প্রতিটি বর্ষা ঋতু আমার কাছে নূতন গানের পসরা সাজায়। যতই মনের দ্বিধা থাকুক, জটিল অঙ্কের ঘনঘটা থাকুক, থাকুক শত বিবর্ণতা – এক বর্ষার কাছে সব যেন শিশুর সরল হাসি হয়ে যায়। তাই আমি খুঁজি। এখনো খুঁজি সেই প্রথম ভালোলাগার মুহূর্তটুকু। বর্ষা, আমার প্রথম ভালোলাগা আমার প্রথম ভালোবাসা।

এই বছরও আমার শহরে বর্ষা এসেছে। সময়ের আগে একবার পালাবদলের সুর গেয়ে গেছে, এবং সময় করে আবার এসেছে। মেঘের আড়ালে আমি তাকে নূতন করে আবিষ্কার করি। ছোটবেলা থেকেই একটা অভ্যেস হয়ে গেছে আমার বৃষ্টি এলেই, সে রাতের শেষ প্রহরেই হোক না কেন আমার ঘুম ভেঙে যায়। বৃষ্টি হলে আমি টের পাই। বৃষ্টি আমাকে শত যন্ত্রণার মাঝেও বিহ্বল করে, উত্তাল করে দেয়, চিৎকার করে গান গাইতে শেখায়। ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে টিনের ছাউনির ঘরে শনশন শব্দে বৃষ্টি বিলাস এর যে সুখ, কংক্রিটের শহরে সেগুলি মিস করেছি বহুদিন, বহুবছর। এইবার যেন সব পুষিয়ে নিচ্ছি। বৃষ্টি মানেই আমার রাঙা দোয়েলের গান, বৃষ্টি মানেই আমার লালন ফকিরের কলতান।

গত আটচল্লিশ ঘণ্টা আমার শহরে প্রায় বিরামহীন বৃষ্টি হয়ে গেছে। সাথে প্রবল ঝড়। বৃষ্টির সাথে ঝড় মানেই সবকিছু উলটপালট করে দেওয়া উন্মাদনা। গাছপালা থেকে শুরু করে অনেক কিছু তছনছ করে দেওয়া। তারপর ঝুপ অন্ধকার। বিদ্যুৎ-হীন কাল। বেশ লাগে। যান্ত্রিকতা থেকে কখনো কখনো মুক্তির স্বাদ যে এত মিষ্টি হয় তা বর্ষার দিনগুলিতে আঁধারের সাথে কথা না বললে বোঝা যায়না।

ছেলেবেলায় বৃষ্টির দিনে ছাতা মাথায় টাপুর টুপুর শব্দ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার দিন আজও ইতস্তত মোচড় দিয়ে যায়। হয়তো তাই বৃষ্টির দিনে রাত দুটোর সময় আঁধার বারান্দায় বসে বসে ভাবি একদিন আবারও শৈশবে ফিরে যাওয়ার কথা। যা আর কোনদিনও হবেনা। ভুলে থাকার চেষ্টা করি স্কুলের বারান্দায় বসে কাগজের নৌকো বানিয়ে মনমাঝি সেজে রূপকথার সফরে যাওয়ার দিনগুলি। বৃষ্টি আমার কাছে মেঘলা মানুষ, একলা আকাশ।

উদভ্রান্ত হয়ে অনেককিছু খোঁজতে গিয়ে শুধুই শব্দ আমার কাছে ধরা দেয়, সাথে মূর্ছনা। ইদানিং অঞ্জনের একটা গান আমাকে উদভ্রান্ত করে দেয়। আরো গভীর ভাবে মনে করিয়ে দেয় বৃষ্টির সোপান এবং তার ভঙ্গুর কথকতা। ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি, বৃষ্টির ছবি এঁকেছি’- আপাদমস্তক বর্ষা যাপন না হলেও আমি রাতের অন্ধকারে এই গানটাকে শিয়রে নিয়ে ঘুমাই। আবার কখনো শ্রীকান্ত এঁকে দিয়ে যায় –‘আমার সারটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম...’’ ... বৃষ্টি মানেই আমার কাছে বাউল গান – মাঝ দরিয়ায় উঠল তুফান হাল ধর হে, ... বৃষ্টি মানেই একতারার ধার, বৃষ্টি মানেই দোলাচলে যাওয়া, বৃষ্টি মানেই কথায় ও সুরে রবীন্দ্রনাথ – ‘আমি কান পেতে রই...’

