যে কথাগুলি ব্যক্তিগত - ০২

তাপস শর্মা এর ছবি
লিখেছেন তাপস শর্মা [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৯/০৫/২০১৫ - ৩:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যদি আমার শৈশবের একমাত্র সুখের স্মৃতির পাতা কেউ আমাকে খুঁড়ে আনতে বলে তাহলে একটা মাত্র নাম আমার মন থেকে ওঠে আসবে - দাদু। আমার বাপের বাপ। আমার দাদু ছিলেন হোমিওপ্যাথের ডাক্তার। অবিভক্ত বাঙলার কুমিল্লায় জন্ম-কর্ম মানুষটার। দাদুর কাছে শুনেছি সেখানেই দাদুর চেম্বার ছিলো। সাথে আয়ুর্বেদের চর্চাও করতেন। সবসময় চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে সিগারেট এবং টেবিলের উপর ইয়াব্বর মান্ধাতা আমলের বইয়ে মুখ ঢেকে রাখতেন। রুপোর একটা সিগারেট-ভক্ষক ছিল দাদুর, নাম জানিনা তাই সিগারেট-ভক্ষক বললাম। ঐটা ছিল কলমের মুখটা (ক্যাপ) যেমন হয় সেই টাইপের কিছু একটা এবং সেটা গুঁজা থাকত সিগারেটের শেষ প্রান্তে। সেটার আবার একটা লতানো অংশও ছিল, রুপোর তৈরি। দেশভাগ, দাঙ্গায় সর্বহারা হন দাদু। কোপ খেয়ে একটা হাত প্রায় অচল হয়ে গিয়েছিল তার। পূর্ব-বঙ্গ ছেড়ে একবস্ত্রে বউ ছেলেপিলে নিয়ে একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের রাজাদের রাজধানী ছিল সেই উদয়পুরে মাথা গুঁজেছিলেন তিনি। এই উদয়পুরের সাথে জড়িয়ে আছে কত রাজাদের ইতিবৃত্ত। এবং রবীন্দ্রনাথের অমর গাঁথা - ভুবনেশ্বরী মন্দির, 'রাজর্ষি', হাসি-তাতার কথা - 'এত রক্ত কেন'?...

বিখ্যাত একটা ছাতা ছিল দাদুর। আমি মনে করতাম সেই ছাতায় গোটা এলাকাকে ছায়া দেয়া যাবে। এবং সাথে একটা হোমিওপ্যাথির ব্যাগ। এবং সেই ব্যাগে ছোট ছোট শিশি এবং পিচ্চিপিচ্চি সাবু-দানার মত মিষ্টি মিষ্টি বস্তু। অন্যপ্রান্তে থাকত তেজ লাগানো ওষুধ। তাছাড়া বড় একটা আলমারি ছিল, তাতে রাসায়নিক জিনিষ ছিল এবং আরও বেশ মোটামোটা বই। সেই রাসায়নিক বোতলগুলির মধ্যে সাদা কাজগে কি কি জানি লেখা থাকত। এই সমস্ত দানা ও ওষুধের নিয়মিত ভক্ষক ছিলাম আমি। দাদুর ন্যাওটা হওয়াতে পান থেকে চুন খসলেই 'ইস কি না কি হয়ে গেল' বলে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে ওষুধ খাওয়ানো হতো। দাদুর স্টেথোটা ছিল আমার প্রিয় জিনিষ, ছেলেবেলায় ঐটা নিয়া অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছি। দাদুর মৃত্যুর পর সেই সমস্ত জিনিসগুলি সব কিছুই স্মৃতিতে বিলীন হয়ে গেলো। ছোট ছিলাম তাই বুঝিনি। আসলে দাদুর কুলাঙ্গার ছেলেগুলি সেগুলির মর্মটাই বুঝেনি... যদিও তখন সংসারের অবস্থা খারাপ হওয়াতে সেই জিনিষগুলি দিকে নজর দেয়ার চাইতে ডাল-ভাতের সংস্থান করাটা জরুরি ছিল। তারপরেও কিছু না থাকলেও দাদুর সেই প্র্যাকটিসের ব্যাগটা নিয়ে বহুদিন যাবত বাড়ির অন্যান্য পিচ্চিদের খেলতে দেখেছি...

