চারিদিকে ধবধবে সাদা, ফেনিয়ে ওঠা সাদা দুধ জমাট বাধলে যেমন গাঢ় সফেদ বর্ণ ধারণ করে তার চেয়েও অদ্ভুত এক আঁধার দূর করা আলোর সমাহার চারিদিকে, আকাশ থেকে শুরু করে দূরদিগন্ত- সবখানেই এই শুভ্র বর্ণের অস্তিত্ব বর্তমান। অবস্থান ৮৫ ডিগ্রী ৫৭ মিনিট উত্তর, সুমেরু থেকে মাত্র হাজার মাইল দক্ষিনে গ্রিনল্যান্ড পাড়ি দিয়ে মানবজাতির ইতিহাসে কাঠের সবচেয়ে মজবুত জাহাজ ফ্রাম, ক্যাপ্টেন ডেকে দাড়িয়ে আছেন বিশ্বখ্যাত দুঃসাহসী নরওয়েজিয়ান অভিযাত্রী ফ্রিতজফ নানসেন, গন্তব্য উত্তর মেরু বিন্দু , যেখানে তখন পর্যন্ত কোন মানব সন্তানের পায়ের ছাপ পড়ে নি, সময়- ১৮৯৩ সাল।
কিন্তু বিধিবাম, এই জমাট বাঁধা উত্তর মহাসাগরের পর্বতপ্রমাণ আইসবার্গগুলো ঠেলে ফ্রামের আর মেরুবিন্দুতে পৌঁছানো হল না, বিফল মনোরথে ফিরতে হয় নানসেনকে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আর কোনও কাঠের জাহাজ এর বেশী উত্তরে পৌঁছাতে পারে নি।
এরপর ১৯১০ সালে আরেক অকুতোভয় প্রাতঃস্মরণীয় নরওয়েজিয়ান অভিযাত্রী রোয়াল্ড অ্যামুন্ডসেন সেই একই জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন অচেনা সুদূর দক্ষিণের পথে, গন্তব্য চির দক্ষিণের কুমেরু বিন্দু (অ্যামুন্ডসেন প্রথমেই উত্তর মেরু জয়েরই পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু পিয়েরী সেখানে পৌঁছে যাওয়ায় এক রকম গোপনেই তিনি দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেন), সেখানেও তখন পর্যন্ত মানবজাতির বিজয় গাঁথা গায়তে পারে নি তাদের কোন সদস্য। অবশেষে ৭৮ ডিগ্রী ৪১ মিনিট দক্ষিণে পৌঁছে বরফ মহাদেশের এক প্রান্তে নোঙ্গর ফেলে ফ্রাম, কুকুর টানা স্লেজ নিয়ে সঙ্গীদের সাথে রওনা দেন অ্যামুন্ডসেন।
এর পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। ১৯১১ সালে ১৪ ডিসেম্বর প্রথম মানুষ হিসেবে দক্ষিণ মেরু বিন্দুতে পদার্পণ করেন অ্যামুন্ডসেন এবং তার অল্প কিছু দিন পরেই সেখানে পৌঁছান ব্রিটিশ অভিযাত্রী রবার্ট ফ্যালকন স্বক্ট এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হিমশীতল মৃত্যুকে বরণ করেন।
কিন্তু এর মাঝে অজানা তথ্য হল, ফ্রাম পৃথিবীর নৌ যাত্রার সুদীর্ঘ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী উত্তরে ও দক্ষিণে যাওয়া একমাত্র কাঠের জাহাজ হয়ে আছে, ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে উভয় মেরু অভিযানের সাথেই। অ্যামুন্ডসেনের সাথে সফল অভিযানের পরে ফ্রাম আর কোন অ্যাডভেঞ্চারে অংশ নেয় নি বরং ১৯৩৫ সালে জাহাজটিকে নরওয়ের রাজধানী অসলোর কাছের বিগডয় দ্বীপে নিয়ে গিয়ে গোটা জাহাজটিকেই জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। আমাদের আজকের ভ্রমণ এই ফ্রামকে নিয়েই, সাথে সঙ্গী হিসেবে আছেন বাংলার প্রাতঃস্মরণীয় দুঃসাহসী অভিযাত্রী পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক।
