ডায়েরিঃ সেপ্টেম্বর ৫

তারেক এর ছবি
লিখেছেন তারেক (তারিখ: শনি, ০৬/০৯/২০০৮ - ১০:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হয়। গভীর রাতে মৃদু বাতাসে এলোমেলো মেঘ পাখা উড়িয়ে চলে যায়। এই বিশাল শহরের বড় বড় দালানের আলোয় আকাশের ও নিভৃতি জোটে না। রাতের নিজস্ব শব্দসমূহ জেগে ওঠে সন্তর্পণে। স্থান-কাল মুছে দেওয়া এক নিঃসঙ্গতার ভুত আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। ঘুমুতে পারি না। দুঃস্বপ্ন দেখার আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। এই জীবনে অজস্র মানুষের ভালোবাসায় আমার দিন কাটে। ভীষণ স্বার্থপরের মত স্নেহের শেষবিন্দু পর্যন্ত শুষে নিচ্ছি অনবরত। ফিরতি কিছু দেওয়ার সামর্থ্য কখনো ছিলো কি না জানা নাই, তবে চেষ্টা ও তো করিনি। ফেব্রুয়ারির কোন এক বিকেলে ডিসি হিলে হাত ভেঙ্গে গেলো যে বারে, আমার কপাল কেটে দরদর করে রক্ত পড়ছে আর আমি বোকার মত নিচে তাকিয়ে দেখছি ফোঁটাগুলো শুকনো বালিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। কালচে রক্ত জমে দলা বেঁধে যাচ্ছে বালিতে। আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকা কতগুলো উদ্বিগ্ন হাত, উৎকন্ঠায় বিহ্বল কিছু অতি প্রিয় মুখ... হাজার বছর বেঁচে থাকলেও ভুলতে পারবো না।

আমার অন্তর্মুখিতা আমাকে আর কারো জন্য ভাবার ছুটি দেয় না। এক হাভাতে স্বার্থপরতা আমার সারাজীবনে তীব্র বিষাদগ্রস্ততার মতই বিস্তার করে আছে। এই অনুভূতিটুকু আমার একার- খুবই ব্যক্তিগত এবং ভীতিকর। আর কেউ জানে না হয়তো। কিংবা হয়তো অনেকেই জানে। হয়তো প্রত্যেকের নিজের গল্পগুলো একইরকম বিপন্নতার বিষাদে ঢাকা। এইসব ভেবে নিজেতে মগ্ন থাকার প্রবণতাই হয়তো আত্মমুখিতা। জীবন জুড়ে বুনে যেতে থাকা সম্পর্কের গিঁটগুলো কখন যে আলগা হতে শুরু করে তা টেরই পাই না। এক একটা উল্কাপতন হয় নিজস্ব আকাশে আর এক একটা করে গভীর খাদ তৈরি হয় বুকের জমিনে। কোন কোন মাঝরাতে যখন ঘরের বাতি জ্বলে ওঠে, দেয়ালে বসে থাকা টিকটিকি ভীতভাবে ডেকে উঠে শিকার ছেড়ে অন্ধকারে সরে যায়। আমি আলো জ্বালিয়ে বসে থাকি, অন্ধকারে ভয় আমার। আমি আলোতে প্রাণ দেখি। শিকারের আশায় পেতে রাখা মাকড়শার জালে আটকে পড়া পতঙ্গরা আমাকে সঙ্গ দেয়। ভয় কেটে যায়। সামনেই, জানালার বাইরে ঘনায়মান অন্ধকার, দূরের অ্যাপার্টমেন্টের জানালায় নক্ষত্রের আলো। মাঝখানের শূণ্যতাটুকু আমার। অথচ আমি তো কোথাও নাই! ছিলাম কি কখনও?

