অমিতাভ দাশগুপ্তর কবিতা

তারেক এর ছবি
লিখেছেন তারেক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/১১/২০০৮ - ২:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'অমিতাভ দাশগুপ্তর শ্রেষ্ঠ কবিতা' থেকে সদ্য পড়েছি এরকম ভালো লাগা কিছু কবিতা দিলাম সচলের কবিতাপ্রেমীদের জন্য। আরো অনেক পছন্দের কবিতা ছিল। কিন্তু সেগুলোর কিছু কিছু এত বড় যে টাইপ করতে ইচ্ছে হল না আর...


আমার স্বপক্ষে/ আমি তোমাদেরই লোক


এইখানে চর ফুটেছিল। জ্যোৎস্না। হোগলার বন।
বানভাসি মানুষের বাধ্যতামূলক অরন্ধন
কিছুকাল বন্ধ ছিল। ঘর, শিশু, আউসের ক্ষেত,
পানের বরোজ বুকে অকস্মাৎ চর ফুটেছিল।

ফোটে। কোনদিন ফুটে আমাদেরই অসতর্কতায়
হাতে এসে ছোঁয়া দিয়ে ঝরে যায় সকল মুকুল,
তপ্ত অধীরতা প্রাণে ছুটে ছুটে ভ্রুক্ষেপবিহীন
করতল তুলে দেখি গন্ধ নয়, গন্ধের মতন
কিছু নমনীয় ব্যথা, ভুল প্রত্যাখ্যান লেগে আছে।
পাথর! পাথর! আমি কজ্জল-নিবিড় মেঘমালা
দু'কূল ভাসানো ক্ষিপ্র বহতা জোয়ারে বেঁধে দিতে
কঠিন ধাতুর দৃঢ় নিশ্চয়তা-ভিখারি এখন,
প্রতিকূলে নিদ্রাহীন পিতামহ, নারায়ণী সেনা,
আমার স্বপক্ষে কৃষ্ণ- তারা কেউ জীবিত ফিরবে না।



অলীক বন্দুক/ ছিন্নপত্র নয়, ছেঁড়া পাতা

বড় ভালোবাসা ছিল। তাই বড় বেশি শংকা ছিল।
সেই বিষে নীল হয়ে
আপ্রাণ বাঁচার ইচ্ছে নিয়ে
কখন যে বোঁটা-ছেঁড়া ফলের মতন
টুপ্‌ করে খসে গেছ জলে,
তোমাকে চিনত যারা, গোল হয়ে বসে
তারা সে দুঃখের গল্প বলে।

পাথর, গিয়েছো সরে। এত সুখ, আহ্‌ এত সুখ!
তাই আমি আশাতীত এমন সুযোগে
নিজের বুকের দিকে তুলি ধরি আত্মঘাতী অলীক বন্দুক।



দশটি তরঙ্গ/ নীল স্বরস্বতী


২.

ত্বকের গভীরে ছুঁই, সেই দৃষ্টি কোথায় আমার?
মাংসের মর্মর শুনে, ঢেউ গুনে গুনে দীর্ঘদিন
সুগোল ফলের নিচে কাকের মতন জব্দ আছি,
ফুলের নিবিড়ে পুলকের লাল খুঁজে নিতে নিতে
সব কিছু দূরে যায়, লোহিতসাগরও দূরে যায়।
আমার সঙ্গম মানে ভাপওঠা মাংসের গরম-
ত্বকের গভীরে ছুঁই, সেই দৃষ্টি কোথায় আমার?

৫.

নীল সিন্ধুপারে এসে
নুনে পোড়া হৃদয়ের অর্থ জানা গেল।
জানা গেল শোনিতের প্রকৃত প্লাবন,
আমাকে ফিরিয়ে নাও, ও শহর, পাথুরে শহর,
আমার হৃদয় নেই, ভালোবাসা নেই,
আমার কবিতা লেখা দন্ডিতের মৃত্যুর সমান।



অমীমাংসিত/ মৃত্যুর অধিক খেলা


গাঢ় চুম্বনের মত ছেঁড়া ছেঁড়া রক্তমেঘ ঝুলে ছিল এখানে ওখানে,
গরম অশ্রুর দানা বৃষ্টি ছিল পাতার ডগায়,
ম্লান চরাচর ঝেঁপে ভিখারির রিক্ত করতল
আর
শাদা কাগজের মত নারী।