সেই ছেলেবেলা পর্যন্ত যদি আমাকে কিছু বলতে বলা হয় আমি দাদুর নামটাই নিই। আর অন্য কিছু না। বলতে গেলে কান্না পায়, ভীষণ কান্না পায়। দাদু বলতেন আমার থেকে অনেক দূরে থাকলেও আমার বুকের শব্দ নাকি তিনি শুনতে পেতেন। কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ানো, হাতি হাতি খেলা, সরস্বতী পুজোর দিনে সকলকে ফাঁকি দিয়ে অঞ্জলি দেওয়ার আগেই আমাকে বাজার থেকে পেট পুড়ে খাইয়ে নিয়ে আসা, সময়ে-অসময়ে আমার আবদারে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসা - সব কিছুতে আমার একমাত্র সঙ্গী দাদু। একবার মেলার মধ্যে গাড়ি কিনে দিয়ে মহা-ফ্যাদাসে পড়েছিলেন দাদু। গাড়ি হাতে নিয়ে আমার সেকি কান্না। কেন?... না, এতো মানুষ এই ভিড়ে আমি গাড়ি চালাবো কী করে, মানুষগুলিকে তাই সরিয়ে দেওয়ার আবদার। ছেলেবেলায় দাদু ভোরে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতেন। অলমোস্ট জন্মের পর থেকেই মা-বাবার স্পর্শে ছিলাম না। মা অসুস্থ, আর বাবা ঠিক খবর রাখার প্রয়োজন মনে করতেন না। দাদুর কাছেই থাকতাম, খেতাম, ঘুমুতাম। অনেক রাতের বেলায় ঘুম না এলে কিংবা কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলে দাদু বুকের কাছে টেনে নিতেন কিংবা আমিই দাদুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকতাম। ভয় পেলে দাদু বলতেন - ''ফুঁ দিয়া দিলাম, এইবার তোর ঘুম আইব দ্যাখ'', বলেই মাথায় আলতো হাত দিয়ে গাইতেন - আয় ঘুম আয় ঘুম আয় ঘুম আয়, ঘুম আয় ঘুম আয়, ঘুম ঘুম আয়...

সকালে ঘুম থেকে ওঠে প্রথম কাজ সূর্যপ্রণাম করা, তারপর প্রাতঃভ্রমণ। প্রাতঃভ্রমনের সময় ফুলের সাজি নিয়ে বের হতাম আমরা ফুল কুড়ানোর জন্য। সূর্যপ্রণামের সময় দাদু জোরে জোরে গায়েত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, আমি ঐ শ্লোক বলতে পারতাম না বলে মুখ নাড়ার ভান করে বিড়বিড় করতাম। একই নিয়ম বাড়ির অন্যান্যদের জন্যও ছিল। আমার ১২ বছর বয়সে দাদু ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। মারা গেলেন এক বছর পর। সেই এক বছর দাদু কিছু খেতে পারতেন না আখের রস ছাড়া, গলায় ক্যান্সার হয়েছিল। কিন্তু তাকে একদিনের জন্যেই শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে দেখিনি সেইসব দিনেও। রোগা হয়ে গেছিলেন ভীষণ। কাজ করতে ভীষণ পছন্দ করতেন। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। ঐ সময় আমাকে তার কাছে যেতে দেয়া হতো না। আমি কাঁদতাম, কেউ পাত্তা দিতো না... সবাই আমার ভালো চাইতো, যদি আমারো সেই রোগ হয়ে যায়... দাদু যেদিন মারা গেলেন আমি বাজারে কি একটা কিনতে গিয়েছিলাম সেই সময়, বিকেলবেলা। রাস্তা থেকে বাড়িতে কান্নার শব্দ শুনে বুঝেছিলাম মৃত্যুটা এসে গেছে...

এরপর থেকে আমি আর কোনোদিন সূর্যপ্রণাম করিনি। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা এখনো সূর্যপ্রণাম করেন। পরিণত বয়সে এসে যখন মাথাটা কিছুটা সচল হল তখন বুঝতে পারি দাদু কেন সূর্যপ্রণাম করতেন ঘুম থেকে ওঠে। উনার সংস্কারকে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কুসংস্কার মনে হয়, কিংবা বিজ্ঞানকে সামনে রেখে ভিটামিন ডি গ্রহণ করার প্রয়াস। তবুও এটা ছিল দাদুর শেল্‌টার বা আশ্রয়; এটা ছিল একটা দিনের শুরুর আগে নিজেকে প্রিপেয়ার করা, এতে করে বেঁচে থাকার জন্য রসদ খুঁজে নেয়া। ...এখন আমি ঘুম থেকে ওঠে রোজ মৃত্যুর কথা ভাবি, একটা দিন শুরু হয় এবং আমি মরার জন্যে প্রস্তুত হই। ঘুম থেকে ওঠে মৃত্যু নিয়ে বিড়বিড় করি, প্রিপেয়ার হই। আমি বুঝি মৃত্যুটা মেনে নিলে বাঁচাটা সহজ হয়ে ওঠে

০২

দুটো সংলাপ :
- ''আমি সব সময় তোমার ভালো চেয়েছি...''
- ''অনেক দিন ধরে একটা কথা বলার ছিল, ঠিক বলা হয়ে ওঠেনি। তোমাকে, আমার বাপকে এবং প্রত্যেক সেই মানুষকে যারা আমার ভালো চেয়েছে - গো টু হেল...''

২০১৫. ০৫ .০৯ .