‘একাকীত্ব বরাবরই আমার প্রিয় সাবজেক্ট। একাকীত্ব আমি উপভোগ করি। বিশেষ করে বৃষ্টির রাত, বৃষ্টির ঝর্ণাধারার উচ্ছ্বাস। তখন আর অন্যকিছুর চিন্তা বা জীবনের শত ছিন্নমূল উচ্ছেদগুলি হারিয়ে যায় অনায়াসে। চ্যানেল-নাইন এর মস্তি, এম-টিভির ড্যাসিং এটিটিউড, এএক্সএন এর উথাল-পাথাল সবকিছু ক্লিশে হয়ে যায় বর্ষা সফরে। গোপনে এক টুকরো মেঘ যা লালন করি সারাটা বছর তা আষাঢ়ের এক দিবসেই যেন বিলীল হয়ে যায়। এবং আবারও মেঘ জমানোর জন্য আশায় মন বাঁধতে শুরু করি, এই বলে – একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে...

ভোর থেকে টাবা বৃষ্টির পর বিকেলের দিকে একটু অবসর দেখা গেলো। তাই পাশের মাঠে খোলা আকাশে বৃষ্টির চিহ্ন দেখতে গেলাম, এবং --

IMG_bristi_05

IMG_bristi_09

IMG_bristi_08

IMG_bristi_07

IMG_bristi_06

IMG_bristi_04

IMG_bristi_03

IMG_bristi_02

IMG_bristi_01

IMG_brishti_10

----------------------
জুন। ২১। ২০১২ ।
[ ছবিগুলি নোকিয়া – ৩৫০০ ক্ল্যাসিক ( মোবাইল-এ) তোলা ]


মন্তব্য

 মেঘলা মানুষ এর ছবি

আমার মনে হয় মন্তব্য করা উচিত এই পোস্টে। অনেক দিন ধরেই আমি অনলাইনে এই নিক ব্যবহার করে আসছি।

খুব বিষণ্ণ লাগল ছবিগুলো। মন খারাপ
ভালো থাকবেন।

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনার নিকটা খুবই সুন্দর। ভালো লাগল আপনার মন্তব্য পেয়ে। হাসি

ছবিগুলো আসলে সাধারণ মোবাইলে তোলা। যদিও বৃষ্টি আমাকে বিষণ্ণ করেনা।

আপনিও ভালো থাকুন।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ভোর থেকে টাবা বৃষ্টির

টানা বৃষ্টি?

তাপস শর্মা এর ছবি

হুম। ওটা টানা-ই হবে। টাইপো হয়ে গেছে দাদা।
থ্যাঙ্কস। হাসি

মরুদ্যান এর ছবি

হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

তাপস শর্মা এর ছবি
বন্দনা এর ছবি

আপনার একাকীত্ত এত প্রিয় কেন তাপসদা, আমার তো মাঝেমাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে একা থাকতে থাকতে। তবে বৃষ্টি আমার খুব প্রিয় , আমার অনেক ভাললাগা মন্দলাগার নির্বাক বন্ধু। আপনার উল্লেখ করা বেশ কিছু গান আমার ও মেলা ভাললাগার গান।

তাপস শর্মা এর ছবি

আসলে মোটামোটি কৈশোর পেরিয়েই আমি একপ্রকার একাএকাই কাটিয়েছি এযাবৎ। তাই একাকীত্ব আমার সহজাত। এবং আমি ভয়ানকভাবে অসাজিক মানুষও বটে। তাই বলতে পারেন একাকীত্ব আমার ছায়া হয়ে গেছে, একাকীত্ব আমি এনজয় করি সত্যিই। হাসি

শুভ বর্ষা। হাসি

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

লেখাটা আমার দারুণ লেগেছে তাপসদা। হাততালি

তবে ছবিগুলো অতটা ভালো লাগেনি।
কেমন যেন হেজি লাগল।

অবশ্য হেজি মানে ঝাপসা হলে, বৃষ্টি দিনের ছবিরা তো ঝাপসাই হবে। হাসি

তাপস শর্মা এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ প্রদীপ্ত।

বুঝতেই পারছ হে, ০২ মেগাপিক্সেল এর ছবি। অতএব......