খুব কষ্ট পেলে কবি এরকম কয়েকটি লাইন
আচমকা লিখে ফেলে একদম বোবা মেরে যায়।
বারবার কেঁপে ওঠে কলমের নিস্পিষ্ট প্লাসটিক,
ব্রেনের ভিতর তীব্র কানামাছি,
জ্বলে নেভে লক্ষ লাল টুনি।
এক সময় লাফ দিয়ে উঠে
দু'হাতে করোটি চেপে টেনে ধরে ব্যাক-ব্রাশ চুল,
চটির অধীর শব্দে ভরে যায় দীর্ঘ করিডর-
পোল পার হয়ে যাওয়া-সন্ন্যাসীর পায়ে পায়ে
কোথায় মিলায় বর্ণমালা!

শুধ কবি বসে থাকে।
আর থাকে মীমাংসাবিহীন
আঙুলের খাঁজে খাঁজে
গাঢ় চুম্বনের মত ছেঁড়া ছেঁড়া রক্তমেঘ,
গরম অশ্রুর দানা,
ভিখারির করতল,
নারী।



বন্ধুর মৃত্যুর পর/ মৃত্যুর অধিক খেলা


নক্ষত্রমালার দিকে উড়ে যায় একটি মানুষ।
তার নীল শার্ট উড়ে হয়ে যায় প্রচুর আকাশ,
সেই আকাশের নীচে অন্যসব মানুষেরা থাকে।
গ্রীষ্ম ও শীতের ফাঁকে, স্বপ্ন ও কাজের ফাঁকে ফাঁকে
হঠাৎ দেখেছে তারা, বা হঠাৎই দেখতে চেয়েছে
নক্ষত্রমালার দিকে উড়ে যায় একটি মানুষ।

ভুল মৃত্যু ছুটে আসে ভুল অশ্ব-ঘোষণার মত,
ভুল মৃত্যু ঘাসে শুয়ে গুপ্তি মেরে নামায় আকাশ,
নিয়ে যায় সখা, উষ্ণ করতল, সাহস চৌমাথা,
তার হিরন্ময় দ্যুতি, পরাজয়, কবিতার খাতা।
আমাদের ঈর্ষা নিয়ে, নিরুপায় বেঁচে থাকা নিয়ে
নক্ষত্রমালার দিকে উড়ে গেলে একটি মানুষ
নতুন নক্ষত্র-বেঁধা সেই নীলিমার দিকে চেয়ে
মানুষেরা ভুল করে নারীকে 'নীলিমা' বলে ডাকে।


মন্তব্য

রাফি এর ছবি

"....সব রাঙ্গা কামনার শিয়রে এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ"

বড় বিষাদময়তার কবিতা এই বিষন্ন দুপুরে..............

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

তারেক এর ছবি

....সব রাঙ্গা কামনার শিয়রে এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ

কী সুন্দর!
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

খুব ভাল লাগল কবিতাগুলো।

একটা মজার ব্যাপার, বেশ কয়েকদিন থেকেই আমার মাথায় "আমি তোমাদেরই লোক"- কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল, লিখতে চাচ্ছিলাম কিছু একটা; কিন্তু আমি তো এই কবিতা আগে কখনো পড়িনি! বুঝলাম না এটা কী শুধুই কাকতালীয় কিছু, নাকি অনেক আগে কোথাও পড়ার কারণে অবচেতনে লুকিয়ে ছিল!

ভাই তারেক, এখন কেমন আছেন আপনি?

তারেক এর ছবি

"আমি তোমাদেরই লোক" রবীন্দ্রনাথের "পরিচয়"-কবিতার একটা পংক্তি। ভীষণ প্রিয় সেই কবিতাটা আমার। না পড়া থাকলে অবশ্যি অবশ্যি পড়ে নেবেন।

স্ল্যাশের পরের নামগুলো আসলে যে কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতাটা উদ্ধৃত হচ্ছে সেই বইয়ের।
আমি ভাল আছি। আপনার লেখাটা নামায়ে ফেলুন জলদি।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

মনে হয়- ওই কবিতাটা পড়সিলাম, এই জন্যই লাইনটা মাথায় ছিল। কবিতার নামটাও অতি পরিচিত, এখন যদিও লাইনগুলা মনে করতে পারতেসি না, তবে আমি মোটামুটি নিশ্চিত পড়সি এইটা। তবুও আরেকবার পড়ব।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

নক্ষত্রমালার দিকে উড়ে যায় একটি মানুষ।
তার নীল শার্ট উড়ে হয়ে যায় প্রচুর আকাশ,
সেই আকাশের নীচে অন্যসব মানুষেরা থাকে।

এই কবিগুলো এতো ভুগায় কেনো?