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দিব্যচক্ষে দেখতে পেলাম একজন মানুষ উদীয়মান সূর্যের দিকে চেয়ে উচ্চারণ করছেন,

ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ
তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ

(যাঁ হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়িছে পৃথিবী আকাশ তারা,
যাঁ হতে আমার অন্তরে আসে বুদ্ধি চেতনা ধারা
— তাঁরি পূজনীয় অসীম শক্তি ধ্যান করি আমি লইয়া ভক্তি)

এই দৃশ্য বাস্তবে কোনদিন দেখতে পাইনি।

শরণার্থীর মানসিক গঠন ও আচরণ সম্পর্কে ধারণা আছে, তাই বোধকরি তোমার ঠাকুরদা'কে যৎসামান্য বুঝতে পারলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাপস শর্মা এর ছবি

পান্ডব'দা আমি আশা করি একদিন ঘুরতে ঘুরতে নিশ্চয়ই আপনি চলে আসবেন এই লাল মাটির রাজ্যে, ত্রিপুরায়। তখন আপনাকে নিয়ে যাবো গোমতীর পাড়ে, তর্পণ দেখাতে, যদিও আমি ঐ সব দেখতে যাই না। আপনাকে নিয়ে যাবো সঙ্গে করে...

হুম। বড্ড ভয়ংকর ছিল ছিন্নমূল মানুষদের সেই সংগ্রাম। গল্প-উপন্যাসে এর যতটুকু দেখা মেলে তার চেয়েও ভয়ংকর এবং নির্মম। আমার পরিবারের কথাটুকু অন্তত আমি জানি। একটা উদ্বাস্তু পরিবারের উত্তর-প্রজন্ম হিসেবে আমিও সেই ক্লেশগুলি এখনো বহন করে চলেছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

রাস্তা থেকে বাড়িতে কান্নার শব্দ শুনে বুঝেছিলাম মৃত্যুটা এসে গেছে...

চোখের সামনে ভেসে উঠল বারো বছর বয়সী একটি বালকের দুনিয়াটা কিভাবে ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, যেই অভাব আর কখনো ঘুচবে না! প্রচন্ড নাড়া দিয়ে গেছে, তাপসদা, আর কিছু বলতে চাই না!
।।।।।।
অন্ধকূপ

তাপস শর্মা এর ছবি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

লেখাটা ভালো লেগেছে।
আমি কখনো আমার দাদুকে দেখিনি। আমার জন্মের আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তাপস শর্মা এর ছবি

নজরুল ভাই, এই একটা দিক থেকেই আমি অভাগা নই। উনি না থাকলে আমার বেঁচে থাকাটাও হয়তো...

আয়নামতি এর ছবি

একটু একটু করে জানছি আপনার কথা তাপসদা। লিখে যান...

তাপস শর্মা এর ছবি

হুম...

যেহেতু কিছু করার নেই, তাই লিখবো। যেহেতু শেষ বলে কিছু নেই তাই লিখবো...

আয়নামতি এর ছবি

এগান্টা শোনা রে! দেঁতো হাসি দুটো ভার্শনই ভালু, তবে শানেরটা বেশি ভালু।

তাপস শর্মা এর ছবি

ঠিকাছে। আমার এটাই বেশী ভালো লাগে। তবে এই জিনিস রেখে গেলাম

আয়নামতি এর ছবি

বাহ! তাপসদা বেশি কমন পড়ে গেলে মুসিবতের কথা কিন্তু শয়তানী হাসি

তাপস শর্মা এর ছবি

এটাও কমন হিছে?আপ্নি এত ভাল স্টুডেন্ট ক্যান? লন এইটা মনে লয় কমন হইব না

আয়নামতি এর ছবি

ডাহা লেগেছে হে! তবে তা অন্যভাবে। কারণ উহাতে কী আছিলো তাহা আমার এই আকাশে পাখা মেলবার অনুমতি পাইবে না বলিয়া অক্ষরে অক্ষরে জানানো হইল। গানের কথা বলেন তু?

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনি বেশী ভাল শ্রোতা। খেলুন না ইয়ে, মানে...

শেষ, এটা লোপামুদ্রার একটা মাইল ফলক

কর্ণজয় এর ছবি

মানুষ যখন সত্য বলে, কী বলার থাকে তখন- কিছুই বলার থাকে না।
মানুষের যখন ভাল লাগে, তখন কী বলার থাকে- কিছুই না।
আমরা শুধু বলার প্রিপারেশনই নিতে পারি।

তাপস শর্মা এর ছবি

হ্যাঁ। এই প্রস্তুতিই জীবনভর চলতে থাকে। মাঝে শুধু সামান্য দেয়া-নেয়া, ব্যস...

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

হ্যাঁ, লিখে যান একটু একটু করে আর আমরাও একটু কটু করেই নাহয় জানি! হাসি

তাপস শর্মা এর ছবি

লিখবো। সেই ইচ্ছেই আপাতত আছে...

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তাপস শর্মা এর ছবি

আচ্ছা...

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ভাল লাগছে, সাথেই আছি।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

তাপস শর্মা এর ছবি

হুম... চেষ্টা করছি লিখতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।