ফ্রাম জাদুঘর বিশ্বের অন্যান্য জাদুঘরের চেয়ে আলাদা, যেহেতু গোটা জাহাজটাই আজ সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত, তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা তিনকোণা আকৃতিটি চোখে নজরে আসে বহু দূর থেকে। জাদুঘরের সামনে অ্যামুন্ডসেনের মুখমণ্ডলের ধাতব ভাস্কর্য, অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি দুর্দম নেশা আর অদম্য সাহস নিয়ে ছুটে চলা এই অভিযাত্রীদের জীবনাবসানও ঘটেছিল অভিযানের মধ্যেই, বরফে ঢাকা উত্তর মহাসাগরে বিমান দুর্ঘটনায়, থেমে যায় উত্তর মেরুতে উড়োজাহাজ নিয়ে প্রথম পাড়ি দেওয়া এবং দক্ষিণ মেরুতে প্রথম পা রাখা ব্যক্তির অজানার পথে যাত্রা, কিন্তু তিনি অমর তার কীর্তির জন্য।
এরপর প্রধান ফটক পেরুতেই চোখে পরে আর্কটিক ও অ্যান্টার্কটিক অঞ্চলের জীববৈচিত্রের কিছু নমুনা, স্টাফ করা পশু, পাখি, মাছের বিশাল সংগ্রহ। দানবীয় শ্বেতভল্লুক চোখের সামনে দু পায়ে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে প্রায় চমকেই উঠলাম, যদিও জানা ছিলে এরা আমাদের গ্রহের অন্যতম বৃহত্তম স্থলচর শ্বাপদ, তারপরও এরা যে এত বৃহদাকৃতির হতে পারে তা চোখে সামনে না দেখলে বিশ্বাস হত না, পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ শ্বেতভল্লুক আমাদের দেশের কালো ভালুকের প্রায় তিন গুণ বড় হয়! অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে আছে তুন্দ্রা অঞ্চলের ষাঁড়, মেরু শেয়াল, নানা ধরনের সীল।
পাখির নমুনার অভাব নেই, বিশেষত নানা ধরনের পেঙ্গুইনের ! অ্যান্টার্কটিকার অভিযাত্রী ইনাম ভাইয়ের তোলা ছবি থেকেই নানা ধরনের পেঙ্গুইন চেনা শিখেছিলাম, তার কাছে এবার শুনলাম অমূল্য সেই অভিজ্ঞতার কথা।
এর পরপরই দেখা গেল লাল-কালো রঙের কাঠের জাহাজ ফ্রাম, উপর থেকে কায়দা করে ঝোলানো এর দুটি নোঙর, যার ঠিক নিচেই ফ্রিতজফ নানসেনের ভাস্কর্য, বরেণ্য সব অভিযান ছাড়াও বিশ্বশান্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯২২ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হন নানসেন।
ফ্রাম একনজর বুলিয়েই বোঝা যায় কেন তাকে বলা হয় কাঠের তৈরি সবচেয়ে মজবুত জাহাজ, একেবারে গোটা গোটা প্রকাণ্ড সব গাছের গুড়ি থেকে তৈরি হয়েছে এর গলুই, মাস্তল, খোল। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে উঠে পড়া গেল পিচ্ছিল ডেকে, সেখান থেকে দড়িদড়ার স্তূপ এড়িয়ে জাহাজের ভিতরে। চমৎকার সাজসজ্জার মাধ্যমে সেই শত বছর আগেকার মেরু অভিযানের একটা আবহ ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে সর্বত্র। আর যেহেতু ফ্রামের শেষ অভিযান ছিল অ্যামুন্ডসেনের নেতৃত্বে দক্ষিণ মেরু অভিযান, সেই হিসেবেই সাজানো প্রতিটি কামরা, গ্যালি, খাবার ঘর, ভাড়ার, বসার ঘর, তরঙ্গ উত্তাল হিম সমুদ্রে খানিকটা বিনোদনের জন্য পিয়ানো।
দর্শনার্থীদের জন্য মূল আকর্ষণ অবশ্যই ক্যাপ্টেনের খাস কামরা, যেখানে একদা বছরের পর বছর থেকেছেন নানসেন এবং অ্যামুন্ডসেন। ক্যাপ্টেনের পোশাক, পড়ার বই, নানা ধরনের মানচিত্র সবই নান্দনিক ভাবে সাজিয়ে রাখা আছে পরম মমতায়, দেখে মনে হয় যে কোন মুহূর্তেই ক্যাপ্টেন এসে হাজির হবেন ঠোঁটে পাইপ নিয়ে!
গোটা জাহাজের দেয়ালেই দুর্লভ সব আলোকচিত্র ফ্রেমে বাঁধানো।
নরওয়েজিয়ান ভাষায় ফ্রাম শব্দের অর্থ সামনে এগোনো ( ফরোয়ার্ড), আর জেনে অবাক হবেন এই ফ্রামের মহিমা নিয়ে আজ পর্যন্ত কত গান, থিয়েটারের নাটক, বই লেখা হয়েছে, কত জাহাজের নামকরণ করা হয়েছে। এমনকি মঙ্গলগ্রহের এক জ্বালামুখের নামকরণ পর্যন্ত!