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তারেক এর ছবি

ভোগাবে জেনেও তো বারবার এঁদের কাছেই ফিরে আসতে হয়... কি আশ্চর্য না?
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

তারেকের কারণেই পড়া হলো...

ধন্যবাদ।

তারেক এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ শিমুল ভাই হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

বোহেমিয়ান এর ছবি

কি অসাধারন সব শব্দচয়ন......।
আহা......

সবজান্তা এর ছবি

জাঝা তারেক।

তোমার কারণেই আবু হাসান শাহরিয়ারের পর অমিতাভ দাশগুপ্তর লেখা পড়া হল।


অলমিতি বিস্তারেণ

তারেক এর ছবি

থ্যাংকু!
এরপর কার লেখা পড়তে চাও কও তাইলে দেঁতো হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

সুমন সুপান্থ এর ছবি

পশ্চিম বাংলা কী, পুরো বাংলা ভাষায়ই উত্তরাধুনিক কাব্যচর্চার পুরোধা পুরুষ এই অমিতাভ দাশগুপ্ত আমার খুব প্রিয় কবিদের একজন । অসংখ্য ধন্যবাদ তারেক ! তা-রে-ক র-হি-ম , মূলতঃ আর ভুলতঃ কবি বলেই তোমার সৌজন্যে অনেকগুলো কবিতা পড়া হলো । এইভাবে আরো পড়িয়ে যেও ভাই । আমরা থ্‌ হয়ে পড়বো -

আমাদের ঈর্ষা নিয়ে, নিরুপায় বেঁচে থাকা নিয়ে
নক্ষত্রমালার দিকে উড়ে গেলে একটি মানুষ

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

তারেক এর ছবি

"এসো রাত্রি। এসো হোম। এসো,এসো অনন্তদীপিকা। " - এই ভীষণ দীর্ঘ কবিতাটা পড়েই আমি এঁর কবিতার ভক্ত।
বাংলায় উত্তরাধুনিক কাব্যচর্চার পুরোধা তো বটেই। কালীকৃষ্ণ গুহ, বীতশোক ভট্টাচার্য এঁদের নাম ও বোধহয় নেওয়া যায়। আমি বিস্তারিত জানি না অবশ্য। কোন একটা বই বা প্রবন্ধে হালকা রেফারেন্স ছিল, পড়েছিলাম।
অনেক ধন্যবাদ সুপান্থদা।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

হিমু এর ছবি

দশটি তরঙ্গের দু'টি বাদে বাকি কবিতাগুলি খুব ভালো লাগলো। আমার ইচ্ছা ছিলো "পিরানে ঝোলের দাগ" নাম দিয়ে একটা সিরিজ লিখবো, সেখানে বিভিন্ন লেখার প্রিয় অংশগুলো তুলে ধরবো নিজস্ব টুকটাক আবোলতাবোলসহ। তা আর হলো না।


হাঁটুপানির জলদস্যু

তারেক এর ছবি

দশটি তরঙ্গের সবগুলো কবিতা একসাথে পড়লে আপনার ভালো লাগতো নিশ্চয়।তবে কিনা বড়, টাইপ করার আলসেমি আর বাকি কবিতাগুলোর জায়গা কুলোত না এখানে তাই দিই না।

আমার এই অভ্যাসটা আছে। আমার মনে হয় অনেকেরই আছে কোন লেখার প্রিয় অংশগুলো টুকে রাখার।
সিরিজের নামটা দারুন। প্রিয় লেখার সাথে সাথে আপনার "নিজস্ব টুকটাক আবোলতাবোল" হলে তো দারুন হয়!
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

তিথীডোর এর ছবি

'কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প'ড়ে আছে---
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক'রে নিয়ে যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি---সব ; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি পথ ক'রে দিতে পারে; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায়...'
#বিনয় মজুমদার

এই কবিগুলো এতো ভোগায় কেন?

মন খারাপ

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।