"কোথাও একটা উড়ে যাওয়ার সাধ/ দাঁড়িয়ে ছিলো কেমন করা মন/ মনের তলে মনের তলদেশ ..." এক জীবনের নিঃসঙ্গতা নিয়ে দূরবর্তী বাতিঘরের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকা বুঝি শেষ হতে চায় না।


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

প্রথম প্যারা তো প্রায়-কবিতা! ‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍

একবার বলেছিলাম, আবার বলি - এমন কাব্যময় গদ্য লিখতে পারি না বলে আপনাকে আমি ঈর্ষা করি।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। - হুমায়ুন আজাদ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

তারেক এর ছবি

আর আপনাকে যে আমি কত কারণে ঈর্ষা করি তার ইয়ত্তা নাই হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

আপনার ভাষাশৈলীর রীতিমতো মুগ্ধ পাঠক আমি। অবাক হয়ে চিন্তা করি, এমন অসাধারণ সব কথা এমন অবলীলায় কিভাবে লিখে যান? সন্ন্যাসীদা'র মতো আমিও আমার ঈর্ষা প্রকাশ করে গেলাম।
_________________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

তারেক এর ছবি

লজ্জাই দিলেন। যা হোক, ধন্যবাদ আপনাকে।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

রাফি এর ছবি

মন খারাপ হয়ে গেল...।

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

রায়হান আবীর এর ছবি

এক হাভাতে স্বার্থপরতা আমার সারাজীবনে তীব্র বিষাদগ্রস্ততার মতই বিস্তার করে আছে। এই অনুভূতিটুকু আমার একার- খুবই ব্যক্তিগত এবং ভীতিকর। আর কেউ জানে না হয়তো। কিংবা হয়তো অনেকেই জানে। হয়তো প্রত্যেকের নিজের গল্পগুলো একইরকম বিপন্নতার বিষাদে ঢাকা

তারেক ভাই, অসাধারণ চলুক

=============================
তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা!
রাঙ্গা মাটির দেশে যা!
ইতাক তুরে মানাইছে না গ!
ইক্কেবারে মানাইসে না গ!

শেখ জলিল এর ছবি

মনকাড়া লেখা।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

নিঝুম মজুমদার এর ছবি

ভাইগ্না, কি লেখলা ? আমি একটা লেখা নিয়া গুঁতা গুতি করতেসি সেই একমাস থেইকা । তোমার লেখার টোনের সাথে আমার লেখার কি যে ভয়ানক মিল । এখন তোমার লেখার কাছে আমার লেখাটারে জঘন্য লাগতেসে ... ধূর মিয়া!!!!

তারেক এর ছবি

কী একখান ভাব লইলেন মামু! ভালাই চোখ টিপি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

নিরিবিলি এর ছবি

কি সহজভাবে লিখে গেলেন! অনেক ভাল লাগলো ভাইয়া।

অনিকেত এর ছবি

অসাধারন লাগল লেখাটা। আগে যেমন হয়েছে, আমি এসে আপনার লেখা পড়ে চুপচাপ সরে গিয়েছি। আজ আর পারলাম না। এতদিন ধরে জানতাম আমার নামের সাথে আপনার নামের মিল। আজকে জানলাম আমার কষ্টের অনুভুতি গুলোও ঠিক আপনার মত।

--খালি তফাত এই যে, এত চমৎকার করে আমি লিখতে পারতাম না।

আমার একান্ত কিছু ব্যথা আপনার যাদুস্পর্শে কন্ঠ পেয়েছে।

অশেষ ধন্যবাদ।

তারেক এর ছবি

খুব ভালো লাগলো আপনার মন্তব্য।
আপনার কি কিঞ্চিত মন টন খারাপ হইছে? আসেন আমরা নিজেদের উইশ করি। পৃথিবীর সব তারেক সুখী হোক। শান্তিতে থাকুক চোখ টিপি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

মুজিব মেহদী এর ছবি

বড়ো নির্মেদ গদ্য, সৌরভ ছড়ায়।
................................................................
তোমার হাতে রয়েছি যেটুকু আমি, আমার পকেটে আমি আছি যতটা, একদিন মনে হবে এটুকুই আমি, বাকি কিছু আমি নই আমার করুণ ছায়া

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

পরিবর্তনশীল এর ছবি

হাজার বছর বেঁচে থাকলেও ভুলতে পারবো না।

এই-ইত

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

কীর্তিনাশা এর ছবি

আপনার লেখার আরেকজন ভক্ত বাড়লো। চলুক
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তারেক এর ছবি

রাফি, আবীর, শেখ জলিল, নিরিবিলি, নুজিব মেহেদী, পরিবর্তনশীল, কীর্তিনাশা -- মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের। যারা পড়েছেন তাঁদেরও হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

রূপক কর্মকার এর ছবি

আচ্ছন্ন হওয়ার মতো গদ্য। ধন্যবাদ।
____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]

____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]

গান্ধর্বী এর ছবি

বিষাদমাখা চমৎকার গদ্য! হাততালি

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।