মনের কোণে অশেষ খুশীর বন্যা নিয়ে আমরা দুই ভ্রমণপিপাসু এই জীবন্ত ইতিহাসের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে চললাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে- ভাইকিং জাহাজ জাদুঘরে।
( মেক্সিকো সিটি থেকে সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা, ভোরের কাক জেগে ওঠার আগেই জেগে বসে আছি বিচ্ছিরি জেট ল্যাগের জন্য। একাধিক টিনটিন পড়ার পর ভাবলাম, টেকিলা সানরাইজের দেরী আছে এখনো, এই ফাঁকে একটা স্মৃতিচারণ করে ফেলি, অন্যতম প্রিয় ৩ অভিযাত্রী নানসেন, অ্যামুন্ডসেন এবং ইনাম আল হককে এক সুতোই গেঁথে। এখানে সবসময় নেট নাও পেতে পারি, তাই সবাইকে আগাম ২০১২-এর শুভেচ্ছা আবারও। )
মন্তব্য
নতুন বছরে আমার নতুন শপথ - ভাইজান আপনারে আর হিংসা করুম না ।
হ্যাপি নতুন বছর
ডাকঘর | ছবিঘর
facebook
অনেক ধন্যবাদ আমাদের জন্য এই লেখাটা উপহার দেয়ায়।
নৌকাটির আরো ছবি দেখতে ইচ্ছে করছিল। বিশেষ করে ভিডিও। যাই হোক, আরো লেখা ছবি দেন-- যাওয়া তো হবে না, পড়েই সুখ মেটাই। এত আগে কিভাবে এত শক্ত ও ডিজাইনের দিক থেকে কৌশলী নৌকা তৈরী করতে পারলো সেটা কি বিস্ময় নয়? আর নানসেনের থেকে এ্যামুন্ডসেন কিভাবে নৌকাটি নিলেন সেটাও জানতে ইচ্ছে করছে। ওরা কি একে অপরের পরিচিত ছিলেন?
তাতো ছিলেনই, কিন্তু নৌকাতো জনগণের টাকায় বানানো, তাই রাষ্ট্র যাকে মনে করেছে তাকেই দিয়েছে।
facebook
হিংসা করলাম না। সুযোগ পেলে আমিও ঘুরে আসতে চাই, নতুন বছরে ইচ্ছে থাকলো!
facebook
facebook
হুম। শেষ দিনটা আমিও আর হিংসা বিলালাম না। (আরে একটা কাঠের নৌকাইতো দেখেছেন। ওরকম কত আছে আমাদের দেশে। :-" ) নতুন বর্ষের শুভেচ্ছা।
facebook
নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা অনু। অপেক্ষায় থাকলাম.........মেক্সিকো সিটিতে নববর্ষ উদযাপন নিয়ে পরের পোস্টটির জন্য।
দীপাবলি।
ধন্যবাদ। জানাবো---
facebook
ধন্য ছেলে আপনি! একের পর দেশ ঘুরেই বেড়াচ্ছেন, ঘুরেই বেড়াচ্ছেন। ঘুরতে থাকুন সাথে আমরাও
আপনার জন্যও নতুন বছরের শুভেচ্ছা থাকলো।
facebook
নতুন বছরে যেন তারেকাণুরে নতুন নতুন ডিম দিতে পারি। এই ডিমগুলি যেন ক্যাকটাসের মতো কণ্টকিত হয়। আমিন।
কি আজিব, সেই দিনই জীবনের প্রথম ক্যাকটাস খেলাম, বেশ খেতে !
facebook
ভালো
facebook
- ফ্রাম একটা জাহাজ, সেও ক্ষান্ত দিল, কিন্তু তারেক অনুর কোন বিচার নাই। একটা বছর এট্টু আরামে কাটান। তারেক অনুরে একটা যাদুঘর করে রাখা হোক। নাইলে নববর্ষের শুভেচ্ছা দিমু না।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
facebook
facebook
সাথে রইল একবিংশের এক যুগ পূর্তির শুভেচ্ছা ও
facebook
আমি তাপস দার মতো এতো উদার হতে পারছি না । আমি আপনাকে হিংসে করেই যাব। একটা মানুষ এত্তো জায়গা ঘুরবে আর এত্তো চমৎকার পোস্ট লিখবে আর আমি কিছুই করতে পারব না।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা অণু দা ।
অনেক ধন্যবাদ। মায়া এলাকা থেকে মায়ামোড়া শুভেচ্ছা।
facebook
আর একখান জায়গা যোগ হল আমার লিস্টে, আপনারে নিয়ে আর পারিনা।
কেন ?
লিস্ট রেখে পথে নেমে পড়েন!
facebook
ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা। নতুন ধরনের যাদুঘর সম্পর্কে জানলাম, সেই সাথে ইতিহাসও। ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভেচ্ছা।
facebook
দাদা নতুন বছরের শু...........................ভেচ্ছা। আশা করি নয়া বছরে আপনারে কেউ না কেউ গলায় দড়ি দিব।
facebook
উপভোগ্য লেখা। নববর্ষের শুভেচ্ছা।
মেক্সিকো থেকে বেরিয়ে কোনদিকে যাচ্ছেন?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আর অল্পদিন আছি, এরপর পেরু !
facebook
জাহাজটি সম্পর্কে জেনে অতিশয় আনন্দিত হলাম এবং বিমল জ্ঞান লাভ করলাম
আছ কেমন?
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
জটিল !
facebook
নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, প্রজেক্টঃতারেক অণু
সবটি পইড়া সারমু আর কিছু না পারি
আরে ব্যাপার না, আমরা আমরাই তো !
facebook
[কিস্যু আর কওনের নাই! তারেকঅণু!]
(গুড়)
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
facebook
নতুন মন্তব্য করুন