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটার কথা নতুন করে কিছু বলছি না।

তবে একখানা মোবাইল ক্যামেরা‌‌য় যা কারসাজি দ্যাখালেন, বলতেই হবে গুরু গুরু

তাপস শর্মা এর ছবি

থ্যাঙ্কস।

আসলে আমার ক্যামেরার পেটে অসুখ করেছে তাই এটা দিয়েই সামান্য চেষ্টা দিলাম। হাসি

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ছবিগুলান এমুন ক্যানগো দাদা? মনে হয় পোতায়ে গেছে খাইছে , অতিবৃষ্টিতে হয়ত দেঁতো হাসি

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

তাপস শর্মা এর ছবি

হ। দুই মেগাপিক্সেলে আর কদ্দুর। হাসি

চরম উদাস এর ছবি

লেখা ভালো লাগলো চলুক
ছবি কয়েকটা ব্লু ফ্লিম হয়া গেছে গা শয়তানী হাসি

তাপস শর্মা এর ছবি

থিঙ্কু ভাইজান। হাসি
এ হে হে হে, আসলে মূল ছবিগুলি সামান্য এডিট করা আছে। তবে কালারটা অলমোস্ট এমনই এসেছে। মোবাইলে লং এক্সপোজারে আকাশ এর সিনারিওগুলি এমনই এলো। তবে ব্লু ফ্লিম হয়ে যাওয়ায় আমার নয় ব্যাটা এই পিচ্চি ক্যামেরাই দায়ী। খাইছে দেঁতো হাসি

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

চলুক

একাকীত্ব অবশ্য আমার জন্যে বিপদজনক ছিলো একসময়ে তবে এখন বেশ কাটিয়ে উঠেছি।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

তাপস শর্মা এর ছবি

কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলে অনেক অভিনন্দন বড় ভাই। হাসি
তবে আমি ওটাতে এখন পর্যন্ত ঝুলে থাকতে চাই। আপাতত কাটানোর ইচ্ছে নেই। হাসি

আশরাফুল কবীর এর ছবি

‘একাকীত্ব বরাবরই আমার প্রিয় সাবজেক্ট। একাকীত্ব আমি উপভোগ করি। বিশেষ করে বৃষ্টির রাত, বৃষ্টির ঝর্ণাধারার উচ্ছ্বাস।

#অনেক দারুনভাবে বলেছেন এবং সাথে ছবিগুলো দিয়ে আবহাওয়াকে আরো বিষন্ন ও মাদকতাপূর্ন করে তুলেছেন-সত্যিই দারুন!

#ভাল থাকুন।

তাপস শর্মা এর ছবি

থ্যাঙ্কস। হাসি

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

লেখাটা খুব ভালো লাগলো, তাপসদা। বৃষ্টি আমারও ভয়াবহ প্রিয়।

মোবাইল দিয়ে যা তুলেছেন, ভাবছি ভালো একটা ক্যাম্রা হলে নিশ্চয়ই আরও জোশ হতো !!!

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

তাপস শর্মা এর ছবি

প্রিয় ফুডুগফুর এর কমেন্ট পেয়ে খুবই খুশি হলাম। হাসি

দাদা আমার একখান ক্যাম্রা আছে মোটামোটি। তবে গতমাসে ওর লেন্সাসুখ করেছে। এখনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। মনে হয় এই যাত্রায় আমার ক্যাম্রা অক্কা পাইছে। দেখি কি করতে পারি। মন খারাপ

গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় বিরামহীন বর্ষণে প্লাবিত আমার শহর! চারদিকে জল তাতা থৈ থৈ। অন্ধকার, বিদ্যুৎহীন। এবং সব চরিত্র কাল্পনিক হয়ে গেছে। গতকাল বৃষ্টি দেখতে গিয়ে বিষাক্ত এক পোকার কামড়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা হাফ-অজ্ঞান। ভয়ানক পেইন এবং রক্তারক্তি অবস্থা! যদিও খুব ভিজেছি। বিদ্যুৎহীনতার ফলে ফেবুজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বইপাঠ অব্যাহত। বৃষ্টির সোপান বেয়ে এখন ধাতব গান ছেড়ে আউল বাউলে মনযোগ।

সর্বশেষ সংযোজন ---- এখনো ঝরছে, তামাম দুনিয়ার কান্না ঢেলে সুরের মূর্ছনা তুলছে বৃষ্টি। হাসি

mnurmkt@gmail.com এর ছবি

চমৎকার লেখা।ভাল লাগলো চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো। পড়তে পড়তে যেন মনে হচ্ছিলো আমার সব কথা যা বলতে পারিনি বা লিখতে পারিনি তা আপনার লেখায় প্রকাশ পেল। সত্যিই আমি কেন আরও অনেকেই হইত এই রকম ভাবে কিন্তু হইত বৃষ্টির শেষে ভুলে যাই – কি তাদের মনে ছিল? আবারও বলছি , লেখাটা খুব ভালো হয়েছে।

সুপম রায়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।